নিরন্জন বেহেরাকে তোমরা চিনবে না। অনেক বছর আগের কথা । সালটা খুব সম্ভব ১৯৭২।আমি তখন স্নাতক পরীক্ষায় সফলহয়ে সবে একটা বিদেশী বেসরকারী সওদাগরী প্রতিষ্ঠানের চাকরীতে ঢুকেছি। চৌরঙ্গীতে অফিস। একদিন দেখি একজন বয়স্কমানুষ একটি চোদ্দ পনের বছরের রোগা লিকলিকে ছেলেকে নিয়ে অফিসে ঢুকছেন। ছেলেটির চেহারা দেখে ‘চারমূর্তির’ প্যালারামের কথা মনে পড়ে গেছিল। শুনলাম বয়স্ক মানুষটির নাম ক্ষেত্র বেহেরা। আমাদের দপ্তরের খানসামা, চাপরাসী, পিওনবলতে যা বোঝায় এককথায় তিনি নাকি সবই।
উড়িষ্যার কেন্দ্রাপাড়ার পাট্টামুণ্ডাই গ্রামে তাঁর বাড়ী।ছুটিতে বাড়ী গিয়েছিলেন। আড়াই মাস বাদে ফিরেছেন। তখনকার দিনেএরকমটাই চল ছিল। এইসব প্রবাসী মানুষেরা একবার ছুটিতে বাড়ি গেলে দু তিন মাসের আগে ফিরতেন না। আর তখন যাঁরাঅফিসের কর্তাব্যক্তি ছিলেন তাঁরাও এ ব্যাপারগুলি মেনে নিতেন। যাই হোক, ক্ষেত্রদার সাথে ঐ ছেলেটি কে ! সবারই খুবকৌতুহল। দেখে ত’ মনে হয় একেবারেই গ্রাম্য, বোকাসোকা। জানা গেল ক্ষেত্রদা নাকি আর কাজ করবেন না। তাঁর জায়গায়বহাল করার জন্য ঐ ছেলেটিকে নিয়ে এসেছেন। ছেলেটি তাঁর আপন ভাইপো। তখনকার দিনে চাকরি অনেক সময় এভাবেই হত।এত নিয়মকানুন ছিল না। বড় সাহেবের মুখের কথাই ছিল আইন।
আমাদের অফিসের যিনি বড়কর্তা ছিলেন তিনি ছিলেন ইউরোপিয়ন।তখনো আমাদের দেশের বিদেশী প্রতিষ্ঠান গুলিতে কিছুকিছু ইউরোপিয়ন, আমেরিকান কর্তার দেখা মিলত। দশাসই চেহারা আজ বাজখাঁই কণ্ঠস্বর, কিন্তু মানুষটি মোটের ওপর খারাপছিলেন না।সেই বড়কর্তা অ্যাশ্টন সাহেবের সাথে ক্ষেত্রদার কি কথা হল জানি না, কিন্তু পরদিন থেকে তাঁর ভাইপো নিরন্জনকাজে বহাল হয়ে গেল।
নিরন্জন ত’ কাজে বহাল হল। কিন্তু থাকবে কোথায় ! কেষ্টদা যেখানে থাকতেন শ্যামবাজারের সেই ‘মেসটা’ নাকি বন্ধ হয়ে গেছে।‘মেস’ মানে জানো ত’ । ‘মেস’ হল সস্তায় একসঙ্গে অনেক লোকের খাবার ও থাকবার জায়গা। তখনকার দিনে কলকাতারবিভিন্ন এলাকায় অনেক ‘মেস’ ছিল যেখানে কলকাতার বাইরে এমনকি বাঙলার বাইরের লোকেরা যাঁরা কলকাতায় চাকরিবাকরিকরতে আসতেন, তাঁরা থাকতেন।আমিও সেই সময় ভবানীপুরে ঐরকম একটা ‘মেসে’ থাকতাম। কারণ আমার বাড়ি ছিলকলকাতা থেকে অনেক দূরে।
পরের দিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখি ক্ষেত্রদা অফিসে আমার জন্য নির্দিষ্ট দেরাজের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন-“দেখোবাবু, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়নি বটে, কিন্তু অনেকের মুখেই তোমার খুব প্রশংসা শুনেছি। তুমি খুব করিতকর্মা, চটপটে আর সেইসাথে মহা উপকারী ছেলে। তা বাবা, দেখো না যদি আমার ভাইপো নিরন্জনের একটা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পার।শুনেছ ত’ সে শ্যামবাজারে আমি যেখানে থাকতাম, সেই বাড়িটা মালিক ভেঙে দিয়েছে। আমি জানি যে তুমি ভবানীপুরে একটা‘মেসে’ থাক। দেখ না বাবা, যদি কিছু করা সম্ভব হয়। বাপ মা মরা ছেলেটার জন্যে আমার খুব চিন্তা।”
ক্ষেত্রদার কথায় আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঐটুকুন বয়সে ছেলেটা বাবা মাকে হারিয়ে বিদেশ বিভুঁইতে এসে পড়েছে পেটেরটানে। কিছু ত’ করা দরকার অবশ্যই। আমি ক্ষেত্রদাকে অভয় দিয়ে বললাম-“চিন্তা করবেন না, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
‘মেসের’ কর্তা তুলসীদাকে বলে নিরন্জনের একটা মাথাগোঁজার ঠাঁই আর দুমুঠো আহারের ব্যবস্থা করে দেওয়া গেল। আপাততচিলেকোঠায় একটা ঘরই হল তার ঠিকানা। ক্ষেত্রদা ত’ আমায় অনেক আশীর্বাদ করে উড়িষ্যার গ্রামে ফিরে গেলেন। কিন্তু কেজানত যে নিরন্জনের ঠিকানা ঠিক করে দেওয়ার ফলে আমাকে নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে যাবে !
কদিন পরের ঘটনা। ভোর পাঁচটা নাগাদ হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। ছাদের ওপর থেকে আওয়াজটা আসছে বলে মনেহল। অনেকেই দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওপরে উঠছেন। কি ব্যাপার ! ওমা ছাদে উঠে দেখি চিলেকোঠার ঘর থেকে চিলচিৎকারের রব আসছে।ভাল করে শুনে বুঝলাম নিরন্জন উড়িয়া ভাষায় গান গাইছে। তারই আওয়াজ। ‘ আজি সকালু অজানাএ শহরে মাহি রে
দোলা রে দোলা রে।’ সংগে একটা ভাঙা হারমোনিয়মোর ভয়ঙ্কর শব্দ।’ আজ সকালে অজানা এ শহরে মনে বুঝি তার দোলালেগেছে। অনেক কষ্টে তাকে থামান গেল। বললাম-“বাবা, তোমার গান ত’ একেবারে ‘জি.ইউ.এন’ গান।হৃদয়কে এ ফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।দয়া করে ক্ষ্যামা দাও।” নিরন্জন ভাঙা ভাঙা বাঙলা আর উড়িয়া ভাষার জগাখিচুড়িতে যা বললে তারতর্জমা করলে এটাই দাঁড়াল – “বাবু সকালে গান গাউছিলা অনেকদিন। কোলকত্তা আসি গাইতে না পারি মনে খুব কষ্ট পাইছিলা। তাই গান করুছি।” আমাদের ত’ শুনে চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। এরকম গান যদি রোজ গায় তাহলে ত’ আমাদের অবস্থাসঙ্গীন হয়ে যাবে। তখন তুলসীদা হাত জোড় করে বললেন যে সকালে যদি গান গাইতেই হয় বাবা, তাহলে কিছু দূরে একটা মাঠআছে।ওখানে গিয়ে গাইবে। কিন্তু এখানে আর দয়া করে গান গেয়ো না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি।
কে জানতো তুলসীদার কথাটা নিরন্জন সত্যি বলে ভেবে নিয়েছিল। দিন দুয়েক বাদে ঐরকম একদিন কাকভোরে আমার ‘মেসের’ ঘরের দরজায় ধাক্কার পর ধাক্কা। দরজা খুলে দেখি তুলসী দা, আমাদের ‘মেস’ বাড়ির সহকারী নৃপতিদা এবং আরও কয়েকজনযেমন ভানুদা, হরিদা, শীতলদা সবাই আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সকলেরই যেন চোখে মুখে একটা উৎকণ্ঠা। আমিজিজ্ঞাসা করলাম – “ কি হল, এত ভোরে সবাই আমার কাছে কেন ! নৃপতিদা বললেন-“যাও বাবু, নিরন্জনকে উদ্ধার কর। সেহাজরা পার্কে গান গাইতে বসেছে।” শুনেই আমার ভিরমী খাবার জোগাড়।কোনক্রমে সামলে নিয়ে ছুটে গেলাম মাঠে। সাথেশীতলদারা সবাই। দেখি ব্যাটা নিরন্জন সেই ভাঙা হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেদিনের মত চিৎকার করে গান গাইছে। ‘জীবনেরোশেষো বন্ধু , ডুব দিব সমুকা সিন্ধু’। মানে জীবন শেষ হয়ে গেছে , এবার সাগরে ডুব দেব। বুঝলাম ওর জীবন শেষ না হোক , আমার জীবন শেষ হতে চলেছে। গোটা দশেক নেড়ী কুত্তা তার গানের সাথে তাল মিলিয়ে সঙ্গত দিচ্ছে। আর কয়েকজনপ্রাতর্ভ্রমণকারী দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কানে হাত দিয়ে। হঠাৎ দেখি দুজন সিপাই হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। নিরন্জনকে গ্রেপ্তার করেআর কি ! তারপর দেখি গুপী গাইন বাঘা বাইনের রাজার মত তার হারমোনিয়ামটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে গেল একজন পুলিশ। কিন্তুনিরন্জন সেটা হতে দেবে কেন ! সঙ্গে সঙ্গে সে বাধা দিল। ফলত তার গায়ে দুচারটে কিল থাপ্পড়। অবস্থা খুবই বেগতিক। আমিদেখলাম আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। ব্যাটাকে বাঁচানো দরকার। অতএব সিপাই বাহাদুরদের কাছে গিয়ে অনেকবুঝিয়েসুঝিয়ে সাধ্যসাধনা পূর্বক চা জলখাবারের জন্যে কিছু টাকা পয়সা দিতে তবে তাঁরা বিদায় নিলেন। এবার নিরন্জনকেধমক ধামক দিয়ে বগলদাবা করে অবশেষে মেসে ফিরে এলাম সকলে। তবে তাকে সাবধান করে দিলাম যে সে যদি আবার গানগায় তাহলে তার জেলে যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।
ধমক ধামকের জন্যেই হোক আর জেলের ভয়েই হোক, নিরন্জন বাবু এবার থেকে বেশ শান্তই হয়ে গেলেন। শুধু একবার খুবশীতের সকালে আমার ঘরে এসে তার কি কান্না। বলে-“বাবু, আমার পেটে আগুন নাগুচি। হাঁ করুচি ত’ ধূঁয়া বের হয়, প্রস্রাবকরুচি ত’ সেই ধূঁয়া। বাবু, আমি কি করিবি। আমি মরি যাবি।” বলে তার কি কান্না। তার কান্নার আওয়াজ শুনে আশেপাশের ঘরথেকে সবাই হাজির। তারপর তার কথা শুনে হাসতে হাসতে সবার পেটে খিল ধরে যাবার জোগাড়।
এদিকে আমাদের হাসতে দেখে নিরন্জন বাবুর বোধ হয় রাগ হয়ে গেল। গজগজ করতে করতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।” সবাইহাঁসুচি।আমার পেটে আগুন নাগুছি। আর বাবুরা মজা করিছেন।” বুঝলাম নিরন্জন কেবল অজ পাড়াগাঁ থেকে আসেনি, তারমাথাটি একেবারেই নিরেট। তাকে বোকা বললেও কম বলা হয়, সে একটি আস্ত গবেট। পরে নিরন্জনকে সব বুঝিয়ে বলেছিলাম।সে আমার কথা বিশ্বাস করেছিল কিনা বলতে পারবো না, তবে তারপর থেকে নিরন্জনের জন্য ‘মেস’ বাড়িতে আমাকে আর কোনদুর্ভোগ পোহাতে হয়নি।
কিন্তু এবার অফিসে শুরু হল তার কেরামতি । আমাদের দপ্তরের বড়বাবু ছিলেন শ্রীযুক্ত ধুরন্ধর পাকড়াশী। নামটিও যেমন, কাজেও তেমন। একবার যাকে পাকড়াও করবেন তার দফারফা। সেই ধুরন্ধর পাকড়াশী দেখি একদিন সকালে এসে তর্জন গর্জনকরছেন।তাঁর টেবিলের ওপরে বেশ কিছু কাগজ ছিল। সেগুলি নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিরন্জন সকালে রোজ সবার টেবিলঝাড়পোঁছ করে। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে যা বললে তার অর্থ এই যে সবার টেবিলে সেরকমভাবে কোনো কাগজ থাকে না, কিন্তুপাকড়াশী বাবুর টেবিলে মেলাই কাগজ। এই বিষয়টা তার একেবারেই পছন্দ নয়। তাই সব কাগজ সে বাইরে ঝুড়িতে ফেলেদিয়েছে। ধুরন্ধরের ত’ মাথায় হাত। সব দরকারী কাগজ। অনেক খুঁজে পেতে ঝুড়ি থেকে সব কাগজ আবার নিয়ে আসা হল।ভাগ্য ভাল যে সে কাগজপত্র সব ছিঁড়ে ফেলেনি।তাই রক্ষে।নয়তো হয়েছিল আর কি ! সেই সংগে যদি পুরসভার সাফাইওয়ালাএসে যেত তাহলে আর কোন কাগজেরই টিকিটিও আর খুঁজে পাওয়া যেত না। পাকড়াশী ত’ নিরন্জনকে মেরেই ফেলেন বুঝি।অনেক কষ্টে তাঁকে সামলানো গেল। কিন্তু তিনি নিরন্জনের ওপর হাড়ে চটা হয়ে রইলেন। তবে সেদিন থেকে বাড়ী যাবার সময়ধুরন্ধর তাঁর সমস্ত কাগজ দপ্তরের একটা আলমারীতে রেখে দিয়ে যেতেন । বুঝলাম–নিরন্জন কিন্তু বড়বাবুর একটা অভ্যাসে বদলএনে দিয়েছে। আমরা তখন নিরন্জনকে একটা বুদ্ধি দিলাম।বললাম-“ নিরন্জন, তুমি প্রতিদিন বড়বাবুকে সেলাম দেবে। সেশুধালে– “সেলামের মানে কি হচ্ছি”।আমরা বললাম–নমস্কার।
ব্যাস, শুরু হয়ে গেল। সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা যখনই নিরন্জন বড়বাবুর মুখোমুখি হচ্ছে তখনই সে বলা শুরু করে দিত – “বাবু, নমস্করো অছি।” প্রথম প্রথম হয়তো ধুরন্ধরের বেশ ভাল লাগছিল।কিন্তু তারপর পুরো ব্যাপারটা একেবারে চরমে উঠতেশুরু করলো। একদিন দুপুরবেলা ধুরন্ধর দেখি হন্তদন্ত হয়ে ওঁর চেয়ারে এসে বসলেন। চোখমুখ সব লাল, রাগে থমথম করছে।মনে হল তিনি নিরন্জনকে কাছে পেলে চিবিয়েই খেয়ে নেবেন। অনেক কষ্টে তাঁকে শান্ত করা গেল।কিন্তু আর একটা ঘটনায়নিরন্জনের সঙ্গে পাকড়াশীর যুদ্ধ ভয়ংকর দিকে মোড় নিল।
একদিন পাকড়াশী নিরন্জনকে ডেকে একটাকার চারটি মুদ্রা ভাঙিয়ে আনতে দিলেন।তখন ত’ ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২০ পয়সারমুদ্রার প্রচলন ছিল। এমনকি ২ পয়সা, ১ পয়সারও মুদ্রাও পাওয়া যেত। তা নিরন্জন গেল ত’ গেল। আর আসে না। প্রায়ঘণ্টাখানেক বাদে নিরন্জনের উদয়। আমরা সবাই জিজ্ঞাসা করলাম-“এত দেরী হল কেন !” সে যা বললে শুনে সবার চক্ষুস্থির।আর বড়বাবুর ত পাগল পাগল অবস্থা। সে বাংলা আর উড়িয়া ভাষা মিশিয়ে যা বললে তার মর্মার্থ হল এই যে সে মুদ্রা চারটিনীচের ‘লেদ মেশিনের’ কারাখানায় ভাঙাতে নিয়ে গেছিল। মেশিনে একটা অন্য কাজ হচ্ছিল কিনা, তাই তার এত দেরী। এইবলে সে পকেট থেকে একটা কাগজের মোড়ক বড়বাবুর হাতে দিল। কাগজটা খুলে দেখা গেল যে তার ভেতর ঐ দুটো একটাকারমুদ্রার বেশ কয়েকটি ভাঙা টুকরো রয়েছে। নিরন্জন আবার জিজ্ঞাসা করলো-“ কি বাবুরা, ঠিকমত ভাঙানো হয়েছে ত’ বাবুরা ! “ আমরা ত’ তার কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারলাম না। ইতিমধ্যে ধুরন্ধর একেবারে পাগলের মত ছুটে বেরিয়েবোধ হয় উপরের তলে চলে গেলেন যেখানে অ্যাশ্টন সাহেবের ঘর।কিছুক্ষণ বাদেই বড়সাহেবের বাজখাঁই গলার অট্টহাসি শোনাগেল। আর পাকড়াশীকে দেখলাম নীচে নেমে এসে মাথায় বেশ কিছুটা ঠাণ্ডা জল দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।এরপর থেকে তিনিআর নিরন্জনকে ঘাঁটাতে সাহস করতেন না। আর আমরাও নিরন্জনকে বলে দিলাম যে
বড়বাবুকে আর সেলাম দেবার কোনো দরকার নেই।
এরপর কিছুদিন বেশ শান্তিতেই কেটে গেল। কিন্তু তারপর ঘটনা অন্যদিকে মোড় দিল। ঘটল এক আজব ঘটনা আর তাও সেইনিরন্জনকেই ঘিরে। তখন ত’ কম্পিউটারের যুগ নয় । স্টেনো টাইপিস্টের যুগ। আমাদের দপ্তরে এক দশাসই চেহারার অ্যাংলোইণ্ডিয়ান মেমসাহেব স্টেনোগ্রাফার ছিলেন। মিসেস অ্যাডামস্। তাঁর বরের স্কুটারের পিছন বসে রোজ আসা যাওয়া অফিসে। বরেররোগা পাতলা চেহারা। অথচ মিসেস অ্যাডামস্ একেবারে বিপরীত। যখন স্কুটারের পিছনে বসতেন তখন একটা দৃশ্য হত বটে ।যেমন লম্বা চওড়া চেহারা, তেমনি মোটাসোটা। তার ওপর গোল গোল লাল চোখ, চুলগুলো ‘বয়কাট’ করা।তাই আড়ালে তাঁকেআমরা জলদস্যু বলে ডাকতাম।তিনি আবার বড়কর্তা অ্যাশ্টন সাহেবের অত্যন্ত প্রিয়পাত্রী ছিলেন।
সেদিনটা ছিল সোমবার। অ্যাডামস্ দু সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে সবে অফিসে এসেছেন।একটু সকাল সকালই এসেছেন।আর এসেই দেখেন তাঁর টেবিলে সাধের টাইপ মেশিনটি নেই। মেশিনটা পুরোনো হলেও খুব ঝকঝকে ছিল। আর জলদস্যুর খুব আদরেরছিল মেশিনটা। তিনি সবসময় মেশিনটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতেন। সেই টাইপ মেশিনটা পাওয়া যাচ্ছে না।আমরা অফিসেএসে দেখি একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে দপ্তরে। খোঁজ খোঁজ। মেশিনটা চুরি হয়ে গেল নাকি ! শনিবারও বাড়ী যাবার সময় দেখেগেছি টাইপ মেসিনটা মেমসাহেবের টেবিলে যথারীতি রাখা আছে। তাহলে !
নিরন্জনকে দেখলাম চুপচাপ দরজার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
কেমন যেন সন্দেহ হল। একটু চাপাচাপি করতেই সে বলে ফেললে-“বাবু, ওই যন্তরটাতে ত’ মেলা ধূলা জমি গিলা। তাই ওটারেধৌত করি ধাঁইকিরি ধাঁইকিরি ছাদে শুখাতে দিয়ে আসুচি। অ্যাডাম মেমসাব ত’ ছুটি বাদে যখন আসিবি দেখিবি যে যন্তরটা কেমনঝকঝকে হইলা।হুড়মুড় করে সবাই ছাদে উঠে দেখি মিস অ্যাডামসের সাধের টাইপ মেশিনটা উল্টো করে ছাদের পাঁচিলের ধারেদাঁড় করানো একটা বাঁশের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝোলান আছে।আর যন্তরটা থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। অক্ষর, চিহ্ণ সবপ্রায় ধুয়ে মুছে সাফ। এককথায় তার দফারফা। মিস অ্যাডামস্ দেখে শুনে প্রায় মুর্ছা যান আর কি ! অনেকক্ষন বাদে একটু ধাতস্থহয়ে “ও মাই গড, ও মাই গড” বলতে বলতে নিরন্জনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। বুঝলাম তিনি অ্যাশ্টনসাহেবের ঘরে গেলেন।
তারপর কি হল জানি না। আমরা ভেবেছিলাম টাইপ মেশিনের সাথে সাথে নিরন্জনেরও দফারফা হল। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাইদিয়ে নিরন্জনের উন্নতি হল। মানে তার তলোন্নতি হল। হয়ত বড়সাহেব অসহায় ছেলেটিকে ভালবেসে ফেলেছিলেন। তাই সেসরাসরি তাঁর ঘরের সামনে বহাল হল। অর্থাৎ দোতলা থেকে সরাসরি তিনতলায়। এবং সকলকে অবাক করে দিয়ে সে সেখানেবহাল তবিয়তে থেকে গেল। কোন ঝুটঝামেলা নেই। সবাই ভাবলাম অ্যাশ্টন সাহেবের পাল্লায় পড়ে নিরন্জনটা এবার সত্যিইমানুষ হয়ে গেল। শুনলাম বড়সাহেব নিরন্জনের কাজে খুব খুশী। সে আবার নাকি ইংরাজী শিখেছে। তাই তার মাইনে বেড়েগেছে।
কিন্তু মাসছ’সাত বাদে এক আজব ঘটনায় সব হিসেব ওলটপালট হয়ে গেল। মনে হয় সেদিনটা ছিল শনিবার।
অ্যাশ্টন সাহেবের স্ত্রী লণ্ডন থেকে সবে কলকাতায় এসেছেন।দুপুরবেলা তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে অফিসে ঢুকেছেন।অফিসে ঢুকে আমার সঙ্গেই তাঁর দেখা। আমি ত’ কোনদিন তাঁকে দেখিনি বা তিনি যে বড়কর্তার স্ত্রী জানতামও না। তাঁর হাতেআবার একটা ছোট্ট সাদা কুকুর। ত’ তিনি আমায় তাঁর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন–বাবু , আমি অ্যাশ্টন সাহেবের পত্নী আছি।সাহেবকে কুঠায় পাব !” তাঁর মুখেই শুনলাম যে খারাপ আবহাওয়ার কারণে তাঁর বিমান অনেক দেরীতে পৌঁছাইয়াছে দমদম। তাইসাহেব বিমানবন্দরে যাইতে পারেন নাই, তবে বিমানবন্দরে কোন্ম্পানীর গাড়ি তাঁকে নিতে গেছিল।বড়কর্তার স্ত্রী বলে কথা। তাইতিনি সরাসরি অফিসে এসেছেন। তখন বড় সাহেবদের ঘরে যেতে আমার মত ছোটখাটো কর্মচারীদেরও এখনকার মতবাধ্যবাধকতা ছিল না। আমি তাঁকে সঙ্গে করে অ্যাশ্টন সাহেব ঘর যেখানে সেই দোতলায় নিয়ে গেলাম। ঘরের সামনে নিরন্জনবসে ছিল।মেমসাহেবকে আরাম কেদারায় বসিয়ে তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে আমি নিরন্জনকে বললাম-“সাহেবকে খবর দাও, নিরন্জন।তাঁর স্ত্রী এসেছেন লণ্ডন থেকে।” কিন্তু সে বলল–সাহেব এখন কাম করিছেন। এখন দেখা হবি নি।” আমি যতই তাকেবোঝাই, কিন্তু তার একটাই জবাব-“এখন দেখা হবি নি।” এ ত’ ভারী মুস্কিলে পড়া গেল। তখন মেমসাহেব দেখি নিজেই রেগেমেগেউঠে এসে নিরন্জনকে বললেন-“তুমি এইক্ষণে সাহেবকে খবর ডাও। বোলো তাঁর ওয়াইফ আসিয়াছেন লণ্ডন হইটে।” কিন্তুনিরন্জন ত’ অ্যাশ্টন সাহেবের স্ত্রী কে চেনে না। সুতরাং কেন তাঁকে সাহেবের ঘরে ঢুকতে দেবে ! সে এবার মেমসাহেবের দিকেতাকিয়ে ইংরেজীতে বললে– “সাহেব ওয়ার্কিং । নো কলিং।” আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছি না, এমন সময় দেখিঅ্যাশ্টন সাহেব নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হয়ত চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে থাকবেন । তারপর ত’ ওয়াইফকেদেখে তিনি আহ্লাদে আটখানা। “হ্যালো ডার্লিং , মাই ডিয়ার ওয়াইফ, মাই ফেয়ার লেডী, মাই সুইটি এমিলি –এইসব বিভিন্নবিশেষণে স্ত্রীকে ভূষিত করে তাঁর হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলেন।
আগেই বলেছি অ্যাশ্টন সাহেবের স্ত্রীর কোলে একটা ছোট্ট সাদা কুকুর ছিল। সে মনে হয় এতক্ষণ তাঁর কোলে ঘুমিয়ে ছিল।এইসব আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে সে নিরন্জনকেই প্রথম সে দেখতে পায়।নিরন্জনের ফড়িঙের মত চেহারাটাদেখে সে ফিক করে হেসে তার মালকিনের কোল থেকে নেমে নিরন্জনকে তাড়া করলো। আর নিরন্জন তখন-“সারমেয় মুকে দেখিহাঁসুছি আবার মুকে তাড়া করুছি “ – এই কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে একেবার পগারপার। কিন্তু সেই যে সে চলেগেল আর ফিরে এল না। তার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া গেল না। কেবল একজন নাকি তাকে হাওড়া স্টেশন যাবার ট্রামে উঠতেদেখেছে বলে সোমবার দিন খবর পেলাম। তখন অফিসের উল্টোদিকে চৌরঙ্গী দিয়ে শ্যামবাজার–হাওড়া স্টেশন–শ্যামবাজার ট্রামচলাচল করতো। কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হলো না। নিরন্জন যে কলকাতার কিছুই চিনত না সে কিনা হাওড়া স্টেশনে চলে গেল ! তাজ্জবব্যাপার । তবে কি সে বাডী ফিরে গেছে ! এমনকি ভবানীপুরের ‘মেসে যেখানে সে থাকতো সেখানেও তার পদার্পণ ঘটল না তারফেলে যাওয়া জিনিসপত্র নেবার জন্য। অফিস থেকে পার্কস্ট্রীট থানায় খবর দেওয়া হল। কিন্তু সুরাহা কিছু হলো না। পুলিশ এসে‘মেসে’ তার ঘরটা তালাচাবি দিয়ে গেল, আর আমাকে বলে গেল যে কোন খবর পেলে থানায় জানাতে।একটা জলজ্যান্ত ছেলেকিনা দিনের আলোয় একেবারে উপে গেল। অ্যাশ্টন সাহেবও দেখলাম খুব চিন্তিত। আমার সঙ্গে দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করতেন-“বাবু , নিরন্জনের কিছু খবর পাইয়াছ ! “ আমি আর কি বলবো ! নতমস্তকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
এই ঘটনার পর প্রায় তিনমাস অতিক্রান্ত।হঠাৎ আমার নামে একটা চিঠি এসে হাজির উড়িষ্যার কেন্দ্রপাড়া থেকে। তাড়াতাড়িখাম খুলে দেখি এ যে ক্ষেত্র বেহেরার চিঠি। নিরন্জন তার উড়িষ্যার গ্রামে ফিরে গেছে। সে আর কলকাতায় আসবে না, কাজওকরবে না। তার মতে “কলকাতার লোকেরা নাকি বড় দুষ্ট অছি।” চিঠিটা পড় অফিসে হৈচৈ পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাশ্টনসাহেবকে খবর দেওয়া হল । তিনি ত’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। পার্কস্ট্রীট থানাতেও নিরন্জনের উড়িষ্যা ফিরে যাওয়ার সমাচার সঙ্গেসঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হল।
ক্ষেত্র বেহেরার চিঠি পড়ে যেটা জানা গেল নিরন্জন নাকি সবথেকে অপমানিত হয়েছিল অ্যাশ্টন সাহেবের পত্নীর কোলে থাকাকুকুরটির ব্যবহারে। সে কেবল নিরন্জনকে তাড়াই করেনি, তাকে দেখে নাকি হেসেওছিল। তাই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে সে আরকোনদিন কলকাতায় আসবে না। কারণ তার কাছে টঙ্কার চাইতে সম্মানো অনেক দামী।
কুকুর কারোকে দেখে হাসে কিনা জানিনা। পরে অবশ্য পরম শ্রদ্ধেয় বরেণ্য সাহিত্যিকে শ্রী সত্যজিৎ রায়ের ‘অসমন্জ বাবুর কুকুর’ গল্পে কুকুরের হাসির কথা পড়েছিলাম। কিন্তু সেটা ত’ ছিল নিছক গল্প। আর নিরন্জনের ঘটনা স্বয়ং চাক্ষুষ দেখা। কুকুরটারহাসিমুখ আমিও দেখেছিলাম আর তার খুকখুক করে হাসির শব্দ ত’ এখনো আমার কানে বাজে। কেউ বিশ্বাস করবেনা বলেএতদিন বলিনি। যদি মোবাইল ফোন থাকত তবে সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই রেকর্ড করে রাখতাম। আর এটাও সত্যি কথা যে কুকুরযদি কারোকে দেখে হাসে তবে তার খারাপ লাগতেই পারে । অতএব নিরন্জনের খারাপ লাগাটা কোন দোষের নয়।
আরো প্রায় মাস দুয়েক বাদে যখন ক্ষেত্র বেহেরা ‘মেস’ থেকে নিরন্জনের জিনিসপত্র নিতে এসেছিলেন তখন কথায় কথায়নিরন্জনের প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন – বাবু ছেলেটা ভালই আছে। এখন চাষবাসে বেশ মন হয়েছে । তবে একটা ব্যাপার আমাকেখুব ভাবাচ্ছে।আমি হেসে শুধালাম – “ বুঝেছি, ও মনে হয় কুকুর দেখলে তাড়া করে, তাই না !” ক্ষেত্রদা বললেন-“ হ্যাঁ বাবু ঠিকধরেছ, কুকুর দেখলেই সে হাসতে হাসতে তাদের পেছনে তাড়া করে। তাই গ্রামের লোকেরা কেউ কেউ বলে কোলকাতা থেকে আসারপর ওর মাথাটা একটু খারাপ হয়ে গেছে।কিন্তু আমি মোটেই বিশ্বাস করি না সেসব কথা। ও ত’ অন্য সময় বেশ ভালই থাকে, শুধুকুকুর দেখলেই ঐরকম করে ।” আমি হাসতে হাসতে বললাম – “ ও আপনি কিছু ভাববেন না। নিরন্জন অপমানের বদলানিচ্ছে।” ক্ষেত্রদা মনে হয় একটু আশ্চর্য হলেন, কিন্তু আর কিছু বললেন না।
সেই ক্ষেত্রদার সঙ্গে শেষ দেখা। ক্ষেত্রদা সম্ভবত আর ইহলোকে নেই, কিন্তু নিরন্জন বেহারা নিশ্চয়ই এখনো জীবিত। সে কোথায়আছে, কেমন আছে , কুকুরদের ওপর তার প্রতিশোধের বৃত্ত সম্পূর্ণ হল কিনা কিছুই জানি না। তবে আজ এত বছর পরেও যখনতার কথা মনে পড়ে তখন আর হাসি চাপতে পারি না । সত্যিই এই পৃথিবীতে এমন কত অদ্ভুত চরিত্র আমাদের চারপাশে নিয়তইঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনতরো আরো একজনের কথা স্মৃতিপটে চির জাগরুক হয়ে আছে। ভূতনাথ মশাট। তবে তার কথা তোমাদেরবলব অন্য আর এক দিন। আজ এখানেই ইতি।