প্রায় তিরিশ বছর আগে, একবার বিজয়ার দিন সন্ধ্যেবেলা দিদির বাড়িতে যাচ্ছিলাম, রাস্তায় ইন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা । ‘অধিপের খবর শুনেছিস?’ ও বলল। অধিপ আমার স্কুলের বন্ধু। স্কুলে আমরা যে চারজন খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম অধিপ তাদের একজন। যদিও ও আমার বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে থাকে না, তবুও ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই অনেকদিন। তবে খবরাখবর পাই মাঝে মধ্যে। ‘কী হয়েছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। ইন্দ্রনাথ ডাক্তার। বলল কিডনির প্রবলেম। ‘জানিস তো খুব ক্রিটিকাল ষ্টেজে এসে গিয়েছিল। একটা অপারেশন হয়েছে। আপাতত: ভাল আছে। তবে আর একটা অপারেশন না হলে কিছু বলা যাচ্ছে না।’ আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। দিদির বাড়ি আর যাওয়া হল না। ওয়ার্ডের নাম আর কেবিনের নম্বর নিয়ে আমি ছুটলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
আর জি কর হাসপাতালের তিন নম্বর কেবিনে গিয়ে দেখি এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক শুয়ে আছেন। তাড়াহুড়োয় ইন্দ্রনাথকে হাসপাতালের নামটা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি। ধরেই নিয়েছিলাম বাড়ির কাছের আর জি কর-এই আছে ও। হাসপাতালের করিডোর দিয়ে ফিরতে ফিরতে মনে হল অধিপের দাদা তো ন্যাশানাল মেডিক্যালে আছেন; আর ইন্দ্রনাথ তো ওখানেই হাউস ষ্টাফ, সুতরাং ওখানে থাকার সম্ভাবনাই বেশী। আর জি কর রোডের ভিড় ঠেলে শ্যামবাজারের মোড়ে আসতেই একটা ৩৩ নম্বর বাস পেয়ে গেলাম – একদম ফাঁকা। কলকাতায় সন্ধ্যেবেলায় এ রকম একটা ফাঁকা বাস পাওয়া খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। কারণটা অবশ্য একটু পরেই বুঝতে পারলাম। বাসে লোক থাকবে কি করে, লোক তো সমস্ত রাস্তায়। বাস এগুচ্ছে শম্বুকগতিতে, প্রতিমার শোভাযাত্রা এবং তার দর্শনার্থীদের ভিড় ঠেলে। এদিকে ফাঁকা বাসে বসে আমি ছটফট করছি, অস্বস্তি হচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে আমি একটা যা তা। কেন ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি, আমার কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।
ঘন্টা খানেকের মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করার পর ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের সার্জিকাল ওয়ার্ডের তিন নম্বর কেবিনে গিয়ে হাজির হলাম। আমাকে দেখে অধিপ প্রথমে চমকে উঠল। তারপর ওর সমস্ত মুখটা হাসিতে ভরে গেল। ওর কাকা বসেছিলেন। অধিপ ওঁকে বলল, ‘তুমি চলে যাও। আজ হয়ত বাস পেতে অসুবিধে হবে। ও কিছুক্ষণ থাকবেখন।’ কাকা চলে গেলেন, আমি বসলাম। হঠাৎ আমার কী রকম লজ্জা করতে লাগল। আমি কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রাসেল না কার লেখায় পড়েছিলাম অনেকদিন কাউকে চিঠি না লিখলে তাকে চিঠি লেখা নাকি কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এমন অনেক কিছু ঘটে যায়, যে গুলো না জানলে ঠিকমত চিঠি লেখা যায় না। অনেক দিন পরে দুই বন্ধুর দেখা হলেও বোধহয় এই রকমই হয়। প্রথমে কিছু কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। ওই প্রথমে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এখন কোথায় আছিস?’ আমি বললাম। এইভাবে শুরু হল। ও নিজে থেকে অসুখের কথা বলল না। আমিও আর ওসব কথা তুললাম না। খানিকক্ষণের মধ্যেই আমরা স্বাভাবিক হয়ে এলাম। পুরোনো দিনের তুচ্ছ তুচ্ছ কথায় হাসতে শুরু করলাম। যেমন একবার মোহনবাগান, বি এন আর-এর খেলা দেখার জন্য লাইন দিয়েছিলাম আমরা। ছিলাম অনেক পিছনে। টিকিট পাওয়ার কোন আশাই ছিল না। হাঠাৎ হৈ হৈ কান্ড। আমাদের লাইন নাকি ভেঙ্গে গেছে – কাউন্টারের টিকিট শেষ হয়ে গেছে। লোকে হুড়মুড় করে ছুটল অন্য কাউন্টারের দিকে। খানিকক্ষণ কী হল মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা গেল না। মাঝখান থেকে আমরা লাইনের প্রথমে এসে গেলাম এবং দেখলাম তখনও টিকিট পাওয়া যাচ্ছে।
‘আর সেই দল বেঁধে ইংল্যান্ড আর ইন্ডিয়ার স্কুল টিমের খেলা দেখতে যাওয়া।’
‘প্রণবের মা কীরকম সবাইকার জন্য খাবার করে পাঠাতেন!’
‘আর গাভাসকারের সেই স্কোয়ারকাট!’
সেই প্রথম আমি গাভাসকারের খেলা দেখি। সেবারে গাভাসকার খুব কম রান করেছিল, কিন্তু একটা রাজকীয় স্কোয়ার কাট মেরেছিল। আজও সেটা মনের মধ্যে ছবি হয়ে আছে। মাঝে মাঝে অবশ্য আমরা দুজনেই চুপ হয়ে যাচ্ছিলাম অল্প সময়ের জন্য। তখন আমার কানে আসছিল পটকার আওয়াজ, ঢাকের বাজনা। অধিপের মাথার পেছনের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল রাস্তার শোভাযাত্রা – প্রতিমা যাচ্ছেন বিসর্জনে। কিন্তু নীরবতা বেশীক্ষণ স্থায়ী হচ্ছিল না। ততক্ষণে হয়ত অধিপের মনে পড়ে গেছে অন্য কথা।
‘“দি কিড” দেখার কথা মনে আছে তোর?’
স্মৃতি জিনিসটা ভারি অদ্ভুত। সমস্ত ঘটনাটা মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠল। স্কুলে নিয়ম ছিল যে কোন কারণে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হলে অভিভাবকের চিঠি আনতে হবে। আর অভিভাবকেরা, কেন জানি না, সবাই ইংরেজিতে চিঠি লিখতেন। ক্লাশ টেনে এক দিন আমি, প্রণব আর অধিপ নিজেরাই চিঠি লিখে বাবাদের নাম সই করেছিলাম। স্কুল কেটে সিনেমা দেখা সেই আমাদের প্রথম। এই সমস্ত গল্প করছি আর হো হো করে হাসছি। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে দেখি সাড়ে নটা বাজে। অধিপের দাদার জন্যই সম্ভবত: এতক্ষণ বসতে দিতে কেউ আপত্তি করে নি। অধিপের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লাম। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই দেখি একটা স্পেশাল বাস দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের ফুটপাতে। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম বাসটায়। কন্ডাকটর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাবেন?’ আমি প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাসটা কোথায় যাবে?’ ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন। ভুল বাসে ওঠার জন্য বাড়ি থেকে অনেক দূরে নামতে হল। কিন্তু আর বাসে উঠলাম না। হাঁটতে হাঁটতেই বাড়ি ফিরলাম। একটা অদ্ভুত খুশিতে ভরে ছিল মনটা। সেই খুশির সঙ্গে খেলা করতে করতে রাতে ঘুমটা এল অনেক দেরীতে।
ছুটি শেষ হওয়ার জন্য আমাকে পরের দিনই ফিরে যেতে হল আমার কর্মস্থলে, কলকাতার বাইরে। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এবার থেকে বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ রাখব। পরের বার ফিরে গিয়ে প্রথমেই অধিপের সঙ্গে দেখা করব। মাস দুয়েক পরে এক রোববার সকালে আবার কলকাতায় এলাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করেই ছুটলাম অধিপের বাড়িতে। কলিং বেলের আওয়াজে একজন চাকর বেরিয়ে এল। মনে পড়ল বছর খানেক আগে মাসীমার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম। অধিপের কথা জিজ্ঞেস করতেই লোকটি বলল, ‘ভেতরে আসুন। দাদাবাবু ঘরেই আছেন।’ বহু পরিচিত ঘর। এক সময় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছি এখানে। তবু দীর্ঘ সাত বছর পরে সেই ঘরেই ঢুকতে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়ালাম। দরজার পর্দাটা হাওয়ায় উড়ছে একটু একটু। ঘরের ভেতর থেকে প্রবল হাসির আওয়াজ আসছে, একটি মেয়ের গলাও পাওয়া যাচ্ছে। আমি একটু ইতস্তত: করে ডাকলাম,‘অধিপ।’ ঘরের মধ্যে হাসির আওয়াজ থেমে গেল। অধিপ ঘরের মধ্যে থেকে সাড়া দিল, ‘কে?’ আমি পর্দা সরিয়ে উঁকি মারতেই অধিপ খুব অবাক হয়ে বলল, ‘আরে তুই। আয় ভেতরে আয়।’ ঘরের মধ্যের জানলার দিকের বিছানায় অধিপ আর অধিপের দাদা বসে। আর একটি যুবতী বসে আছে অধিপের পড়ার টেবিলের সামনের চেয়ারটায়। আমি বিছানায় বসতে বসতে অধিপকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে কবে ফিরলি?’ ‘এই তো মাস খানেক হল।’
‘এখন কেমন আছিস?’
‘ভালই।’
অধিপের দাদা বললেন, ‘আরে রূপক! তোমায় বহুদিন পর দেখলাম। তোমায় দেখতে কিন্তু একই রকম আছে।’ আমি হাসলাম। কথাবার্তা কিন্তু একটু পরেই থেমে গেল। আমি আর কোন কথা খুঁজে পাচ্ছি না। বুঝতে পারছি সবাই অস্বস্তি বোধ করছে। অধিপের দাদা আমার চেনা। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে কেউ আমায় পরিচয় করিয়ে দিল না। ফলে আমি বুঝতে পারছি না মেয়েটি কে। সে কি অধিপদের আত্মীয়া, পরিচিত কেউ, নাকি অধিপ বা অধিপের দাদার প্রেমিকা? মাঝে মাঝে অধিপ মেয়েটির পেছনে লাগার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটি তেমন সাড়া দিচ্ছে না। মিনিট পাঁচেক পরে আমি বললাম, ‘এই এবার উঠি। আর এক জায়গায় যেতে হবে।’ অধিপ বলল, ‘আরে বস না একটু। কতদিন পরে এলি।’ অধিপ মাঝে একবার ঘর থেকে বেরিয়েছিল, সুতরাং এ কথার অর্থ আমি বুঝতে পারলাম। নির্ঘাত চাকরকে কিছু খাবার আনতে পাঠিয়েছে। সুতরাং বসতেই হল। অধিপের দাদা গম্ভীরভাবে একটা ডাক্তারি পত্রিকার পাতা ওল্টাতে লাগলেন। মেয়েটি তার কাঁধের ব্যাগ, হাতের রুমাল এবং শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলা করতে লাগল। অধিপ এটা ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। মাঝে একবার দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখে এল। আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। দূর থেকে একটা বিদেশী বাজনার সুর ভেসে আসছে। পাশের ফ্ল্যাটে বোধহয় কেউ কাপড় কাচছে। আমি নানা রকম অবান্তর কথা ভাবতে লাগলাম – ছোটবেলায় আমরা যখন অধিপদের বাড়ির ছাতে আন্ডারহ্যান্ড ক্রিকেট খেলতাম, তখন অধিপের দাদা আমার লেগব্রেক বল একদম খেলতে পারতেন না ইত্যাদি। মিনিট পনেরো এ রকম অস্বস্তিকর অবস্থায় কাটার পর চাকরটি ঢুকল দুটো সিঙাড়া, দুটো মিষ্টি আর চা নিয়ে। আমি কোন রকমে সেগুলো খেয়ে উঠে পড়লাম। বললাম, ‘আজ চলি।’ অধিপ আধশোয়া অবস্থাতেই বলল, ‘আসিস আবার।’ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসার পর চাকরটা দরজা বন্ধ করে দিল।
দ্রুত কয়েকটা সিঁড়ি নামার পর হঠাৎ আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম বাঁকের মুখের ল্যান্ডিং-এ। মুখটা বিস্বাদ লাগছিল। মনটা ভারাক্রান্ত। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। চমক ভাঙ্গতে মনে হল, আরে ওদের ফ্ল্যাট থেকে যদি কেউ বেরিয়ে আমাকে এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, তাহলে? তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। মনকে বোঝালাম এটাই তো স্বাভাবিক। এক অস্বাভাবিক মুহূর্তে আমরা দুজন দুজনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, পরস্পরের কাছাকাছি; আবার ফিরে গেছি যে যার বৃত্ত -এ। এতে দু:খ পাওয়ার কি আছে? এটাই তো স্বাভাবিক। এরকমই তো হয়। এই রকমই হয়ে থাকে।
‘ফিরে দেখা’ – বৃত্ত
Subscribe
Login
0 Comments
Oldest