তিন নম্বর গুটখা এটা। খাব কি খাব না, ওসব কিছু চিন্তা না করে ছেলেটা প্যাকেটটা ছিড়ে সটান মুখে পুরে দিল। গাল আর চোয়াল দেখলেই বোঝা যায় পাক্কা নেশা করা ছেলে। গালদুটো ঢুকে গেছে, অজত্নে আচরান চুল, গালে তিনদিনের না কাটা দাড়ি, রোগা টিং টিং এ চেহারা, হাতের কবজিগুলো সরু সরু, কাধ থেকে গলাটা কেমন যেন ঠেলে উপরের দিকে উঠে এসেছে। বাহাতে একটা সস্তার ঘড়ি, ফাটা জিন্স, তার সাথে মানানসই একটা নোংরা শ্যাওলা নক্সাকাটা টি – সার্ট। হাতের মোবাইলটা যদিও ছেলেটার সাথে মোটেও মানানসই নয়। দেখে তো বেশ দামিই মনে হল অপর্ণার। স্মার্টফোন। হাওড়া থেকে উঠেছে আর তখন থেকেই খুটখুট করে যাচ্ছে মোবাইলটা নিয়ে। আর গুটখা চিবিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো দেখেই বোঝা যায় নেশা করা অভ্যেস ছেলেটার। এক্কেবারে ঢুলুঢুলু। পুরো ধুকছে। সিটে ঠিক মত বসতেও পারছে না। ট্রেন এর দুলুনির সাথে সাথে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। মাঝে মাঝেই বাহাত দিয়ে চোখ দুটো ডলছে, আর পা দুটো অবিরাম নাড়িয়ে যাচ্ছে। চোখে মুখে কেমন যেন একটা বিরক্তি বিরক্তি ভাব। রাতটা আজ একটু বেশিই হয়ে গেছে অপর্ণার। না হলে ৯.২০ র বর্ধমান লোকালে কোনদিন আজ অবধি একা একা ফেরেনি। তাও আবার শনিবার রাতে। গোদের ওপর বিষ ফোড়ার মত আবার দুপুর থেকে তেড়ে বৃষ্টি । বাইরেটা বেশ ঠাণ্ডা, তার সাথে মানাসই অন্ধকারও বটে। দুপাশে ধানক্ষেতে অবশ্য কেই বা আর আলো জ্বেলে রাখতে যাবে এত রাতে। মাঝে মাঝে দু চারটে আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওগুলো নেহাতই বাল্ব এর আলো, রেললাইন এর পাশের খুটিতে সরকার বাহাদুর এর কৃপায় ঝোলানো। যদিও কামরার ভেতরে পর্যাপ্ত আলো আছে বটে, কিন্তু যাত্রী বলতে অপর্ণা, ওই ছেলেটা, আর একটা মাত্র লোক। তাও খানিকটা দূরে। এদিকে পিঠ করে বসে আছে। হাওড়া থেকে যখন উঠেছিল তখন এই কামরাটায় মোটামুটি ভিড় ছিল, কিন্তু ডানকুনি আসতেই ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল, আর কামারকুন্ডু ছাড়াতেই কামরাটা এক্কেবারে ফাকা হয়ে গেল। শুধু এই দুজন বাদে। সাধারনত এত ফাকা কোনদিন হয় না, কিন্তু আজ হিসেবটা একটু ওলট পালট হয়ে গেছে। এখন সবে চন্দনপুর। বর্ধমান এখনো দেড়ঘণ্টা মত। বুকটা অনেক্ষন থেকেই ধুকপুক করছিল, কিন্তু অপর্ণা এবার সত্যিই ভয় পেল। এই গতকালই টিভিতে দেখেছে বারাসাতে একটা মেয়েকে রেপ করা হয়েছে। খবরের কাগজ খুললেই রোজ এই সব কিছু না কিছু লেখা থাকেই। যদিও যা ঘটে তার অর্ধেক জানা যায়, বাকি অর্ধেক ঘটনা ঘটনাই থেকে যায়। ভয়ে অপর্ণার গা হাত পায়ে কাটা দিয়ে উঠল। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও, ও যে মোটেও স্বাভাবিক নেই সেটা ভেতর ভেতর বেশ ভাল মত টের পাচ্ছিল অপর্ণা। ছেলেটা একবার উঠে দরজায় গিয়ে গুটখার পিকটা ফেলল বাইরে। তারপর অপর্ণার কোনাকুনি উলটো দিকে এসে বসল। দৃষ্টি জানালার বাইরে থাকলেও অপর্ণা স্পষ্ট বুঝতে পারল ছেলেটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখল – হ্যা ওর দিকেই।
অপর্ণা দেখতে শুনতে মোটেও খারাপ নয়। ছিপছিপে গড়ন, টিকালো নাক, টানা চোখ। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও বেশ একটা নজরকাড়া ব্যাপার আছে। এক নজরে দেখে যে কেউই প্রেমে পড়ে যেতে পারে। আর সেটা অপর্ণা ভাল করে জানে বলেই কলেজে কোন ছেলেকে কাছে বিশেষ ঘেঁষতে দেয় না। দুচার জন যে ছেলে বন্ধুরা আছে, তারা হয় খুব ক্যালানে গোছের, না হয় পড়াকু। অপর্ণার মেয়ে বন্ধুই বেশি কলেজে। লেডি ব্রেবন এ ইংরেজি নিয়ে পড়ে ও। পড়াশুনায় নেহাত খারাপ না। স্বভাবে খুবই নম্র, হাজরার সামনে একটা পিজি তে থাকে। বাবা যা পাঠায় তা ছাড়াও দুচারটে টিউশনি করে নিজের হাত খরচের জন্য। তবে কলেজে সবাই ওকে যে কারনে বিশেষ ভাবে চেনে, সেটা হল ওর গান। গলাটা নেহাত খারাপ না। গত বছর সা রে গা মা তে অংশও নিয়েছিল। কিছু না হতে পারলেও ওর গানের গলা প্রশংসা পেয়েছিল।
এই মুহূর্তে দাড়িয়ে গলা দিয়ে যে একটুও স্বর বেরোবে না, এটা ও ভাল মত বুঝতে পারল।
কাল অভিষেক এর জন্মদিন। অভিষেক ওর ভাই। মাধ্যমিক দেবে। তাই জন্যই এত রাতে বাড়ি যাওয়া। তার ওপর কাল আবার রাখি। আর সোমবার থেকে অপর্ণার কলেজে দুদিনের ছুটি। বাড়ির সাথে দু দিন কাটাবে বলে আজই রওনা হয়েছিল অপর্ণা। ভাই একটা টিনটিন এর বই আব্দার করেছিল। দুটো দোকান ঘুরেও সেই বইটা না পেয়ে ও সোজা চলে গেছিল সাউথ সিটি মলের বিশাল বইয়ের দোকানটায়। কিন্তু বই দেখতে গিয়ে ঘড়িটা আর দ্যাখা হয়নি। মাকে ফোন করলে মা বলেছিল এত রাতে না এসে আগামিকাল আসতে। কিন্তু কটা বাঙালি ছেলেমেয়ে আর মার কথা শোনে? অর্ধেক রাস্তায় এসে অপর্ণার মনে হতে লাগল, মার কথাটা শুনলেই হত। অবশ্য এখন আর ফিরে যাওয়ার উপায়ও নেই। বৃষ্টি নামলো বলে।
পোড়াবাজারে থামল ট্রেনটা। মনে মনে হিসেব করে নিল ও। আরও প্রায় ঘণ্টা খানেক। বর্ধমানে নামতে নামতে প্রায় সাড়ে এগারটা। আর যদি মাঝপথে লেট করে তো হয়ে গেল। স্টেশন থেকে ওদের বাড়ি রিক্সায় প্রায় তিরিশ মিনিট কিন্তু বাবা বলেছে আজ স্কুটার নিয়ে আসবেন। অবশ্য এই বৃষ্টির রাতে বাবা আসবেনই বা কি করে! যদিও স্টেশনে একবার নামতে পারলে আর বিশেষ অসুবিধে হবে না। কিছু না কিছু ঠিকই ম্যানেজ হয়ে যাবে। কিন্তু তাও ঘণ্টা খানেক। ততক্ষণ ওই ছেলেটা …
বেলমুরি ছাড়াতেই আবার বৃষ্টি এল। বৃষ্টিটা আজ খেপ খেলছে, বারেবারে থেমে থেমে আসছে। জানালা থেকে একটুখানি ভেতরের দিকে সরে এল অপর্ণা। সাথের কাধের ব্যাগটা জাপ্টে ধরে বসে রইল। সরে বসলেও হাল্কা হাল্কা ছাট আসছিল ভেতরে, কিন্তু আরও ভেতরে সরে বসার সাহস পেল না ও। ছেলেটা উল্টোদিকের সিটের ওপর পা তুলে বসেছে। হোয়াটস আয়প এ চ্যাট করছে কারও সাথে। কারন ওদিক থেকেও মেসেজ আসছে ক্রমাগত। সামনে তাকাতে বুকটা হঠাত ছ্যাত করে উঠল অপর্ণার। দূরে বসে থাকা লোকটা নেই। কখন নেমে গেছে খেয়াল করেনি। মানে কামরায় মাত্র দুজন। ও আর ওই ছেলেটা। তাও যে কিনা আবার ওর প্রায় ঘাড়ের কাছে বসে। মোবাইল আর গুটখা নিয়ে। হাত পা অবশ হয়ে এল ওর। এই অবস্থায় কিছু যদি এদিক ওদিক করে ছেলেটা, তাহলে ওর বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। চিৎকার করার মত গলার জোরও নেই। আর ছেলেটার হাবভাব মোটেও সুবিধের মনে হচ্ছে না। বারবার বাইরে তাকাচ্ছে আর ঘড়ি দেখছে। মেসেজ এর রেপ্লাই দিচ্ছে। কখনো কখনো ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। একবার উঠে দরজায় গিয়ে গুটখার পিকটা ফেলে এল। চ্যাট করে কি আরও লোকজন ডাকছে নাকি? গ্যাং রেপ? আর ভাবতে পারল না ও। জোর করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে নিজেকে হাজারটা গালি দিতে লাগল। কেন যে আসতে গেল আজকেই। কাল সকালেও তো দিব্যি আসা যেত। যদিও ভুল হয়ে গেছে, কিন্তু সেই ভুল এর মাসুল যদি এভাবে দিতে হয়; কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না ও। আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। মনে মনে একটা জোর আনার চেষ্টা করতে লাগল। যদি মরতেই হয় তো লড়ে মরতে হবে। ব্যাগটাকে আরও জরে জাপটে ধরে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল অপর্ণা।
চার নম্বর প্যাকেটটা ছিঁড়ল ছেলেটা।
শিবাইচণ্ডী হল্ট এ কোনদিন ট্রেনটা দাড়ায়, আবার কোনদিন দাড়ায় না। আজ দাঁড়াল। চারটে ছেলে উঠল কামরাটায়। অপর্ণা হাত ঘড়ি দেখল, প্রায় সাড়ে দশটা। আরও এক ঘণ্টা। এই ছেলেগুলোকেই ডেকে আনল নাকি চ্যাট করে? এক জনের বিরুদ্ধে তাও রুখে দাড়ান যায় কিন্তু পাঁচজনকে কিভাবে মোকাবিলা করবে? সালোয়ারের ওড়নাটা মাথায় ঘোমটার মত করে দিয়ে বসল ও, সাথের ব্যাগটা কে আরও জোরে চেপে ধরে। অপর্ণা যেদিকে বসেছে ছেলেগুলো সেদিকের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। বৃষ্টিটা বেড়েছে আরও। ট্রেনের আওয়াজ আর বৃষ্টির আওয়াজে পাশের লোকের গলাও বোধয় শোনা যাবে না। সেই ছেলেটা এখনও মোবাইল নিয়ে খুটখুট করে যাচ্ছে। অদ্ভুত নির্লিপ্ত। আর সবে ওঠা ছেলেগুলো দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে, আর নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে। পোশাক আসাক দেখে বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। ওর মধ্যে একটা ছেলে, বয়স বছর তেইস কি চব্বিশ হবে, মাঝে মাঝে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে মিচকি মিচকি হাসছে আর চোখটা ওর মাথার চুল থেকে ঠোট এবং কাধ হয়ে বুকের ওপর ঘোরাফেরা করছে। কোলে রাখা ব্যাগটা ছেলেটার দৃষ্টিটাকে আরও নিচে যেতে বাধা দিচ্ছে।
ছেলে চারটে ওপাশে গিয়ে বসে পড়লো।
অপর্ণা হিসেব করে দেখল বর্ধমান পৌছতে এখনও আরও ঘণ্টা খানেক আছে। মনে মনে বিভিন্ন প্ল্যান করা শুরু করল ও। যদি উলটো পাল্টা কিছু ঘটে আজ ওর সাথে, মরার আগে অন্তত একটা ছেলের বাবা হওয়ার স্বপ্ন আজ ও ভাঙবে। ট্রেন থেকে লাফ দেওয়ার আগে চেনটা টানার চেষ্টা করবে। মনে করে দেখল ব্যাগে এমন কিছু আছে কিনা যাতে করে ছেলেগুলোকে ঘায়েল করতে পারে। অনেক কষ্টে মনে পড়লো, ব্যাগে যে সুইস নাইফটা রাখত সেটা ওদের পিজির রমিলাকে দিয়েছিল নখ কাটবে বলে, ফেরত নেয়নি। ইস … কেন যে নেয়নি, মনে মনে নিজেকে দু-চারটে গালি দিয়ে দিল। নিজের হাতের নখগুলো পরীক্ষা করে দেখল, আছর কামর দিলে ভালমতই আহত হবে ছেলেগুলো।
ছেলে চারটে জউগ্রামে নেমে গেল। আবার ও আর ওই ছেলেটা। আর এবার শুধুই ও আর ওই ছেলেটা। অপর্ণা এবার ভাল করে ছেলেটাকে পরখ করার চেষ্টা করল। ছেলেটার কি সত্যিই সেরকম কিছু মতলব আছে? সারাক্ষন তো মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত। নাকি কামরাটা ফাকা হওয়ার অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ? নিজের মোবাইলটায় হেডফোনটা গুজল ও। বাবাকে একটা ফোন করে জানিয়ে দিতে হবে কতদূর পৌঁছল। বাবা বলেছিল বটে কিন্তু টেনশন এর জেরে সেটা পু্রোপুরি ভুলে গেছে।
নট রিচবল।
টাওয়ার পাবে না মনেই হয়েছিল। বাবাও নিশ্চয় চেষ্টা করেছে, কিন্তু পায়নি। মানে কিছু উলটোপাল্টা ঘ্টলে কাউকে ফোন করে ডাকার রাস্তাও বন্ধ। আর ওর খবর নেওয়ার মতও কেউ নেই।
মসাগ্রাম। ছেলেটা এবার উঠে দাঁড়াল। একটা আড়মোড়া ভাঙল। দরজায় গিয়ে গুটখার পিকটা অত্যন্ত ঘৃণার সাথে বাইরে ফেলল। বর্ধমান আর চার পাঁচটা স্টেশন। ছেলেটার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এর মধ্যে কিছু একটা করার জন্য মরিয়া। স্টেশন ছাড়াতেই হাতের আঙ্গুল মটকাল। ঘাড় ভাঙল দুবার। আরেকটা গুটখা খেল। অপর্ণা ব্যাগ হাতড়ে একটা চুলের কাটা বের করল। কিছু না হোক সোজা চোখে ধুকিয়ে দেবে। তারপর যা হবে দ্যাখা যাবে। কাটাটাকে শক্ত করে ধরে বসল ও। ছেলেটা এবার আর বসল না। গেটে দাঁড়িয়ে রইল। হাওয়া খাচ্ছে। একবার কাউকে একটা ফোন করার চেষ্টা করল। বোধয় সেই ফোনটাও নট রিচবল। অপর্ণা এবার মনে মনে ভাবতে লাগল ছেলেটা কি সত্যিই ওকে রেপ করতে পারে? ওর কি সেরকম কিছু মতলব আছে? যদি থেকে থাকে, তাহলে এর থেকে ভাল সময় তো আর পাবে না। তাহলে কি ও সেরকম কিছু ভাবছে না? নাকি পাল্লা রোডে ট্রেন থেকে নামিয়ে ঝোপের ধারে নিয়ে গিয়ে কিছু করতে চায়? অনেক সময় ট্রেনে করাটা রিস্কি হয়ে যেতে পারে। পুলিশ কেসে ফেসে যাওয়ার চান্স থাকে। নাকি ওকে ট্রেন থেকে ফেলে দিতে চায়। যদি সেটা হয়, তাহলে কেন? কারও সাথে তো শত্রুতা আছে বলে মনে পড়ে না। ওর বাবার ধানকল আছে। ওর বাবার সাথে এমন কারও কি শত্রুতা আছে, যার প্রতিশোধ নিতে সেই লোকটা ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায়? নাকি সুনির্মল এর প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিল বলে ওই লোক লাগিয়ে … হাজার একটা চিন্তা মাথায় খেলতে লাগল ওর। আর হাতে খেলতে লাগল চুলের কাটাটা। কিছু হলে সোজা চোখে। তারপর যা হবে … হোক।
পাল্লা রোড পেরিয়ে গেল। এবার অপর্ণার মনে হল ছেলেটার বোধয় ওর প্রতি কোন আগ্রহই নেই। এখনও মোবাইলটা নিয়ে কি যে খুটখুট করে যাচ্ছে ভগবান জানে। মনে মনে এবার বেশ বিরক্তই হল অপর্ণা। যদি ভাল ছেলেই হবি, তো কথা বলতে আপত্তি কোথায় ছিল। ক্যালানে নাকি? আড়চোখে তাকিয়ে এবার কোলের ব্যাগটাকে পাশে নামিয়ে রাখল ও। বৃষ্টি টা থেমেছে। কিছুক্ষনের জন্য। কিন্তু যে কোন সময়ে আবার আসতে পারে। ছেলেটা আবার একটা গুটখার প্যাকেট ছিড়ে মুখে পুরল।
ট্রেনটা শক্তিগড় ছাড়াতেই বাবাকে ফোনে পেল অপর্ণা। স্কুটা্র নিয়ে স্টেশন আসার জন্য। না হলে এত রাতে রিক্সা পাবে না। ছেলেটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। বাইরের দিকে তাকিয়ে। পেছন ফিরে দেখছেও না একবারের জন্য। কামরায় একটা একা মেয়ে আছে, সে আদৌ আছে, না চলে গেছে তার দিকে যেন কোন ভ্রুক্ষেপই নেই ওর। অপর্ণার মনে সেই ভয়টা আর নেই এখন। হাত পায়ের অবশ ভাবটাও কিছুটা কম। চুলের কাটাটাও ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছে। মাথায় চিন্তা নেই, কিন্তু মনে প্রশ্ন – কে এই ছেলেটা? রাতে কোথাও যেতেই পারে, কিন্তু সারা ট্রেন এত চুপচাপ কেন? ফোনে চ্যাট করে গেল, কিন্তু যার সাথে চ্যাট করল তাকে একটা ফোন করল না কেন? বোবা? নাহ … অপর্ণার মনে পড়লো হাওড়াতেই একটা লেবু চা কিনে খেয়েছিল, আর একটাই কথা জিজ্ঞেস করেছিল বিক্রেতাকে – কত? তিন টাকার চায়ে পাঁচ টাকা দিয়ে দু টাকা ফেরত নিয়ে কয়েনটা উলটে পালটে দেখে আবার বলেছিল – এটা পালটে দিন।
তিন নম্বরে গাড়িটা দাঁড়াল। দু নম্বরে একটা মেল ট্রেন দাঁড়িয়ে। পাশের প্লাটফর্ম দিয়ে একটা মাল গাড়ি যাচ্ছে, যেন মনে হচ্ছে সোমবার জোর করে কেউ ওকে ঠেলে অফিস পাঠাচ্ছে। বৃষ্টি টা সামান্য ধরেছে, কিন্তু তাও আকাশটা বেশ লাল। মনে হচ্ছে রাতে আরও ঝেপে নামবে। পুরো ট্রেনটা থেকে সাকুল্যে তিরিশ জন লোক নামল। অপর্ণা নেমে নিজেকে সামলাতে সামলাতে দেখল ছেলেটা প্ল্যাটফর্ম এ দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের দিকে ছুটে গেল। আক্ষরিক অর্থেই ছুটে গেল। মেয়েটার বয়স মেরে কেটে কুড়ি। শ্যামলা গায়ের রঙ, রোগাটে। পরনে সস্তার একটা সালোয়ার। পিঠে একটা পড়ার ব্যাগ। ছেলেটাকে দেখতে পেয়ে একটা মিষ্টি হাসি। স্বস্তির হাসি। ছেলেটা মেয়েটিকে কিছু একটা দিল। অপর্ণার দূর থেকে মনে হল ক্যাডবেরি জাতীয় কিছু একটা। এই প্রথম ছেলেটার মুখে হাসি দেখল অপর্ণা। হাসলে বেশ মিষ্টি লাগে। এই মেয়েটার জন্য এত দূর থেকে ছেলেটা ছুটে এসেছে? ওরা কথা বলছিল প্ল্যাটফর্ম এর একটা স্টল এর সামনে দাঁড়িয়ে। এই স্টলটা মোটামুটি সারারাত খোলাই থাকে। অপর্ণা এগিয়ে গেল স্টলটার দিকে। আকাশের দিকে তাকাল একবার। বৃষ্টিটা নামলো বলে।
- একটা জল দিন না দাদা।
এতক্ষণ অপর্ণার সাথে একসাথে ট্রেনে করে এসেছে, সারা ট্রেন অপর্ণার দিকে কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, সেটা কেউ বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে পারবে না ছেলেটার হাবভাব দেখে। যেন মেয়েটিকে পেয়ে সব কিছু ভুলে গেছে। যার দিকে ও তাকিয়ে ছিল, যে ওর সাথে সারা ট্রেনে একা একা এসেছে, যে ওকে দেখে রেপিস্ট ভেবে নিজের ব্লাড প্রেসার কয়েক কদম বাড়িয়ে নিয়েছে, সে যে দু হাত দূরে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে, সে দিকে যেন বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। অপর্ণা কান পেতে শোনার চেস্টা করল ওদের কথা।
“কি দরকার ছিল তোর আসার এই শরীর নিয়ে?” মেয়েটি জিজ্ঞেস করল।
“চারিদিক দেখছিস তো, তোকে এত রাতে একা আসতে দেব ভেবেছিস? আমাকে কি এতটাই ইরেস্পন্সিবল মনে হয়? ” ছেলেটা বলল।
“তাও, তোর শরীর তো খারাপ। আর আমি তো জউগ্রাম যাব, চার-পাঁচ টাই তো স্টপেজ। বাড়ি গিয়ে রেস্ট তো নিতে পারতি। ব্লাড টেস্ট করিয়েছিস আজ কে? ”
“ কোত্থেকে করাব? কাল সকালে করাব।”
“আগে তুই ব্লাড টেস্ট করাবি তারপর আমি তোকে রাখি পরাব। ”
“আগে তুই রাখি পরাবি, তারপর আমি যাব। ”
“না, আমি পরাবই না। আগে তুই যাবি। আর তুই ভাল মত জানিস তোকে রাখি না পরিয়ে আমি খাব না কিছু। সুতরাং তুই যদি আমাকে না খাইয়ে রাখতে চাস, তো রাখবি।”
“ওককে বাবা, কাল সকালে ডেকে দিস। আর এই ঢপের কাজটা ছাড় এবার। রোজ তোর রাত হয় ফিরতে। কি দরকার আছে তোর এক্ট্রা ইনকামের? আমি তো টাকা পাঠাই তোকে। চারিদিকে যা আরম্ভ হয়েছে, একা ছাড়তে ভরসা হয় না। আমি কি রোজ আসতে পারব তোকে নিতে? আর বাবার পক্ষে সম্ভব?”
“আরে আজকেই শুধু লেট হয়েছে। আজ মিমির জন্মদিনের পার্টি ছিল বলে লেট হয়ে গেল। রোজই তো সাড়ে নটার মধ্যে ঢুকে যাই। তুই কিন্তু ডিরেক্ট বাড়ি চলে গেলে পারতি। কলকাতায় একা একা থেকে শরীরটার বারোটা বাজিয়েছিস। তোর শরীরটা মোটেও ভাল লাগছে না।”
“আরে বাবা বাড়ি ফেরার পথে তোকে তুলে নিয়ে গেলাম। তোর অসুবিধে হচ্ছে? যদি হয় তো বল, আর আসব না।”
“না, তা না। শোন না, কালকে তোকে একটা সুইট গিফট দেব।”
“কিরে কিরে ?? ”
“কেন বলব কেন? ”
অপর্ণার মোবাইল বেজে উঠল।
“হ্যা বাবা … এসে গেছ? … কোথায় দাঁড়িয়ে আছ? …… ওকে ওকে আমি বেরচ্ছি … হ্যা এক নম্বরে … হ্যা দুমিনিট দাড়াও আসছি … আরে না না বেশি ব্যাগ নেই, দাড়াও না আসছি।”
অপর্ণা মোবাইল রেখে ঘুরে তাকিয়ে দেখল ছেলেটা আর মেয়েটা ওভারব্রিজ এর দিকে উঠছে। ঘড়িতে দেখল, এগারটা চল্লিশ। আকাশটা মেঘলা। বৃষ্টিটা আবার নামলো বলে। ডাউন ট্রেনটা গ্যালপিং। একটা এক্সপ্রেস বেরচ্ছে, ওটা বেরলেই। ওরা ততক্ষণে ওপারের প্ল্যাটফরমে নামার সিঁড়িটা দিয়ে নামছে। এই ট্রেনটা আর পাঁচ মিনিট পরে ছাড়বে। এক্ষুনি মাইকে আনাউন্স করল। এটা যতদুর মনে হয় কামারকুন্ডু অবধি যায়। অপর্ণা ফোনটা বের করল ব্যাগ থেকে।
“বাবা? … হ্যা শোন না, আমার এক স্যারের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, একটু কথা বলে আসছি … পাঁচ মিনিট … আরে না না দেরী হবে না। … হ্যা রে বাবা ঠিক আছে সব … না না আসতে হবে না, তুমি বাইরে দাড়াও, পাঁচ মিনিটে আসছি। ”
অপর্ণার কোন দাদা নেই। আর রাজীবের সেই খেয়ালটাই কোনোদিন ছিল না, যে অপর্ণা বলে কেউ আছে ওর লাইফে।
জলের বোতলটা খুলল ও। পাঁচ মিনিট। এত রাতে ট্রেন সাধারনত লেট করে না।
ওপারের প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকাল অপর্ণা। বৃষ্টি টা নামলো বলে।