সুজয় নোটের ভাঙানিটা হাতে নিয়ে বেশ হকচকিয়ে গেল। টাকা কটা পকেটে পুরে চট করে বেরিয়ে এলো দোকানের ভীড় ঠেলে। খানিকটা এগিয়ে বাঁদিকের গোলির পথ ধরলো, এইটাই সুজয়ের বাড়ির পথ। একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজছে সুজয়। সামনে মোটা গুঁড়ি ওয়ালা গাছটার আড়ালে গেলে মন্দ হয় না। পকেট থেকে টাকা গুলো বার করলো সুজয়। কড়কড়ে পাঁচ পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট। সব কটা নতুন। বড্ড দরকার ছিল টাকাটার… …কিন্তু এই ভাবে পাওয়া টাকা। মন থেকে মানতে পারছে না সুজয়। ফেরৎ দিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু এই মুহুর্তের সমস্যা মিটবে কিসে। টাকা ফেরৎ দিলে বাহবা পাওয়া যাবে কিন্তু মিন্টূর স্কুলের মাইনে…। নাঃ…ফেরৎ দেওয়া বোকামি হবে। পরে কোথাও থেকে যোগাড় করে কিছু একটা বলে ফেরৎ দিলেই হবে, কিন্তু এখনই নয়। মুখে চোখে উত্তেজনার ছাপটা কাটিয়ে তুলতে হবে। বাড়িতে কেউ যেন কোন ব্যপারে সন্দেহ না করে।

কেষ্টদার দোকান থেকে মাস কাবারির জিনিষ গুলো কিনে সুজয় এখন বাড়ি ফিরবে। ব্যাগটা বেশ ভারী হয়েছে। গোলির মোড় থেকে একটা রিক্সা করলে হতো। হাঁটলে অবশ্য ছটা টাকা বাঁচে। চাকরী ছাড়ার পর সবটাই চলছে জমানো টাকায়। আজ রবিবার, তাই খানিকটা শান্তি। সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় সময় যেন আর কাটতে চায় না। যতোটা পারা যায় দেরী করেই বেরোয় সুজয়। বাড়ীওয়ালাকে দেখাতে হয় সব কিছু ঠিক ঠাকই চলছে, অন্ততঃ চাকরীটা। মনের অশান্তিকে মনের ভেতরে রেখে আগের মতোই বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায় সুজয়। এইতো গতকাল মিন্টূ বায়না ধরলো, “বাপী অনেকদিন মাংস হয়নি বাড়িতে, কাল রবিবার, মাংস খাবো।“ পাঁচশো টাকা কিলো মাংস কিনতে মনটা খুঁত খুঁত করছিল। অপেক্ষা করছিল ছেলেটা আপন মনে থাকতে থাকতে যদি ভুলে যায়। সুজয় ছেলের সঙ্গও একটু এড়িয়ে চলছিল সারাদিন। খাবার টেবিলে মাংসর প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য কথা হলো, কিন্তু, কেন জানিনা, মিন্টূ আজ মাংসর কথা ভুলছে না কিছুতেই।

সোমা মাঝে মাঝেই ছেলের পিঠে দু-এক ঘা বসায়। সোমার মনের অবস্থাটা সুজয় বোঝে কিন্তু ছেলের গায়ে, কারণে অকারণে, হাত তোলাটা ও ঠিক মেনে নিতে পারে না। মিন্টূ দশটা টাকার জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করছিল, কম্পিউটার গেম খেলবে বলে। সোমা ছোট ছোট ব্যপার নিয়ে বড্ড চ্যাঁচায়। দশটা টাকা তো দিয়ে দিলেই হয়। ছোট্ট মিন্টূ কিই বা বোঝে। সুজয়ের চাকরীর ব্যপার মিন্টূ কিছু জানেনা। ও জানে অফিসে ওর বাবা খুব গুরুত্বপুর্ণ লোক। আজ প্রায় চার মাস ওর চাকরী নেই। গতকাল হিসেব করে দেখেছে সুজয়…মেরে কেটে দুমাস আর চলতে পারে। একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ক্রমশঃ গ্রাস করছে সুজয়কে। মাথা গরম করে চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে একটা বিপর্যয় ডেকে এনেছে সে সংসারে। এমন একটা কাজে সুজয়ের দক্ষতা যে তাকে সম্বল করে মাঝে মাঝে চাকরী বদলানো সহজ নয়। অথচ এটাকে সম্বল করেই, গত পাঁচ বছরে, কাজের জায়গায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল সে। এর মধ্যে চার-পাঁচটা ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েছে, কিন্তু সুবিধে হয়নি। যাঁরা চার মাস আগেও সহকর্মী ছিলেন তাঁরা মাঝে মাঝেই আসেন খবর নিতে।

কিছু টাকা অফিসের কাছে এখনও পাওনা আছে। কেন সুজয় জানেনা, না না অছিলায় টাকাটা আটকে রাখা হয়েছে। চ্যাঁচামেচি একদম ওর ভাল লাগছে না। পাছে রাগারাগি করে বসে তাই অ্যাকাউন্টান্ট মাধববাবুকে ইদানিং কালে আর টাকার তাগাদা করে ফোন করেনি। টাকাটা সুজয়ের খুব প্রয়োজন। ভেবেছিল লাঞ্ছের পরে মাধববাবুকে আজ একবার ফোন করবে। কিন্তু আজ সকালে কেষ্টদার দোকানে যা ঘটে গেল তা অভাবনীয়। এই মুহুর্তের প্রয়োজনটা মিটেছে। তাই কটা দিন পরেই না হয় মাধববাবুকে ফোন করবে। একটু সময় তো পাওয়া গেল। কিন্তু আজকের ব্যপারটা সোমাকে বলা যাবে না। পাঁচটা নোট সোমাকে আড়াল করে লুকিয়ে রাখলো সুজয়। এখন টানাটানির সময়, হঠাৎ এই টাকাটাই বা কোথা থেকে পেলো সুজয়, জানতে চাইতেই পারে সোমা। আবার কিছু মিথ্যে বলতে হবে…না সুজয় তা চায় না। সাধারণতঃ সোমার কাছে ও কোন কথা লুকোয় না। একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া ওদের মধ্যে অটুট বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে।

সোমা গত মাস থেকে দু-তিনটি ছেলে মেয়েকে পড়াচ্ছে। যা আসে তাতে কিছু দিনের বাজার খরচাটা উঠে আসে। এ পাড়ায় ছেলে মেয়েদের পড়িয়ে সেই রকম টাকা পাওয়াটা কঠিন। এতো আর গড়িয়াহাট বা নিউ আলিপুর নয়। তার ওপর ঠিক মতো পড়াতে গেলে নিজেকেও পড়তে হয়। সোমা কি করে যে এতো সামলায় কে জানে। মিন্টূর স্কুলের পড়াও তো বেশীর ভাগটাই সোমাই সামলায়। গত মাস থেকে স্কুলের বাস বন্ধ করে দিয়ে সুজয় নিজেই পৌঁছে দেয় মিন্টূকে। প্রতিবেশীদের কৌতুহল এতোটাই যে স্কুলের বাস কেন বন্ধ হলো তার জবাবদিহিও করতে হয়েছে সোমাকে। কি যেন একটা বানিয়ে বলেছে সোমা। প্রতিবেশীদের এতো খবর কিন্তু সোমা বা সুজয় রাখে না। সোমা অবশ্য অনেকের বাড়িতে মাঝে মধ্যে গল্প-টল্প করতে যেতো। না না প্রকারের অস্বস্তিকর প্রশ্নবাণ থেকে বাঁচতে কারুর বাড়িতে যাওয়াটা ও এখন এড়িয়ে চলে। এই তো সেদিন পাশের ফ্ল্যাটের অমলবাবু বেলা সাড়ে বারোটার সময় ঢাকুরিয়া লেকে একটা বেঞ্চে সুজয়কে বসে থাকতে দেখেছেন। যদিও সুজয় অফিসের পোষাকেই ছিল। কিন্তু ঢাকুরিয়া লেকে ওই সময় সুজয় বেঞ্চে বসে একা কি করছিল। কেন সোমাকে ছেলে-মেয়ে পড়াতে হচ্ছে সামান্য টাকার জন্যে।

বেল বেজে উঠলো। কে আবার এলো এই সময়। সব সময় কেমন যেন একটা আতঙ্ক সুজয়ের বুকে চাপ বেঁধে বসে আছে। কোন পাওনাদার নয় তো! ঘর থেকে উঁকি মেরে দেখলো সুজয়। সোমা দরজা খুলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। কি এতো কথা বলছে সোমা। অস্থির হয়ে উঠছে সুজয়। এবার সোমা আসছে। কাকে একটা দাঁড় করিয়ে রেখে এলো দরজার বাইরে। কেষ্টদা নয় তো! সর্বনাশ, সোমাকে কিছু বলেনি তো! গায়ে ঘাম দিচ্ছে সুজয়ের। “কে এসেছে কে, কার সঙ্গে এতো কথা বলছো?” ঝাঁঝিয়ে উঠলো সুজয়।

“ওমা, এতো কথা আবার কোথায় বললাম। কে এসেছে, কেন এসেছে দেখবো না?” বললো সোমা।

“তাই তো জিজ্ঞেস করছি, কে এলো।“ একটু সামলে নিয়েছে সুজয়।

“তুমি এরকম করছো কেন? কিছু তো হয়নি। এতো ঘামছো কেন তুমি? শরীর কি খারাপ লাগছে?” আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলো সোমা।

“বলো না কে এসেছে?” অধৈর্য জিজ্ঞাসা সুজয়ের।

“মুদীর দোকান থেকে নিমাই এসেছে।” সোমার সহজ উত্তর।

“নিমাই? …কেন? কি বলছে নিমাই ।” নিমাই-এর নাম শুনে আতঙ্কিত সুজয়।

“একি নিমাই-এর নাম শুনে এরকম করছো কেন তুমি? কি হয়েছে তোমার? জল খাবে? তোমার হাত কাঁপছে…তুমি বোসো না গো, কেন এমন করছো।” সোমা বললো।

সুজয় নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে। যতোটা সম্ভব শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “নিমাই কি বলছে?”  “তেমন কিছু নয়। তুমি শান্ত হও। সকালে মুদীর জিনিষ পত্র নিয়ে… ”  সোমার কথা শেষ হয় না।

“না না কেষ্টদার দোকানে কিছু হয়নি। কেষ্টদা ভুল করেছে।”  পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে সুজয়। সোমা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সুজয়ের দিকে। এখন সুজয় এক অন্য মানুষ। এই সুজয়কে সোমা চেনে না। সুজয় মাথা নীচু করে বসে আছে, দুহাতে মাথার দুপাশ চেপে ধরে। বাইরে নিমাই-এর গলা পাওয়া গেলো, “কাকীমা আমি কি একটু পরে আসবো।”

“না নিমাই, একটু দাঁড়া, আমি আসছি।” সোমা জবাব দেয়।

নিমাইকে নিশ্চয়ই কেষ্টদা পাঠিয়েছে। সুজয় ভাবতে থাকে। এতক্ষণে সোমা সব কি তাহলে জেনে ফেলেছে? কি করবে এখন সুজয়। সোমার সামনে ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সোমা আলমারি খুলে কি যেন একটা বার করলো। নিশ্চয়ই টাকা! নিমাই টাকা চাইতে এসেছে।

“তুমি কি একশো টাকা বাকী রেখে এসেছিলে? নিমাই সেটা নিতে এসেছে। তুমিই নাকি ওকে বলেছিলে আসতে।” সুজয়ের ধরে প্রাণ এলো। ও মিথ্যে ভয় পেয়েছে। সোমা জানতে কিছু পারেনি। তার মানে নিমাই কিছু বলেনি। সুজয় স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে, নিমাইকে সুজয়ই আসতে বলেছিল।

সারাদিন সুজয় এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। কিন্তু সোমা বেশ ভয় পেয়েছে সুজয়ের এই অস্বাভাবিক ব্যবহারে। সোমার মনে হয়েছে সুজয় কি একটা গোপন করছে। কেষ্টদার সঙ্গে কি কিছু হয়েছে!

সুজয় বেরবে মাংস আনতে, বেলা হয়ে গেল। কেষ্টদার দোকানের দিকটা এড়াতে হলে অন্য রাস্তা ধরতে হবে। রবিবার সারাদিন দু-একবার শরীরের কুশল জানতে চাওয়া ছাড়া সোমা সুজয়কে কোন কথা জিজ্ঞেস করলো না। দু-তিন দিন কাটতেই পরিবেশ ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে এলো।

কেষ্টদাকে একদম এড়িয়ে চললে সন্দেহটা বাড়বে। তাই সুজয় দিন পাঁচেক পরেই পাঁউরুটি কেনার নাম করে কেষ্টদার দোকানে এলো। কেষ্টদা দোকানে নেই, নিমাই রয়েছে। দোকানে ভীড় আছে কিন্তু সুজয় সময় নিচ্ছে। সুজয় নিমাইকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে ও কি কিছু জানে! কেষ্টদা ছেলেকে কিছু বলেছে কি! না, নিমাই-এর ব্যবহারে তেমন কিছু দেখছে না সুজয়। একটা সরল শিশু সুলভ হাসি হেসে নিমাই এগিয়ে এলো সুজয়ের দিকে, “কাকু কি দেবো?”

“বাবা কোথায়? আসেনি আজ দোকানে?” জিজ্ঞেস করলো সুজয়।

“মা বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে।”

“কেন, বাবার শরীর খারাপ নাকি?”

“হ্যাঁ, বুকে ব্যথা। সবাই বলল এক্ষুনি ডাক্তার দেখাতে। তাই মা সঙ্গে গেল। আমি দোকান খুললাম।”

সুজয়ের দিন কাটতে থাকলো এক ঘেয়ে আর দূর্ভাবনায়…জমানো টাকা শেষ হয়ে আসছে। মিন্টূর স্কুলের টিউশন ফি বাকী পড়েছে। গতকাল চিঠি এসেছে স্কুল থেকে…অবিলম্বে অ্যাকাউন্টসে দেখা করতে বলেছে। পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোটে আড়াই হাজার টাকা…মাত্র আড়াই হাজার টাকা সুজয়কে কুরে কুরে খাচ্ছে। রাত্রে ঘুমের বড়ি খেয়েও ভাল ঘুম হয় না। চাকরী যদি আর না পায় সুজয়। ওর বন্ধু-বান্ধবরা কে কে আজও বসে আছে অথবা কোন রকমে চালিয়ে যাচ্ছে, মনে মনে তাদের একটা তালিকা তৈরী করে আঁতকে ওঠে সুজয়।

আরো এক সপ্তাহ কাটলো। আজ মাধববাবুকে একবার ফোন করবে সুজয়। পাওনা টাকাটার কথা আজ একটু জোর দিয়ে বলবে। মুদীর দোকানে যেতে ভয় পায় সুজয় কিন্তু একটা চাপা অপরাধ বোধ কেবল ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেষ্টদার দোকানে…তার মন গোপনে বুঝতে চাইছে কেষ্টদা আর নিমাই সুজয়কে নিয়ে কিছু ভাবছে কিনা। কেষ্টদা কি খেয়াল করতে পেরেছে যে, ভুল করে নোট কখানা সুজয়কেই ভীড়ের মধ্যে দিয়ে দিয়েছিলেন…আর কাউকে নয়। দোকানে কিছু কেনার নেই, তবুও সুজয় কেষ্টদার খবর নিতে দোকানে ঢুকলো। দোকানে আজ কেষ্টদা বসে আছে।

“কেমন আছেন কেষ্টদা, শুনলাম শরীর খারাপ?”

“হ্যাঁ, শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা, হার্টের ব্যমো। এক গাদা ওষুধ দিয়েছে আর বলেছে কি সব টেস্ট করাতে হবে। আজকালকার ডাক্তাররা জানো তো, কিছু একটা পেলেই হলো, পা থেকে মাথা পর্যন্ত না না রকম টেস্ট করে তোমাকে সর্বসান্ত করে তবে রোগের চিকিৎসা শুরু করবে। তার মানেই রোগ ধরতে পারে তা নয়। আমাদের বাপ ঠাকুরদার আমলে রুগীর নাড়ী টিপে বলে দিতো ব্যরামটা কি। দেখ সুজয় আমাদের বাড়িতে কেউ কখন অ্যালোপ্যাতী ওষুধ খায়নি। আমার তো সহ্যই হয় না। আমার নাকি ব্লাড পেসার খুব হাই। তারপর কোলেষ্টর না কি একটা বেশ বলল, সেটা খুব বেশী। পাঁচ দিনে রাত্তিরে রোজ একটা করে কোলেষ্টরের ওষুধ খেইচি। ওরে বাবা রে সারাদিন শরীর অস্থির অস্থির কোচ্চে গো। খেয়ে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে, হেঁটে কোন কিচুতে স্বস্তি নেই। আবার বলে দুটো করে ট্যাবলেট সকালে খালি পেটে খেতে হবে পেসারের জন্যে। আমি কি এই সব খেয়ে মরবো? ডাক্তারকে পই পই করে বললুম হোমিওপ্যাতীটা আমার দিব্বি সহ্য হয়। অ্যালোপ্যাতী ওষুধে কেমিকেল বেশী থাকে। আর ওই কেমিকেল রক্তে মিশে একদম হাড়গোড় সব খইয়ে দেয়। এই কতা শুনে ডাক্তার ক্ষেপে গিয়ে এই মারে তো ওই মারে। আচ্ছা বলো তো আমি অন্যায়টা কি বললুম। কেমিকেল জিনিষটা শরীরের পক্ষে খুব খারাপ এটা তুমি মানো তো?” এক টানা বলে গেল কেষ্টদা।

“দেখুন কেষ্টদা আমি মানি, কি না মানি সেটা এখানে আলোচনা করে লাভ নেই। আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, ডাক্তার যা করতে বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন। কোন ওষুধ বন্ধ করবেন না। সব টেস্ট গুলো এক্ষুনি করিয়ে নিন, দেরী করবেন না।”

“কি বলচো তুমি! আমি তো ওষুধ বন্ধ করে দিইচি আগেই। আমার জানাশোনা একজন ধন্বন্তরী হোমিওপ্যাত ডাক্তার আচে। পরিবারে সবাই আমরা তাকেই সব সময় দ্যাকাই। তিনি সব শুনে-টুনে মাত্র দুটো ওষুদ দিয়েচেন। খেয়ে আমি ফলও পেইচি। পেসার কমে গ্যাচে। বুকে ব্যতাটাও আর হয়নি। আমার ডাক্তার বলেচে বুকে ব্যতাটা গ্যাস থেকে হচ্চে। হার্টে কিচু হয়নি। ধন্বন্তরী ডাক্তার মশাই। এক ওষুদে সব অসুক-বিসুক গায়েব। এবার কি বলবে তুমি?”

“আপনাকে হাসপাতালের ডাক্তার কি কি টেস্ট করতে বলেছে?” জিজ্ঞেস করলো সুজয়।

“ওই তো সিএমটি না পিএমটি কি একটা বেশ বললো। সব পেসকিপসানে লিকে দিয়েচে।”

“ও আচ্ছা টিএমটি করতে বলেছে। কেষ্টদা এটাকে এই ভাবে অবহেলা করবেন না। টিএমটি-টা অবিলম্বে করিয়ে নিন।” বললো সুজয়।

“অবহেলা করচি কে বললো। আমি তো টিটমেন্ট বন্দ করিনি। পুরো চালু রেকিচি, কিন্তু হোমিপ্যাতী।” সুজয় দোকান থেকে বেরতে যাচ্ছিলো। কেষ্টদা হঠাৎ বলে উঠলো, “তোমার সঙ্গে একটু দরকার ছিল। দোকানে হবে না, বাড়িতে যাবো। একটা ব্যপারে একটু কতা বলবো।” সুজয়ের বুকে যেন সহস্র হাতুড়ি পড়ছে। কেষ্টদাকে বাড়িতে আসতে দেওয়া যাবে না। সোমা জানতে চাইলে কি বলবে সুজয়। কেষ্টদাকে এড়িয়ে চলতে হবে এখন। বাড়িতে ঢুকেই সোমাকে আড়াল করে তার লুকিয়ে রাখা পাঁচটা নোট গুণে একবার দেখে নিলো। মিন্টূর টিউশন ফি-এর আরো দুহাজার টাকা ওর যোগাড় হয়নি। এই আড়াই হাজার টাকা থেকে সেটা নিতে হবে।

টেলিফোন বেজে উঠলো। বুকটা ধরাস করে উঠলো সুজয়ের। কেষ্টদা নয় তো! “সোমা তাড়াতাড়ি একবার ফোনটা ধরো না। কে ফোন করছে একবার দেখ। কেষ্টদা হলে বলবে বাড়িতে ফিরিনি।” ফোন তুলে হ্যালো বলতেই একটা ভারী অচেনা গলা ভেসে এলো। ভাঙা ভাঙা বাংলায় ভদ্রলোক সুজয়ের খোঁজ করলেন। পরিচয় দিলেন যে নামে তাঁর কথা সোমা অনেক শুনেছে সুজয়ের মুখে। ফোনের স্পিকারের দিকটা হাতে চেপে সোমা ফিসফিসিয়ে সুজয়কে বললো, “এই কথা বলো, তোমার বস্।”

বেশ কিছুক্ষণ সুজয়ের সঙ্গে মিস্টার মালহোত্রার কথা হলো। সোমা কাজের মাঝে সজাগ হয়ে শুনছিল সেই কথোপকথন। সবটা না শুনতে পেলেও এটা বুঝতে দেরী হলো না সুজয়কে তিনি অবিলম্বে অফিসে দেখা করতে অনুরোধ করলেন। সুজয় অফিসে গিয়েছিল পরের দিনই। সুজয়কে তিনি সব রাগ-অভিমান ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এক্ষুনি আবার জয়েন করতে বললেন। সুজয়ের মাইনে বাড়লো অনেকটা। সুজয়কে এখন থেকে কোম্পানী চব্বিশ ঘন্টার জন্যে একটা গাড়ি দেবে। সুজয় যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কোম্পানীর ফ্ল্যাটে উঠে যাবে। এছাড়া আরো কিছু সুবিধে দিয়ে সুজয়কে জেনারাল ম্যানেজারের পদে নিয়োগ করা হলো। এই মাইনে বাড়ানো নিয়েই মালহোত্রার সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছিল। মাথা গরম করে চাকরী ছেড়েছিল সুজয়।

চাকরী ছাড়ার পর সুজয়ের খবর যাদের কাছ থেকে মালহোত্রা পেতেন তাঁরা প্রায়ই আসতেন সুজয়ের কাছে। সুজয় যে ভাল নেই সে খবর মালহোত্রা রাখতেন। সুজয়ের মতো কাজের লোককে খুইয়ে তিনি পড়েছিলেন ভিষণ বিপদে। গত চার মাসে দুটো প্রোজেক্ট নিয়ে তিনি হিমসিম খাচ্ছেন। কোন সুরাহা এখনও হয়নি। সুজয়কে তাঁর বড় প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই চার মাসের দূর্বিসহ সময়টার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দুজনেরই বোধহয় ভাল হলো। এই সব না না এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে সুজয় বাড়ি ফিরলো। সুজয়ের ছোট্ট সংসারে শান্তি ফিরলেও পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে তার মনে।

মাস দুয়েক হলো সুজয় নতুন পদে অভিষিক্ত হয়ে তার পুরণো চাকরীতে ফিরে গেছে। বাড়ি এখনও বদলানো হয়নি তবে তার প্রস্তুতি চলছে পুরো মাত্রায়। তবে নতুন একটা গাড়ি পেয়েছে সুজয়, ড্রাইভার সমেত। সোমার মনে স্বস্তি এলেও সুজয়ের গোপন করা রহস্যের কিনারা করতে পারেনি সে। সুজয় অনেকদিন হলো কেষ্টদার দোকান থেকে কিছু কেনে না। কেষ্টদারও কোন খবর নেই। গাড়িতে অফিস যাতায়াতের সুবাদে রাস্তায় আজকাল হাঁটতে হয় কম। বাড়িতে ঝি-চাকরের সংখ্যা বেড়েছে ফলে সুজয়কে আর অতো দোকান-পাট করতে হয়না।

আজ শনিবার, সপ্তাহের দুটো ছুটির আজ প্রথম দিন। সুজয় বাড়িতে এক গাদা ফাইল সমেত ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে সেই সকাল সাতটা থেকে। কাজের চাপ থাকায় খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ে সে। কাজকে খুব ভালবাসে সুজয় আর এই ভালবাসাই তার উত্তরোত্তর উন্নতির চাবিকাঠি।

কে যেন বেল না দিয়ে ডাকছে সদর দরজার বাইরে। সুজয়ের নাম না করলেও “কাকু” ডাকের কন্ঠস্বর তার চেনা। বুকটা কেঁপে উঠলো সুজয়ের, নিমাই ডাকছে। সোমা দরজা খুলে চমকে উঠলো। সুজয় দৌড়ে এলো। দুজনের দৃষ্টি হতবাক হয়ে দেখছিল নিমাইকে। নিমাই-এর খালি পা, পরনে অনভ্যস্ত ধূতি, মাথার চুল এলোমেলো, চোখ দুটো উদাস…ক্লান্ত। অনেক কেঁদেছে নিমাই ।

“ভেতরে আয় নিমাই ।” ডাকলো সুজয়।

নিমাই-এর পিঠে হাত রেখে কাছে টেনে নিলো। ঘরের ভেতরে এনে কাছে বসালো। নিমাই কাঁদছে অঝরে।

“কাকু বাবা তোমার কথা শুনলো না। পরশু দিন সকালে রুটি খেতে খেতে বুকে ব্যথা উঠলো আর শুয়ে পড়লো। ডাক্তার ডাকার সময়ও দিলো না…চলে গেল।”   নিমাইকে সোমা খেতে দিয়েছিল কিন্তু নিমাই কিছু খেলো না। যাওয়ার সময় এক টুকরো কাগজ সুজয়ের হাতে দিয়ে বললো, “বাবা তোমার কাছে আসবে ভেবেছিল, কিন্তু শরীর রোজ খারাপ থাকতো। তাই আসতে পারতো না। দোকানেও যেতে পারতো না। বাবা আমাকে এই কাগজটা কদিন আগে দিয়ে বললো, কাকু শনিবার বাড়িতে থাকে, কাগজটা কাকুর হাতে দিয়ে চলে আসবি, দাঁড়াবি না। কাকুর হাতেই দিবি কিন্তু, আর কাউকে না।”

কাগজটা হাতে নিয়ে সুজয় দাঁড়িয়ে রইলো। সোমার মুখেও কোন কথা ছিল না, শুধু তাকিয়ে ছিল ফ্যাল ফ্যাল করে সুজয়ের দিকে। নিমাই চলে যেতেই কাগজের ভাঁজ খুলে সুজয় পড়তে থাকে। কেষ্টদা লিখেছে, “তোমার কথা তখন শুনলে বোধহয় ভাল হতো। সবাই বলছে টেস্ট না করে ভাল করিনি। বুকের ব্যথাটা আবার হচ্ছে। যখন হাঁটি তখন ব্যথাটা বাড়ে। কতো শুয়ে থাকবো বলো তো। আমার শুয়ে থাকলে কি চলবে? নিমাইটা তো অতো বড় হয়নি যে সব ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চন্ত হবো। কি করি বলো তো? সত্যি কথা বলতে কি একটু ভয় ভয় করছে। কি বলো, ওষুধ গুলো আবার শুরু করবো? টেস্টগুলো করিয়ে নিই, কি বলো? তুমি যা বলবে তাই হবে।

সেদিন যখন পাঁচশো টাকার নোটটা ভাঙিয়ে দিতে বললে, তখন পাঁচটা একশোর বদলে পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট ভুল করে দিয়ে ফেলেছিলাম তোমাকে। শরীর খারাপ থাকার ফলে আজকাল কাজে বড্ড ভুল হয়। এই তো সেদিন বিভাসদাকে পাঁচের বদলে তিন কিলো চিনি দিয়ে দিয়েছি। বিভাসদা অতো দেখেনি। পরে বাড়িতে বৌদি দেখিয়েছে। আর কি বলবো, আমাকে দোকানে এসে যা তা বললো। বললো কি, আমাকে বিশ্বাস করে বলে আমি তার সুযোগ নিয়েছি।  এরকম হয়তো আমি আগেও করেছি, কে বলতে পারে। আরো অনেক ভুল হচ্ছে আজকাল। তাই নিমাইকে বলি একটু খেয়াল রাখিস, আমি তো বুড়ো হচ্ছি।   তোমার সময়টা যে একটু খারাপ যাচ্ছে তা আমি জানি। তাই টাকাটা ফেরৎ দিতে পারোনি। আমি কিছু মনে করিনি। দোকানে আসা বন্ধ করো না। আর যদি খুব খারাপ লাগে, অবস্থা সামলে টাকা ফেরৎ দিও। আমার কোন তাড়া নেই। তুমি খুব বড় ঘরের ছেলে। গ্রহের ফেরে সময়টা খারাপ যাচ্ছে। ওরকম সবার জীবনে হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে। টেস্ট আর ওষুধের ব্যপারে তোমার পরামর্শের আশায় রইলাম। দোকানে এসো। ইতি তোমার কেষ্টদা।

পরামর্শের আশায় কেষ্টদা বসে ছিল আর একটু বাঁচবে বলে, কিন্তু মাত্র পাঁচটা নোটের কাঁটা পেরিয়ে পৌঁছতে পারেনি সুজয়, কেষ্টদার কাছে।

 

 

~ টাকার ভাঙানি ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleত্রিকূট দর্শন (প্রথম পর্ব)
Next articleমোনালিসা , শুধু তোমার জন্য (তৃতীয় পর্ব)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments