ঘুমটা ভাঙলো একটা ঠ্যালায়।

শমীক চমকে উঠে তাকালো, রোদ্দুরের ঝাঁঝটা কমেছে, দুপাশে কাশফুল আর ধানের ক্ষেতের বুক চিরে তীর বেগে ছুটে চলেছে ট্রেনটা। ঝাঁকুনিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল, পাশে বসা মোটা মতন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক কটমট করে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। বোধহয় ওনারই কাঁধটায় ঢলে পড়েছিল ও। ওনারই ঠ্যালায় ঘুমটা ভেঙেছে — শমীক বুঝতে পারলো। মাথার দুপাশের রগদুটো খুব ব্যাথা করছে, ও আসতে আসতে মাসাজ করতে লাগলো। কি যেন একটা স্বপ্ন দেখছিলাম, তাই না? একটা ট্রেন…উল্টো দিক থেকে আরেকটা ট্রেন আসছে….একটা হাত এসে….

“মুড়ি লজেন্স…”

ফাটা বাঁশের মতন গলা করে বিঘত লম্বা একটা লোক উঠে, চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছে। ও-পাশের জানলার ধরে বসা বাবার কাছে বায়না ধরেছে খুকি। একটু পরেই বাগনান আসবে। ঘড়ি দেখলো ও, সন্ধ্যা হবে হবে করছে। মেচেদা পৌঁছতে পৌঁছতে আটটা তো হবেই। ভালো ফ্যাসাদে পড়েছে ও। খুড়তুতো ভাই বিক্রমটা চিরকালই ভুগিয়েছে। গত বছর কাকে যেন ভালোবেসে, আঘাত পেয়ে, অ্যাসিড খেয়ে প্রায় দু মাস হাসপাতালে ছিল, বেলেঘাটার আই.ডি.তে। মেচেদা-কলকাতা: মোটামুটি দু-তিন মাস ধরে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতে হয়েছে। দু’তিন মাস যাবৎ বাবু ঠিক করলেন ব্যবসা করবেন। কলকাতার বড়-বাজারে মোবাইলের দোকান খোলা হলো। ও আর ওর বন্ধু দিপু। এক মাস চলল কোনো রকমে। লোকে যত না কেনে, ওর দোকানে ঢক্কা-নিনাদ তার থেকে অনেক অনেক বেশি। স্মার্ট ফোনের দোকানে তারক-তারকাদের গ্ল্যামারে চোখ ধাঁধিয়ে যাবার অতিক্রম। বিক্রম বড়-বাজারের কাছেই একটা পিজিতে থাকে।

গত সপ্তাহে সকাল বেলা ফোন করে বলে আমি লুটে গেলাম। দোকানের সব মাল আর নগদ বেশ কিছু টাকা নিয়ে দিপু ভেগেছে। বিক্রমের মাথায় হাত। দুতিন দিন পুলিশ কাচারী করা হলো, ফল হলো না।

এরপর হঠাৎ গত দুদিন ধরে — বিক্রমকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানের তালা বন্ধ, মেসের লোকরাও বললো আগের রাত্রির থেকেই নাকি বাড়ি ফেরেনি।

যত্ত ঝামেলা !

এরই জন্য, আবার কলকাতা-মেচেদা করতে হচ্ছে শমীককে। আজ সকালে এসেছিলো কলকাতায়। থানায় থানায় ঘোরাঘুরি করার পর এখন ঘরে ফেরার পালা। কাল আবার আসতে হবে।

কিছুক্ষণ আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে চোখ পড়লো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক বয়স্কা মহিলার দিকে। শমীক উঠে দাঁড়ালো — অদ্ভুত সমাজ আমাদের, তাই না? শালা — মায়ের বয়সী একজন দাঁড়িয়ে আছে, আর দেখো গাধা গুলো বসে বসে তাস পিঠছে, তাও উঠবে না।

ভদ্রমহিলা বসে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

শমীক সরে এসে বাথরুমটার কাছে এসে দাঁড়ালো, দুজন অনর্গল দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে আর খুব উত্তেজিত ভাবে কি যেন বলাবলি করছে — “দূর শালা…দেখ তুই ! এবার পুজোটা মাটি না যায়। ওর মতন গাড়ল পার্টনার পেয়ে জীবনটা আমার মরুভুমি হয়ে গেছে রে ! সব কাজ তো আমায়ই করতে হয়। ও কি করতে আছে বল তো?”

উত্তরে আরেকজন বলল — “হ্যাঁ…বড় বাজারের মতন জায়গায় তুই অমন একটা দোকান নিলি। এত দামি দামি মোবাইল ফোন রেখেছিস — কিছু যদি হয়ে যায়….”

শমীক বেশ চমকেই উঠলো কথা শুনে। বড় বাজার? মোবাইলের দোকান? পার্টনার? দামি স্টক? কথাগুলো যেন খুব চেনা চেনা, তাই না?

উল্টো দিক দিয়ে একটা ট্রেন আসছে, শমীক এগিয়ে এলো। দুজনে নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছে, আধ খোলা দরজাটার পাশ দিয়ে উল্টোদিকের ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের আলোগুলো চোখে বেতের বাড়ি মারতে মারতে ছুটে চলেছে।

শমীক একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতেই….

একটা হাত।

পিছন থেকে এক ধাক্কা।

****

একটা জোড় ঝাঁকুনিতে চমকে উঠে তাকালো শমীক।

ঝিমিয়ে এসেছে রোদ্দুরের ঝাঁঝ। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। বেশ ভালোই স্পীড নিয়েছে ট্রেনটা। কখন যে দুলুনীতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে। সারাদিন যা গেলো ! পাশে বসা মোটা মতন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক কটমট করে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। বোধহয় ওনারই কাঁধটায় ঢলে পড়েছিল ও। ওনারই ঠ্যালায় ঘুমটা ভেঙেছে — শমীক বুঝতে পারলো। মাথার দুপাশের রগদুটো খুব ব্যাথা করছে, ও আসতে আসতে মাসাজ করতে লাগলো। কি যেন একটা স্বপ্ন দেখছিলাম, তাই না? একটা ট্রেন… অদ্ভুত একটা স্বপ্ন….

“মুড়ি লজেন্স…”

আরে….

একটু আগেই এরকমই…

এরকমই কিছু একটা দেখছিলাম, তাই না? একটা অদ্ভুত স্বপ্ন। একটা ট্রেন। দুটো লোক কথা বলছিলো। অন্য দিক থেকে একটা ট্রেন আসছে।

“একটু…একটু জায়গা হবে?”

এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা এসে পাশে দাঁড়িয়ে করুন ভাবে জানতে চাইলেন। সামনের সীটের ওঠালো না — তাস পেটাচ্ছে।

শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত যেন কিলবিলিয়ে নামে এলো। এই ভদ্রমহিলাকেও ও স্বপ্নে দেখেছি, আমি। চেনা মুখ। চেনা হাসি। চেনা সৌজন্যতা। এক ঝটকায় লাফিয়ে সরে দাঁড়ালো শমীক — না, না…এ হতে পারে না।

“তুই ব্যাপারটা বোঝ….অত দামি জিনিস পত্র ওই দোকানে রেখে আসাটা কি ঠিক হচ্ছে? ওরকম একটা ইডিয়েট জুড়িদার পেয়েছিস…এরকম বেয়াক্কেলে কাজ করাটা কি ঠিক হচ্ছে?”

হ্যাঁ। ঠিক। সেই চেনা দুটো মুখ। বিড়ির গন্ধ। দরজাটা আধখোলা। একটা ট্রেন আসছে উল্টো দিক থেকে।

একটা হাত এসে পিছন থেকে…..

****

“উফফ, একটু ঠিক করে বসুন না”, এক ঠ্যালায় ঘুমটা ভাঙলো শমিকের।

মোটামতন ভদ্রলোকের ললাটে বিশাল খাঁজ, খুবই বিরক্ত এভাবে ওনার কাঁধটাকে বালিশ মনে করায়। তাস পার্টিরা নিজেদের মধ্যে প্রচুর জটলা করছে। জানলার ধারের খুকি বাপির কাছে বায়না ধরেছে মুড়ি লজেন্সের জন্য। আধ খোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুই মক্কেল গল্প করছে গল্প করছে।

না….না….

আমার মাথাটা….উফফফ কি ব্যাথা করছে, তাই না? সারাদিন বিক্ৰমটার জন্য এই থানা ওই থানা করতে করতে, ভাদ্দরের রোদ্দুরে তেতে পুড়ে পুড়ে…উফফ, বোধয় পাগল হয়ে যাবো। সেই মহিলা কোথায়? একটু পরেই তো এখানে এসে দাঁড়ানোর কথা তাই না?

কি হচ্ছে আমার? একটা স্বপ্ন, তার ভিতরে আরেকটা, তার ভিতরে আরেকটা। অনেকটা যেন পিঁয়াজের খোসার মতন….ছাড়িয়েই চলেছি, ছাড়িয়েই চলেছি। চারপাশ থেকে এক অদ্ভুত ভয় যেন ঘিরতে লাগলো শমীককে। শূন্যতা। জীবনের চরম শূন্যতা। ছোটবেলায় মা, বাবা মারা যাবার পর, কাকার বাড়িতেই মানুষ। কাকার প্রচুর পয়সা, নিজের ছেলেটাকে আদর দিয়ে বেয়াদব বাঁদর করেছে। মূলতঃ শমীক বিক্রমের বাবার চাকর হয়েই যেন বড় হয়েছে। বিক্রমের বাবা যখন যা বলে, শমীক তাই শোনে। বিক্রমকে আজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ওকে খুঁজতে আসাটাও ওর বাবা’র ই আদেশে। ঋণ চোকাচ্ছি। আজীবন চোকাতে হবে।

রাগে আর বিরক্তিতে গা ঘিনঘিন করে উঠলো শমীকের। আজকাল যেন বড় বেশিই করছে।

যতদিন বিক্রম আর ওর বাবা বেঁচে থাকবে, এরকম চাকরের মতনই বেঁচে থাকতে হবে শমীককে। খুব জোরে নিশ্বাস নিলো ও।

নাহ, কোনো ভুলই করে নি ও — মরা বাপিকে বলে হাওড়া ব্রিজের নিচে মাঝ গঙ্গায়, পায়ে ভারী পাথর বেঁধে, হাত বেঁধে, বিক্রমকে বিসর্জন দিয়ে এসেছে ও। ওকে কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না। যতই ওর বাবা শমীককে থানায় থানায় খুঁজতে বলুক না কেন। ওই ক্যালানে ছেলেকে খুঁজে বের করা পুলিশ তো কোন ছাড়….শিবেরও অসাধ্য।

আশা করি কাকা উইলটা মরবার আগে শমীকেরই নামে করে যাবে। অন্তত এই টুকু বুদ্ধি  আছে, তাই তো?

কৈ? কি হলো? সেই বুড়ি মহিলা তো আর কি এলেন না?

হাসলো নিজের ওপর। অবশেষে তাহলে জাগলাম। শালা…রাইটার্সের ফুটপাতের দোকানের ঘুগনি আর তন্দুরিতেই বোধহয় পেট গরম হয়ে ওই সব ভুলভাল স্বপ্ন দেখছিলাম।

আরও আধঘন্টা লাগলো মেচেদা পৌঁছতে। এখান থেকে টুক করে রাস্তাটা পের হয়েই, একটা টোটো ধরে নিয়ে দশ-মিনিটের মধ্যে বাড়ি। কাকিমা আজ নারকোল দিয়ে ডাল বানিয়েছে। সাথে মাছের ঝাল আর তেঁতুলের চাটনি। খেয়েদিয়েই বিছানায় ডাইভ মারতে হবে।

ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো শমীক।

যে লোকটা এক কোনে বসে পাঁপড় আর চপ বাজে, ও আজ বসে নি। রাস্তা-টা অন্ধকার আর খালি খালি।

নাহ, ঠিক খালি না।

কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

খুব চেনা চেনা।….

হ্যাঁ…একটু এগোতেই চিনতে পারল শমীক। “দিপু? তুই?”, অস্ফুটে গলা দিয়ে স্বরটা যেন বেরোলো না।

“আমায়…আমায় ক্ষমা কর শমীকদা। আমি বিক্রমকে ঠকিয়েছি”, দিপু কাঁদছে — “অনেক টাকা…অনেক টাকা…. সামলাতে পারি নি।”

আমি আসতে আসতে এগোচ্ছি — “বিক্রম….বিক্রম আমার কথা শুনছে না দাদা…ওকে একটু বোঝাও না…..”, একটানা বলে চলেছে দিপু।

পিছন থেকে একটা হাত। খুব জোরে একটা ঠেলা…

টাল সামলাতে না পেরে ব্রিজটার ওপর দিয়ে পরিষ্কার টের পেলো ছিটকে পরে যাচ্ছে শমীক। নিচ দিয়ে মেচেদার কি যেন একটা লোকাল ট্রেন ছুটে আসছে…..

না….ঠিক তা নয়।

পরার ঠিক আগে হাত দুটো কার সেটা শমীক দেখতে পেলো। পরিষ্কার। স্টেশনের মসলা মুড়ি মাখা  দোকানের আলো আর আগত ট্রেনের ঝাঁঝাঁ রোশনাইয়ে।

বিক্রম।

নীল রঙা শার্টটাকে নদীর নিচের পলি মাটির বাদামি রঙে মজে মজে আর চেনাই যাচ্ছে না।

****

“কি রে বাবা…কথা কি কানে যাচ্ছে না, নাকি? বলি একটু সরে বসুন না?”

পাশে বসা মোটা লোকটার বাজখাঁই গলায় চমকে উঠল শমীক। তীর বেগে ট্রেনটা ছুটে চলেছে কাশফুলের চক্রবুহ্য চিরে। কখন যে শমীক ঘুমিয়ে পড়েছিল, নিজেই বুঝতে পারেনি।

ফাটা বাঁশের চেরা চেরা গলায় হকার হাঁক পারলো — “মুড়ি লজেন্স…..”

 

~ লুপ ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleTHE BONDING
Next articleবৈকাল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments