হোটেল মঞ্জুসার নীল কাচ দিয়ে তুষারাবৃত হিমালয়ের রূপ দেখছিলাম । দার্জিলিঙে এসে হিমালয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম প্রতি মুহূর্তে । চা বাগান ঘেরা , পাখির কূজন ভরা , ফুলের রঙ্গিন গন্ধে মাতোয়ারা দার্জিলিং এসেছি সেই ছোটবেলায় । কিন্তু এবারে শুধু আমি আর ইন্দ্রদা । পাহাড়ের খাদের ধারে বড় বড় পাইন গাছ মাথা নাড়ছে । মাঝখানে পাতার ফাঁকের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে ঝলমলে রোদ্দুর । কোলকাতার ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে হাঁফিয়ে উঠেছিল মন । তাই দুজনে বেরিয়ে পড়েছি এবার মানুষের দৈনন্দিন কোলাহল ও দূষণ থেকে বহুদূরে ।

ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল … “ কিরে কেমন লাগছে দার্জিলিং ? ”

“ ভাল । ”

“ শুধু ভাল ? ”

“ হ্যাঁ শুধুই ভাল । তুমি তো যেখানেই যাও সেখানেই রহস্যের পরিবেশ গড়ে ওঠে । কই এবারে তো আর তেমন কিছু হল না ? ”

“ ওহো এই ব্যাপার , তা দার্জিলিঙে এসে হিমালয়ের থেকে আর বেশি কি রহস্যময় তুই আশা করিস ? ”

যাইহোক আমাদের কথার মাঝেই কলিংবেলটা বেজে উঠল । আমিই গিয়ে দরজা খুললাম । এক অপরিচিত ব্যক্তি , বয়স ইন্দ্রদার মতই সাতাশ আঠাস হবে , বেশ লম্বা চওড়া , গৌরবর্ণ , মাথাভর্তি ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়ানো চুল , চোখে ফাসট্র্যাকের সানগ্লাস , কপালে ছোট্ট একটা ব্যান্ডেজ ।

ভদ্রলোক বললেন … “ ইন্দ্রজিৎ আছে ? ” ততক্ষনে ইন্দ্রদা উঠে এসেছে । ওরা কিছুক্ষণ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল । তারপর ইন্দ্রদাই প্রথম কথা শুরু করল …

“ আরে সুমিত না ? কেমন আছিস ? ”

“ হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস , তুই কেমন আছিস ? ”

“ ভাল । তা তুই এখন কি করছিস ? শুনেছি নাকি একটা ক্রিকেট দলের পরিচালনা করিস ? ”

“ ঠিকই শুনেছিস , একটা ছোটখাটো ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন । আর তুই তো এখন বেশ নামকরা ডিটেকটিভ … দার্জিলিঙেও তো তোর নাম ছড়িয়ে গেছে রে সেবারে কি একটা রহস্যের কিনারা করে । ”

“ হ্যাঁ ঐ আর কি । ”

“ আমি কালকেই জানতে পারলাম তোরা দার্জিলিং বেড়াতে এসেছিস , তাই দেখা করতে চলে এলাম । তা তোর সঙ্গে এটি কে ? তোর সেই বিখ্যাত অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌম্য বুঝি ? ”

আমার সঙ্গে পরিচয়ের পালাটা শেষ হতেই ইন্দ্রদা হোটেলে তিনটে কফির অর্ডার দিল । ততক্ষনে হালকা এক পশলা বৃষ্টি নেমেছে । পাথুরে মাটির সোঁদা গন্ধে সে এক আলাদা আমেজ ।

অনেকদিন পর দুই বন্ধুর রিইউনিয়ন খোশমেজাজেই চলছিল । তারপর একসময় ইন্দ্রদার বন্ধু সুমিতদা বলে উঠল …

“ তোরা কোলকাতা কবে ফিরছিস ? ”

“ আপাতত চার পাঁচদিন তো এখানে আছিই । ”

“ তাহলে সৌম্যকে নিয়ে কাল সকাল আটটা নাগাদ একবার শিবতলা স্টেডিয়ামে চলে আয় না ? ”

“ কেন ? ”

“ কাল সেমি ফাইন্যাল ম্যাচ , আর পরশু ফাইন্যাল । আমরা সেমি ফাইন্যালে উঠেছি । তোদেরকে ভি আই পি গেস্ট হিসেবে থাকতে হবে । আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো । ”

“ কিন্তু … ”

“ দার্জিলিঙের সাইটসিনগুলো অন্য দিন করে নিস । কোনো কিন্তু শুনতে চাই না । কাল আর পরশু আমাদের সঙ্গে থাকতেই হবে । এতদিন পর দেখা , এত সহজে তোকে ছেড়ে দেবো ভাবলি কি করে ? আমি কাল গাড়ি পাঠিয়ে দেবো । ”

ইন্দ্রদার বন্ধু চলে গেল । পরে ইন্দ্রদার কাছে সুমিতদার পরিচয় জানলাম । নাম সুমিত বিশ্বাস , একসময় ক্লাসের সেরা ক্রিকেট প্লেয়ার ছিল সে । যেমন ব্রিলিয়াণ্ট স্টুডেন্ট , তেমন তুখোড় ক্রিকেট প্লেয়ার । এখানে একটা কথা বলে রাখি , ইন্দ্রদার একটা পরিচয় পাঠক পাঠিকারা সবাই জানে না । একদিকে ও যেমন একজন নামকরা ডিটেকটিভ , অন্যদিকে ক্রিকেটারও বটে , যদিও খুব নামকরা নয় । ইন্দ্রদার কাছে আজই জানলাম , প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ইন্দ্রদা আর সুমিত বিশ্বাস দুজনেই ছিল ওপেনিং জুটি । মাইক্রোবায়োলজি তে মাস্টার্স করে ইন্দ্রদা ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে রিসার্চ শুরু করে দিল , তারপর থেকে দুই বন্ধু দুইদিকে । ইন্দ্রজিৎ সান্যাল জয়েন করল ক্রাইম ব্রাঞ্চে । ক্রিকেটটা আস্তে আস্তে ইন্দ্রদার জীবন থেকে জলছবির মত মুছে গেল । বদলে ইন্দ্রদার গ্রিন পিচে বাউন্সারের মত আবির্ভাব হল এক মিষ্টি মেয়ে ঝিলিক সেনগুপ্ত । পেশায় ফটোগ্রাফার , ইন্দ্রদার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট । কথায় আছে না , প্রত্যেকটি সাকসেসফুল পুরুষের সাফল্যের পেছনে একজন নারীর অবদান আছে । ইন্দ্রদার ক্ষেত্রেও তেমন এই ঝিলিক সেনগুপ্ত । গল্পের প্রয়োজন ছাড়া ইন্দ্রদা অপ্রাসঙ্গিক মানুষের বিবরণ দেওয়া একদম পছন্দ করে না । তাই ইন্দ্রজিৎ সান্যাল ও ঝিলিক সেনগুপ্তের প্রেমপর্বটি একান্তই ব্যক্তিগত ভেবে বিষয়টির ইতি টানলাম এখানেই । অনেকটা অফ স্ট্যাম্পের বল কাট না মেরে সেফলি লিভ করা , কারন বয়েসে ইন্দ্রদার থেকে অনেকটা ছোট হওয়ায় ওর কাছে এল বি ডবলু হবার ভয় আমার আছে ।

বাইরে কালো মেঘের অবগুণ্ঠন মোচন করে সূর্যদেব উঁকি মারছেন আকাশ থেকে । সূর্যের আলোটা পাহাড়ের বরফের উপর পড়ে চমৎকার দেখাচ্ছে । আর সেই মলিন আলোয় মিশে যাচ্ছে গোটা চা বাগান লাগোয়া বিস্তীর্ণ অঞ্চল । ঘন পাইন ফার ওক বনের পরতে পরতে যেন কোনো রহস্য উঁকিঝুঁকি মারছে । গলার মাফলারটা বিছানাতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ব্যাগ থেকে দার্জিলিং জমজমাট বইটা এনে পাতা ওলটাতে লাগলাম । পরশু টাইগার হিল দেখতে গিয়েছিলাম তাই আজকের দিনটা দার্জিলিং ঘুরে দেখার জন্য স্থির রইল ।

বিকেলে একটু মেঘলা মেঘলা ছিল । ইন্দ্রদা তবুও ঝিলিকদির দেওয়া হ্যান্ডিক্যামটা আনতে ভোলেনি । ঘন চা বাগানের মধ্যে দিয়ে নানা পাখির কলতান শুনতে শুনতে ঘন সবুজে চোখ ভিজিয়ে একটা পাহাড়ের খাদের ধারে এসে পড়লাম । ধীরে ধীরে সূর্য পাহাড়ের বুকে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে । এই নিস্তব্ধতার মাঝেও এক আলাদা রোমাঞ্চ খুঁজে পাচ্ছিলাম আমি । ডিঊল্যান্ড পার্কে এসে বসেছি , মনে হল পেছন থেকে কেউ যেন আমাদের ফলো করছে । প্রথমটা অতটা না বুঝলেও আমরা যখন পার্কের সিংহদ্বারটার কাছাকাছি তখন ইন্দ্রদা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল … “ কে তুমি ? ”

এবার যাকে দেখলাম তার চেহারার বর্ণনা দেওয়াটা বেশ হাস্যকর । দেখে মনে হল বদ্ধ পাগল , পরনে ময়লা হাফপ্যান্ট , ছেঁড়া কালি লাগা একটা টি শার্ট , মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি , জামার পকেটটা বেশ ভারী , মনে হয় অনেককিছু ভরা আছে , মাথায় একটা সাদা টুপি , দাঁতগুলো অদ্ভুত রকমের বড় , বয়স বড়জোর ত্রিশ বত্রিশ । প্রথমেই লোকটা এসে সোজা ইন্দ্রদার কাছে গড়গড় করে কথাগুলো বলল ইন্দ্রদাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে …

“ আপনার নাম ইন্দ্রজিৎ সান্যাল , তাই না ? হ্যাঁ আমি জানি তো আপনার নাম । কিন্তু আপনি কালকে যাবেন না , একদম যাবেন না ওখানে । তাহলে ওইসব বেআইনি চোরাকারবারের সাথে আপনিও যুক্ত হয়ে যাবেন । ও হ্যাঁ , কোথায় যাবেন না , তাই তো ? খেলার মাঠে , শিবতলা , শিবতলা স্টেডিয়াম । সত্যি বলছি ইন্দ্রজিৎ স্যার । পাগলা ভাবছেন ? আমাকে সবাই তাই ভাবে । আমি কিন্তু পাগলা নই ।  ”

এবার ইন্দ্রদার প্রশ্ন … “ কিন্তু তুমি কে ? ”

লোকটা অদ্ভুতভাবে হাসতে হাসতে নিমেষের মধ্যে ছুটে চলে গেল । আমরা কিছুক্ষন ওইদিকে চেয়ে রইলাম ।

“ রহস্য যখন গজায় , তখন এমনি ভাবেই শুরু হয় সৌম্য । তোর কথাটা মিলে যাচ্ছে । দার্জিলিঙে এসেও রহস্য পিছু ছাড়বে না মনে হচ্ছে । ”

“ তাহলে তুমি বলতে চাইছো স্টেডিয়ামে কিছু একটা রহস্য রয়েছে ? ”

“ সেটা তো না গেলে বোঝা যাবে না । তবে রহস্যকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে ক্রিকেটকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম , এবারে তো দেখছি দার্জিলিঙের পাটা পিচেও রহস্যের বল সুইং করবে মনে হচ্ছে । ”

“ ক্রিকেট রহস্য ? ”

“ না সৌম্য , রহস্যের নাম ক্রিকেট । ”

( ২ )

“ নাম ধাম কিছু বলল না , তবে শিবতলা স্টেডিয়ামে চোরাকারবার নিয়ে কিছু একটা বলছিল মনে হল । ”

“ ওসব বাদ দে , পাগল টাগল হবে হয়তো । আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি , তোরা রেডি হয়ে নে । আমাকে আবার টিম মিটিং এ বসতে হবে । ”

সকালে উঠতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল আমাদের । সুমিত বিশ্বাসের ফোনটা রাখার পর ইন্দ্রদা চট করে কোটটা পড়ে নিল । আমিও সোয়েটার মাফলারটা গলায় জড়িয়ে নিলাম । মুখ ধুয়ে ফ্রেস হতে প্রায় আটটা বাজতে দশ হয়ে গিয়েছিল । ব্রেকফাস্ট না করেই সোজা আমি আর ইন্দ্রদা একটা জাইলো গাড়িতে করে শিবতলা স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিলাম । বাইরে কুয়াশার ঘনঘটা । তুমুল বৃষ্টিতে চারদিক ঝাপসা লাগছিল । গাড়ির কাঁচের বাইরে তখন ধারাজলের আল্পনা আঁকা হচ্ছে । পাহাড়ের বৃষ্টির একটা আলাদা মোহময়ী রূপ আছে । সেই রূপসাগরে ডুব দিতে দিতে গাড়ি হালকা চালে এগোতে লাগলো ।

স্টেডিয়ামে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ি বলছে সাড়ে আটটা । বৃষ্টি কমে গেলেও গাছের পাতা থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে জলের ফোঁটা । দুপাশে সবুজ চা বাগান আর সবুজ পাহাড়ে ঘেরা শিবতলা স্টেডিয়াম । বৃষ্টিস্নাত হয়ে পাহাড়ি সবুজ যেন আরো সতেজ দেখাচ্ছে ।

দূর থেকে মনে হল একজন কেউ হন্তদন্ত হয়ে আসছে । ফিচেল গোছের লোকটা আমাদের কাছে এসে বলল … “ আপনারা সুমিত বিশ্বাসের বন্ধু ? ”

আমরা মাথা নাড়লাম । লোকটার কথায় বুঝতে পারলাম সুমিত বিশ্বাসই তাকে পাঠিয়েছে । যেহেতু সুমিতদা এখন খেলার প্রাকটিসে ব্যস্ত তাই লোকটা আমাদের স্টেডিয়ামের ভি আই পি সিটের কাছে নিয়ে এল ।

ইন্দ্রদা অনেকের সাথে পরিচয় করছিল , সেখানে ইন্দ্রদাকে চেনে এরকম দু তিনজন পরিচিত লোকও বেরিয়ে গেল । আমাদের নিয়ে ভি আই পি সিটে প্রায় পঞ্চাশ জনের মত লোক ছিল । বাকি স্টেডিয়াম ভর্তি । স্টেডিয়ামটা খুব বড় না হলেও মাঠটা বেশ বড় । দক্ষিন দিকটাতে রয়েছে স্কোরবোর্ড , প্রত্যেকটা ব্লকে রয়েছে তিন ফুট লম্বা করে আয়তকার সাউণ্ড বক্স যা থেকে কমেন্টটেটর এর ধারাভাষ্য ভেসে আসছিল । আর আমাদের পাশেই রয়েছে দুটো দলের ড্রেসিংরুম কাম ওয়েটিং রুম । ইতিমধ্যে ইন্দ্রদার সঙ্গে অনেকে দেখা করে গেছে । সুমিত বিশ্বাস যে এখানেও রহস্যভেদী ইন্দ্রদার বেশ গুণগান গেয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি ।

প্রথমত ইন্দ্রদার বন্ধু সুমিত বিশ্বাস । সে আজকে অবশ্য সম্পূর্ণ খেলোয়াড়ের ড্রেসে ছিল । দেখে মনে হল সেই ওপেনিং করবে ।

দ্বিতীয়ত সুমিত বিশ্বাসের বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন সৌরভ নাগ । ইন্দ্রদার সঙ্গে ওর বেশ ভাব আলাপ হল । আমি সৌরভ নাগের চেহারার মোটামুটি বর্ণনা দিচ্ছি । মোটাসোটা , কালো গায়ের রং , হাইট খুব বেশি নয় , আইডিয়াল স্পোর্টসম্যান টাইপ ফিগার নয় , মুখে গোঁফ দাড়ি পরিস্কার করে কামানো , আর সম্পূর্ণ খেলোয়াড়ের ড্রেসে । কথায় কথায় জানতে পারলাম সৌরভ নাগের দলটার নাম জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব এবং সুমিত বিশ্বাসের দলটার নাম বলাকা স্পোর্টিং ক্লাব ।

তৃতীয়ত শিবতলা স্টেডিয়ামের কনভেনার এবং ম্যাচের আম্পায়ার দুজন গনেশ ঘোষ ও তপেন গুহ । দুজনেরই বয়স চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে , মাথায় সাদা টুপি , পুরো সাদা ড্রেস , বলিষ্ঠ চেহারা , চোখে রেব্যানের অ্যাভিয়েটার সানগ্লাস ও হাতে বড় বড় দুটো স্পেশাল হাতঘড়ি সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছিল । দুজনের মধ্যে একটাই তফাত । গণেশ ঘোষ কথা বলতে বলতে চোখ পিটপিট করেন আর তপেন গুহর কথা বলার সময় চোয়ালটা একটু বাঁদিকে বেঁকে যায় ।

যাই হোক বক্সে শুনতে পেলাম … “ এবার শুরু হচ্ছে বলাকা আর জয়পুরের সেমিফাইন্যাল সংঘর্ষ । ”

ঘড়িটা একবার দেখে নিলাম বাজছে নটা । পাশের এক ভদ্রলোকের কাছে জানতে পারলাম জয়পুর ক্লাব টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের দল আর দুজন আম্পায়ার মাঠে নামল । ইন্দ্রদার বন্ধুর দলের প্লেয়ারগুলো আমাদের থেকে দশ হাত দূরে বসে আছে । ওরা কফি খাচ্ছিল । সকালে ব্রেকফাস্ট করিনি বলে বেশ খিদেই পাচ্ছিল । ইতিমধ্যে আমাদের টিফিন আর কফি ভি আই পি সিটে চলে এল । পাশের এক মোটাসোটা ভদ্রলোক অতিরিক্ত এক্সাইটমেণ্টে হাততালি দিতে লাফিয়ে উঠেছিল বলে ইন্দ্রদার কাপ থেকে কিছুটা কফি ভদ্রলোকের ডেনিম জিন্সে পড়ে গেল । ইন্দ্রদা অবশ্য দোষটা নিজের কাঁধে নিয়েই পকেট থেকে রুমাল বের করে ভদ্রলোকের প্যান্টের কফিটা মুছে দিয়েছিল ।

ওপেনিং করতে নামল সুমিত বিশ্বাস ও আর একজন । খেলা শুরু হল , টোয়েণ্টি টোয়েণ্টি ম্যাচ । টিফিন আর কড়া ব্ল্যাক কফি খেতে খেতে ইন্দ্রদার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম । মুখ দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না , তবে বেশ গম্ভীর । প্রথম ওভারেই ফিল্ডারদের মধ্যে একটা চিৎকার শুনতে পেলাম । বলাকা ক্লাবের ওপেনার , ইন্দ্রদার বন্ধু সুমিত বিশ্বাস বোল্ড আউট । ইন্দ্রদা বেশ গম্ভীর , ও এখন মাঠের দিকে লক্ষ্য করছে না । মাঠের উত্তর দিকে যেখানে স্টেডিয়ামটা শেষ হয়েছে সেখানে তাকিয়ে রয়েছে একদৃষ্টে । পাশের এক ভদ্রলোক দূরবীন নিয়ে খেলা দেখছিল । ইন্দ্রদা “ প্লিজ ” বলে দূরবীনটা একবার চেয়ে নিল । কি এত মন দিয়ে দেখছে তা ইন্দ্রদাই জানে । কিছুক্ষন পর স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি , দশ ওভারে পঁচিশ রান , পাঁচ উইকেট । ইন্দ্রদা ভদ্রলোককে দূরবীনটা ফেরত দিল । আমি তখনই কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না ।

সুমিত বিশ্বাস ইন্দ্রদার পাশে এসে একটা খালি সিটে বসল … “ আজকে আমাদের হার অবধারিত । ”

ইন্দ্রদা বলল … “ ক্যাপ্টেনের মুখে এসব কথা ? ”

“ তুইও আমার জায়গায় থাকলে একই কথা বলতিস । ”

“ মানে ? আমি তো তোকে বেশ পজিটিভ মাইন্ডেড বলেই জানতাম । এখনো খেলার অনেক কিছু বাকি আছে । ”

“ হয় আমাদের ফিটনেসের ঘাটতি আছে , তা না হলে অন্য কিছু … ”

“ কি বলতে চাইছিস বলতো ? ”

“ এখানে নয় , পরে বলবো । ”

“ তাই বলিস । তবে আজ আর ভাল লাগছে না রে সুমিত । বড্ড অলস লাগছে , কাল ফাইন্যালে আসবো । ”

স্কোর বোর্ডে যাবার সময় চোখ পড়ল । বলাকা ক্লাবের অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে , কুড়ি ওভারে সাতচল্লিশ রান , আট উইকেট । এতটা একপেশে ম্যাচ হবে আশা করিনি । এক এক করে বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবের সাপোর্টাররা সব স্টেডিয়াম ছাড়ছে । আমরাও চলে এলাম হোটেল মঞ্জুসায় ।

একটানা চুপচাপ বসে থাকলে নাকি ঘুম পায় শুনেছি । অনেকক্ষণ স্টেডিয়ামে বসেছিলাম তাই টায়ার্ড লাগছিল । খাবার রেডি ছিল । লাঞ্চের জন্য হোটেলে ইন্দ্রদা আগেই ফোন করে দিয়েছিল । স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে আমি আর ইন্দ্রদা শুয়ে পড়লাম । টায়ার্ডনেসে চোখ বুজে যাবার আগে পর্যন্ত বুঝতে পারছিলাম ইন্দ্রদা কিছু বলছে …

“ পাগলটার সঙ্গে দেখা হওয়াটা কি নিতান্তই কাকতালীয় বলে মনে হয় তোর সৌম্য ? শিবতলা স্টেডিয়ামের সঙ্গে চোরাকারবারের কি সম্পর্ক থাকতে পারে ? ”

( ৩ )

“ আমার মনে হয় ইন্দ্র , এই খেলার সঙ্গে কিছু গভীর রহস্যের সম্পর্ক আছে ? ”

“ হেরে গেছিস বলে এখন যা তা বকছিস , তাই তো সুমিত ? ”

“ না না , তার জন্য নয় । আমি তোকে কিছু বলতে চাই ইন্দ্র । ”

“ আচ্ছা আগে ঘরে এসে বোস তো ? ”

এক্কেবারে পাক্কা চারটে পর্যন্ত ঘুমোনোর পর আমরা বিকেলে মার্কেটে যাবো বলে বেরোচ্ছিলাম , ঠিক তখনই কলিংবেল বাজলো । ইন্দ্রদা অবশ্য আমার একটু আগে ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে কি একটা কাজ সেরে এসেছে বলল । দেখলাম সুমিত বিশ্বাস এসেছে , ভ্রু যুগলের নিচে একজোড়া গম্ভীর অনুসন্ধানী চোখ । সুমিত বিশ্বাস ব্যালকনির সোফায় উপবেশন করে আবার বলা শুরু করল …

“ বুঝলি ইন্দ্র , গত দু বছর ধরে জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব ফাইন্যাল কাপ জিতছে । আর তুই দেখে নিস ইন্দ্র , এবছরেও ওরা জিতবে । তাই বলে প্রত্যেকটা ম্যাচে ওরা ভাল ভাল টিমকে গোহারানে হারিয়ে দেবে , এটা মেনে নেওয়া যায় না । আমার মনে হয় এর পেছনে কোনো কারসাজি রয়েছে । ”

“ বেটিং ? ” … ইন্দ্রদা বলল ।

“ না , না । ওসব কিছু না । আমাদের টিম কখনও এরকম করতে পারে না । মনে হয় অন্য কিছু । তুই একবার নিজে মাঠে যাবি … মানে শিবতলা স্টেডিয়াম ? ”

“ কখন ? ”

“ এখনই চল না , সন্ধ্যের আগে ফিরে আসবো । ”

“ কিন্তু ওখানে গিয়ে আমি করবোটা কি ? ”

“ ওরা যদি মাঠে গিয়ে কিছু কারসাজি করে রেখে দেয় , তাহলে তোর চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না নিশ্চয় । ”

“ কিসব আবোল তাবোল বকছিস , সুমিত ? আর ইউ ম্যাড ? ওদের ক্ষমতা আছে তাই জিতছে । ”

“ না না , এ হতে পারে না ইন্দ্র । পরপর তিনবছর জিতে কাপ নেবার মত দল জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব নয় । ”

কিছুটা জোরপূর্বক আমাকে ও ইন্দ্রদাকে সুমিত বিশ্বাসের সঙ্গে যেতে হল । আমরা তিন মূর্তি যখন শিবতলা স্টেডিয়ামের মাঠে পৌঁছলাম তখন আকাশে আধো আধো আলো ছিল । তর্জনী ও মধ্যমার ফাঁকে কিং সাইজ গোল্ড ফ্লেকটা চেপে ধরে ইন্দ্রদা পিচটা নিখুঁত ভাবে কি লক্ষ্য করছিল তা ও নিজেই জানে । তারপর সুমিত বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল …

“ আচ্ছা সুমিত , মাঠে নামবার পর থেকে কাউকে তোর সন্দেহজনক বলে মনে হয় না ? যদিও ক্যাপ্টেনসি করতে করতে এ বিষয়টা মাথায় আসার কথা নয় , তবুও জিজ্ঞেস করছি , এনি অকওয়ার্ড সিচুএসন ডু ইউ ফেস ? ”

“ সেরকম তো কিছু মনে পড়ছে না । ”

“ মে বি এনি আনইম্পরট্যান্ট থিংগ । ”

“ যদিও খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় তবুও বলছি , প্রথম ম্যাচ যখন খেললাম , তখন আমি জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ম্যাচের দুজন আম্পায়ারের কিছু কথাবার্তা চলছিল সেটা লক্ষ্য করি । সেটা যে শুধুমাত্র মৌখিক ছিল তা নয় , আই কন্টাক্ট চলছিল তাদের মধ্যে প্রায়ই । ”

“ আর অন্য কিছু ? ”

“ নো … নাথিং ইন্দ্র । ”

“ সুমিত , এটা কোনো সন্দেহজনক ব্যাপার বলে তো মনে হচ্ছে না আমার । প্রত্যেক মাচেই কি এই দুজন আম্পায়ারই খেলা পরিচালনা করেন ? ”

“ হ্যাঁ । তবে এনারা খুব অভিজ্ঞ । প্রথম প্রথম সন্দেহ হত ঠিকই , কিন্তু পরে বুঝলাম এনারা তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত দেন নি । ”

“ তোদের ডে নাইট ম্যাচ হয় ? ”

“ হ্যাঁ ফ্লাড লাইটেও ম্যাচ হয় , তবে কম । ”

“ জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব এই সেশনে কটা ম্যাচ হেরেছে ? ”

“ নট এ সিঙ্গেল ওয়ান , ইন্দ্র । ”

“ ইন্টারেস্টিং । ”

“ দ্যাখ ইন্দ্র , আমি একটা দলের ক্যাপ্টেন । এটুকু বোঝার নিশ্চয় ক্ষমতা আছে যে , কোন দলের উইনিং পাওয়ার কিরকম । কিছু তো একটা গড়বড় হচ্ছেই । ”

আমরা এবার মখমলি সবুজ ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতে চলেছি মাঠের উত্তর দিকটায় । গোটা স্টেডিয়ামটা আজ ফাঁকা , অথচ কাল ফাইন্যালে গোটা স্টেডিয়ামে লোক গিজগিজ করবে । মাঠে প্র্যাকটিসে মত্ত কিছু প্লেয়ার । আকাশের গোলাপি রঙটা ক্রমশ মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে আসছিল । মাঠের একদম উত্তর প্রান্তে যেখানে স্টেডিয়ামটা শেষ হয়েছে , সেখানে একটা একতলা বিল্ডিং দেখলাম । এটাই ক্রিকেট ক্লাব ঘর । ছোট হলেও বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর । ভেতরে টিউব লাইট জ্বলছে বুঝতে পারছিলাম । ঝট করে একটা কথা মনে পড়ে গেল , আজ সকালে স্টেডিয়ামে ইন্দ্রদা দূরবীন দিয়ে মাঠের উত্তর দিকটাতে কিছু একটা দেখছিল । আমার মনে হল ইন্দ্রদাকে একবার কথাটা জিজ্ঞেস করে দেখা দরকার । কিন্তু সেটা আর বলতে হল না , ইন্দ্রদার পরের কথা থেকেই সেটা বোঝা গেল ।

“ সুমিত , সকালে একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম জানিস , একটা পাগলাটে গোছের লোক এই ক্লাবটার ভেতরে ঢুকে গেল , তবে কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে এল । ”

“ কখন ? ”

“ সকালে যখন তোদের ব্যাটিং চলছিল , সবাই খেলা দেখতে মত্ত ছিল । আমি স্টেডিয়াম থেকে দূরবীন দিয়ে লক্ষ্য করেছি । হতে পারে তোদের চেনা জানা কেউ । ”

“ তাহলে কি … ”

“ এই পাগলটার সাথেই কাল আমাদের পার্কে দেখা হয়েছিল । ও বলছিল , এখানে নাকি চোরাকারবার হয় । আর সেজন্য আমাকে সাবধানও করে দিয়েছে । ”

“ বলিস কি রে ইন্দ্র । শিবতলা স্টেডিয়ামে চোরাকারবার ? ”

“ এখন ক্লাবে গেলে গনেশ ঘোষ ও তপেন গুহর দেখা পাওয়া যাবে ? ওনাদের কাছে যদি কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যায় । ”

“ কিন্তু ওনারা তো কাল ফিল্ডে আম্পায়ারিং এ ব্যস্ত ছিলেন । ”

“ এদিকে এসেছি যখন চল একটু দেখা করেই যাই । কিন্তু আসল ব্যাপার একদম ফাঁস করবি না সুমিত । এমন ভাব করবি যেন মনে হয় আমরা ঘুরতে এসেছি । ”

( ৪ )

        “ বাঃ একদম ঘুরতে ঘুরতে ক্লাবে চলে এসেছেন আপনারা । তারপর বলুন ইন্দ্রজিৎ বাবু দার্জিলিং কেমন লাগছে ? ” … তপেন গুহ বলে উঠলেন ।

আমরা তিনজন ছাড়া ক্লাবঘরের মধ্যে ছিলেন ম্যাচের দুজন আম্পায়ার গণেশ ঘোষ ও তপেন গুহ । দুজনে চেয়ারে বসে কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন । আরো চারজন কমবয়েসি ছেলে কম্পিউটারে বসে কিছু কাজ করছিল । কথায় কথায় জানলাম গনেশ ঘোষ ও তপেন গুহই এ ক্লাবের হেড । রুমটা খুব অগোছালো । বাঁদিকে একটা র‍্যাকে হলুদ ফাইল ভর্তি । লাল সিমেন্টের মেঝের উপর কিছু এ ফোর সাইজের প্রিন্ট করা কাগজ ছড়ানো ছেটানো । চার পাঁচটা কম্পিউটার রয়েছে যেখানে বসে কিছু পাহাড়ি যুবক মন দিয়ে কাজ করছে । আসবাবপত্র প্রায় নেই বললেই চলে , তবে অনেকগুলো নীলকমল চেয়ারের ছড়াছড়ি । আমরা আসার পর শ্রীকান্ত বলে একটা বাঙালি ছেলে আমাদের চেয়ার দিয়ে গেল বসবার জন্য । তপেন গুহর প্রশ্নের উত্তরে ইন্দ্রদা বলল …

“ দার্জিলিং ঘুরতে আসাটা এবারে আমার প্রথম নয় তপেনবাবু , তবে আমার এই ভাইটির সঙ্গে প্রথমবার । ”

গণেশ ঘোষ ইন্দ্রদার উদ্দেশ্যে বলল … “ আপনিই তো সেবারে দার্জিলিঙে একটা খুনের কেসের সুরাহা করলেন । তখন থেকেই আপনাকে চিনি । তা এবারে দার্জিলিং কি ঘুরতে এসেছেন , নাকি গোপনে কিছু গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছেন ? ”

“ স্রেফ হাওয়া বদল । তবে এখানে থাকলে কিছু মাথা খেলানোর মত সামগ্রীও জুটে যেতে পারে । আমার এই অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌম্য মনে করে , আমি নাকি যেখানে যাই সেখানেই রহস্যের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় । ”

তপেন বাবু বললেন … “ তা এখানে মানে কি আপনি এই ক্লাবের কথা মিন করতে চাইছেন ? ” … বলেই উনি হাসলেন ।

“ হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে । ” … ঘরের সবাই এখন নিস্তব্ধ , কম্পিউটারের কাছে বসা ছেলেগুলো টাইপ করা বন্ধ করে দিয়েছে । ইন্দ্রদার গলার স্বর হালকা কিন্তু দৃঢ় ।

গণেশ বাবু একটু পরিবেশটাকে সামাল দেবার জন্য কথা ঘোরালেন … “ আপনাদের জন্য চা কফি টফি কিছু বলি ? ”

“ নো থ্যাঙ্কস । আর একদিন এসে দার্জিলিং টি খেয়ে যাবো , বাট নো কফি । সকালের কফিটা বেশ কড়া ছিল । আমরা একটু অসময়ে এসেই হয়তো আপনাদের বিব্রত করছি । তবুও একটা কথা আপনাদের না জানালেই নয় গণেশ বাবু এবং তপেন বাবু … আপনাদের ক্লাবে চোরাকারবার হয় ? ”

“ হোয়াট ? চো রা কা র বা র । ” … গণেশ ঘোষ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে যাচ্ছিল । কথাটা শোনামাত্রই চমকে উঠল ।

ইন্দ্রদা বলল … “ কাল একটা খ্যাপাটে গোছের লোক একথা বলছিল । ”

গণেশ ঘোষ আবার চমকে উঠে তপেন গুহর দিকে আড়চোখে তাকালো ।

“ পাগলাটার মাথায় কি টুপি ছিল ? ” … গনেশবাবু জানতে চাইলেন ।

“ হ্যাঁ । ” … ইন্দ্রদা উত্তর দিল ।

“ তার মানে সেই একই পাগলা । ”

“ মানে ? ”

“ হ্যাঁ , কদিন থেকেই লক্ষ্য করছি ক্লাবের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে , ক্লাবের কাছে এসে ঘুরঘুর করছে । এতদিন ব্যাপারটা খতিয়ে না দেখলেও আজ আপনার কথা শুনে বেশ ভাবতে হচ্ছে তো । ”

ইন্দ্রদা আর কথা বাড়াল না । পাগলটা যে ক্লাবে ঢুকেছিল সেকথাও বলল না । টেবিলের উপর থেকে একটা প্রিন্ট করা কাগজ তুলে নিল … টুর্নামেন্টের সমস্ত ম্যাচের লিস্ট । আমিও ঝুঁকে পড়ে কাগজটার উপর দৃষ্টিপাত করলাম । সব ম্যাচই শিবতলা স্টেডিয়ামে । কিছু কিছু ম্যাচ আবার ডে নাইটের । তবে লক্ষণীয় বিষয় হল এটা যে , জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে যে যে দলের ম্যাচ হয়েছে , কোনোটাই ডে নাইট নয় । যদিও ব্যাপারটা অবাক হবার মত কিছুই নয় তবুও আশা করি ইন্দ্রদার সেটা নজরে পড়েছে । আমরা যে ঘরটাই বসেছি তার ঠিক পেছনের দিকে একটা দরজা রয়েছে , দরজাটা খোলা । ইন্দ্রদা ওইদিকে একবার তাকাতেই সুমিত বিশ্বাস বলে উঠল …

“ ঐ ঘরটাতে ক্রিকেটের সব সরঞ্জাম ব্যাট , বল , উইকেট ইত্যাদি রয়েছে । ”

ইন্দ্রদা বলল … “  আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকলে একবার ঐ ঘরটা দেখা যায় ? ”

ওনারা আপত্তি করলেন না । আমরা ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম । ঘরের ভেতরটা অন্ধকার । তপেন গুহ টর্চ মেরে আলো দেখাচ্ছেন । ঘরে কোনো জানালা নেই তাই আলো প্রবেশ করতে পারে না তাছাড়া বাইরে ততক্ষণ অন্ধকার হয়ে গেছে । আমি ঘরে ঢুকতেই দেখলাম ইঁদুর জাতীয় কিছু একটা পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল । আমি শিউরে উঠলাম ।

গনেশবাবু বললেন … “ কিছু নয় , এ ঘরে ছুঁচোর উৎপাত আছে । ”

ইন্দ্রদা সবার অলক্ষ্যেই ফিক করে হেসে উঠল । আমি মনে মনে খুব বিরক্ত হলাম । আবছা টর্চের আলোতেই তপেন গুহ ঘরটার আনাচকানাচ দেখাচ্ছিলেন । ঘরটা একটা গুদাম ঘরের মতই বলা যায় , ভিজে কাঠের সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছিল মাঝে মধ্যে । একজায়গায় দেখলাম পনের ষোলোখানা ব্যাট সাজানো রয়েছে , ভিন্ন ভিন্ন সাইজের , কোনোটা ভারী কোনোটা হালকা । ইন্দ্রদা সব নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো , তারপর বলল …

“  এখান থেকেই প্লেয়াররা ব্যাট সংগ্রহ করে ? ”

গনেশবাবু বললেন … “ হ্যাঁ । তবে কেউ চাইলে পারসোন্যাল ব্যাটও বাইরে থেকে আনতে পারে । ”

ঘরের মধ্যে ছোট ছোট বস্তা রয়েছে দেখলাম , ভেতরে অনেক বল , এক একটা বস্তাতে তাও প্রায় পঞ্চাশ ষাটটার মত বল । টর্চের আলো ফেলতেই বলগুলো দেখলাম কর্কের তৈরি । ইন্দ্রদা নেড়েচেড়ে কিছুক্ষণ দেখল তারপর কি জানি ভেবে মুচকি হাসল ।

ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল … “ সব বল খেলা হয় ? ”

তপেনবাবু উত্তর দিলেন … “ সব হয় না । তবে হারিয়ে টারিয়ে গেলে বল তো লাগে , তার জন্যই … ”

“ বল মাঠে খেলা চলাকালীন কি দিয়ে যাওয়া হয় ? নাকি আম্পায়াররা বল নির্বাচন করে বেছে দেন ? ”

“ বল মাঠে আমরাই নির্বাচন করি । ডিপেণ্ড করে কত ওভার খেলার পর বল হারিয়েছে বা নষ্ট হয়েছে । অনেক কিছু বিচার বিবেচনা করে আমাদের বল সিলেক্ট করতে হয় । ”

এরপর ঘরের উইকেট বেল সব ইন্দ্রদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল যেন কোনো অজানা রহস্যের ক্লু খোঁজার প্রচেষ্টায় রয়েছে । মাঝে মাঝে ইন্দ্রদার আচরণে এবং সুমিত বিশ্বাসের বোকা বোকা কথাগুলো ভেবে বেশ বিরক্তি আসছিল । ম্যাচ হারার কারন খুঁজতেই ইন্দ্রদা এই অন্ধকার দমবন্ধকরা ঘরে তদন্ত চালাচ্ছিল নাকি চোরাকারবারের সন্ধান করছিল সেটাই মাথাতে আসছিল না । ইন্দ্রদাকে এরকম বোকা বোকা রহস্যের পেছনে ধাওয়া করতে এই প্রথম দেখলাম ।

তপেন গুহ বললেন … “ ভাবছি এবারে ফাইন্যাল ম্যাচটা পুরোটাই ভিডিও রেকর্ডিং করাবো । পরের বার থেকে থার্ড আম্পায়ার ডিসিশন মেকিং এরও ব্যবস্থা রাখার কথাও ভাবা হচ্ছে । ”

ইন্দ্রদা এবার বাম হাতে একটা থাই প্যাড ও ডান হাতে একটা গ্লাভস তুলে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলল … “ তাতে আমার সুবিধেটাই বেশি তপেন বাবু । ”

“ মানে ? ”

ইন্দ্রদা মুখে হাসি এনে বলল … “ কারন ফাইন্যালের দিন স্টেডিয়ামে উপস্থিত নাও থাকতে পারি , জরুরী দরকার আছে । তাই পরে ম্যাচটা দেখতে পাবো । একটা ফাইন্যাল ম্যাচের সি ডি কপি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন তো ? ”

( ৫ )

        “ তা পারবো না কেন ? ”

“ কিছু অ্যাডভানস লাগবে কি ? ”

“ কি যে বলেন আপনি স্যার , আপনি কি দার্জিলিঙে প্রথম নাকি ? আগেরবারও তো মিস পামেলার খুনের ব্যাপারে আমার দোকানে এসেছিলেন সাহায্যের জন্য । আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সারভিস স্যার । ”

“ এই টাকাটা রাখো । যেদিন প্রয়োজন হবে সেদিন এসে নিয়ে যাবো । ”

“ আরে স্যার আমার কার্ডটা রাখুন , একটা ফোন করবেন , দেখবেন বান্দা সি ডি প্লেয়ার নিয়ে হোটেল মঞ্জুসায় হাজির । ”

“ ও বাবা ! হোটেল মঞ্জুসায় উঠেছি সে খবরও রেখেছ দেখছি । এখনও স্যাটেলাইটটা বেশ পাওয়ারফুল আছে দেখছি । ”

“ তা আছে স্যার । এইবারে কি তাহলে আবার কোনো রহস্যের সন্ধানে ? নাহলে দার্জিলিং এসে হোটেলে বসে সিনেমা দেখার লোক তো আপনি নয় স্যার … ”

“ এবারেরটা অন্যরকম । একটু ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছি । ”

শিবতলা স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পথে সুমিত বিশ্বাস বাড়ি চলে যাবার পর ইন্দ্রদা আর আমি হোটেল মঞ্জুসায় ফিরিনি । তবে সেটা যে দার্জিলিং এর রাতের সৌন্দর্য দেখার কারনে নয় তা ইন্দ্রদার সঙ্গে একটা স্যামসাং এর সারভিস সেন্টারে ঢুকেই বুঝতে পারলাম । যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল , সে একটা চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছোকরা , নাম টাইটান , টেকনিসিয়ানের কাজ করে , বাঙালি নয় কিন্তু বাংলাটা ভালই সড়গড় আছে । আকাশী রঙের গেঞ্জিতে তার গায়ের ফর্সা রং ফুটে বেরোচ্ছিল । আমার সঙ্গে ইন্দ্রদাই আলাপ করে দিল । আগের বার মিস পামেলার খুনের রহস্যের সমাধানের সময় ইন্দ্রদাকে অনেকটা হেল্প করেছিল এই ছেলেটি । যাইহোক একটা সি ডি প্লেয়ার ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা সেই খোঁজেই এসেছিল ইন্দ্রদা । বোঝা গেল ইন্দ্রদার প্রশংসায় গদ্গদ টাইটান । কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে সূর্যটাকে তুলে আনতে বললেও হয়তো ইন্দ্রদার জন্য একবার ট্রাই করে দেখতো , এ তো সামান্য একটা সি ডি প্লেয়ার ।

হোটেলে ফিরে রাতের ডিনার সেরে ইন্দ্রদা একটা লবঙ্গ চেবাতে চেবাতে বলল …

“ বুঝলি সমু , রহস্যটা বেশ ঘোরালো হয়ে দাঁড়াচ্ছে । ”

“ কিন্তু তুমি ফাইন্যালের দিন থাকবে না কেন বললে ? ”

“ থাকবো , কিন্তু ভি আই পি গেস্ট হিসেবে নয় । ”

আমি অবাক হলাম । কিন্তু আমি জানি ইন্দ্রদা এখন মুখ খুলবে না । সময় হলেই সব জানতে পারবো । দার্জিলিঙে এসে যে এভাবে ক্রিকেট রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়বো কক্ষনো ভাবিনি ।

“ একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস সৌম্য , অবশ্য সেটা তোর লক্ষ্য করার কথাও নয় । ”

“ কি ? ” … আমার প্রশ্ন ।

“ আমি যখন ক্লাবঘরের বস্তায় বলগুলো লক্ষ্য করছিলাম তখন দেখলাম বলগুলোর গায়ে পেন্সিলে করে ইংরেজির এইচ অক্ষর লেখা । তবে সবগুলোতে নেই সেটাও লক্ষ্য করেছি । ”

“ তুমি কি এর মধ্যেও জোর করে কিছু রহস্যের গন্ধ পেতে চাইছো । আমার বাপু অতসব মাথায় ঢুকবে না । বলে কি লেখা থাকল না থাকল তার সাথে খেলার হার জিতের কি সম্পর্ক থাকতে পারে ? ”

“ সেটাই তো রহস্য । ”

“তবে একটা জিনিস খটকা লেগেছে । ম্যাচের লিস্টটা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছিলে ইন্দ্রদা ? জয়পুর স্পোর্টিং দলের সবকটা ম্যাচই কিন্তু হয়েছে দিনের বেলায় । ”

“ গুড অ্যান্ড ক্লিন অবজারভেশন সমু । কিন্তু সেখানেও সেই একই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে , সেটার সাথে হারা জেতার কি সম্পর্ক ? ”

“ সুমিতদার কথাগুলো কতটা বিশ্বাসযোগ্য বলে তোমার মনে হয় ? ”

“ জানি না । মে বি ফ্রম লিটল বিট অফ ফ্রাসট্রেশন । ”

ইন্দ্রদা মুখে কথাটা বললেও , ও যে শুধু সুমিত বিশ্বাসের মন রাখতে শিবতলা স্টেডিয়ামে তদন্ত করতে যায় নি সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি । দিনে একটানা এতটা ঘুমিয়েও আজ সন্ধ্যে থেকেই হাই তুলতে শুরু করে দিয়েছি । অবশ্য ইন্দ্রদাও যে বেশ খানিকটা টায়ার্ড তা ওর হাবভাব দেখে ভালই টের পাচ্ছিলাম ।

“ আজ অনেক ঘুরেছি ইন্দ্রদা , তাই শরীরটাও আর টানছে না । ”

ইন্দ্রদা মুখের লবঙ্গটা জিভের তলায় রেখে বোতল থেকে এক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলল … “ একটুখানি বারবিটন খেয়েই এত ঘুম এলে চলে সৌম্য ? ”

“ বারবিটন ? ” … আমি অবাক হয়ে ইন্দ্রদার দিকে চেয়ে রইলাম ।

“ হ্যাঁ , একধরনের সাদা গুঁড়ো জাতীয় পদার্থ , জলে দ্রাব্য , ঘুমের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় । আজ সকালে খেলার স্টেডিয়ামে দেওয়া ব্ল্যাক কফিতে মেশানো ছিল । আমিও অবশ্য খেয়েছি , কিন্তু সহ্য করে নিয়েছি । ”

“ কিন্তু কে মেশালো ? আর তুমি বুঝলেই বা কি করে ? ”

“ কালারলেশ বারবিটনের স্বাদ হালকা তেতো হলেও সেটা ব্ল্যাক কফির স্বাদের সাথে মিশে গেছে । আর যে মিশিয়েছে সেই হল ক্রিকেট রহস্যের নায়ক । এ ধরনের পদার্থ নিয়ে আমি আগে ক্রিমিনোলজিতে পড়াশুনো করেছি । হালকা সন্দেহ মনে জাগতেই কফির স্যাম্পেল টেস্ট করার জন্য আমার কফিতে ভেজা রুমালটা নিয়ে ফরেনসিক ল্যাবে গিয়েছিলাম আমি । ”

“ কি সাংঘাতিক ! ” … মুখ দিয়ে আমার কথা বেরোচ্ছিল না ।

( ৬ )

 

“ সাংঘাতিক , মিস্টিরিয়াস , অবিশ্বাস্য যাই বিশেষণ বলিস না কেন সুমিত , আমি কিন্তু এখনও পর্যন্ত জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিটি ম্যাচ জেতার মধ্যে কোনো রহস্য খুঁজে পায়নি । তবে আর কিছুদিন টাইম দে , আশা করি তোকে নিরাশ হতে হবে না । কারন ইন্দ্র – সৌম্য জুটি নিরাশ হয়ে দার্জিলিং ছাড়বে এমনটা আগে কোনো কেসে হয়নি । ”

সকালে একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙল , সাতটার সময় । ফাইন্যাল দেখতে যাবো তবে ভি আই পি গেস্ট হিসেবে থাকবো না , এটুকু মাত্র জানি , আর সবই জানে ইন্দ্রদা । ব্রেকফাস্টটা হোটেলেই সারলাম । তারপর রওনা দিলাম শিবতলা স্টেডিয়ামের দিকে । রাস্তায় সুমিত বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হল । বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবের হারটা এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সুমিতদা ।

“ কিরে ইন্দ্র , তোর তো আজ ফাইন্যাল দেখতে আসার কথা নয় । ”

“ হঠাৎ মত পরিবর্তন করলাম । চল একসঙ্গেই যাওয়া যাক । ”

মেঘবালিকার দল লম্বা চুলের গুচ্ছ খুলে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে । কখন যে বেরিয়ে শিবতলা স্টেডিয়ামটাকে ঝুপুস জলে স্নান করিয়ে দেবে ভরসা করা যায় না । তবে ওয়েদার রিপোর্ট বলছে আজ ম্যাচ চলাকালীন বৃষ্টি হবার কথা নয় । গোটা স্টেডিয়ামটা আজ লোকে লোকারণ্য । ভি আই পি গেস্টের সিটগুলোর  দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম , কালকে যারা ছিল তারা সবাই রয়েছে । আমরা ক্লাবঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম , এখানে ভিড়টা বেশ কম । সুমিত বিশ্বাসকে অবশ্য ইন্দ্রদা  ভি আই পি সিটে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল । ইন্দ্রদার কথায় পরে বুঝতে পারলাম , ও এমন কিছু এখানে লক্ষ্য করতে চায় যেখানে ওর বন্ধুর থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয় । আমি বেশ অবাক হলাম । যেখানটাতে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে কোনো চেয়ার নেই , তবে গায়ে সোনালী রোদের স্পর্শ পেয়ে বেশ আরামবোধ করছিলাম । মেঘবালিকার দল তখন সূর্যের চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে ।

যথারীতি খেলা শুরু হল । জয়পুরের বিপক্ষ টিম ব্যাট করছে । কিন্তু পনেরো ওভার পর ওদের অবস্থা গতকালের বলাকা ক্লাবের মতই হল । দর্শকরাও অনেকে তখন পালিয়ে যাচ্ছে । ইন্দ্রদার মনের অবস্থা যে কি বুঝতে পারছি না । মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করছিলাম ক্লাবটার দিকে চেয়ে কি যেন দেখছে । স্কোর বোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে পেছনে তাকাতেই ইন্দ্রদাকে আর দেখতে পেলাম না । ছুটে গেলাম ক্লাবঘরের দিকে ।

কি মনে হল কি জানি , দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে ভেতরে ঢুকলাম । আমরা যে গুদামঘরটায় কাল ঢুকেছিলাম সেই দরজায় আড়ি পেতে কিছু একটা দেখছে ইন্দ্রদা । আমি সন্তর্পণে পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই ইন্দ্রদা আমাকে গায়ে হাত দিয়ে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত দিল । আমিও এবার উঁকি মারলাম । দেখলাম সেই পাগলটা ঘরের ভেতরে কিছু একটা খুঁজছে । একবার ব্যাটগুলো তুলে জোরে জোরে নাড়া দিল । উইকেটগুলো একবার হাতে তুলেই ফেলে দিল । আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছিল না । এবার দেখলাম অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটাতে পাগলাটা একটা ধারালো ছোরা বের করেছে । আলখাল্লার মত জামার পকেটটা থেকে একটা টর্চ লাইট বের করতে দেখলাম । পাগলটা মনে হল এবার বলের বস্তাগুলোর দিকে এগোচ্ছে । টর্চের সামান্য আলোতেই লক্ষ্য করলাম আজ ওর মুখে পাগলামির কোনো চিহ্ন নেই , নিস্পলক চোখে বস্তাগুলোর দিকে এগিয়ে চলেছে ।

এবার ও বস্তার দড়িটা খুলে কতকগুলো বল নেড়ে চেড়ে মাটিতে ড্রফ মেরে দেখল । তারপর অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল , একটা বলকে ছোরা দিয়ে মাঝামাঝি কেটে দু ফালা করে দিল । বুকপকেট থেকে একটা ছেঁড়া ময়লা ছোট ডায়রির মত কি একটা বের করল । লক্ষ্য করলাম ওর কাছে পেনও রয়েছে । পেনে করে ডায়রিতে কিছু একটা লিখল । ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখে কিছু একটা আলোর আভাস প্রতিফলিত হচ্ছে । মুখে বিড়বিড় করে বলছে …

“ পি এস … পি এস … পি এস । ”

এবার মুখের ওপর টর্চের আলো পড়তেই চমকে উঠলাম । পাগলটা চিৎকার করে বলছে …

“ কে ? কে ওখানে ? ”

ইন্দ্রদা আমাকে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে সোজা ছুটে ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে এল । আমরা দর্শকদের মাঝে মিশে গেলাম । ইন্দ্রদা বাইরে এসে গুম হয়ে গেছে । স্কোরবোর্ডে দেখলাম খেলার অবস্থা শোচনীয় । ফাইন্যাল কাপ অবধারিত জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের হাতে ।

ইন্দ্রদা বলল … “ চল সৌম্য , হোটেলে ফেরা যাক , আর খেলা দেখে কাজ নেই । ”

“ তোমার তদন্ত কতদুর এগোলো ? ”

ইন্দ্রদা হাসল । কিন্তু হাসিটা যেন পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল । ধরা গলায় বলল …

“ সুমিতের কথাটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে , এই খেলার পেছনে রয়েছে এক গভীর চক্রান্ত । ”

“ সুমিতদা যে সত্যি বলছে , মনগড়া কথা বলছে না , সেটা এতটা জোর দিয়ে তুমি ভাবছো কি করে ইন্দ্রদা ? ”

( ৭ )

        “ সত্যি মিথ্যে জানি না ইন্দ্রজিৎ বাবু , তবে বেটিং নিয়ে যদি কিছু বলতে বলেন তাহলে হলফ করে বলতে পারি বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবে এমন কোনো প্লেয়ার নেই , যে এই সাহসটা দেখাতে পারে । অনেক ইয়ং প্লেয়ার বসে আছে টিমে জায়গা পাবার আশায় । বেটিং এ কেউ ধরা পড়লে সে আর কোনদিনও দলে জায়গা পাবে না । ” … বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ সুবিমল বাবু জানালেন ।

এটা দুদিন পর বিকেলের ঘটনা । এই দুদিন আমরা ক্রিকেট রহস্য মাথা থেকে মুছে দিয়েছিলাম । প্রাণ ভরে শুধু দার্জিলিংকে উপভোগ করেছি । কখনও বা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে , কখনও আবার হোটেল মঞ্জুসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘ এসে আলতো স্পর্শে তাদের ভালোবাসা জানিয়ে গেছে । মোটমাট এই দুদিন আমরা যতটা সাইটসিন করা সম্ভব করে নিয়েছি । সুবিমল বাবুর কোয়ার্টার আমাদের হোটেলটা ছাড়িয়ে আর দু তিনটে বাড়ির পরে । তাই বিকেলে ইন্দ্রদার সাথে ওনার বাড়ি এসে পড়েছি । ওনার শরীরখানা রোগা হলেও যেন একেবারে পাথরে কোঁদা , যেমন মজবুত তেমন শক্ত । তবে বুকদুটো তক্তার মত সমতল । ঢলঢলে একটা সাদা গাউন পড়ে ছিলেন , দেখে মনে হচ্ছিল হাড়ের কাঠামোর উপর এগরোলের কাগজের মত সাদা গাউনটা চেপ্টে আছে ।

“ শিবতলা স্টেডিয়ামে চোরাকারবারের ব্যাপারে কিছু জানেন ? ” … ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল ।

“ হোয়াট রাবিশ ! এধরনের কোনো ইনফরমেশন আমার কাছে নেই । ”

“ আপনার টিমের হারার কোনো স্পেশাল রিজন ? ”

“ কে বলেছে আমার টিম সব ম্যাচ হেরেছে ? সেমি পর্যন্ত কোয়ালিফাই করাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ । তবে জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের কাছে প্রত্যেকটা ম্যাচ হারার কারন খুঁজে পাইনি । ”

“ বেটার লাক নেক্সট টাইম সুবিমলবাবু , আজ আমরা উঠি । ধন্যবাদ । ”

ওখান থেকে বেরিয়ে আমি আর ইন্দ্রদা ফুটপাথের একটা দোকান থেকে এক প্লেট মোমো কিনে ভাগাভাগি করে খেলাম । এরপর ইন্দ্রদা ওর বন্ধু সুমিতকে একটা ফোন করল । আধ ঘণ্টার মধ্যে সুমিতদা এসে পড়তেই আমরা শিবতলা স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিলাম । আকাশের মেঘগুলো তখন হুঙ্কার ছাড়ছে । ভয়ংকর কিছু একটা হবার আভাস দিচ্ছে তারা । চারদিকটা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটগুলো জ্বালা ছিল । ক্লাবের কাছাকাছি এসে দরজায় টোকা মারলাম । ভেতরে রয়েছেন গনেশ ঘোষ , তপেন গুহ , জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেন সৌরভ নাগ আর ক্লাবের সেই ছেলে চারটে । ইন্দ্রদাকে দেখে সৌরভ নাগের মুখে হাসি ফুটল । ইন্দ্রদার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করতে করতে উনি বললেন …

“ আমাদের খেলা কেমন লাগল বলুন ? ”

ইন্দ্রদা প্রত্যুত্তরে জানাল … “ দারুন । তবে কিছুটা মিসটিরিয়াস । ”

কথাটা শুনে সৌরভ নাগের মুখটা এক ঝটকায় কালো হয়ে গেল । সুমিত বিশ্বাস সৌরভ নাগের সঙ্গে কোনো কথা বলছে না ।

তপেন গুহ এবার বললেন … “ আসুন আসুন , আপনাদের জন্যেই ওয়েট করছিলাম । আসুন একসঙ্গে ফাইন্যাল খেলাটা উপভোগ করি । ”

“ যদিও উপভোগ্য নয় । ” … ইন্দ্রদা এরকম ঠোটকাটা কথা বলছিল কেন বুঝতে পারছিলাম না । আমরা চেয়ারে বসলাম । বড় প্রোজেক্টরের পর্দায় ভেসে উঠল ফাইন্যাল খেলা । প্রথমেই দেখা গেল ভি আই পি গেস্টের সিটগুলো । তারপর দেখলাম জয়পুর ক্লাবের বিপক্ষ টিমের প্লেয়াররা চেয়ারে বসে কফি আর টিফিন খাচ্ছে । হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা কথা … ইন্দ্রদা বলেছিল কফিতে নাকি বারবিটন মেশানো আছে , যদিও সেটা প্লেয়ারদের কফিতে নাও থাকতে পারে । কিন্তু অবিশ্বাস করতে পারলাম না । এইজন্যই কি প্রত্যেক ম্যাচে জয়পুর জিতে যাচ্ছে ? তার মানে কি জয়পুর টিমের কেউ জেনেশুনেই কফিতে বারবিটন মিশিয়েছে ? কিন্তু তা কি করে সম্ভব ? সামান্য একটু বারবিটন খেয়ে কোনো প্লেয়ার একদম খেলতেই পারবে না , সেটা কি করে হয় ? নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল । প্রোজেক্টর স্ক্রিনের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল , খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছে । আম্পায়াররা চলে এসেছেন , ব্যাটসম্যানও নেমে গেছে ।

খেলা শুরু হবার প্রথম ওভারেই শোনা গেল জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের উল্লাস । প্রথম উইকেট হাতে এসে গেছে । সৌরভ নাগের দিকে একবার চোখ ফেরালাম । খেলার সময় যেমন উল্লসিত হচ্ছিলেন তেমনই তার মনে এখনও উল্লাস রয়েছে । গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছিল , জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন সৌরভ নাগ । ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার উপায় নেই ।

কয়েক ওভার শেষ হতেই আমার ভাল লাগছিল না বলে জানলার পাশে এসে দাঁড়ালাম । বাইরে সন্ধ্যে হয়ে যেতেই শীত ভাবটা একটু একটু করে বাড়ছিল । মাথায় একটা স্পোর্টস ক্যাপ ছিল । ভাবলাম মাফলারটা আনলে ভাল হত । ক্লাবের ঘড়িটা একটা বিচ্ছিরি ঢং ঢং শব্দ করে ছটা বাজিয়ে দিল । আমার সময় কাটছিল না , সুমিত বিশ্বাসকেও দেখলাম উশখুশ করছে । ইন্দ্রদা একমনে খেলা দেখে চলেছে । তবে সৌরভ নাগ লোকটা বেশ মজার । খেলার মাঝে মাঝেই উইকেট পতনের সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছিলেন । ইন্দ্রদা কিন্তু গম্ভীর , গালে হাত দিয়ে বসে আছে । বুঝতে পারছিলাম সুমিত বিশ্বাসও বেশ অস্বস্তি ফিল করছে । ইন্দ্রদাকে বলে আমি আর সুমিতদা একটু বাইরে বেরোলাম ।

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার । তবে দার্জিলিং শহরের আলোগুলো সেই অন্ধকারকে মুছে দিয়েছে । শিবতলা স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইটগুলো এখন না জ্বললেও স্টেডিয়ামের প্রত্যেকটি ব্লকে ব্লকে টিমটিম করে এল ই ডি লাইট দিপদিপ করছিল ।

সুমিতদা বেশ বিরক্তির সুরেই বলল … “ ডিসগাসটিং … ঐ সৌরভ নাগ লোকটার মধ্যে এতটুকু ক্যাপ্টেনসুলভ আচরণ নেই , শুধু পাগলার মত লাফাতেই জানে । ”

“ তা যা বলেছো সুমিতদা । ”

“ আচ্ছা তোমার কি মনে হয় সৌম্য , এই খেলার পেছনে কোনো রহস্যই নেই ? তোমার ইন্দ্রদার তো কোনো সাড়াশব্দ দেখছি না । ”

“ ইন্দ্রদা কি ভাবছে জানি না , তবে আপনাকে একটা কথা বলা দরকার , ম্যাচ শুরু হবার আগে যে কমপ্লিমেনটারি ব্রেকফাস্ট বা এনারজি ড্রিঙ্কস দেওয়া হয় প্লেয়ারদের , সেই কফির মধ্যে বা ড্রিঙ্কসের মধ্যে বারবিটন নামক এক ওষুধ মেশানো থাকে । ”

কথাটা শোনামাত্রই ইন্দ্রদার বন্ধু চমকে উঠল । পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল …

“ তুমি কি করে জানলে ? ”

“ ইন্দ্রদা বলেছে । ”

“ ওহ মাই গড ! সেই জন্যই খেলার সময় মাঠে নেমে শরীরটা ঝিমঝিম লাগে । মনে হয় যেন চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে । আমি নিজে ব্যাটিং করার সময় ফিল করেছি । আর মাঝে মাঝে চোখের সামনে বিদ্যুতের মত রোদ খেলে যায় বলে মনে হয় । ”

“ এফেক্ট অফ বারবিটন সুমিতদা । ”

এরপর আর ওসব নিয়ে কোনো কথা হয়নি । মার্কেটে কিছুক্ষণ ঘোরার পর যখন ক্লাবে ফিরে এলাম তখন ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে আটটা । ক্লাবের দরজার কাছাকাছি আসতেই চমকে যেতে হল , সেই পাগলাটা নিপুণ কৌশলে ক্লাবের দরজায় উঁকি মারছে । আজ ওর মাথায় টুপি নেই । আমরা চুপি চুপি পাগলটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম । সুমিত বিশ্বাস ওর কাঁধে হাত দিতেই পাগলটা চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠল …

“ না ছেড়ে দাও , আমি কিছু করিনি , আমি কিছু করিনি । ”

ততক্ষনে চেঁচামেচিতে ক্লাবের ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে । ইন্দ্রদাই এসে পাগলটার হাত ধরে টেনে তুলে ওকে গণধোলাইয়ের থেকে বাঁচাল ।

“ হাই , মিস্টার চোরাকারবার । ধন্যবাদ তোমার সেদিনের ইনফরমেশনের জন্য । তবে আমি আজ এখানে উপস্থিত না থাকলে তোমার গণধোলাই কেউ আটকাতে পারতো না । পরের বার এরকম কাজ করার আগে ভেবেচিন্তে করবে । ”

ইন্দ্রদার নির্দেশে পাগলটাকে ছেড়ে দেওয়া হল । ক্লাবে আর ঢোকা হল না । ইন্দ্রদা বলল …

“ কাল সকালে আপনারা সবাই থাকছেন তো ? সুমিত তুইও চলে আসিস ? একটা নাটকের যবনিকাপাত হতে চলেছে । ”

“ হ্যাঁ আমরা সবাই থাকবো । পরশু দিনে ফাইন্যাল কাপ দেওয়া হবে তাই একটা মিটিং ও আছে । ”

সৌরভ নাগের দিকে তাকালাম । মুখে দেখলাম গর্বের হাসি । কিন্তু হাসিটা কেমন যেন নৃশংস মনে হল ।

ইন্দ্রদা বলল … “ একবার ফাইন্যালের সি ডি ক্যাসেটটা নিয়ে যেতে পারি কি ? ”

কেউ আপত্তি করলো না । হোটেলে ফিরে এলাম । টাইটান ইন্দ্রদার কথা মত সিডি প্লেয়ার সঠিক সময়ে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেছে ।  নটা পনেরো নাগাদ ইন্দ্রদা একবার বাইরে বেরোল । আধ ঘণ্টা কেটে গেল । আমি সি ডি ক্যাসেটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম । ওপরে একটা হলুদ কাগজ সাঁটা রয়েছে , লেখা ছিল ‘ ফাইন্যাল ব্যাটেল ’ । বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা , হোটেল রুমের ভেতরে থেকেও তা টের পাচ্ছিলাম । ইন্দ্রদা প্রায় এক ঘণ্টা পর কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ঢুকল ।

আমি জিজ্ঞেস করলাম … “ কোথায় গিয়েছিলে ? ”

“ এখন শুধু জেনে রাখ , পুলিশ স্টেশন । ”

“ এখন কি তাহলে আবার খেলা দেখা শুরু করবে ? ”

“ ঠিক তাই । ”

“ ডিনার করার পর ? ”

“ হুম । ”

“ কিছু কি সন্দেহজনক মনে হচ্ছে ? ”

“ হ্যাঁ । ” … এই ছোট উত্তরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই খাবার চলে এল । খাবার পর ঠিক এগারোটায় ইন্দ্রদা সিডি টা চালাল । একই খেলা বারবার দেখার কোনো মানে হয় না । আমি পাঁচ মিনিট দেখার পরই শুয়ে পড়লাম । ঘুম কিন্তু আসতে চাইছিল না । আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে কাল সকালেই ক্লাবে ইন্দ্রদা ক্রিকেট রহস্য ফাঁস করবে । কে হতে পারে এই রহস্যের নাটের গুরু ? কিই বা তার উদ্দেশ্য ? ঘুম আসার আগে পর্যন্ত বুঝতে পারছিলাম ইন্দ্রদা খেলা দেখে চলেছে । মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে … “ শুধুমাত্র বারবিটন খেয়ে যে এটা হতে পারে না সেটা বুঝতে এতটা দেরি হয়ে গেল … ”

( ৮ )

        “ কিছুই দেরি হয়নি সৌরভ বাবু , আসুন । আমিও এই পনেরো মিনিট হল এসেছি । ” … ইন্দ্রদা সৌরভ নাগের উদ্দেশ্যে বলল ।

পরের দিন সকাল নটার মধ্যে আমরা ক্লাবঘরে পৌঁছে গেলাম । তবে ভেতরে না ঢুকে আমরা বাইরে একটা দেবদারু গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিলাম সবাই । কালকের তুলনায় আজকে ঠাণ্ডা অনেকটা কম ছিল , কুয়াশাও ছিল বেশ । আমাদের প্রত্যেকের হাতে মাটির ভাঁড়ে ছিল গরম গরম দার্জিলিং চা । ইন্দ্রদা সি ডি ক্যাসেটটা ফেরত দিয়ে বলতে শুরু করল …

“ সুমিতকে দেখছি না তো ? ”

গণেশ ঘোষ বললেন … “ এখনই এসে পড়বেন । ”

তপেন গুহ জিজ্ঞেস করলেন … “ খেলা কেমন দেখলেন ইন্দ্রজিৎ বাবু ? আমার তো বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে । ”

“ খেলাটা দেখলাম বটে কিন্তু মনের মত হল না । মনে হচ্ছিল মাঝে একটু আকাশ মেঘলা থাকলে ভাল হত বা বৃষ্টি হলে খেলাটা আরো জমে যেত । তাই নয় কি সৌরভ বাবু ? ”

সৌরভ নাগের ডান পা টা সামান্য কেঁপে উঠল ।

গনেশ ঘোষ বললেন … “ তা আপনি কি বলতে চাইছেন খোলসা করে একটু বলুন তো ? ”

“ আমি কি বলতে চাইছি সেটা সৌরভ বাবু ভালই বুঝতে পারছেন । ”

দেবদারু গাছটার পেছনে একটা চেনা গলা শুনতে পেলাম । সুমিত বিশ্বাস চলে এসেছে । একটি অবাঙালি ছেলে সবাইকে মাটির ভাঁড়ে আবার একবার করে চা দিয়ে গেল ।

ইন্দ্রদা চায়ে চুমুক দিয়ে আবার শুরু করল … “ সৌরভ নাগ আপনি ভেবেছিলেন সবার চোখে ধুলো দিয়ে ফাইন্যাল কাপ নেবেন ? কিন্তু সে আশায় যে আমি জল ঢালতে বাধ্য হচ্ছি সৌরভ বাবু । ”

সৌরভ নাগের হাতে চায়ের ভাঁড়টা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে ।

“ আপনি কি বলতে চাইছেন ইন্দ্রজিৎবাবু ? ”

“ আপনি এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন ? আমি জানি আপনার একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয় । ”

চারপাশে একটি পাহাড়ি ময়নার ডাক ছাড়া একদম পিন পড়া নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে । তার ফলে ইন্দ্রদার গলার স্বর পাথরের মত কঠিন । সুমিত বিশ্বাসও ফ্যাকাসে মেরে গেছে ।

“ সৌরভ বাবু আপনি ভেবেছিলেন প্লেয়ারদের কফিতে আর এনার্জি ড্রিঙ্কসে বারবিটন মিশিয়ে দেবেন , আর কেউ সেটা জানতেও পারবে না ? ”

“ আ … আমি কিন্তু … ”

“ আপনি একটা ভুল করেছেন কফিটা আমাকে খেতে দিয়ে । তা না হলে হয়তো এই রহস্যের সমাধান এতটা তাড়াতাড়ি হত না । বারবিটন এমনই একটা ড্রাগস যেটা খেলে যেকোনো শক্তিশালী মানুষ নিমেষের মধ্যে অলস ও অবসন্ন হয়ে পড়ে উইদআউট এনি আদার সাইড এফেক্ট । ”

“ আর আপনি বলতে চাইছেন তার জন্যই প্রত্যেকটা ম্যাচ জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব জিতে যাচ্ছে ? আপনি পারেনও মশাই । ” … হা হা হা করে হেসে উঠলেন তপেনবাবু ও গনেশবাবু ।

সুমিত বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও রাগে ফুঁসছে । ইন্দ্রদার পরের কথাগুলো সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল …

“ ঠিকই বলেছেন আপনারা , একটুখানি বারবিটন খেয়ে কোনো প্লেয়ারকে অবসন্ন করা যায় , কিন্তু একেবারে না খেলার যোগ্য করে দেওয়া যায় না । তাই আমিও চিন্তায় পড়ে যাই কিভাবে জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব , মানে সৌরভ বাবুর টিম অত সহজে প্রত্যেকটা ম্যাচ জিতে যাচ্ছে । আর সেটার কারনও বুঝতে পারি ভিডিও ক্যাসেটটা দেখে । আমি প্রথম দিনই ম্যাচের দুজন আম্পায়ার মানে আপনাদের হাতে বিশেষ বড় বড় ঘড়ি লক্ষ্য করেছিলাম । সূর্যের আলো পড়ে ঘড়ির ওপরের মিরর প্লেটগুলো চকচক করছিল । তখন কিছু বুঝতে পারিনি । পরে যখন ভিডিও দেখলাম তখন আমি ম্যাচের দুজন আম্পায়ারকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করলাম । জয়পুর টিমের বোলার বল করার সাথে সাথেই আম্পায়ার ঘড়ির ওপর সূর্যের আলোর ছটা প্রতিফলন করে ব্যাটসম্যানের চোখে ফেলছেন । আর বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা তখন বারবিটন খেয়ে নেশাগ্রস্ত । নেশাগ্রস্ত চোখকে ফাঁকি দেওয়া আপনাদের পক্ষে কঠিন ব্যাপার ছিল না গণেশ বাবু ও তপেন বাবু । ”

তাচ্ছিল্যের সুরে তপেন বাবু বলে উঠলেন … “ বলে যান , বলে যান ইন্দ্রজিৎ বাবু । আমরাও খুব এনজয় করছি গল্পটা । ”

হঠাৎ সুমিত বিশ্বাস উত্তেজিত হয়ে গণেশ ঘোষ , তপেন গুহ , সৌরভ নাগকে কঠোরভাবে গালাগালি দিতে শুরু করল । ইন্দ্রদাই সুমিতদাকে সামলালো । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসার পর ইন্দ্রদা আবার কথা বলা শুরু করল …

“ আমার প্রথম সন্দেহ তখন জাগে যখন আমি ম্যাচের লিস্টটা দেখি । লক্ষ্য করেছিলাম জয়পুর টিমের সঙ্গে প্রত্যেকটা ম্যাচ দিনের বেলায় হয়েছে কারন সূর্যকে তো কাজে লাগাতে হবে । সূর্যদেবই আপনাদের মত ভীরু কাপুরুষদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন কারন আকাশ মেঘলা থাকলে আম্পায়ারের হাতের ঘড়ি থেকে আলো প্রতিফলন করা সম্ভব হত না । ”

সৌরভ নাগের মুখ নিচু । ভাঙা গলায় উত্তর দিলেন … “আমার ভুল হয়ে গেছে । ফাইন্যাল কাপ জিতে হ্যাটট্রিক করার আশায় টাকা দিয়ে এনাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলাম । আমাকে ক্ষমা করে দিন । আমি কথা দিচ্ছি আবার নতুন করে টুরনামেণ্ট হবে । ”

“ সে তো আপনাকে প্রেস কনফারেন্স করে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে । কিন্তু সৌরভ বাবু আপনাকে ক্ষমা করা গেলেও গনেশবাবু ও তপেনবাবুকে ক্ষমা করা যাবে না । কারন আইনের চোখে এনারা আরো অপরাধী । ”

তপেন গুহ হা হা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন … “ আপনি কি আমাদের পুলিশে দেবেন নাকি মশাই ? ”

ইন্দ্রদার গলার স্বর আরো ধারালো হয়ে গেছে … “ দরকার হলে তাই করবো । ”

গণেশ ঘোষ আবার হেসে উঠলেন … “ কেন , আমরা কি খুন করেছি , না চুরি করেছি যে আমাদের পুলিশে দেবেন ? ”

কঠোর গলায় ইন্দ্রদার উত্তর এল … “ আপনারা খুনও করেননি , চুরিও করেননি , কিন্তু করেছেন চোরাই মালের ব্যবসা । ”

“ আপনার কাছে কি প্রমান আছে তার ? ”

“ শুধু আমার কাছেই নয় , পুলিশের কাছেও প্রমান আছে । আপনার গুদাম ঘরের মধ্যেই রয়েছে চোরাই মাল । খুব সম্ভবত সেগুলো কর্কের বলের মধ্যেই রয়েছে । ”

দুজনেই এবার চমকে উঠলেন । অস্ফুটে কথা বেরোল গণেশ ঘোষের মুখ থেকে …

“আপনি জানলেন কিভাবে ? ”

“ দৃষ্টিশক্তি । দৃষ্টিশক্তি থাকলে সবকিছুই বোঝা সম্ভব । আমি যেদিন গুদামঘরটা দেখতে ঢুকি সেদিনই লক্ষ্য করি বস্তার বলগুলো , কয়েকটার গায়ে এইচ লেখা । তবে সব বলগুলোতে ছিল না । তখন অতটা মাথায় আসেনি । কিন্তু পরে যখন একটা পাগলাকে আপনাদের ক্লাবঘরে ঢুকতে দেখলাম … ”

তপেন গুহ চেঁচিয়ে উঠলেন … “ কি ! পাগলাটা আমাদের ক্লাবঘরে ঢুকেছিল ? ঐ ব্যাটা আপনাকে সব বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলেছে । আর একটা পাগলের কথা বিশ্বাস করে আপনি কিনা … ”

ইন্দ্রদা কথাটা শেষ হতে না দিয়েই বলল … “ সাট আপ মিস্টার গুহ । যাই হোক যেটা বলছিলাম , পাগলটা ক্লাবঘরের ভেতরে একটা বলকে ছুরি দিয়ে কাটল । টর্চের আলোয় দেখলাম বল থেকে বেরিয়ে এল সাদা গুঁড়ো জাতীয় পদার্থ । আমি নিশ্চিত হলাম ওটা হেরোইন ছাড়া কিছু হতে পারে না । ”

এবার সুমিত বিশ্বাসের প্রশ্ন … “ কিন্তু পাগলটা ক্লাবঘরে কেন ঢুকতে গেল ? ”

“ চোরাই মালের ব্যবসা সত্যিই আছে কিনা দেখবার জন্য । যে বলগুলোর গায়ে এইচ লেখা ছিল সেগুলোতেই কেবলমাত্র হেরোইন ভর্তি ছিল । হেরোইন ভর্তি বলগুলোকে আপনারা এইচ অক্ষর দিয়ে সনাক্ত করতেন , তাই নয় কি ? তা কোথায় কোথায় আপনাদের শাখা প্রশাখা গজিয়ে উঠেছে এবার ঠাণ্ডা ঘরে গিয়েই জবাব দেবেন চলুন । ”

ইন্দ্রদা বারবারই আড়চোখে দেবদারু গাছটার পেছনের দিকে তাকাচ্ছিল । এবার বাঁ হাতটা তুলে ইশারা করে বলল … “ বিপ্লববাবু এবারে ভেতরে আসুন । হাতকড়া এনেছেন তো ? ”

আমাদের সামনে এবার যে আসলো তার চেহারা দেখে তো আমার চোখ কপালে উঠে গেল । এ যে সেই পাগলটা , সম্পূর্ণ পুলিশ অফিসারের ড্রেসে ।

ইন্দ্রদা বলল … “ পাগল নয় । ইনি দার্জিলিং পুলিশ স্টেশনের ওসি বিপ্লব সান্যাল । সত্যিই চোরাই মালের ব্যবসা আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য এনাকে পাগলার ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল । ”

বিপ্লববাবু গণেশ ঘোষ ও তপেন গুহর হাতে হাতকড়া পরাতে পরাতে বলল … “ বাঃ মানিকজোড়কে ভালই মানিয়েছে তো হাতে গয়না পড়ে । কিন্তু ইন্দ্রজিৎ বাবু আপনি বুঝলেন কি করে আমি পুলিশের লোক ? আমি তো প্রথম দিন আপনার সাথে দেখা করে আমার পরিচয় আত্মগোপন করেছিলাম আপনাকে ভড়কে দেবার জন্যই । ”

ইন্দ্রদা বলল … “ সেদিন আপনি ক্লাবঘরে যখন ছিলেন তখন আপনাকে একটা ছোট্ট ডায়রি ও পেন বের করতে দেখেছিলাম । তাতে লেখা ছিল দার্জিলিং পি এস । পি এস আসলে পুলিশ স্টেশন । এরপর আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে কি ? ”

মানিকজোড়কে জিপে তুলে দিয়ে শিবতলা স্টেডিয়াম পেছনে ফেলে আমরা হোটেল মঞ্জুসার দিকে পা বাড়ালাম । কুয়াশার চাদরে ঢাকা দার্জিলিং শহর তখন অনেকটা স্নিগ্ধ ও সতেজ ।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleপদাবলি – ৩
Next articleমাখা সন্দেশ
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments