ভক্তির লক্ষণ

(স্বামীজীর ভক্তিযোগ অবলম্বনে পুঁথি)

পাদবন্দনা

শুন শুন সুধীজন স্বামীজীর বাণী ।

শক্তি গুরু পরমহংস মাতা ঠাকুরাণি ।।

সর্বধর্ম জাগরণ জগত কল্যাণ ।

সমন্বয় সহিষ্ণুতা সেবা-পূজা জ্ঞান ।।

প্রচারিলে গুরু বাণী দেশে দেশে ঘুরি ।

পাদ্য অর্ঘ বাণী পুঁথি রূপে সবে নমি ।।

(১) ভক্তির অর্থ

হিয়া প্রেমে পূর্ণ ভক্তি আদি অন্ত মধ্যে ।

দিবা রাতি হিয়াকুল ঈশ্বর দর্শনে ।।

ক্ষণিকের তরে যদি দিব্য উন্মাদনা ।

আনে মুক্তি অন্তহীন ভক্তির মহিমা ।।

ভক্তি প্রেমরূপিনী কহে নারদমুনি ।

শুধু প্রেম, নাই দ্বেষ, সদা মনে সুখী ।।

প্রেমে নাই জগতের কামনার গন্ধ ।

যেথা কামনা বাসনা ভক্তি অন্তঃশুন্য ।।

জ্ঞান কর্ম যোগ সবে ঊর্দ্ধে ভক্তি শ্রেষ্ঠ ।

ভক্তি দিয়া ভক্তি কাম্য ভক্তি হতে জাত ।।

(২) ভক্তিশাস্ত্র সদা প্রিয়

যুগে যুগে ঋষি-মুনি ভক্তিশাস্ত্র প্রিয় ।

সাণ্ডিল্য-নারদ আদি কত ভক্তিসূত্র ।।

জ্ঞান-শাস্ত্র ব্যাসসূত্রে আছে তার ব্যাখ্যা ।

ভক্তি নয় হেও সেথা, না আছে ঢাকা ।।

জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগ অন্তর না দেখি ।

রাজযোগও একই, যদি লক্ষ্য মুক্তি ।।

 

(৩) ভক্তিযোগে গোঁড়ামি

ভক্তিযোগ ইষ্টলাভে সহজ উপায় ।

ভয় নিম্নাধিকারীর প্রথমাবস্থায় ।।

ধর্মে গোঁড়ামি নিম্ন অধিকারী মধ্যে ।

স্বধর্মে তীব্র নিষ্ঠা, ঘৃণাও পরধর্মে ।।

কুকুরের প্রভু ভক্তি একপেশে মাত্র ।

না ভাল-মন্দ বিচার গোঁড়া প্রভুভক্ত ।।

উদার প্রেমিক যদি স্বধর্ম-মানুষ ।

অন্যথা চণ্ডাল ক্রোধ ভুলে মানহুঁশ ।।

বিপদের সম্ভাবনা গৌণী ভক্তি স্তরে ।

পরা ভক্তি নাই শঙ্কা গোঁড়ামির ঊর্দ্ধে ।।

পরা ভক্তি নিয়ে যায় ঈশ্বর সান্নিধ্যে ।

নাই দ্বেষ না গোঁড়ামি সর্বস্বার্থ উর্দ্ধে ।।

 

(৪) যোগ জ্ঞান ভক্তি সম বিকাশ

চরিত্র বিকাশ সেথা শ্রেষ্ঠ আদর্শময় ।

যেথা পূর্ণ জ্ঞান ভক্তি যোগ সমন্বয় ।।

পক্ষী উড়ে পাখনাতে লেজ হাল কর্ণ ।

জ্ঞান ভক্তি দুই পক্ষ যোগ হাল কর্ম ।।

যদি নাই জ্ঞান ভক্তি যোগের সাধন ।

মন চাই ভক্তি মার্গে শুধু আরোহন ।।

পূজা-পার্বন দ্বারাও হয় উদ্দীপন ।

যেথা ঘনীভূত প্রেম ঈশ্বর দর্শন ।।

 

(৫) পূর্ণ প্রেম ও পূর্ণ জ্ঞান

জ্ঞানী করে ভক্তিযোগ মুক্তি হাতিয়ার ।

ভক্ত ভক্তি দ্বারা পূর্ণ হয়ে একাকার ।।

নিম্নস্তরে ভক্তি যদি হয় হাতিয়ার ।

উচ্চস্তরে একাকার থাকে না বিচার ।।

জ্ঞানী ভক্ত ভাবে করে আপন সাধন ।

পূর্ণ প্রেম-জ্ঞান এক সিদ্ধিতে দর্শন ।।

 

(৬) শংকরাচার্য্যের মতে ভক্তি

গুরুভক্তি রাজভক্তি যেথা বিদ্যমান ।

ধ্যান জ্ঞান সব তাই কয় ভক্তিমান ।।

যদি প্রেমিক স্ত্রী করে স্বামীর চিন্তন ।

যে চিন্তন নিরবিচ্ছিন্ন ব্যাকুল মনন ।।

ভক্তি কহে ভগবান শংকর আচার্য্য ।

আবৃত্তিরসকৃদ্রুপদেশাৎ

ধ্যানযোগ প্রয়োজন সূত্রেন কথিত ।।

 

(৭) রামানুচার্য্যের মতে ভক্তি

তৈলধারাবৎ যদি ইষ্টের চিন্তন ।

বন্ধন হয় ছিন্ন যা মুক্তির সাধন ।।

চিন্তনে ইষ্ট দর্শন দূর নিকট নাই ।

হৃদয় গ্রন্থি সন্দেহ কর্ম নাশ হয় ।।

গভীর ইষ্ট চিন্তনে সুদূর দর্শন ।

ঈশ্বরের পূজা ধ্যান চিন্তন মনন ।।

ঘনীভূত চিন্তনেতে প্রত্যক্ষ দর্শন ।

যার ফলে হয় মুক্তি শ্রুতি সমর্থন ।।

আত্মজ্ঞান বহুদূর শাস্ত্র বুদ্ধি দ্বারা ।

যার প্রতি হয় কৃপা তাকে দেন ধরা ।।

শ্রবন মনন আদি নয়কো যথেষ্ট ।

তীব্র ব্যাকুলতা হলে কৃপা করে ইষ্ট ।।

পূজাতে যদি বা থাকে প্রেম ব্যাকুলতা ।

তিনি নেন ভার দেন বুদ্ধি আর কৃপা ।।

নিরবিচ্ছিন্ন চিন্তন মননের ভক্তি ।

প্রত্যক্ষ দর্শন তাঁর কৃপাতে মুক্তি ।।

আথাতো ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা ইতি ব্রহ্মসূত্র ।

ভক্তি ব্যাখ্যা রামানুজ আচার্য্যের ভাষ্য ।।

 

(৮) পাতঞ্জলি যোগসূত্রে ভক্তি

পাতঞ্জলি যোগসূত্রে ঈশ্বরের পূজা ।

পুজা কামনা রহিত ভক্তি ভোজ-ব্যাখ্যা ।।

ব্যাস ভগবান মতে প্রনিধান ভক্তি ।

ইষ্ট দর্শন কৃপায় হয় ইচ্ছাপূর্ত্তি ।।

 

(৯) সাণ্ডিল্য মুনির মতে ভক্তি

ঈশ্বর ভক্তি সাণ্ডিল্যে পর-অনু-রক্তি ।

স্বপ্নেশ্বর ভাষ্যে অনু পরে রক্তি রতি ।।

ঈশ্বরে আসক্তি জেনে তাঁর মহিমা ।

স্ত্রী-পুত্রে অন্ধ আসক্তি ভক্তিরূপ সেথা ।।

অপূর্ব ব্যাখ্যা আছে শ্রী রামানুজ ভাষ্যে ।

তৃণ হতে ব্রহ্মা জন্ম-মৃত্যু কর্ম-পাশে ।।

অজ্ঞানে আবদ্ধ তারা কখন না পূজ্য ।

পরমেশ্বরের ধ্যান রতি মাত্র যোগ্য ।।

 

(১০) ভক্তশিরোমণি প্রহ্লাদের ভক্তি ব্যাখ্যা

ব্যাখ্যা ভক্তশিরোমণি স্রহ্লাদ অপূর্ব ।

ভক্তি প্রেমামৃত মূর্খ ভাবে ইন্দ্রিয়জ ।।

আস্বাদনে আমি রই তোমা ধ্যানে মগ্ন ।

হৃদয় যেন না হয় প্রেম ধনে রিক্ত ।।

 

(১১) উপসংহার

তীব্র ভক্তি আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনা ।

‘পূজা’ হয় যে পরম-পেরমস্বরূপা ।।

– ওঁ তৎ সৎ ওঁ –

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকরোনা শেষের কথা
Next articleছুটি (পর্ব ২)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments