মাথাটা অল্প একটু বাঁ দিকে হেলিয়ে সম্মতি জানাল তৃষা । দূর্বা আর সমর দু’মাস ধরে বেঙ্গলী ম্যটরিমনী থেকে খুঁজে মেয়ের জন্য সাম্যেকে শর্ট লিস্ট করেছেন । অনেকদিন টালবাহানা করে শেষে তৃষাকে আসতেই হল সাম্যর সাথে দেখা করতে । কথাবার্তা অনেকটাই একতরফা চলছিল । সাম্য, তৃষার প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই নিজের কাজ, অভ্যাস, সখ, স্বপ্ন নিয়ে অনেককিছু বলে গেল । হঠাৎই সাম্য জানতে চাইল তৃষারা কয় ভাই বোন ? তৃষা সাবলীল ভাবে জানাল ওরা এক ভাই আর এক বোন ‘দুজন’ ।উওরটা দিয়েই তৃষা চমকে উঠল। গত এক বছরে এ প্রশ্নটা এই প্রথমবার কেউ জিজ্ঞেস করল।
হঠাৎই সাম্য তৃষার লেখালেখি নিয়ে আলোচনা শুরু করল। তৃষা চাকরির অবসরে অল্প সল্প লেখালিখি করে ।ফেসবুকের বিভিন্ন লেখালেখির দপ্তরে নিয়মিত পোস্ট করে। কিছু লেখা অবশ্য সংবাদ পত্রেও প্রকাশিত হয়েছে । সাম্য যে এত হোম ওয়ার্ক করে মেয়ে দেখতে আসবে সেটা তৃষা অবশ্য কল্পনা করেনি।লেখালেখির প্রসঙ্গ ওঠায় তৃষার একটু সস্তি হল।কারণ এ নিয়ে কথা বললে বিষয় বস্তুর অভাব হয় না।সাম্য জানাল তৃষার শেষ ছোটগল্পটা ওর বেশ ভাল লেগেছে । ওর শেষ লেখাটা ছিল সদ্য যৌবনে পা রাখা একটি ছেলের ডাইরির শেষ কয়েকটি পৃষ্ঠা ।
হঠাৎই নেফ্রাইটিসে আক্রান্ত সচ্ছল পরিবারের এই ছেলেটি ।মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে দেশ বিদেশের ডাক্তার ।ও জেনে গেছে দিন ফুরিয়েছে ওর।সি এ ফাইনাল ইয়ারে বই গুলো আর পড়ে না । কিছুদিন জাবত গীতা পড়তে শুরু করেছে । অফুরন্ত অবসর । বই পাগল নাতিটিকে একটু বেশী স্নেহ করতেন দাদু। দাদুকে ইংরেজীতে চিঠি লিখে লিখে ইংরেজি শিক্ষা পুরোদমে চলছে । এ মারন রোগের কথা জানানো হয়নি তাঁকে ।বয়সের ভারে দাদু কলকাতা আসার ক্ষমতা হারিয়েছেন ভাগ্যিস! তাই সব কাছে থাকা প্রিয় মানুষগুলোর মত প্রতিদিন অনুচ্চারিত সমবেদনা আর নীরব অশ্রু বর্ষন করেন না। ইংরাজী ভুল লিখলে ফোন করে ধমকও দেন আবার । বেশ লাগে ওর। আজকাল ওকে আর কেউ বকে না, দিদির সাথে ঝগড়া হয় না, মা কোন অভিযোগ করে না, কেরিয়ার বা নতুন পড়া বই নিয়ে কেউ আর আলোচনাও করে না।
ছুটির দিনগুলোতে দূর দূর থেকে আত্মীয় স্বজনেরা দেখতে আসে আর ফিরে যাবার সময় করূন ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ।ওদের সবার চোখের ভাষা একটা কথাই বলে ‘এ দেখা শেষ দেখা নয় তো ? ‘ তারপর একদিন ডায়েরির পাতাগুলিতে কলমের আচর পড়া বন্ধ হল। ডাইরিটা শেষ করল ওর দিদি। যে দিদি একসময় ভগবানের কাছে ভাইয়ের আরোগ্য কামনা করতে করতে ভগবানের উপর আস্থা হারিয়েছিল, সেই দিদিই ভাইয়ের মৃত্যু ত্বরান্বিত করার জন্য আবারও ভগবানের স্মরণাপন্ন হয়েছিল । করুণাময়ী ঈশ্বর দ্বিতীয়বার অবশ্য তাকে হতাশ করেননি।
গল্পটা মর্মস্পর্শী হয়েছে বলে অনেকেই জানিয়েছিলেন আগে তৃষাকে । সাম্য জানায় মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে অনেক লেখা পড়লেও মৃত্যু পথযাত্রীর মনের এদিকটা নিয়ে লেখা ও আগে কখনো পড়েনি আর ভাবেও দেখেনি। তৃষা ঠিক বুঝতে পারছিল না পাঠকের ভালো লাগার জন্য ওর আনন্দ হওয়া উচিত , না গল্পটা অনুভব করে পড়ার জন্য ওর সাম্যকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত?
চৌরাস্তার মোড়ে গাড়িটা থামল । সাম্যকে বিদায় জানিয়ে স্লথ গতিতে তৃষা বাড়ির দিকে হাটছে । তৃষার সমস্ত মন জুড়ে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এখন ‘ কি ওরা আর দুজন নয় ? যে শুধুই সমস্ত অনুভূতি জুড়ে প্রবল ভাবে বর্তমানে থাকে সে কি সব গুনতিরই বাইরে? ‘

 

~ দুজন না একজন ? ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleজগৎ জোড়া জাল
Next articleAaj Basanta
Koyel Dutta
Koyel Dutta (Female) Profession - Chemical Engineer Staying in Mumbai, India
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments