সেই পুরনো গল্প। সেই সনাতন ‘চাপ’। বাবা মেয়েকে নিয়ে মহা চিন্তিত। তা মেয়ে যদি আবার সোমত্ত হয়। আর এ তো যে সে মেয়ে নয়। রাজকন্যে বলে কথা। এক খান রাজপুত্তুর না হলে তো একেবারেই চলছে না। রাজা অস্থির। মন্ত্রী অস্থির। পাত্র-মিত্র-সভাসদ মায় প্রজারা পর্যন্ত অস্থির।
রাজকন্যের হুঁশ নেই। রাজকন্যে সেতার শোনে, গান বাঁধে, কাব্য করে। সখীরা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে রাজকন্যেকে দেখে পালায়। দেখলেই কাব্য কথা। কাঁহাতক আর পোষায়। কোথায় মখমলের জামা পরবে, গোলাপ জলে চান করবে, বাহারী গয়না পরে আয়না দেখে নিজের স্বপ্নের রাজপুত্তুরের কথা ভাববে—তা নয়। খালি কাব্য কথা। অবশ্য এ নিয়ে রাজকন্যের কোনো দুঃখ নেই। রাজকন্যের এক দুষ্টু সখা আছে। রাজকন্যের তুতো ভাই। সে রাজকন্যেকে বেড়াতে নিয়ে গেছে, ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছে, গাছ থেকে আম পেড়ে খাইয়েছে, তীর মারতে শিখিয়েছে। সুরা পান আর হুকোটা পর্যন্ত খাইয়েছে। রাজকন্যের এই কাব্য করার ‘দিক’—এটাও ঐ তুতো ভাইয়েরই দান। রাজকন্যে অবশ্য বেশ আমোদ পেয়েছে এই তুতো ভাইটিকে পেয়ে।
মন্ত্রী রাজাকে অনেক ভেবে বলল যদি কেউ রাজকন্যেকে বিয়ে করার কথা বলতে পারে তা একমাত্র ঐ তুতো ভাই। রাজার হুকুমে তুতো ভাই গিয়ে বলল। রাজকন্যে ভাবল করেই দেখি। বেশ মজা হবে। রাজকন্যে শর্ত দিয়ে বসল। পরীক্ষা পাশ না হলে বিয়ের কোনো গল্প নেই। রাজা মেনে নিল। রাজকন্যেও খুশি।
পরীক্ষার কথা রাজা বেশ করে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন। দূরদূরান্ত থেকে রাজপুত্তুররা এল। এক মাস গেল। দু’মাস গেল। তিন মাস গেল। রাজপুত্তুররা আস্তে আস্তে ঘরে ফিরতে শুরু করল। কিছু রাজপুত্তুররা তো ভীষণ রাগ করল। কোথায় বলবে তীর মারো, যুদ্ধ করো, শিকার করো, মুক্তো আনো তা না। রাজকন্যের দাবি হচ্ছে একটা ধাঁধা। ধাঁধাটাকে সমাধান করতে হবে। রাজকন্যে একটা বিরাট জায়গা জুড়ে একটা বিশাল ধাঁধা মহল তৈরি করিয়েছে। যে ঐ ধাঁধা সমাধান করে বেরতে পারবে সেই হবে রাজকন্যের স্বপ্নের রাজপুত্তুর।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। কেউ আর ধাঁধার সমাধান করতে পারে না। রাজা আবার চিন্তা করতে শুরু করল। রাজার সাথে মন্ত্রী-সান্ত্রি-পাত্র-মিত্র-সভাসদ মায় প্রজারাও আবার চিন্তা করতে শুরু করল। মন্ত্রী আবার বাতলাল এবার শহরে যত বিবাহযোগ্য পুরুষ আছে সবাইকে ঐ ধাঁধা সমাধানে আসতে হবে। রাজা রাজি হল। রাজকন্যে আরো মজা পেল। রোজ কেউ না কেউ আসে আর হেরে চলে যায়। কেউ আর পারে না ধাঁধা সমাধান করতে। একে একে রাজ্যের সব বিবাহযোগ্য পুরুষ হাল ছাড়ল। রাজার কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো স্পষ্ট। রাজা হুকুম দিল শহরের প্রধান দ্বারের সামনে দিয়ে যে বিবাহযোগ্য পুরুষ যাবে তাকেই আসতে হবে। এই করেই চলতে থাকে। রাজকন্যের বয়স বাড়তে থাকে।
একদিন পেয়াদারা এক উস্কো খুস্কো চুলো, ধুলোময়লা লাগা, আধপাগল এক যুবককে ধরে আনল। কাঁধে অদ্ভুত এক ঝোলা আর তাতে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি। যুবক যে বেশ সুপুরুষ তা নয়, তবে তার চোখ দুটো যেন সব সময় জ্বলছে। রাজকন্যে বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইল। পেয়াদারা প্রায় জোর করেই তাকে ঠেলে দিল সেই ধাঁধা মহলের মধ্যে। রাজকন্যে ওপরে দাঁড়িয়ে।
যুবক কিছুক্ষণ এদিক ওদিক চাইল। তারপর যন্ত্রপাতি বের করে আঁকিবুঁকি কাটল। তারপর বসে হুকো বার করে টানতে আরম্ভ করল। রাজকন্যে বেশ অবাক হল। এরকম বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে রাজকন্যে অধৈর্য হয়ে পড়ল। পেয়াদাদের হুকুম দিল যুবককে জানাতে যে রাজকন্যে দেখছে। পেয়াদারা জানাল। অথচ যুবকের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এক মনে হুকো টেনে চলেছে। হঠাৎ একটা যন্ত্র নিয়ে বাজাতে শুরু করল। এবং সে এক অদ্ভুত সুর। স্বয়ং কেষ্ট ঠাকুর বুঝি সেরকম বাজাতেন। রাজকন্যে আর থাকতে পারল না।
রাজকন্যে যুবকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল সে কেন ধাঁধা সমাধান করার চেষ্টা করছে না। যুবক হেসে রাজকন্যের দিকে তাকাল। জানাল সমাধান অনেক আগেই হয়েছে। তবে এ ধাঁধায় একা খেলে কোনো মজা নেই। দু’জনে মিলে খেলতে হবে। একা খেলে জেতা যাবে। এমনকি রাজকন্যে যুবককে দৌড় করিয়ে বেশ সুখও পাবে। কিন্তু মজা হবে না। এ ধাঁধা মহল দুজনের। দুজনেই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেরালে তবেই মজা। দুজনকেই খেলতে হবে, দৌড়তে হবে, হাঁপাতে হবে, কাঁপতে হবে, ভিজতে হবে, হারতে হবে। তবেই গিয়ে জিত। তবেই গিয়ে শান্তি।
রাজকন্যে হাসল।
রাজকন্যে আর যুবকের বিয়ে হয়েছিল কিনা জানিনা।