।৯।
নিউ ইয়র্কে ফেরার দিন সাতেকের মধ্যে সমর একটা অস্বস্থি বোধ করতে শুরু করলো কোমরের ঠিক ওপরটাতে। প্রথম প্রথম টিয়াকে নিয়ে এত ব্যাস্ত ছিল যে পাত্তা দেয়নি খুব একটা। টিয়ার হাজারটা টেস্টের পর যখন জানা গেল যে বাচ্চা ঠিক আছে, তার কোনো ক্ষতি হয়নি, তখন দুজনেই হাফঁ ছেড়ে বাঁচলো। তবে সমরের ব্যাথাটা গেলো না। কিছুদিন পরেই ফিরে এল। একটা চিনচিনে ছুঁচ ফোঁটার মত অনুভূতি। দিনদিন বাড়তেই থাকলো। শেষ অবধি এমন অবস্থা হোলো যে সমর আর ঠিক মত দাঁড়াতেই পারে না। বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা আর অনেকজন বিশেষজ্ঞের আলাদা করে মতামত নেওয়ার পর নির্ধারিত হোলো যে সমরের কোমরের সামান্য ওপরে মেরুদন্ডের একটা হাড় অনেকটা সরে গেছে। অস্ত্রপচার করে টাইটেনিয়ামএর প্লেট বসিয়ে হাড়টাকে ঠিক জায়গায় আনা সম্ভব, তবে এই ধরনের অপারেশনের একটা বড় রিস্ক হোলো যে হাড় সরাতে গিয়ে স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে যেতে পারে বা নিদেনপক্ষে স্পাইনাল কর্ডে আঘাত লাগতে পারে। সেরকম হলে চিরকালের মত বিকলাঙ্গ হয়ে যাবার সম্ভবনা আছে।
চিকিৎসার অন্য সম্ভবনা হোলো অঙ্গসংবাহন বা ফিসিওথেরাপী। সব ডাক্তাররাই উপদেশ দিলেন যে যেহেতু সমরের বয়েশ কম, আর এক সময় তার স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল, ফিসিওথেরাপীটাই প্রথমে চেষ্টা করা উচিত। এতে সমস্যাটার সম্পূর্ন সমাধান না হলেও কিছুটা উন্নতি হবার সম্ভবনা খুব বেশী। অস্ত্রপচার করতে হলেও, কিছুটা উন্নতির পর সেটা করলে অনেক বেশি কার্জকরী হবে। সমরেরও সরাসরি অপারেশান করাতে আপত্তি। ঠিক হোলো যে দ্বিতীয় পদ্ধতিটাই অনুসরণ করা হবে। তবে ডাক্তাররা সাবধান করে দিলো যে প্রথম এক বছর কোনরকম শারীরিক চর্চা কিছু করা যাবে না। ফিসিওথেরাপীও নয়। শিড়দাঁড়ার আসেপাসে যে টিশুগুলোর ক্ষতি হয়েছে, সেগুলোকে দেহের স্বাভাবিক প্রণালী অনুযায়ী সেরে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। তবেই ফিসিওথেরাপীতে কাজ হবে।
ডাক্তারদের এই রোগনির্নয়কে আশাপ্রদই বলা উচিত, তবে এতে একটা নতুন সমস্যার আবির্ভাব হোলো। যে সমর সবসময় শরীরচর্চা নিয়ে পাগল ছিল, সেই সমরের ওজন হুহু করে বাড়তে শুরু করলো। কিছু না খেলেও ওজন বেড়ে যায়। সারাদিন চেয়ারে বসে কাজ, কোনো শারীরিক পরিশ্রম নেই। ওজন বাড়বে নাই বা কেন? এদেশের ঠান্ডা আবহাওয়ায় ঠিক মত ঘাম পর্জন্ত্য হয় না। এক্সারসাইজ না করলে ওজন কবজায় রাখা অতন্ত্য কঠিন। ওজন বাড়ার সাথে সাথে এলো মানসিক হতাশা। কি ছিলাম আর কি হোলাম? সমরের মাথায় সর্বক্ষন এই চিন্তাই ঘুরতো। এমনকি টিয়ার থেকেও অনেক দূরে সরে গেল সে। জয়কে দেখেও যেন দেখতো না। পেইনকিলার আর হতাশার সর্পিল প্যাঁচে ঘুড়পাক খেতে খেতে নামতে থাকলো সমরের জীবন। টিয়া শুধু চোখে জল নিয়ে তা দেখতে থাকলো। সমরকে সোজা পথে ফিরিয়ে আনা তখন তার ক্ষমতার উর্ধ্বে।
এই সময় একদিন টিয়ার এক সাইকিয়াট্রিস্ট কলিগ্ সমস্ত ঘটনাটা শুনে একটা উপদেশ দিলেন। বয়স্ক এই ভদ্রলোক প্রাক্তন খেলোয়ারদের নিয়ে গবেষনা করে সারা বিশ্বে নাম কুড়িয়েছেন। পেশাদারী খেলোয়াররা অনেকেই চোটের দরুন খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে তাদের অবস্থা হয় অনেকটা সমরের মত। ওজন বাড়তে থাকে এবং এরা অনেকেই মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পরে। টিয়া মড়িয়া হয়ে একদিন তার কলিগের কাছে গিয়েছিলো সাহায্যের আশায়। ভদ্রলোক সব শুনে একটুও অবাক বা বিচলিত হলেন না। “দিস হ্যাপেন্স মোর দ্যান ইউ থিঙ্ক!” হেসে বলেলেন তিনি। “অল হি নিডস্ ইস কমিউনিকেশান উইথ আদার পিপেল লাইক হিম”। টিয়াকে বললেন যে উনি সমরের মত আরো অনেক রুগীদের নিয়ে একটা আলোচনার আয়োজন করেন প্রতি সপ্তাহে। টিয়া চাইলে সমরকে সেখানে নিয়ে আসতে পারে। যদি প্রথম দিন এসে ভালো না লাগে, তাহলে আর আসবে না। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রথম দিন টিয়া সমরকে প্রায় জোর করেই নিয়ে গিয়েছিলো। সমর খুব প্রাইভেট মানুষ। অচেনা লোকের সামনে নিজের সমস্যা আলোচনা করাতে তার ঘোড় আপত্তি। যাইহোক, টিয়া অনেক কান্নাকাটি করাতে শেষমেশ গিয়েছিল। ওখানে গিয়ে দেখলো যে আলোচনায় অংশগ্রহনকারীদের অনেকের অবস্থা তার থেকেও বহুগুন খারাপ।
সব দেখে সমরের নিজের ওপর একটা ঘৃণা জন্মালো। এরা যখন চেষ্টা করছে, আমার চেষ্টা না করার কোনো কারনই থাকতে পারে না, মনে হোলো তার। সেই দিন থেকে সমরের জীবন আবার উর্ধ্বগামী হোলো। টিয়ার সেই কলিগ্, ডাক্তার ফিঞ্চ, হয়ে উঠলেন সমরের সবথেকে বিশ্বস্ত বন্ধু। আলোচনার দলের অনেকেই এখন সমরের কাছের মানুষ। এরা একে অপরকে সাহস যোগায়। এখন আর সমর নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে না। তার মনে বল ফিরে এসেছে। সে জানে যে শারীরিক ভাবে সে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ না হয়ে উঠতে পারলেও, মানসিক দিক থেকে কোনো ঘাটতি তার আর আজ নেই। এই পটভূমিকায় গগাবাবু পদার্পন করেছিলেন ছেলের জীবনে ছ’মাসের জন্য। কাল আবার ফিরে যাবেন।
সেদিন রাতে আর ঘুম হোলো না গগাবাবুর। বার বার মনে হতে থাকলো “কেন এলাম এখানে? বেশ তো ছিলাম নিজের ছোট্ট জগতে!” পরক্ষনেই তার বিবেক উত্তর দিলো “আসাটা তো ভুল নয়। ভুল হচ্ছে তোমার বিচার বিবেচনায়। একজন মানুষ হিসাবে অন্য মানুষের প্রতি তোমার ব্যাবহারে”। ছোটবেলায় মা একটা কথা বলতেন, সেই কথাটা খুব পরে পড়ছে আজ গগাবাবুর। মা বলতেন “যখন মুখ খুলবি, ভেবে চিনতে খুলবি। একবার মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায়না”। আজ চুয়াত্তর বছর বয়েসে অবশেষে মা’র সেই কথাটার মর্ম তিনি বুঝলেন। কথায় আছে না, ঠেকে না শেখাটা শেখা নয়! কত অন্যরকম হতে পারতো তাঁর কালকের চলে যাওয়াটা! সারা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পর অবশেষে যখন ভোরের আলো ফুটলো, তখন গগাবাবু শারীরিক এবং মানসিক ভাবে খুব ক্লান্ত। একবার ভাবলেন ঘর থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল পার্কের গায়ে সূর্জ্যদয়টা শেষ বারের মত দেখবেন। তারপর ভাবলেন, কি লাভ? টিয়ার সঙ্গে কাটানো সেন্ট্রাল পার্কের যে সুন্দর মুহূর্তগুলো এতদিন মনের আয়নায় নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করছিল, আজ সেই মুহূর্তগুলো মলিন হয়ে গেছে।
বিছানাতেই শুয়ে রইলেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা উঠে তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে, গগাবাবু এসমস্ত কিছুই টের পেলেন, কিন্তু ঘর থেকে বেরোলেন না। চুপচাপ ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইলেন। যখন প্রায় দশটা বাজে, তখন দরজায় টোকা শোনা গেল। বাইরে টিয়ার গলা “ড্যাড্, তুমি কি উঠেছো?” অনিচ্ছা সত্তেও গগাবাবুকে এইবারে উঠতে হোলো। “আমি আসছি” উত্তর দিলেন তিনি। কিছুক্ষন পর বাথরুম থেকে সন্তর্পনে বসার ঘরে ঢুকে টিয়াকে বললেন “আমি আর কিছু খাবোনা। আমার খিদে নেই”। “কিন্তু ফ্লাইটে ওঠার আগে তোমাকে কিছু একটু খেতেই হবে। তা না হোলে শরীর খারাপ লাগবে”। টিয়ার কন্ঠ স্বাভাবিকের থেকে আজ একটু কঠোর শোনালো গগাবাবুর কানে। হয়ত তার মনের ভুল! ভাবলেন গগাবাবু। “ঠিক আছে, আধ ঘন্টা পর দিস্। আমি আমার জিনিষপত্রগুলো ততক্ষনে গুছিয়ে নি” বলে সে নিজের ঘরের দিকে আবার রওনা দিল। গোছগাছ আগেই করা ছিল। ছুঁতো করে নিজের ঘরে গেলেন পাছে সমরের সাথে বসার ঘরে সামনাসামনি দেখা হয়ে যায়। আধ ঘন্টা পর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন যে টিয়া খাবার টেবিলে আগে থেকেই তার খাবার সাজিয়ে রেখেছে। রেখে তার জন্য অপেক্ষা করছে। “বোসো, ড্যাড্” বলে নিজে একটা চেয়ার টেনে টিয়া বসলো। গগাবাবু বসলেন খেতে। কিন্তু কি করে খাবেন। গলা যে আবেগরুদ্ধ। “আমি এত খেতে পারবো না রে!” টিয়া ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বললো “তুমি কালকের ঘটনা নিয়ে অত ভেবনা। সমর কিছু মনে করেনি। তুমি তো জানতে না”। গগাবাবু উত্তর দিতে গিয়েও দিলেন না। নিজেকে থামালেন।
উত্তর আর কি দেবেন? সমর হয়ত তাঁকে ক্ষমা করে দেবে, কিন্তু তিনি নিজে যে নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেন না। সেই কথা এই মেয়েকে তিনি কি করে বোঝাবেন? আস্তে আস্তে খেতে শুরু করলেন। দেরী হয়ে যাবে এরপর। “তোরা কিছু খেলি না?” জিগ্যেশ করলেন। “আমরা তুমি ওঠার আগেই ব্রেকফাস্ট খেয়েছি। ফিরে এসে খিদে পেলে তখন খাবো”। গগাবাবু আর কথা বাড়ালেন না।
বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ সমর নিজের শোবার ঘর থেকে বেরোলো জয়কে নিয়ে। ততক্ষনে গগাবাবু রেডি। জয় “ডুডা” বলে গগাবাবুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কান্না কান্না গলায় বলল “ডুডা, ইউ স্টে”। গগাবাবু গলার স্বর হাড়িয়ে ফেলেছেন। কোনোক্রমে জয়এর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন “আমি আবার শিজ্ঞির আসবো দাদু। তুমিও আমাকে দেখতে আসবে। কেমন?” জয় কি বুঝলো কে জানে, গিয়ে বাবার পা জড়িয়ে দাঁড়ালো। টিয়া এগিয়ে এসে প্রণাম করলো “সাবধানে যাবে, ড্যাড্। কিছু দরকার হলে ওদের বলবে। হেসিটেট করবে না”। গগাবাবু আর কিছু বলতে পারছেন না।
তার ঠোঁট কাঁপছে। কেবল মাথা নাড়লেন, তারপর টিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। অনেক্ষন ধরে। টিয়ার চোখেও জলের ধারা। খানিক্ষন পর সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছলো। সমর এগিয়ে এসে বাবার পাশে রাখা হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিল। তারপর নিচু হয়ে বাবাকে প্রণাম করলো। গগাবাবু ততক্ষনে চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন, যাতে ছেলে বৌমার সামনে অশ্রুপাত না হয়। কেবল সাবেকি কায়দায় ছেলের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। পিতা পুত্রে কোনো বাক্যবিনিময় আর হোলো না।
এয়ারপোর্টে পৌঁছতে মিনিট চল্লিশেক সময় লাগলো। আসার দিন গগাবাবু কতকিছু লক্ষ্য করেছিলেন। এ যাত্রায় তিনি আর কিছুই লক্ষ্য করলেন না। তাঁর দৃষ্টি দূর দিগন্তে। গাড়ি থেকে নেমে কখন লিফটএ চড়লেন, কখন নামলেন, কখন টার্মিনালে ঢুকলেন, কখন চেক্-ইন হোলো, সব কিছুই যেন এক ধূসর আবছায়া। “ড্যাড্, তুমি হুইলচেয়ারটাতে উঠে বোসো”। টিয়ার গলার স্বরে তিনি বাস্তবে ফিরে এলেন। দেখলেন তার সামনে একজন স্বল্পবয়েসি অ্যাটেন্ডেন্ট হুইলচেয়ার নিয়ে অপেক্ষা করছে সে বসবে বলে। জয় তার মা’র হাত ধরে দাঁড়িয়ে। আজ সে কোলে ওঠেনি। টিয়াকে আর একবার আলিঙ্গন করলেন। করতে গিয়ে চোখে জল এসে গেল। হুইলচেয়ারে বসতে গিয়েও বসলেন না। ঘুড়ে দাঁড়ালেন। সমরের চোখের দিকে চোখ রেখে সোজা তাকালেন। সমরও তার দিকে তাকিয়ে। গগাবাবুর মুখ বিকৃত হয়ে উঠলো। তিনি আর কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। এগিয়ে গিয়ে ছেলেকে প্রানপনে আঁকড়ে ধরলেন। ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকলেন।
তার আজকের এই আলিঙ্গনের সাথে সেই প্রথম দিনের আলিঙ্গনের কত পার্থক্য! সমর বাধা দিলো না। বাবাকে সেও সমস্ত হৃদয় দিয়ে আলিঙ্গন করলো। অনেক্ষন পর যখন গগাবাবু একটু শান্ত হলেন, সে বলল “তুমি বেশী চিন্তা কোরো না বাবা। সামনের মাস থেকেই আমার ফিসিওথেরাপী শুরু হবে। তার পরের মাসে সাঁতার”। গগাবাবু নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলেন। ছেলেকে প্রান ভরে দেখলেন শেষ বারের মত। তারপর নিজের বাঁ হাত থেকে ফিট্বিট্ টা খুললেন। পড়িয়ে দিলেন সমরের হাতে। “যতদিন বেঁচে থাকবো, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো যেন এমন ফিট্বিট্ এনে দেন যার শক্তিতে তুমি ভালো হয়ে ওঠো”। কথাটা বলে ঘুরে হুইলচেয়ারে বসলেন। অ্যাটেনডেন্টকে বললেন “লেটস্ গো”। অ্যাটেনডেন্ট হুইলচেয়ার ঠেলে সিকুরিটি গেটের দিকে এগিয়ে চলল। ওরা সবাই হাত নাড়লো অনেক, কিন্তু গগাবাবু আর ফিরে তাকালেন না। ওর আর আমাকে দরকার নেই। ওর মেরুদন্ড আমার থেকে অনেক বেশি শক্ত, অনেক বেশী সোজা, ভাবতে ভাবতে যাত্রীদের ভীড়ের মধ্যে হাড়িয়ে গেলেন তিনি।
।সমাপ্ত।