সাদা কালো – অষ্টম পর্ব : Click Here
।৯।
মে মাস। প্রচন্ড গরম পরেছে কলকাতায়। বিকেল চারটে নাগাদ পদা বাড়ি থেকে বেরলো। আকাশটা একটা ফ্যাটফ্যাটে সাদা রঙ। তাতে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। পদা যাবে নন্দিতার বাড়ি। সল্ট লেকের লাবনী অঞ্চলে। নিউ এম্পায়ার সিনেমার সামনের সেই ঘটনার হপ্তাখানেকের মধ্যেই পদা আর নন্দিতার মিটমাট হয়ে গিয়েছিল। পদা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। ক্ষমার বিনিময়ে অবশ্যি সোনালি সঙ্ক্রান্ত সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলতে হয়েছিল নন্দিতাকে। একদিন কলেজের সিঁড়িতে বসে অনেকটা সময় নিয়ে পদা সোনালির সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে দুর্গাপুজোর ঘটনা অব্ধি সব কাহিনী নন্দিতাকে খুলে বলল। নন্দিতা খুব মন দিয়ে শুনলো। অনেক্ষন চুপচাপ বসে রইল কোন কথা না বলে। পদা উদ্গ্রীব হয়ে রইলো নন্দিতার বক্তব্য শোনার জন্য। বেশ খানিক্ষন পর নন্দিতা বলল “আই ডোন্ট ব্লেম হার অ্যাট অল। আমার তো মনে হয় পুরোটাই তোর মনগড়া। প্লাটোনিক! আই থিঙ্ক ইউ নিড টু মুভ অন”। পদার এই কথাগুলো মোটেই পছন্দ হোলো না। মুভ অন বললেই করা যায় নাকি? সে অনেক চেষ্টা করেছে। আজও করে চলেছে। অবশ্যি সে জানে যে সে নিজেই এক সময় ভেবেছিল যে জেম সিনেমার ওই মুহূর্তগুলো, সোনালির সেই মাউথ অরগান শোনানোর আবদার, ওগুলোর কোনটারই কোন গুঢ় অর্থ নেই। কিন্তু অন্যের মুখে একই কথা শুনতে ওর আঁতে লাগলো। পদা অবশ্যি কোন জবাব দেয়নি। চুপ করে ছিল। কাউকে চোখের সামনে দুবেলা উঠতে বসতে দেখলে ভুলে যাওয়াটা অনেক বেশি কঠিন। পরিস্থিতির সম্মুখিন না হলে বোঝা যায়না সেটা কত কঠিন। তবে এবারে সে সাগর পারি দিয়ে বিদেশে চলে যাবে। মুভ অন করাটা অনেক সহজ হবে।
শেষ অব্ধি কর্নেল ইউনিভারসিটিতেই পড়তে যাচ্ছে পদা। ফিজিক্সএ পিএইচডি। তার গবেষনার বিষয় হবে কোয়ান্টাম কনফাইনমেন্ট। যে প্রফেসরের সাথে অনেকদিন ধরে যোগাযোগ পদার, সেই প্রফেসর জোন্সই পদাকে একটা ভালো ছাত্রবৃত্তি পাইয়ে দিয়েছেন। সাধারনত আগস্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাসে নতুন ছাত্ররা শুরু করে, কিন্তু বৃত্তির চিঠিপত্র দেরীতে আসাতে পদার ওই সময় যাওয়া সম্ভব হবে না। ভিসার অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে দেরী হয়ে গেছে। সে পরের বছর জানুয়ারী মাসে আমেরিকা যাত্রা করবে। বাবা খুব খুশী হয়েছেন। মা’র অবশ্য খুব মন খারাপ। এখন থেকেই কাঁদেন আড়ালে।
কাঠফাটা রোদে পদা এগিয়ে চলল শুকিয়া স্ট্রিট বাস স্টপের দিকে। পৌঁছে একটা অ্যাডভারটিসমেন্ট বোর্ডের ছায়ায় দাঁড়ালো। বিকেল হয়ে গেছে কিন্তু অস্বাভাবিক গরম বলে রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। কয়েকটা বাস ধুঁকে ধুঁকে চলেছে। বাসে গোনাগুন্তি কয়েকটা লোক। পদা দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, তার বাস আসার কোন নামগন্ধ নেই। একটু পরে বেরলেই বোধহয় ভাল হোতো। কিন্তু নন্দিতা বারবার শাঁসিয়েছে “আমি কিন্তু ঠিক ছটায় বেরিয়ে যাব টিউশানিতে। এক মিনিট দেরী করলে আমাকে আর পাবি না”। পদা তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। পরশু সকালে সে ভিসার জন্য আমেরিকান কন্সুলেটএ যাবে। তাই একটা জরুরী কাগজ নন্দিতার কাছ থেকে নিতে হবে। পদা ধৈর্জ ধরে দাঁড়িয়ে রইল বাসের জন্য। কোন উপায়ও নেই। এখান থেকে নন্দিতার বাড়ি হেঁটেও যাওয়া যায় না। একবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটা এখনো সেই ফ্যাটফ্যাটে সাদা। তবে দূর দক্ষিন দিগন্তে মনে হোলো যেন একটা সামান্য কালচে আভাষ। ঘড়ি দেখলো একবার। ৪:৫০। নন্দিতার বাড়িতে কি আর ছটার মধ্যে পৌছানো যাবে? মনে হয় না। হঠাত পদার মনে পরলো যে মা’র জন্য একটা প্রেসারের ওষুধ কিনতে হবে। ফুরিয়ে গেছে। আজ রাতেই দরকার। পদা মনস্থির করলো যে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে বরং ওষুধটা এখনই কিনে নেবে। বাস যদি আসে তো আসবে। এমনিতেও দেরী হয়ে গেছে। সে সারকুলার রোডের বাঁ দিক বরাবর দক্ষিন মুখো হয়ে রাজাবাজার সাইন্স কলেজের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। মাঝেমাঝে পেছনে তাকিয়ে দেখছে তার বাস আসছে কিনা। দক্ষিন দিগন্তটা এখন সত্যিই ঘণ কালো রূপ নিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন একটা কালো সৈন্যবাহিনী তিব্রবেগে ধেয়ে আসছে সাদা সৈন্যবাহিনীকে আক্রমন করতে। পদা আকাশের দিকে চোখ রেখে এগিয়ে চললো। কি অপূর্ব এই মেঘের খেলা। আর দু মিনিটের মধ্যেই পদা ওষুধের দোকানে পৌঁছে যাবে। এর মধ্যেই হাওয়ায় একটা সামান্য ভেজা ভেজা ভাব। মেঘ ডাকতে শুরু করেছে।
ঠিক যেই মুহূর্তে পদা ওষুধের দোকানে ঢুকলো, ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট শব্দে বাজ পরলো আর মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হোলো। পদা ওষুধের দোকানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে খানিক্ষন সেই বৃষ্টি উপলব্ধি করলো। পদার গায়ে ছাঁট লাগছে, কিন্তু তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কি আরাম! মাটি থেকে একটা সোঁদা সোঁদা মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে। খানিক বাদে যখন বৃষ্টির প্রবলতা কমলো, তখন পদা দোকানের ভেতর ঢুকল। এ দোকান তার জানাশোনা। নিয়মিত ওষুধ কেনে এখানে। দোকানের মালিক মিত্রবাবু খালি বললেন “খুব বাঁচলাম জানো। আর পারা যাচ্ছিল না। এক সপ্তাহ না দু সপ্তাহের দেবো?” পদা আঙ্গুলের ইঙ্গিতে এক দেখালো। ওষুধ নিয়ে যখন সে দোকান থেকে বেরোলো, তখন সাদা কালো মিলে মিশে আকাশের রঙ ধুসর হয়ে গেছে। অদূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এখনো মেঘ ডাকছে মাঝেসাজে। বৃষ্টি অনেক কমে গেছে। তবে এখনো টিপিটিপ করে পরছে। আজ আর নন্দিতার বাড়ি গিয়ে লাভ নেই। পদা গড়পার রোডের দিকে অগ্রসর হোলো। সে সবে কয়েক পা এগিয়েছে, হঠাত পেছন থেকে ডাক এলো “অনীক!” পদা গলার স্বর চিনতে পেরেছে। সে ভাব করলো যেন ডাকটা শোনেনি। এগিয়ে চলল। আবার ডাক “অনীক! দাঁড়াও”। পদা এবারে আরষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। পেছন ফিরলো না। কয়েক মুহূর্ত পর হাঁপাতে হাঁপাতে এল সোনালি। সে বোধহয় পদাকে ধরার জন্য দৌড়াচ্ছিল। এসে পদার একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ালো। “কি ব্যাপার? তোমাকে কতবার ডাকছি। শুনতে পাও নি?” পদা দেখলো যে সোনালি আজ একটা কালোর ওপর সাদা ফুল কাটা স্কার্ট পরেছে, আর ওপরে একটা ধবধবে সাদা জামা। বৃষ্টির জলে জামাটা কয়েক জায়গায় ভিজে গেছে। “শুনতে পেয়েছি, কিন্ত…” “কিন্তু কি?” পদা এক মুহূর্ত সময় নিল। নন্দিতার কথাটা মনে পরে গেল। আই নিড টু মুভ অন। “ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং,…” পদা তার বাক্য শেষ করতে পারলো না। সোনালি তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো “কি?” পদা লক্ষ্য করলো যে বৃষ্টিতে সোনালির চোখের পাতাগুলোও সামান্য ভেজা। তার মসৃণ গালে মুক্তোর মত কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা। “দ্যাট ইউ ডোন্ট গিভ আ ড্যাম? বলেই ফেলো। আমি কিচ্ছু মাইন্ড করবো না”। বলে মুখ নিচু করলো সোনালি। পদা কি বলবে? সে কি করে বোঝাবে যে এই ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আর রেঠ বাটলারের ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং এক নয়। সে বলতে চেয়েছিল ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, তুমি কাছে এলেই যে আমার সমস্তকিছু ওলোটপালোট হয়ে যায়। নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তাই তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তা আর বলতে পারলো না। সোনালির দিকে তাকিয়ে শেষে বলল “না, তা নয়”। সোনালি কি বুঝলো পদা তা কোনদিন জানতেও পারবে না। হয়ত পদার ভেতরের আবেগ তার গলার স্বরে ধরা পরেছিল। সোনালি মুখ তুলে সরাসরি পদার চোখের দিকে তাকালো। পদা দেখলো যে এই সোনালি আর সেই চতুর্দশ বয়েসি জেম সিনেমার সোনালি এক নয়। এই সোনালি পরিপূর্ণ যুবতী। এর চাহনিতে একটা মায়া আছে, এর গলার স্বরে একটা আত্মবিশ্বাস আছে। এত বছরে পদার অজান্তে তারও হয়ত খানিকটা আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। এবার সে আর চোখ সরালো না। সোনালি মিষ্টি করে হাসল। তারপর পদার হাতটা নিজের নরম হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল “চলো। আমরা একটু হাঁটি”। দক্ষিন আকাশে তখন তুলোর মত ধবধবে সাদা কয়েকটা নতুন মেঘ এসে হাজির হয়েছে। পরন্ত সূর্যের রক্তিম আলো ঠিকরে পরছে তাদের গায়ে।
।সমাপ্ত।