সাদা কালো-চতুর্থ পর্ব : Click here
।৫।
নরেন্দ্রপুর পদার ভীষন ভালো লাগছে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ করতো। সব কিছুর অভাব বোধ করতো, বিশেষত মায়ের গন্ধ আর মায়ের হাতের রান্না। এখন তা সয়ে গেছে। এখানকার খাবার দাবার ভালই বলতে হবে। বাড়ির মত না, তবে বেশ ভাল। কিছু কিছু রান্না—যেমন খিচুরি—বাড়ির থেকেও বেশী মুখরোচক লাগে পদার। আস্তে আস্তে অনেকের সাথে বেশ বন্ধুত্বও হচ্ছে। সবাই খুব মেধাবী। তবে সবাই যে বন্ধুত্ব পাতাবার উপযোগী তা নয়। জনা তিনেক খুব ভাল বন্ধু হয়েছে পদার এই আট মাসে। ক্যাম্পাসের পরিবেশটা ভারী ভাল লাগে পদার। এক ফোঁটা নোংরা নেই। রোজ খুব ভোরে ওঠে সে। উঠে ঘন্টাখানেক ব্যাম করে। বিকেল বেলা ফুটবলও খেলে। তার শরীর এখন খুব মজবুত। চেহারা আগেই ভাল ছিল, এখন মাথা ঘুরিয়ে দেখার মত। তবে গলার স্বরটা এখনো ক্লার্ক গেবেলের মত হয়নি। মনে হয়না কোনদিন আর হবে। আজকাল সে আবার মাউথ অরগান বাজাতে শুরু করেছে। নরেন্দ্রপুরের সব থেকে ভালো যেটা পদার লাগে সেটা হোলো পড়াশুনার আবহাওয়াটা। শিক্ষকরা খুব যত্ন নিয়ে পড়ান। আর কত কিছু শেখান; জীবন সম্পর্কে, এই জগত সম্পর্কে। পদা মাঝেমাঝেই বাবাকে এই জন্য মনেমনে ধন্যবাদ জানায়।
রবিবার দুপুরবেলা পদা নিজের ঘরে দিবানিদ্রা দিচ্ছিল। এই সপ্তাহে সে বাড়ি যায়নি। সামনের সপ্তাহে স্কুলে বড় একটা অনুষ্ঠান আছে বলে। এর মধ্যে তার বন্ধু রাজু এসে ঘুম ভাঙ্গালো “এই অনীক, ওঠ, মহারাজ তোকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তোর খোঁজ করছেন একজন”। “কে?” “একজন অল্প বয়েসি মহিলা”। “কি নাম বললেন মহারাজ?” পদা জিগ্যাশা করলো। রাজু নাম জানে না। পদার ভুরু কুঁচকে গেল। “অল্প বয়েসি মহিলা। কে হতে পারে? তবে কি…”। পরমুহূর্তেই সে নিজেকে থামায়। নিজেকে বোঝালো “তা কেন হতে যাবে?” আর তাছাড়া লিগাল গার্জেন ছাড়া কারো যখন খুশি দেখা করার নিয়ম নেই। যাইহোক, রহস্যটা রয়েই গেল। হৃতপিন্ডটা কি বেশি ধুকপুক করছে? তাড়াহুড়ো করে একটা জামা চড়িয়ে নিচে নেমে এলো সে। ভিজিটর রুমের দিকে হাঁটা লাগালো। ঘরে ঢুকে দেখলো সত্যিসত্যিই একজন মহিলা তার জন্য অপেক্ষা করছে। পদার পায়ের শব্দে সে ঘুরলো। অচেনা। পদা তাকে কখনো দেখেছে বলে মনে পরছে না। বয়স অল্পই। সিঁথিতে সিঁদুর। পদা কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা গলা অত্যন্ত নামিয়ে বললেন “আপনি কি অনীক রায়চৌধুরী?” “হ্যাঁ”। “গড়পাড়ের পদা?” “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে…”। “আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার নাম মাধবী। কিছু মনে করবেন না, ওনাদের আমি বলেছি যে আমি আপনার জ্যাঠতুতো দিদি আর আপনার জ্যাঠার শরীর খুব খারাপ”। পদা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলতে পারলো না। তার একমাত্র জ্যাঠা বহুকাল আগে পরলোকগত। মহিলা আবার বলল “আপনি বাবলুদাকে চেনেন তো?” “বাবলুদা?” “হ্যাঁ বাবলুদা। আপনাদের পাড়ায় আগে থাকতো”। “আমাকে প্লিস আপনি বলবেন না। হ্যাঁ চিনি বইকি। কিন্তু বাবলুদার কথা আপনি বলছেন কেন?” “ওঁ আমার স্বামী”। পদা আবার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। সেই সিনেমা দেখতে যাওয়ার দিনটার কথা মনে পরে গেল। বাবলুদার বিয়ে হয়ে গেছে? কই, জানতে পারেনি তো? চিন্তার ঘোর ভাঙলে বলল “বাবলুদা কোথায়? আপনি কেন এখানে এসেছেন?” মহিলার চোখ ছলছল করে ওঠে। কোনরকমে কান্না চেপে বললেন “বাবলুদা তোমাকে একটু দেখতে চেয়েছে”। “দেখতে চেয়েছে মানে? ওর কি হয়েছে?” পদার গলার স্বরে সামান্য উদ্বেগ। মহিলা আর কান্না থামাতে পারলেন না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে যে কাহিনি উনি বললেন, তা শুনে পদা ভিষন বিচলিত হয়ে পরলো। বাবলুদা বজবজ লাইনের ট্রেনে সেন্ট, আতর এই সব বিক্রি করে সংসার চালাতো। একদিন চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিল। তাতে তার বাঁ হাতের দুটো আঙ্গুল কাটা গেছে। হয়ত তা সত্যেও সে চালিয়ে যেত, কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে হাসপাতাল প্রাথমিক চিকিতসা করে ছেড়ে দাওয়ার পর কাটা জায়গাটা সারছে না। বোধহয় ইনফেকশন হয়ে গেছে। গত দুদিন ধরে প্রচন্ড জ্বর আসছে আরে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। তারই মধ্যে সে বারবার পদাকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। মাধবী প্রথমে পদার বাড়ি গিয়েছিল। সেখান থেকে এখানে ছুটে এসেছে। সব ঘটনা শুনে পদা কি বলবে বুঝতে পারছে না। বাবলুদার আজ এই দশা? তাকে যেতেই হবে। কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে সে হঠাত দাঁড়িয়ে উঠে বলল “আপনি আমাকে কয়েক মিনিট সময় দিন। আমি আসছি এক্ষুনি”। বলে নিজের ঘরের দিকে দৌড় লাগালো। স্যুটকেস তন্নতন্ন করে খুঁজে মাত্র বাহান্ন টাকা পাওয়া গেল। আসলে পদার কাছে টাকা পয়সা বিশেষ থাকে না। টিউশন ফি, খাবার খরচ ইত্যাদি সোজাসুজি স্কুলে জমা পরে যায়। এই কটা টাকা পদার জমানো টাকা। টাকা কটা পকেটে গুঁজে, জুতো মোজা পরে সে আবার দৌড় লাগালো। সে জানে যে ক্যাম্পাস ছেড়ে এই সময় যাওয়া নিয়মভঙ্গ করা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বেপরোয়া। যা হবার হবে। পরে দেখা যাবে। “চলুন”। “তুমি না বলেই চলে যাবে? কিছু হবে না?” “ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। চলুন”।
দুজনে রাস্তায় বেরলো। রবিবার দুপুরে রাস্তায় বাস কম। পদা একবার ভাবলো একটা ট্যাক্সি ডাকবে। কিন্তু পরে ভাবলো যে টাকা কটা বাঁচানো দরকার। যদি বাবলুদাকে ট্যাক্সি করে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হয়! নারকোলডাঙ্গার বস্তিতে পৌঁছতে ঘন্টা দুয়েক লেগে গেল শেষ অব্ধি। কিন্তু কিছু করার ছিল না। বাস থেকে নেমে মাধবী অলিগলির ভেতর দিয়ে পদাকে নিয়ে গিয়ে শেষে এক অন্ধকার ঘরে ঢোকালো। ঘরের দরজার বাইরেই একটা কর্পরেশনের জলের কল। সেখানে অনেক ভীড়, অনেক কলরব। মাধবী ঘরে ঢুকে সঙ্গেসঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিল। আলো থেকে অন্ধকারে ঢুকে অভ্যস্ত হতে পদার একটু সময় লাগলো। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হওয়ার পর দেখলো যে ঘরের এক কোনে কিছু বাসন কোসন, জলের বালতি ইত্যাদি ছড়ানো। অন্য কোনে একটা বিছানা। সেই বিছানার এক পাশে শুয়ে আছে একটা লোক। ইতিমধ্যে মাধবী পদাকে একটা টিনের চেয়ার টেনে দিয়েছে। নিজে দাঁড়িয়ে। আগে থেকে না জানলে পদা কিছুতেই বাবলুদাকে চিনতে পারতো না। বাবলুদার কপালে হাত রাখলো পদা। কপাল পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বাবলুদার চোখ বোজা। পদা ডাক্তার নয়, কিন্তু তার অনুভূতি তাকে জানালো যে পরিস্থিতি খুব সঙ্গিন। “একে এক্ষুনি হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া দরকার”। মাধবী এগিয়ে এসে পদার হাত ধরে ফেলল। “তুমি এসেছো এই যথেষ্ট। ওসব করার দরকার নেই। আমি বরং জলপট্টি দিই একটু। জ্বরটা নেমে গেলেই ও চোখ খুলবে। তারপর তুমি চলে যেও। রাতে না ফিরলে তোমার হস্টেলে অনেক ঝামেলা হবে”। এই দ্বিতীয়বার কোনো মেয়ে পদার হাত ধরলো। প্রথমবার সে লজ্জা পেয়েছিলো। হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিল। আজও সেই মুহূর্তটা ভুলে উঠতে পারে নি। কিন্তু এইবার সে হাত ছাড়ালো না। উল্টে মাধবীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল “তা হয় না। বাবলুদা আমার দাদা। আপনি ওকে রেডি করুন। আমি ট্যাক্সি ডাকতে যাচ্ছি”।
ট্যাক্সি নীলরতন সরকার হসপিটাল এর দিকে ছুটে চলেছে। পদা ড্রাইভারের পাশে। পেছনে মাধবীর কোলে মাথা রেখে বাবলুদা শুয়ে আছে। তার এখনো হুঁশ নেই। পাড়ার লোক ডেকে কোলে করে তাকে ট্যাক্সিতে তুলতে হয়েছে। পদার মন বারবার চলে যাচ্ছে পুরনো দিনগুলোতে। এই সেই বাবলুদা যে ওকে সাইকেল চড়া শিখিয়েছিল। ঘুরি ওড়ানো শিখিয়েছিল। কি চেহারা ছিল আর এখন কি হয়েছে। মাধবীর সাথে ওর আলাপ, বিয়ে এসবই বা কবে হলো? কিভাবে হলো? এইসব নানা চিন্তা ওর মস্তিষ্কের মধ্যে পাক খেতে থাকলো। একবার পেছনে তাকালো। দেখলো মাধবী বাবলুদার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে জানলার বাইরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো চিকচিক করছে। কান্না চেপে আছে নিশ্চয়ই। বহুদিন আগে আর একজনের চোখ এরকম চিকচিক করতে দেখেছিল। সাদা কালো এই জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়! ভাবে পদা। কোখায় সেই সিনেমা আর কোথায় এই বাস্তব জীবন। বাবা ঠিকই বলেছিল। পদা যেন হঠাতই আজ বড় হয়ে উঠলো!
To be continued…