প্রতিদিন সকালবেলায় চোখ মেলে প্রথমেই যে মানুষটাকে না দেখলে অনুপ্রিয়ার সারাদিন কেমন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যেত সে হল ওর ঠাকুরদা । ভারী রসিক মানুষ ছিলেন তিনি । বয়স তাঁর যা-ই হোক না কেন তিনি একাই মাতিয়ে রাখতে পারতেন নিজের প্রায় বারো জন সদস্যের গোটা পরিবারকে। নিতীনবাবু অর্থাৎ অনুপ্রিয়ার ঠাকুরদা যেমন নিজে কোনো ঝামেলা পছন্দ করতেন না, তেমনই কোনো ঝামেলায় পড়লে ঠান্ডা মাথায় তা সামলাতেও জানতেন। বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের সাথে কীভাবে মিশতে হয়, কীভাবে, কীধরনের কথা বলে তাদের মন জয় করা যায় তা তাঁর চেয়ে ভালো বোধহয় আর কারো জানা ছিল না। পাড়ারলোকে কখনো প্রকাশ্যে কখনো বা আড়ালে বলতো ” নিতীনবাবু আছেন বলেই তাঁর ছেলেমেয়েদের হাঁড়ি এখনও আলাদা হয়নি, নাহলে এযুগে যৌথপরিবার সহজে দেখা যায় কি ?
সেদিন ছিল অনুপ্রিয়ার একাদশ শ্রেণীর চতুর্থদিন। প্রতিদিনের মতোই সেদিন সকালেও অনুপ্রিয়ার ঘুম ভাঙলো একইসময় কিন্তু ঘুমটা ভাঙলো কয়েকজনের কান্নার আওয়াজে। নিতীনবাবু অমন একজন হাসিখুশি মানুষ সবার অগোচরে গতরাত্রেই যে চিরবিদায় নেবেন তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। যে বাড়িতে নিতীনবাবু সহ সকলের হাসি, আনন্দ সারাদিন ধরে লেগেই থাকত সেই বাড়ি ধীরে ধীরে বোবাখানায় পরিণত হল।
একদিন সকল শোকস্তব্ধতা ভেঙে অনুপ্রিয়ার ঠাকুমা বাড়ির সকলকে ডেকে বললেন , ” শোনো সবাই, প্রায় মাস দেড়েক হল তিনি গত হয়েছেন। আমি চাই এ পরিবারকে তিনি যেরূপ হাসিখুশি আনন্দে রেখে গিয়েছিলেন, পরিবারের সেরূপ যেন শীঘ্রই ফিরে আসে। আশা করি তিনি আজ জীবিত থাকলে একই অনুরোধ করতেন তোমাদের…। কাল তোতার এক বছর পূর্ণ হবে, সেই উপলক্ষে বাড়িতে একটা ছোট অনুষ্ঠান পালনের কথা ভেবেছি। তোমরা তার আয়োজন সকলে মিলে হাসিমুখে শুরু করে দাও। আয়োজনে কোনও ত্রুটি কিংবা বিষাদের চিহ্ন না থাকে…। ” — বলে ঠাকুমা উঠে চলে গেলেন। এ কেমন আদেশ তাঁর ? পাষাণ তিনি ? স্বামীর মৃত্যুতে কোনও দুঃখ হয় না তাঁর? নাকি স্বামী হারানোর শোকে নিয়ম কানুন সব ভুলে গেছেন ? লোকে দেখে বলবে কী! তোতা হল অনুপ্রিয়ার ছোটকাকার ছোটমেয়ে। সে ছোট তাই তাকে ভুলানো সহজ, কিন্তু তার ঠাকুমাকে ভুলানোর সাধ্য আছে কার? অগত্যা ঠাকুমার আদেশ মতোই জন্মদিন পালন করা হল তোতার । অনেক উপহার, রঙীন আলোয়, গান-বাজনায় জীবনের দ্বিতীয় বর্ষে তোতার পদার্পণ তোতাসহ সকলের মুখেই হাসি ফোটালো। কর্মব্যস্ততায় হোক কিংবা আনন্দের ভিঢ়ে সকলেই কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও দুঃখ-শোক ভুলে থাকতে পারলো। আমন্ত্রিত পাড়াপ্রতিবেশীরা আহার সম্পূর্ণের পর ফিরে গেল, নিন্দুকেরা স্বভাববশত নিন্দা করলো। আর কে কী মনে করল জানিনা তবে তোতা আর ঠাকুমা সেই নিন্দায় কর্ণপাতও করলেন না।
ঠাকুমার সকল নাতি-নাতনীদের মধ্যে অনুপ্রিয়া ছিল সবচেয়ে বড়। বারান্দায় বসে ঠাকুমা একদিন অনুপ্রিয়ার লম্বা ঘন চুলে তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন এমন সময় প্রায় বেখেয়ালেই অনুপ্রিয়া এক ভয়ানক প্রশ্ন করে বসল —
— ” আচ্ছা ঠাম্মি, দাদাই-এর জন্য তোমার এখন মনখারাপ হয় না?”
— ” হঠাৎ এ প্রশ্ন? ” ঠাকুমা আগেথেকেই জানতেন এইরূপ প্রশ্ন কেউ না কেউ, কোনো না কোনদিন করবেই তাঁকে….।
অনুপ্রিয়া মনে মনে ভাবলো সে কী বেশি আস্পর্ধা দেখিয়ে ফেলছে ? কিন্তু এ প্রশ্ন তো তার একার নয়, বাড়ির অনেককেই এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে শুনেছে সে। অনুপ্রিয়া ভীতস্বরে বললো, ” এমনি …. sorry” – ততক্ষনে তার চুলে তেল মাখানো সম্পূর্ণ হয়েছে বুঝতে পেরে অনুপ্রিয়া উঠে চলে যাবে এমন সময় ঠাকুমা বললেন, ” উঠে যাচ্ছিস যে ? শুনবি না তোর প্রশ্নের উত্তর ? শুনবি না কেন আমি জোর করে তোতার জন্মদিন পালনের আদেশ দিয়েছিলাম?” অনুপ্রিয়া চুপ করে ঠাকুমার সামনে এসে বসলো। অপরাধের লজ্জায় সে আর সামনে তাকাতে পারলো না, জানিনা আদৌও সে কোনও অপরাধ করেছিল কিনা…।
ঠাকুমা বলতে শুরু করলেন , ” তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ঠিক কতটা ছিল তা কখনো মেপে দেখিনি…। জাদুমন্ত্রের মতো যে কারোর উপরেই কাজ করতো ওনার কথা, ব্যবহার। একটা ঘটনা বলি তোকে আজ — আমার সর্বপ্রথম একটি মেয়ে হয়েছিল। নাম দিয়েছিলাম তার বাসন্তী, সরস্বতী পুজোরদিন জন্মেছিল কিনা…।ওর তখন তিন বছর বয়স, আমরা সবাইমিলে দার্জিলিংয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ঘন কুয়াশা চারিদিকে, এক হাত দূরত্বের মানুষকে দেখতে পাওয়াও মুশকিল ছিল সেদিন। আমি স্নানে গিয়েছি এমন সময় সবার নজর এড়িয়ে কী করে যে হোটেল থেকে বেড়িয়ে মেয়েটা আমার খাঁদের ধারে এসে পড়েছিল আমি আজও বুঝতে পারি না, আর তারপর…। ঠাকুমার গলা কেঁপে উঠল। অনুপ্রিয়ার চোখ ছলছল করতে লাগলো। নিজের চোখের জল জোর করে আটকে ঠাকুমা আবার বলতে লাগলেন, ” ওর মৃতদেহ শনাক্ত করার সাহস আমার ছিল না , তোর দাদাই গিয়েছিলেন…। এরপর থেকে আমার দিন কাটতো ঘরের একটা কোণায় একাকী বসে কাঁদতে কাঁদতে। মেয়েটার সাথে জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম আমার ঘুম , খিদে, তেষ্টা, শক্তি সবকিছু। তিনি হাজারো চেষ্টা করতেন বোঝানোর, মনের পরিবর্তনের জন্য, কিন্তু সেদিনগুলোতে তাঁর জাদুমন্ত্র কিছুতেই কাজ করতো না । এভাবে মাস ছয় কাটল। তোর দাদাই আমার অগোচরেই আমাদের বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন বাড়িতে। সন্ধ্যে হলে উনি আমার বিনা সজ্জায়ই যখন আমাকে সকল আত্মীয়পরিজনদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন, তখন প্রচন্ড রাগে আমি সকলের সামনে তাঁকে কত কটু কথাই না শুনিয়েছিলাম। একটা কথাও বলেননি তখন। মুহূর্তের মধ্যে সেই সকল রাগ-দুঃখ- অভিমান উবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যখন দেখলাম দলে দলে কতক ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙ-বেরঙের পোশাকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কেউবা ছুটে আসছে, কেউবা হেঁটে, কেউবা টলমল পায়ে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে এবং আবারও উঠে হাঁটার চেষ্টা করছে। অপূর্ব ! অপূর্ব ছিল সে মুহূর্ত। সেদিন আমি একসাথে আমার অনেক বাসন্তীকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পেলাম।”
অনুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, ” ওরা কারা ছিল ঠাম্মি ? ”
— ” তোর দাদাই যে অনাথ-আশ্রমে আজীবন দান করতেন অর্থ, বস্ত্র, পুঁথি, সেখান থেকে এসেছিল ওরা তোর দাদাইয়ের অনুরোধে”- ঠাকুমা উত্তর দিলেন।
অনুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, ” তারপর কী হল ? ”
— ” তারপর আমি সেদিন প্রত্যেক বাচ্চাকে নিজে হাতে কেক, মিষ্টি, পায়েস খাইয়েছিলাম, তোর দাদাই আমার হাত দিয়ে ওদের কিছু উপহার বিতরণ করিয়েছিলেন। তারপর থেকে যখনই বাসন্তীর কথা মনে পড়তো, ছুটে চলে যেতাম ওদের কাছে।” ঠাকুমা একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, ” তিনি আমায় বলতেন জীবনের কঠিনতম মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে অনেকসময় নিঃস্ব মনে হয় ঠিকই কিন্তু নিঃস্বতাই জীবনের শেষ নয়। কিছু জিনিস হারালে ফেরত পাওয়া যায় না কোনদিন । তাই সে জিনিস হারানোর যন্ত্রণা দীর্ঘদিন নিজের মনে পুষে রেখে তিলে তিলে দগ্ধ না হয়ে শুধু তার স্মৃতিটুকু নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করাই শ্রেয়। ” ঠাকুমা এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
অনুপ্রিয়া যেন পরিষ্কার বুঝতে পারলো কেন ঠাকুমা সবার আপত্তি সত্বেও তোতার জন্মদিন পালন করেছিলেন। অনুপ্রিয়া আবারও জিজ্ঞেস করল, ” কিন্তু সবাই বলছে আমরা দাদাইয়ের মৃত্যুর একবছরের মধ্যেই তোতার জন্মদিন পালন করে নাকি নিয়মভঙ্গ করেছি, তাই কী ঠাম্মি?”
— আমি বিশ্বাস করি নিয়ম তাদের জন্য তৈরী হয় যারা বিশৃংখল, যারা দুর্বল। আমি জানি নিয়ম ভঙ্গ করলেও শৃংখলতা আমি ভাঙিনি। তিনি জীবিত থাকাকালীন আমরা তাঁকে প্রভুজ্ঞানে সেবা করেছি, কখনো তাঁর অবহেলা করিনি তা তিনি নিজেও জানতেন। সারাজীবন ধরে হাজারো নিয়ম ভঙ্গ করলেও তাঁকে সেই একইভাবে শ্রদ্ধা করে যাব। তোতার দ্বিতীয় বর্ষের শুরু আমি সব বুঝেও কিভাবে দুঃখ-শোকের মধ্য দিয়ে শুরু করতে দিতাম? পুরাতনকে জোঁকের মতো আঁকড়ে রাখলে নূতনকে স্বাগত জানাব কী করে?আর নূতন কে না আপন করলে সামনে এগোবো কিভাবে ?
দেখ না বাড়ির সবাই কেমন আগের মতো হাসছে, ছোটরা খেলছে, মজা-ঠাট্টা করছে, তাই বলে কী সবাই তোর দাদাইকে ভুলে গেছে? আমি জানি কাজের ফাঁকে অনেকেরই সাময়িক ভাবে মনখারাপ হয় তাঁর জন্য, এমনকি অনেকে হয়তো লুকিয়ে চোখের জলও ফেলে। লোকে কী বললো তাতে কার কী-ই বা যায় আসে, যদি আমরা নিজেদের কাছে পরিষ্কার থাকি তো ?”
ঠাকুমার প্রতি অনুপ্রিয়ার শ্রদ্ধা হাজার গুণ বেড়ে গেল। ঠাকুমার আরেকটু কাছে এসে সে বললো,”আশীর্বাদ কর ঠাম্মি যেন তোমাদের মতো হতে পারি। ”
অনুপ্রিয়ার গালে হাত বুলিয়ে ঠাকুমা বললো, ” কোনও পরিস্থিতিতে যেন দুর্বল না হয়ে পড়িস, নিজে শক্ত থেকে অপরকেও যেন উঠিয়ে দাঁড় করাতে পারিস– এই প্রার্থনাই করি। যা অনেক বেলা হয়ে গেল যে, স্নান সেড়ে নে তাড়াতাড়ি…।”

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleনীরবতা
Next articleবুলেট
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments