ফিট্বিট্ (3rd part) – click here
।৪।
জেট্ ল্যাগের দরুণ ভোর রাত্তিরে গগাবাবুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। মার্চ মাস। এখনও নিউ ইয়র্কে বেশ ঠান্ডা। দিনের বেলা রোদ উঠলে একটু তাপমাত্রা বাড়ে, তবে তাও কলকাতার শীতের থেকে অনেক বেশী ঠান্ডা। রাত্তির বেলা বেশির ভাগ দিনই শূণ্যের নিচে তাপমাত্রা থাকে। যদিও ফ্ল্যাটের ভেতর তাপমান নিয়ন্ত্রিত, এসে অব্ধি গগাবাবুর শীতশীত করছে। গতকাল সন্ধ্যেবেলায় স্নানটান সারার পর গগাবাবু আর চোখ খুলে রাখতে পারেন নি। কিছু না খেয়েই শুয়ে পরেছেন। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। টানা ৯ ঘন্টা ঘুমানোর পর তার ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। মনে পরে গেল যে তিনি ছেলে বৌমার ম্যানহ্যাটেন্এর ফ্ল্যাটে। গলাটা প্রচন্ড শুকিয়ে গেছে। চোখ খুলে দেখলেন চারিপাশে অন্ধকার। নিঃশব্দ। কিছুক্ষন চুপচাপ শুয়ে নিজের পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করলেন। খুব জল তেষ্টা পেয়েছে কিন্তু এই অন্ধকারে তিনি কোথায় জল খুঁজবেন? হঠাৎ মনে পরলো যে বাথরুমটা ঘরের লাগোয়া। ওখানেই তো জল। সে জল খাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে আর উনি বিশেষ ভাবলেন না। বিছানা থেকে নামতে যাবেন, হঠাৎ নজরে পরলো বিছানার পাশেই ছোটো টেবিলের ওপর একটা জলের বোতোল আর গেলাস। নিশ্চয়ই টিয়ার কাজ।
এসে থেকেই দেখছেন মেয়েটার অনেক গুন। ঢকঢক করে বোতোল থেকেই সোজা গলায় জল ঢাললেন গগাবাবু। প্রানটা জুড়ালো। টেবিলের ওপর ঘড়িও রয়েছে। বড়বড় সবুজ অক্ষরে দেখাচ্ছে ৪:১০। একবার ভাবলেন আবার শুয়ে পরবেন। কিন্তু জলটা খেয়ে শরীরে একটা চনমনে ভাব এসে গেছে। আর শুতে ইচ্ছা করলো না। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে ততক্ষনে। বিছানার ওপর রাখা সোয়েটারটা গায়ে চড়িয়ে গগাবাবু সন্তর্পনে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। এই ফ্ল্যাটে কোনো ব্যালকনি নেই যে গিয়ে দাঁড়াবেন। কেবল আছে সারি সারি কাঁচের দেয়াল। অবশ্যি ব্যালকনি থাকলেও এই শীতে সেখানে দাঁড়ানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। গগাবাবু গিয়ে দাঁড়ালেন সেন্ট্রাল পার্কের মুখোমুখি দেয়ালের পর্দার সামনে। পাছে পর্দা সরানোর শব্দ হয়, সেই ভেবে পর্দাটা সামান্য ফাঁক করে গলে গেলেন ভেতরে। ঠান্ডা কাঁচে নাক ঠেকিয়ে বাইরে দৃষ্টিপাত করলেন। স্তম্বিত হয়ে গেলেন। আকাশ ফেটে নিঃশব্দে তুষার ঝরে পরছে। নিচে সেন্ট্রাল পার্কের আলোয় প্রতিটি তুষারকনা যেন জ্বলে উঠেছে। তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে—আমদের সাথে তুমিও নিচে নেমে এসো গগা। রাস্তাঘাট ধবধবে সা্দা। এত বড় শহরে কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই। কেবল এক অদ্ভুত মায়াবি ভাব। চল্লিশ বছর পর আবার তুষারপাত দেখে নতুন করে মুগ্ধ হলেন গগাবাবু। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি উপভোগ করতে লাগলেন। কেবল মাঝেমাঝে আলতো করে কাঁচের গায়ে জমা বাষ্প মুছে দিচ্ছেন।
এক সময় তাঁর মন হারিয়ে গেল বহু যুগ আগের সব ঘটনায়। সমর তখন স্কুলে পড়ে। ফ্র্যাঙ্ক অ্যান্টনি পাবলিক স্কুলে। পড়াশুনায় তার মোটে মন ছিল না। সারাদিন কেবল ফুটবল, ক্রিকেট, আর রকে বসে গুলতানি অথবা গলির মোরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্যারাম। এই ছিল সমরের দৈনন্দিন জীবন। অবশ্যি ফুটবলটা খেলতো ভাল। স্কুল টিমের এক নম্বর স্ট্রাইকার ছিলো। অল্প বয়সে মা মারা যাওয়া ছেলেটাকে গগাবাবু কিছুটা নেগ্লেক্ট করেছিলেন। তা তিনি জানেন। সে কাজেকর্মে ব্যাস্ততার জন্যই হোক বা অন্য কারনেই হোক। গগাবাবুর ইচ্ছা ছিলো ছেলে বিগ্যান নিয়ে পরাশুনা করে বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। তিনি নিজে যেটা করতে পারেন নি—পি-এইচ-ডি—ছেলে সেটা করে দেখাবে। মৃনালিনিরও সেরকমই ইচ্ছা ছিল। ওই জন্য ছেলেকে ছোটবেলায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেও ভর্তি করালেন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। গগাবাবুর পি-এইচ-ডি করার স্বপ্ন একদিন ভেঙ্গে গিয়েছিলো হঠাৎ তাঁর বাবার অকাল মৃত্যুতে। পার্ডুতে পি-এইচ-ডি শেষ না করেই তাকে দেশে ফিরে এসে চাকরি নিতে হয়েছিলো সংসার চালানোর দায়ে পরে। সমরের সে ধরনের কোনো দায়ই ছিলো না। কিন্তু ছেলেটা পড়াশুনার ধার দিয়ে গেলো না। আই এস সি তে অতি সাধারন ফল করার পর বাধ্য হোলো কমার্সে ভর্তি হতে। অবশ্য সমরের সাইন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছে এমনিতেও ছিল না। ভাগ্যক্রমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ঢুকতে পেরেছিল।
কলেজে পড়া কালিনই হঠাৎ সমরের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন গগাবাবু। অনেক বেশি সিরিয়াস। অনেক বেশি কর্মঠ। একদিন এসে বলল “বাবা, আমার অনেক টাকার দরকার”। গগাবাবু একটু বিচলিত হলেন। ছেলে কি জুয়াটুয়া খেলে ধারদেনা করে এসেছে নাকি? “কেন রে?” একটু ইতস্তত করে সমর বলল “আমি আমেরিকায় গিয়ে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে চাই”। “বিজনেস ম্যানেজমেন্ট? সে আবার কি? তার থেকে এদেশেই চারটার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড় না? ওদের মাইনে পত্র ভালো” “ওসবে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আর তাছারা আমার স্ট্রেন্থ হচ্ছে আমার কমিউনিকেশন স্কিল, আমার পার্সোনালিটি। ম্যানেজমেন্ট আমার জন্য ঠিক”। গগাবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। যে ছেলে ভালো করে কথা পর্জন্ত্য বলে না, তার স্ট্রেন্থ তার কমিউনিকেশন স্কিল, তার পার্সোনালিটি? কিন্তু তিনি আর বিতর্কে গেলেন না। “অত টাকা আমি কোথা থেকে পাবো?” এই প্রশ্নের পর আর কোনো আলোচনা থাকতে পারে না। সমর কাঁধ নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে বাবার দিকে একবার তাকিয়েছিল মাত্র, কোনো কথা বলেনি। তার সেই দৃষ্টি গগাবাবু আজও ভুলতে পারেন নি। সেই ক্ষনিকের দৃষ্টিতে ছিল অনেক শুপ্ত বেদনা, অনেক জমে থাকা অভিমান। পরক্ষনেই গগাবাবুর মনে হয়েছিল এ তিনি কি করলেন? এই প্রথম সমর মুখ ফুটে তার কাছে কিছু চেয়েছিলো! মাস দুয়েক পরে ছেলেকে ডেকে বললেন যে তিনি টাকা জোগার করে দেবেন। যা লাগে। “কিন্তু তোকে পরীক্ষা টরীক্ষা দিতে হবে না?” “দেওয়া হয়ে গেছে। আমার স্কোর্ যা তাতে যেকোনো ইউনিভারসিটি আমাকে অ্যাডমিশান দেবে”। সমরের চোখে সেদিন ধরা পরেছিলো আত্মবিশ্বাস। পার্সোনালিটি আছে বটে ছেলেটার, ভেবেছিলেন গগাবাবু। এই ঘটনার মাস ছয়েক পরে আমেরিকা যাত্রা করেছিলো সমর। ফিলাডেলফিয়াতে। হোয়ার্টন স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টে এম-বি-এ পড়তে। সেখানেই টিয়ার সাথে আলাপ।
তুষারপাত থেমে গেছে। পূবের আকাশে একটা হাল্কা রক্তিম আভা। তা ক্রমশ বাড়ছে। আকাশের সেই রঙ ফটফটে শুভ্র তুষারে আবৃত গাছ, পথঘাট, গাড়ি, বাড়ী সমস্ত কিছুতে প্রতিফলিত হয়ে সকালটাকে মোহময় করে তুলেছে। এই শেষ বয়েসে একবার এখানে এসে ভালোই হোলো, ভাবলেন গগাবাবু। একটু অন্যরকমের অভিজ্ঞতা। তবে একটা হিসেব তিনি কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। সমরের ওজন এত কবে বারলো? পাঁচ বছর আগে যখন বিয়েতে দেখলেন তখন তো সেই তেজী ফুটবল খেলোয়ারদের মতই পেটানো চেহারা। কি সুন্দর মানিয়েছিল টিয়ার পাশে সমরকে! এই ক’বছরে এতটা কি করে পরিবর্তন হতে পারে? গগাবাবু পূবের দিগন্তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার আনমনা হয়ে গেলেন।
To be continued…