Go to Part 1
… বাবা কে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় কোন রকম ত্রুটি রাখেনি মহাদেশ কিন্তু কোন ভাবেই সে তার বাবাকে নিয়ে যাওয়া তো দূর তার কাছটিতে যেতেও পারে না আর। সেদিন তার বাবা বলেছিল যে গাঁ থেকে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই সে এখানে কোন এক দলের ড্রাগ ডিলিং এর সাথে জড়িয়ে পরে, তাদের দয়াতেই বাবার এই আরাম আয়েশের জীবন যাপন। কিন্তু এখানে এসে এই সমাজ বিরোধী কাজের সাথে জরিয়ে বাবার আদপ কায়দা থাকা খাওয়ায় আমূল পরিবর্তনের সাথে সাথে তাকে তার গ্রাম, পরিবার এমন কি নিজের সেই চেনা মাটির মানুষটিকে ও ঝেড়ে ফেলতে হয়। আরাম আয়েশের পাশাপাশি এখানে রয়েছে বিপদ পদে পদে। তার পরিবার বর্গের এমনকি তার ছেলে এখানে এসেছে জানা গেলেও তাদের ওপর হামলা করে তার বাবা কে বিপদে ফেলতে পারে বাবার বিপক্ষ্যের দল গুলি, সে যতক্ষন এই ঘরটিতে আছে ততক্ষন তার প্রাণ বায়ু চলছে এই বদ্ধ জীবনের বাইরে পা রাখলেই তাকে জীবনে বেচে থাকার আশা ত্যাগ করতে হবে। খুব অল্প দিনেই মহাদেশের বাবা ওই এলাকায় ওই দলটার একটা মাথা হয়ে ওঠে এখন তার অঙ্গুলি হেলনেই মাদক এবং বাকি সমাজ বিরোধী দ্রব্যাদির ব্যাবসা চালায় তার দল। এই আকস্মিক উন্নতিতে তার দলের ও অনেকেই তার বিপক্ষে সড়যন্ত্র করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। কাজেই এখান থেকে তার পরিবার বর্গের সাথে কিংবা আজ মহাদেশ কে তার কাছে রেখে দেওয়ার মতো কোন কাজ সে করতে পারবে না। এমন কি পারবে না মহাদেশের সাথে তার গাঁয়ে ফিরে মহাদেশের মা কে এক বারের জন্য দেখে আসতে। সেদিন বাবার কথা গুলো শোনার পর বাবার ওপর খুব রাগ হয়েছিল মহাদেশের, বাবাকে স্বার্থ পর মনে হয়েছিল, কিন্তু সেদিন রাতে যখন সেই বাবার ছেলে হওয়ার অপরাধে চার জনের এক দুষ্কৃতি দল হামলা করে মহাদেশের ওপর সেদিন তার বাবার ওপর রাগ কমে এক লহমায়। সেদিন এই নান্টুর দূরদর্শিতার জন্যেই তারা ওই চার জনের দল তাদের ওপর হামলা করতে আসার আগেই সরে যায় নিজেদের চেনা আস্তানা ছেড়ে আর তাতেই প্রানে বাঁচে মহাদেশ। কাজেই এবার ও বুঝতে পারে বাবার বলা প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। যদিও তার পরেও বাবা কে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক অন্ধ জেদে বেশ কিছুদিন নানা ভাবে চেষ্টা চালায় সে কিন্তু না তাতে কোন ফল হয়নি, বাবার সাথে যোগাযোগ তো দূরে থাক বাবার দলের লোকেরা মহাদেশ কে বাবার কাছেও ঘেঁষতে ও দেয়নি, শুধু বাবার সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়েছে। তাতেই বাবা তাকে বোঝায় যে সে জেন আর কোন রকম ভাবে তার সাথে যোগাযোগ রাখার কোন চেষ্টা না করে তাহলে ওর প্রাণ সংশয় হতে পারে, আর ্যা মহাদেশ কিছুতেই হতে দিতে পারে না, কারণ বাবার পর মা এবং বোন দুজনেই এখন পুরোপুরি নির্ভর শীল তার ওপর, কাজেই আর কোন রকম ভাবে বাবার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা না করে সে গ্রামে ফেরার প্রস্তুতি নেয়। আরো হয়তো কিছুদিন সে শহরে কাটাতো কিন্তু তা সম্ভব হয় নি সেদিন সকালে গাঁয়ের মুদি দোকানের মালিক গোপালকার ফোন আসায়, সে ফোন করে মহাদেশ কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার কথা বলে। ইতি মধ্যে মায়ের সাথেও বেশ কয়েক বার কথা হয় মহাদেশের বাবাকে খুঁজে পাওয়ার পরের দিনি সে মা কে ফোন করে সুখবর দেয় কিন্তু মায়ের গলার স্বরে সেদিন তার বাবাকে ফিরে পাওয়ার উচ্ছাস সে খুঁজে পায় নি বরং পেয়েছিল মহাদেশ কে বাড়ি ফিরে আসার করুন মিনতী। মায়ের সেবারের ওরকম ব্যবহারে মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছে মহাদেশ, রাগ ও হয়েছিল তার মায়ের ওপর। এত কষ্ট করে সে বাবাকে খুঁজলো আর মা কি না সে ব্যাপারে কোন রকম কোন উচ্ছাস প্রকাশ করলো না। এমন কি মা এমন ভাব করলো বাবার সাথে মায়ের জেন কোন সম্পর্ক কোন কালে ছিল না। কাজের শেষ সাত দিন সে এক প্রকার রাগে বাবা মা দুজনের কাছ থেকেই প্রত্যাক্ষিত হওয়ার জ্বালায় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল। হয়তো আরো কিছুদিন থাকতো যদি না মুদির দোকান থেকে সেই ফোনটায় গোপাল কা ওকে বলে “সব্বনাশ হইছে রে মদেশ, তু তাতাড়ি গাঁয়ে ফেরা কেনে” অনুরোধ না করতো। কাজেই একপ্রকার অনিচ্ছা নিয়েই সে ফের শিয়ালদা স্টেশানে পৌঁছাল, এবং তার গাঁয়ে যাওয়ার ট্রেনে উঠলো। আর চোখে মুখে বাবাকে ফিরিয়ে না নিয়ে যেতে পারার একটা আফসোস ছিল ঠিকি কিন্তু মনে মনে সে খানিক স্বস্তিও পেয়েছে যে অবশেষে সে তার লক্ষ্যে পৌঁচেছিল। এ এক অদ্ভুৎ অনুভুতি যা তার চোখে মুখে আফসোস আর নিজের বাবার থেকে দূরে যাওয়ায় দুঃ খের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়েছে, তো অন্যদিকে মনে উঠেছে বাবাকে খুঁজে পাওয়ার খুশিতে এক অদম্য সফলতার ঝড়। অন্যদিকে গোপাল কার সব্বনাশের অর্থ যে মহাদেশের মায়ের দিকেই ইঙ্গিত করছে তা বুঝতেও দেরি লাগে না তার। এখন সে বুঝতে পেরেছে কেন সেদিন মা মহাদেশের বাবা কে খুজে পাওয়ার মত বিষয়ের থেকে বেশি জোর দিয়েছিল মহাদেশের বাড়ি ফিরে আসার পেছনে। কিন্তু এমন কি হল মায়ের যে…? নাকি বুনের কিছু? এক দিকে বাবাকে হাতের নাগালে পেয়েও তাকে গাঁয়ে ফিরিয়ে না নিয়ে যেতে পারার গ্লানি, অন্যদিকে এত বড় শহরে বাবার মতো একটা মানুষ কে খুঁজে পাওয়ার সফলতা, এবং গাঁয়ে ফেলে আসা মা বুনের জন্যে দুশ্চিন্তা এবং সব্বনাশের বার্তা, সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটাই জট পাকানো অবস্থায় সেদিন ট্রেনে চেপেছিল মহাদেশ, যত ট্রেন এগিয়েছে বেড়েছে সেই মাথার জটের বহর। একদিকে যেমন ট্রেনের অবিচল ধারা নিজেকে মহাদেশের গাঁয়ে পৌঁছানোর তেমনি সেদিন মহাদেশের মাথায় ছিল জট আর দোলাচলের বহর সে যত নিজের গাঁয়ের কাছে আসে তত জেন সেই জট আর দোলাচলে তার মাথা ভার হয়ে আসতে শুরু করে আবিরাম অনরগল হয়ে ঠিক ট্রেনের চলার শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে।
মহাদেশ কে দেখেই তার গাঁয়ের প্রতিটা মানুষ চোখের জল ফেলতে শুরু করে, ও প্রথমটায় কিছু বুঝতে পারে না, কিন্তু ভোলার মুখোমুখি হওয়ার সাথে সাথেই ভোলা যে ভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পরে, তাতে ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তার মা আর বুনের সাথে মারাত্মক কিছু ঘটেছে। ভোলা অনরগল হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে আর মহাদেশের সামনে বসে হাত জোড় করে বলতে থাকে”আমারে তু ক্ষেমা করি দে মদেশ, এই শালার পঙ্গু পা দুটির কারনে আমি পারলুম নি রে পারলুম নি।” কি হয়েছিল সেরকম ভাবে তখনো কিছুই বোধ গম্য ছিল না মহাদেশের কাছে কিন্তু সে এটুকু বোঝে এত দিন পর বাবাকে খুঁজে পাওয়ার কারনে মায়ের উদাসিন্য হয়ে থাকার কারণ ছিল মায়ের দিকে এগিয়ে আসা ভয়ানক কোন মৃত্যু থাবা, মায়ের জা শরীর তাতে মৃত্যু তাকে থাবা বসাতোই তা তো মহাদেশ ভালো করেই জানে, ভোলাও জানত তাহলে আজ ভোলার এরকম ভাবে কাঁদার পেছনে কেন কোন অনুশুচনা বোধ কাজ করছে বলে বার বার ওর মনে হচ্ছে? এই সব প্রশ্ন নিয়ে যখন ওর মাথার ভেতর টা তোলপাড় হচ্ছে, মুখে কি বলবে না বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক তখন গাঁয়ের বড়রা ওর কাছে এসে ওকে ওর শহরে যাওয়ার পর থেকে যা যা হয়েছে, বা বলা ভালো ওর পরিবারের সাথে ঘটেছে তা সব বলতে শুরু করে,আর যত ঘটনা এগোতে থাকে ততই ওর চোখে মুখে বিশ্ময় ফুটে উঠতে থাকে। হতবম্ব হয়ে যায় সে সমস্ত ঘটনা শুনে… যে মোড়ল কাকা কে বিশ্বাস করে মা ও বোনের দায়িত্ব সে দিয়ে গিয়েছিল তার ঘাড়ে সেই তার মোড়ল কাকাই আসলে তার মাকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর কোলে। দিনের পর দিন এই কাকার হাতে মা হয়েছে নির্যাতিত, সয়েছে যৌন নির্যাতন, কোন কারনে তার মা বাধা দিতে গেলে তাকে হয় হতে হয়েছে লাঞ্ছিত অপমানিত। এমন কি মাঝে মাঝে মোড়ল কাকা ওর তিন বছরের বোনটাকে শিখন্ডি করে চালিয়েছে তার নির্যাতন। প্রথম প্রথম এ সবি চলেছিল একলা ঘরের ভেতর, কেউ কিচ্ছুই টের পায় নি, এমন কি মোড়ল কাকার ছেলেও এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না। কিন্তু গেল শীতে মহাদেশের মা যখন এরকম ভাবে আর অত্যাচারিত হওয়ার থেকে মুক্তি পেতে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করে এবং ওই মোড়লের এসে পরায় তার চেষ্টা ব্যার্থ হয়, রাগের বসে মোড়ল সেদিন ওর মায়ের গায়ে হাত তোলে, শীতের রাতে পুরো নগ্ন দেহে মহাদেশের মা কে গোটা গাঁয়ে ঘোরায় মোড়ল, এক দুশ্চরিত্র মহিলার অপবাদ দিয়ে। এবং সাথে পায় তার বাকি সাগরেদ দলকে, সেদিন প্রথম ব্যাপারটা সকলের নজরে আসে। ভোলা তার বন্ধুর মায়ের ওপর লাগানো এই অপবাদ কে বিশ্বাস না করায় প্রথমে ওর বাবার ওপর চড়াও হতে শুরু করে। ছেলের কাছে ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে আর মহাদেশের মাকে শাস্তি দেওয়ার মোহে মোড়ল সেদিন আটকে রেখেছিল ভোলাকে নিজেদের বাড়ির এক ঘরের ভেতর। ভোলা সেদিন তার বাল্য বন্ধুর মায়ের এই দুরাবস্থা দেখে ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে হায় হাউ করে কাঁদতে থাকে আর একে তাকে তার বন্ধুর মাকে এই অপমানের হাত থেকে বাচানোর জন্যে সকলের কাছে প্রার্থনা করে,কিন্তু গ্রামের কেউ সেদিন মহাদেশের মায়ের ওপর দেওয়া এ অপরাধ বিশ্বাস করেনি ঠিকি কিন্তু মোড়লের লোক বলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবে সে সাহস টুকু ও দেখায় নি। কাজেই এই পঙ্গু অথর্ব ছেলে ভোলা সেদিন অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দেখেছিল তার মাতৃতুল্য মহিলার নিজের বাবার হাতে অপমানিত লাঞ্ছিত হওয়ার করুন দৃশ্য। এই ঘটনা ঘটার সাত দিনের মধ্যেই মহাদেশের মা আত্মঘাতী হয়। তারপর সত্য জানাজানি হলে গাঁয়ের লোকেরা থানা পুলিশ করতে চাইলে, এক জোট হয়ে হয়ে মোড়লের বাড়ি চড়াও হওয়ার পরিকল্পনা সাজাতে থাকলে মোড়ল ও তার সঙ্গীরা মহাদেশের বোন কে সঙ্গে করে নিয়ে পালিয়ে যায়। গোটা ঘটনা শোনার পর থেকে একটাও কথা মুখ দিয়ে সরাতে পারেনা মহাদেশ। মায়ের ইশারা সে বুঝতে পারে নি, সে যে কি বড় অপরাধ করেছে তা বুঝতে পারছে এখন। কোন মাই তার নিজের ছেলেকে নিজের যৌন নির্যাতনের কথা বলতে চায় না, মহাদেশের মাও তাই মুখ ফুটে বলতে পারেনি, কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে বার বার মহাদেশ কে গাঁয়ে ফেরার ইনুরোধ জানাতে থাকে। কিন্তু তা না বুঝে মহাদেশ অখন মগ্ন থেকেছে বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে। সেই তো সে বাবাকে নিয়ে আসতে পারে নি, আর কিছুদিন আগে এলেই হয়তো,…। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে, মোড়ল সাগরেদ, এবং নিজের বোনের কোন খোঁজ সে আর পায় নি। শেষ জেনেছে মোড়ল তার বোন কে নিয়ে শহরের দিকে গেছে। কথাটা শোনা মাত্রই ভোলা নিজেদের অর্ধেক জমি জায়গা বেচে সব টাকা তুলে দেয় মহাদেশের হাতে। আর বলে মহাদেশ জেন নিজের বোন্টাকে সুস্থ ভাবে খুঁজে বের করে তাকে তার বাপের করা এই পাপের বোঝা থেকে কিছুটা হলেও জেন হালকা করে। গাঁয়ের বাকিরাও একি উপদেশ দেয় সকল কে। কাজেই গায়ে মায়ের কাজ মিটিয়েই ভোলা ফের রওনা দেয় শহরের উদ্দেশ্যে, আর মনে মনে ভাবতে থাকে “আগের বার সে যখন শহুরটিতে গেইল তখন তার মুনে বিশ্বাসটি ছিল যে সে ঠিক ফরে আইসবে তার রঞ্জনা গাঁয়ে, এক্কেবারে জোরটো দিয়ে এ কতাটি কয়েছিল তার মুন্টি সে বার, কিন্তু এই বারটি তে তার মুন টি আর উ কতাটি বইলছে নেকো, বরং তার মুন্টি কেমন জানে উন্য পতটি ধইরেছে, কেনে বল দিনি?”
আবার করে শহরে পা পরার সাথে সাথেই তার বুঝতে এবার আর এত টুকু অসুবিধা হয় না যে ঠিক কি কি করা উচিত। কোন দিকে না তাকিয়ে সে সোজা শিয়াল দা স্টেশান থেকে বাস ধরে বড় বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তার দোস্ত নান্টুর কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে। যদিও সেবার যাওয়ার আগে নান্টু তাকে পই পই করে বলেছিল সে জেন আর ভুলেও এই শহরে না আসে, কারণ তার বাবার শ্ত্রুরা শহরের চারিদিকে, কোন ভাবে সে আবার তাদের হাতে ধরা পরলে হয় মরবে নয় তো তার বাবা কে ওই ঘর থেকে বার করবে তারা, কিন্তু এবারেও তো নিরুপায় হয়েই শহরে এসে গেল মহাদেশ, আর তা ছাড়া শহরের শ্ত্রুরা তো তার সেরকম অর্থে কোন ক্ষতি করতেই পারেনি, কিন্তু গ্রামে বন্ধু ভেবে আপন জন ভেবে যে শত্রু কে সে বিশ্বাস করে ছিল সে তো তার সবকিছুকে কেড়ে নিয়ে ধুলিস্মাত করেদিল। তার তিন বছরের ছোট বোন্টা এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে তা তো কেউ জানে না।আদেও মোড়লা কাকা তাকে বাচিয়ে রেখেছে না মেরে ফেলেছে তাও সে জানে না। এই শ্ত্রুর করা ক্ষতিটা সে পূরণ করে কি করে? তার আর প্রাণের মায়া নেই, বাবা যে পথে গেছে একদিন না একদিন তাকে মরতেই হবে , কিন্তু সে যদি বাঁচে তাহলে সে তার বোন টাকে একদিন না একদিন খুঁজে বার করে তাকে একটা সুস্থ জিবন দেবে কাজেই বোন কে খুজে না পাওয়া পর্যন্ত সে আর শহর ছাড়তে পারবে না, আর সে এও জানে যে এত তাড়াতাড়ি সে তার বোন কে খুঁজে পাবে না, কারণ তার মন বলছে তাকে তার বাকি জীবনটা এই শহরেই কাটাতে হবে, লড়াই করে… বোনের খোজ চালাতে হবে আমরণ।
মানুষের মনের কথা কখনো মিথ্যে হতে হয়তো আমরা কেউ শুনিনি, মন কিন্তু পুরোটাই একটা নিছক প্রেডিকাশান করে, কিন্তু অদ্ভুৎ ভাবেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার প্রতিটা কথা সত্যি ও হয়ে যায়। মহাদেশের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি, সেদিনের পর থেকে আজ প্রায় পনেরটা বছর কেটে গেছে মহাদেশের এই শহুরে জীবনে কিন্তু এখন পর্যন্ত সে তার বোন কে খুঁজে পাওয়া দূর তার কোন হদিশ পাওয়ার ইঙ্গিত ও পায় নি। শহরের সমস্ত এলাকায় সে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে তার বোন কে কিন্তু কোথায় তার বোন তার সন্ধান এখনো তার কাছে অধরা। সেদিন নান্টুর কাছে যাওয়ার পর সে নান্টুকে সব কথা খুলে বলে, এবার ও নান্টু তার পাশে দাঁড়াবার প্রতিশ্রুতি দেয়। এবং এখন পর্যন্ত সে তার প্রতিশ্রুতি নিভিয়ে চলেছে প্রান পনে। সে বার নান্টুর মুখে সে শোনে বিল্ডিং তৈরির কাজে মহাদেশ কে আর নেবে না মালিক কাজেই এবার তাকে নতুন একটা কাজ খুঁজতে হবে, নতুন কাজ খুঁজতে বেশি সময় ও লাগে না নান্টুর, ধর্মতলার এক ডান্সিং বারে সামান্য বেয়ারার কাজে ঢোকে মহাদেশ তার পর সেখান থেকে নিজের সততা আর পরিশ্রম দিয়ে এবং মালিক পরিবারের সহানুভুতিকে আশ্রয় করে সে সেই বারের ম্যানেজার হয় তারপর মালিকের অবর্তমানে সেই বারের হয়ে ওঠে মালিক। আজ যে বারে একদিন সে এসেছিল ওয়েটারের চাকরী করতে আজ সে সেখাঙ্কার মালিক। কোলকাতার নামি দামি লোকেরা ভোড় করে রোজ সন্ধ্যে হলেই তার বারে, কারণ কোলকাতা শহরে সবথেকে দামী আর সুন্দরী ডান্সার দের দিয়ে সে তার বারে নাচ গান করায়। সেরা আমোদ প্রমদের ব্যবস্থা করায় অচিরেই সে বার এখন কোলকাতার সব থেকে নামি বার গুলোর মধ্যে একটা। এখন সে বেশ টাকা পয়সাও করেছে, আর তার দৌলতে টাকা বাড়ি গাড়ি করে পথের নান্টু এখন রাজা বলা চলে। নান্টু এখন মহাদেশের ছায়া সঙ্গী। অদ্ভুৎ ভাবে এতদিনে এক বারের জন্যেও মহাদেশ তার বাবার সাথে দেখা করেনি, প্রথম প্রথম তার ইচ্ছা হয়েছিল বাবার কাছে যায় কিন্তু পরে নান্টু বাধা দেয় এখন সে ইচ্ছা চলে গেছে। এখন আর জানেও না সে যে তার বাবা আদেও বেচে আছে না নেই। ইতিমধ্যেই কোলকাতার অন্ধকার মহলে সকলের মন জয় করে রেশমী বলে একটি অল্প বয়স্কা মেয়ে। যার নাচ আর গানে মুগ্ধ গোটা কোলকাতার আমুদে মানুষেরা। মহাদেশ তার বন্ধু স্থানীয় এক লোকের বার দেখতে গিয়ে সেই মেয়ের সাথে পরিচয় হয় এবং তাকে বেশি টাকা দিয়ে নিয়ে আসে নিজের বারে নাচা গানা করাতে। রেশমীর মহাদেশের বারে প্রবেশ জেন মা লক্ষীকে টেনে আনার সমান। এখন প্রতিদিন সন্ধ্যে বেলা তার বারে লোকেদের লম্বা লাইন পরে রেশমীকে এক ঝলক দেখার উদ্দেশ্যে। মহাদেশ ও লক্ষ্মীর নাচে গানে মুগ্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যে বেলা সে নিজের লেবিনে বসে বসে দেখতে থাকে গোটা শহর বাসি কি রকম নেকড়ের চোখ দিয়ে দেখতে তাকে তার রেশমী কে আর যত রাত বারে, রেশমীর জেল্লা আরো বারতে থাকে আর তত বারতে থাকে তার আশেপাশে নাচতে থাকা নেশায় চুর থাকা মানুষের খিদেটা, আর তত টাকা ছড়াতে থাকে তার বারের আনাচে কানাচে। রেশমীর আগমন তার দিনে পুরুষ জাতির লোভনীয় দৃষ্টি সব কিছুই মহাদেশ কে পৌঁছে দিতে শুরু করে শিখরের উচ্চতায়। হঠাৎ এর মধ্যেই কয়েকদিন রেশমী আর আসে না তার বারে, বেশ কিছু দিন এরুপ চলতে থাকায় ঘাটতি হতে থাকে তার লাভের খাতায়, সে নিজে খোজ খবর করতে শুরু করে রেশমীর এবং জানতে পারে যে রেশমীর বাড়ি সেই সোনাগাছী এলাকায়, সেখানে সে থাকে তার বাবার সাথে। এরকম একটা মেয়ের ওরকম একটা জায়াগায় থাকাটা মোটেই অসম্ভব না, কিন্তু মায়ের বদলে বাবার সাথে থাকাটায় প্রথম খটকা লাগে মহাদেশের, ইতি মধ্যে নান্টুর সাথে রেশমীর সম্পর্ক বেশ গভীর হয়, কিন্তু সে কোন ভাবেই এ কথাটা মহাদেশ কে বলে না। কাজেই রেশমীর সাথে সাথে নান্টুর ও বারে আসা বন্ধের কারণ কি জানতে এক প্রকার কৌ্তুহল বসত-ই সে এক দিন তার গাড়িটা নিয়ে পৌছায়ঁ সেই রেড লাইট চত্তরে। সে জানে এখন আর কেউ তাকে তার বাবার ছেলে হিসাবে চিনতে পারবে না,। এমন কি তার বাবাও যে এখন জিবীর তার ও কোন খবর যেহেতু সে জানে না তাই তাকে মৃত অনুমান করেই এগোতে থাকে সে। হঠাৎ সেই বাড়িটা ঢুকতে যে গলিটা দিয়ে যেতে হয় তার সামনে দেখে নান্টুর গাড়ি। ও সেটা দেখে গাড়ির দিকে যায়, ওর ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে পারে নান্টু এই বাড়ির ভেতরেই কোথাও গেছে, সেখান থেকেই ওর মনে খটকা টা আরো বেশি করে বারতে শুরু করে। এখন সে কোলকাতার নামী বারের মালিক, অনের সম্পত্তি আর টাকা পয়সার অধিকারী সে, কাজেই কেউ তাকে আত আটকাতে আসার চেষ্টাও করে না। সে ধিরে ধিরে ওপরে ওঠে, কাউকে কোত্থাও দেখতে পায় না। ধিরে ধিরে ঘরের ভেতরে ঢোকে সেখানেও কাউকে দেখতে পায় না, এদিক সেদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ তার কানে আসে নান্টুর কথা, সে কারুর সাথে কথা বলছে,সেই গলার স্বর অনুসরন করে সে একটি খোলা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। ভেতরে না ঢুকেই পর্দার আড়াল থেকে দেখে, নান্টুর বুকে মাথা রেখে কাঁদছে রেশমী আর পাশে মৃত দেহের ন্যায় শুয়ে আছে যে মানুষ টি সে…… বাবা বাবা—অস্ফুটে নিজের মুখ দিয়ে এই স্বর বেরিয়ে আসে মহাদেশের, অন্যদিকে রেশমী নান্টুর বুকে মাথা রেখে বলছে, “আমি চাইনা দাদা জানুক বাবার আমার এই অবস্থার কথা, তোমার মুখে তো শুনলাম সে কত কষ্টে আছে আমার জন্যে, তার পর যদি এই খবর পায়, আমার গায়ে খারাপের তকমা পরে গেছে, আর তা পরেছে তোমাদের বারেই এখন যদি লোক জন জানে যে রেশমী নেচে গেয়ে ওই বারে লোক জন কে আনন্দ দিয়েছে সে আর কেউ নয় ওই বারের মালিক মহাদেশ বাবুর নিজের মায়ের পেটের বোন তাহলে দাদার সম্মানে কেমন কালীটা ছিটবে বুঝতে পারছো। তোমায় আমার দোহাই নান্টু দা, তুমি একথা দাদা কে বল না, আমি কাল এখান থেকে চলে যাব। আমি নোংরা নান্টুদা, সেদিন ওই মোড়ল লোকটা আমাকে এখানে এনে বেচে দেয়, আত তাও কিনা আমার বাবার হাতেই, আমার বাবাও আমাকে কোন দিন না দেখায় চিনতে পারে নি, পরে ঘটনা চক্রে সে সব জানে ঠিকি কিন্তু তত দিনে আমার গায়ে পাক লেগে গেছে। আমি মনে করি এতে তোমার দাদার বা বাবার কারুর কোন দোষ নেই এ আমার ভবিতব্য, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি, কিন্তু আমার মত মেয়েদের যে কারুর ঘরের বঊ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে নেই নান্টু দা। কাজেই তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি তোমার আর দাদার গায়ে কালি ছেটাতে পারবো না, তোমাদের দামী জামাকাপড়ে আমার গায়ের পাঁক লাগাতে আমি কিছুতেই দেব না। তুমি চলে যাও কোন দিন এসো না এখানে, আর পারলে দাদা কেও কিচ্ছু বলো না, বলো না যে এই বাজারের মেয়ে রাতের রেশমী আসলে ওরকম এক মানুষ মহাদেশ বাবুর বোন তাহলে ও আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না,”
কথা শোনা মাত্রই দরজা থেকে সরে আসে মহাদেশ, পেছনে টেবিলের সাথে ও গোঁতা খায় তাতে যে আওয়াজ পায় তাতেই সজাগ হয়ে যায়, রেশমী আর নান্টু, ওরা দৌড়ে বাইরে এসে দেখে মহাদেশ, ওদের চোখাচুখি হতেই, বিশেষ করে রেশমীর চোখাচুখি হতেই ও দৌড়ে পালাতে থাকে নিচে নিজের গাড়ির দিকে… ওরাও পেছন পেছন যায়। মহাদেশ নিজের গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয় এবং প্রান পনে গাড়ি ছোটাতে থাকে… নান্টু আর রেশমী নান্টুর গাড়িতে উঠে ওর পেছু নেয়, দুটো গাড়ি তীব্র বেগে ছুটতে থাকে কোলকাতার রাস্তা ধরে, বেশ কিছুটা চলার পর মহাদেশ গঙ্গার ধারের এক ফাকা জায়াগায় গাড়ি দাড় করিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে, নিজের বোন কে এত দিন না চিনতে পেরে তাকে দিয়েই আর পাঁচটা লোকের নোংরা নজরে ঠেলে দিয়ে সে অর্থ উপার্জন করেছে এত দিন, এই পাপ বোধে সে আজ চূর্ণ বিচুর্ণ হয়ে যাচ্ছে পদে পদে। দাদা হয়ে যে বোন কে তার আগলে রাখার কথা সেই বোন কেই সে বাজারে নামিয়েছে, অজান্তে হলেও মহাদেশের কাছে এ এক চরম অপরাধ। নান্টু আর রেশমীর গাড়ি ও ওখানে দাঁড়ায়ে, রেশমী আর নান্টু মহাদেশ কে ওরকম পাগলের মতো কাদতে দেখে প্রথমটায় হতবম্ব হয়ে যায়। এত লড়াই করে যে ছেলেটা একদিনের জন্যেও চোখের জল ফেলেনি তার কি হলো? নান্টু মনে মনে এই কথাই বলতে থাকে… রেশমী দাদার এই অবস্থা দেখে আর কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে দাদা কে সামলাতে দৌড় লাগায়, রেশমীকে দেখে মহাদেশ আবার দূরে সরতে গেলে রেশমী ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরে, মহাদেশ কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করে, বুন তু আমার কাইছটিতে না আলে আমু যে আর কুনোদিন সেই মহাদেশ টি হতে পারবো নেকো রে… এই শহর মহাদেশের সমস্তটাই নিয়ে নিয়েছিল, নান্টু মহাদেশ এরকম গাঁয়ের ভাষায় কথা বলতে দেখে অবাক হয়, দীর্ঘ পনের বছরে এক দিন ও মহাদেশ এই ভাষা ব্যবহার করে নি, নান্টু তো ভেবে ছিল মহাদেশ বুঝি এই ভাষা ভুলেই গেছে। কিন্তু না সে বোঝে যে সে ভুল ছিল, কারণ শহুরে পরিস্থিতি মহাদেশ কে বদলে ছিল ঠিক কথা, তার মুখে ফুটিয়েছিল শহুরে বুলি, পরনে তুলেছিল প্যান্ট শার্ট, কিন্তু অন্তরে অন্তরে সে যে এখন একটা রঞ্জনার মানুষ হয়ে আছে তা সে বা রেশমী কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি এতদিন। গাঁয়ের ছেলে মহাদেশের বুকে মাথা রাখা সেই গাঁয়ের মেয়ে রেশমীকে দেখে নান্টুর চোখেও জল চলে আসে। মানুষ না চাইলে গাঁয়ের মাটি কক্ষনো তাদের মাটির মানুষ গুলো কে ছেড়ে যায় না, যেমন যায়নি মহাদেশ আর রেশমীকে ছেড়ে। হাজার হোক তাদের গাঁয়ের নামটি হলো রঞ্জনা কি না?