(ছোটবেলার সেইসব লেখকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যাঁদের লেখা অসাধারণ ভূতের গল্পগুলো আজও আমাকে টানে)

অফিসের কাজে আমাকে প্রায়ই জলপাইগুড়ি যেতে হয়। মাস ছয়েক হলো অফিসের নতুন একটা ব্রাঞ্চ খুলেছে এখানে। তারই তদারকির ভার এসে পড়েছে আমার কাঁধে। এই বিশেষ কাজটিতে সাধারণত আমি পদাতিক এক্সপ্রেস কেই প্রেফার করি। এর অবশ্য একটাই কারণ, সেটা হলো এই ট্রেনটা মাথাভাঙ্গা নামক একটি স্টেশনে দাড়ায় আর সেখান থেকে আমার অফিস এর লোকেশনটাও খুব কাছাকাছি হয়। মাসের মধ্যে একবার কি বড়োজোর দুবার আসতে হয়, তাও ২-৩ দিনের জন্য। অবশ্য আমার কাছে এই জলপাইগুড়ি আসা যাওয়াটা অনেকটা উইকেন্ড এ ছুটি কাটানোর মতোই। জায়গাটা এতো সুন্দর যে মাঝেমধ্যে অফিসে তেমন কাজ না থাকলে একাই বেরিয়ে পড়ি। আশপাশটা ঘুরে দেখতে মন্দ লাগেনা। এখনো অফিসের কোনো কোয়ার্টার তৈরী হয়নি, তাই অফিস থেকেই বুক করা হোটেলই আমার আস্থানা । যদিও এখানে হোটেল বলতে গুটিকয়েক খুবই ছোট মাপের হোটেল আছে, তার ই মধ্যে সুরঙ্গনা নামে একটি হোটেলে আমার বুকিং করা থাকে।

যাই হোক আসল গল্পে আসি। ঘটনাটি ঘটে অক্টোবর মাসে। জলপাইগুড়ির অফিসের লোকেশন নিয়ে একটা আইনি সমস্যা অনেকদিন ধরেই চলছিল। সেটার জন্যই সেবার হটাৎ করে যাওয়া। আসলে সমস্যাটা ছিল থাকার জায়গা নিয়ে কারণ এই সময়টা আবার বাঙালিদের নর্থ বেঙ্গল, দার্জিলিং ঘুরতে যাওয়ার হিড়িক পরে যায়। অফিস থেকে ট্রেন এর টিকিটটা বুক করা গেলেও থাকার জায়গা বুকিং নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছিলো। তখন আমি ই বললাম যে “এতদিন ওখানে যাতায়াত আছে, ওখানকার লোকজন মোটামুটি আমার চেনাশোনা, নিশ্চই কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে”। অফিসের বড়োবাবু একরকম না চেয়েও আমাকে সম্মতি দিলেন কারণ থাকার চেয়েও ওই আইনি মামলার সমস্যার সমাধানটাই বেশি জরুরি ছিল। যাই হোক সাতপাঁচ না ভেবে পৌঁছে গেলাম। হোটেলের রিসেপশন কাউন্টার এ আমাকে দেখে তো ম্যানেজার অবাক। সে বললো “স্যার আপনি !!! কিন্তু কোনো বুকিং এর ইনফরমেশন তো আপনার অফিস থেকে আসেনি। সব ঘর তো অলরেডি booked হয়ে আছে”। আমি মাথা নেড়ে বললাম “জানি, সেটাই তো সমস্যা, কি করবো বলো, এই ২-৩ দিনের জন্য একটা ঘর খুঁজে দাও, খুবই জরুরি কাজে আসতে হয়েছে”। আমার অবস্থা দেখে ম্যানেজার বললো, “স্যার, এই মুহূর্তে কোথাও ঘর পাবেন বলে মনে হয়না, তবুও চেষ্টা করে দেখছি, আপনি বসুন আপাতত” এই বলে ম্যানেজার একটা ছেলেকে ডেকে তাকে কিসব বলে পাঠিয়ে দিলো। আমি পাশের সোফায় বসে একটা সিগারেটে টান দিতে থাকলাম। আধঘন্টা পর ছেলেটা এলো এবং তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো কোনো ঘর পাওয়া যায়নি। সত্যি কথা বলতে আমি এই অবস্থাটার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলামনা। ভেবেছিলাম একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, কিন্তু কোনো উপায় না দেখে জলপাইগুড়ি কিংবা শিলিগুড়ি গিয়ে কোনো হোটেলে ওঠার কথা মাথায় এলো। ম্যানেজারকে বলতেই সে বললো “কোনো লাভ নেই স্যার, এইসময় ওখানে আরোই পাওয়ার সম্ভাবনা কম”। কি করবো, কোথায় থাকবো এইসব ভাবছি আর ইতস্ততঃ বোধ করছি দেখে ম্যানেজার বললো “থাকার একটা জায়গা আছে স্যার, কিন্তু………..”বলে মনেহলো সে নিজেও একটা চিন্তার মধ্যে পরে গেলো। আমি বললাম “কিন্তু আবার কি……আমার থাকার জায়গা হলেই চলবে”।

ম্যানেজার বেশ কিছুক্ষন আবার ভাবলো এবং তারপর আমাকে নিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে বসিয়ে গলা নামিয়ে বললো, “আসলে আমাদের হোটেলেই দোতলায় একটা ঘর আছে, কিন্ত সেই ঘরটা ২ বছর ধরে বন্ধ।  দুবছর আগে এক দম্পতি আত্মহত্যা করেছিল, জানিনা ওরা দম্পতি ছিল কিনা, সেসব নিয়ে পুলিশি কারবার, জেরা তো ছিলই, তার উপর নাকি অনেকে রাতে তাদেরকে দেখতে পায়, তারা নাকি কথা বলে, ঘরে হেটে চলে বেড়ায় এইসব, বুঝতেই তো পারছেন এইসব গল্প লোকের মুখে এতো ছড়ায় তারপর থেকে ওই ঘরটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এমনিতেই লোকজন হয়না, তার উপর টুরিস্ট লোকেরা এসব শুনলে কেউ কোনোদিন আসবে বলে মনে হয় আপনার, আপনি এতদিন আমাদের এখানে আছেন আর আজকে সমস্যায় পড়েছেন বলে আপনাকে সব খুলে বললাম, আপনি দয়া করে কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলবেন না, এরপর যদি আপনার থাকতে মনে হয় তাহলে ঘর খুলে দিচ্ছি। পুরোটাই স্যার আপনার রিস্ক, আপনি যা ভালো বুঝবেন দেখুন।

সত্যি কথা বলতে তখন ভালো মন্দ বোঝার মতো কোনো অবস্থাতেই ছিলাম না। সেই ঘরটা তখন হাতে চাদ পাওয়ার মতো। আমি বললাম ওখানেই থাকবো, আপনি ঘরটা সাফ করে দিন আর দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দিন। এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে স্নান করে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সন্ধ্যা ৭ টা বাজে। তাড়াহুড়ো করে হাত মুখ ধুয়ে নিচে এলাম। ম্যানেজার আমাকে দেখে বললো “রাতে কি এখানেই খাবেন?” আমি বললাম না, এমনিতেও বাইরে যেতেই হতো, সিগারেটে শেষ, ফেরার পথে কোনো হোটেল থেকে খেয়ে আসবো।

রাতে খেয়ে দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফিরছি চেনা রাস্তা দিয়ে আর মনে মনে সকালের ম্যানেজার এর কথাগুলো ভাবছি। সকালে অত টেনশন এর মধ্যে আমল দেয়নি ব্যাপারটা, কিন্তু এখন মনে পড়তেই আপনমনেই হো হো করে হেসে উঠলাম। মনে মনে ভাবলাম “একে শালা থাকার ঘর নেই, তার উপর ভূতের জন্য ঘর বুক করে রেখেছে, যত্তসব…”। হোটেলে ফিরে কিছু অফিসের কাজকারবার করতে আর আইনি কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে প্রায় ১০ টা বেজে গেলো। একটা সিগেরেট শেষ করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে যথারীতি ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য রেডি হলাম আর যাওয়ার পথে ম্যানেজার কে একটু বিদ্রুপআত্মক সুরেই বললাম, “কি মশাই আপনার দম্পতি কি কাল ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি????”

অফিসের কাজ সেরে একেবারে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। সিগেরেটটা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব ধকল গ্যাছে আজ, তবে কাজ টা শেষ করে বেশ একটা শান্তি পাওয়া গ্যাছে মনে হচ্ছিলো। অফিস এ জানিয়ে দিলাম তৎকালে কালকে ticket বুক করার জন্য মানে পরশু রওনা দেব । আগামীকাল সারাটাদিন ঘুরে কাটানো যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। মাঝরাতে ঘুমটা হটাৎ এ ভেঙে যায় একটা চাপা কান্নার আওয়াজ শুনে। কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু মনেহচ্ছে এই ঘরের মধ্যেই কেউ যেন খুব ক্ষীণ স্বরে কাঁদছে। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও কিছুক্ষন পর একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দও যেন  পরিষ্কার শুনতে পেলাম। হটাৎ করে ম্যানেজার এর কথা মনে পড়লো। কাজের মধ্যে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে সেই কথাটা ভুলেই গেছিলাম। তাহলে কি সত্যিই এইঘরে আমি ছাড়া কেউ আছে, তাহলে কি আমি ভয় পাচ্ছি, কিন্তু কেন ? ঘরের মধ্যে চাপা কান্নার আওয়াজটা যেন আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে। তার সঙ্গে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ টাও আরও পরিষ্কার বাজছে আমার কানে। হাত বাড়িয়ে সুইচটা জ্বালাতে যাবো, দেখি হাতটাও  যেন অবশ হয়ে গ্যাছে। শরীর নড়ছেনা, ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে যাচ্ছে। এ কি হচ্ছে আমার, সত্যি কি কেউ আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু কেন, আমাকে কি মেরে ফেলতে চায়. মাথা কাজ করছিলো না, গলা শুকিয়ে আসছে, প্রানপনে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, গলা থেকে আওয়াজ বেরোলোনা। অনেক সময় ভয়ের স্বপ্নে এরকম অবস্থা হয়, তাহলে কি স্বপ্ন দেখছি? না, আমার ভুল ভাঙলো, আমার গায়ে কে যেন একটা টোকা মারলো, কিছুক্ষন পর আবার, বারবার টোকা মারতে থাকলো আমার গায়ে। আমি শরীরের সব শক্তি এক করে বিছানা থেকে দিলাম এক লাফ আর গিয়ে পড়লাম একেবারে দরজার সামনে। সঙ্গে সঙ্গে দরজার পাশে ঘরের সুইচটা  জ্বালিয়ে দিলাম আর তারপর যা দেখলাম তাতে আমার শরীর আরও হিম হয়ে গেলো। দেখলাম আমার বিছানায় বসে এক মহিলা মুখে হাত রেখে ক্ষীণ স্বরে কাঁদছে আর উপরে তাকিয়ে দেখলাম সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে একটা গলা পচা মৃতদেহ, আর তার পা টাই বারবার আমার গায়ে এসে লাগছিলো।  ক্যাচঁ ক্যাচঁ শব্দ করতে করতে সেই দড়িটা যখন একটু ঘুরলো, আরও পরিষ্কার হয়ে গেলো সেই ঝুলন্ত মৃতদেহ টার  মুখ।  সেকি বীভৎস মুখ, আমি কোনোদিন ভুলতে পারবোনা। এরপর আর আমার কিছু মনে ছিলনা, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

এই অবদি বলে ভদ্রলোক থামলেন।

আমিও এতক্ষন মন দিয়ে ঘটনাটা শুনলাম। আমি অভিরূপ, অভিরূপ সেন। কলিকাতা ইউনিভার্সিটি তে রসায়ন নিয়ে পিএইচডি করছি। নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি তে একটা কনফারেন্স এ যাচ্ছি। ৩ দিনের কনফারেন্স, তারপর সেখান থেকে সবাই দার্জিলিং যাওয়ার প্ল্যান করেছি। পদাতিক এক্সপ্রেস এ টিকেট কেটেছি। বাকি বন্ধুবান্ধবরা অন্য কোচে আছে, আর আমার কোচে আছে রাই, পাশের বার্থে ঘুমাচ্ছে। আমার আবার চিরকালই রাতে দেরি করে ঘুমানো অভ্যেস। হোস্টেল এ থাকলে এই এক বদঅভ্ভাস তৈরী হয়, কি আর করা যাবে, রাই তো রীতিমতো একপ্রস্থ গালাগালি শুনিয়ে ঘুমাতে গেলো। পুরো ট্রেনটা ঘুমাচ্ছে আর আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি। রাত প্রায় ২ তো নাগাদ বোলপুর স্টেশন এ ট্রেন ঢুকলো। দেখলাম আমার সামনের সিট এর ভদ্রলোক নেমে গেলেন আর তার জায়গায় উঠলেন আপাদমস্তক চাদর জড়ানো এক লম্বা ভদ্রলোক। এখন অবশ্য অতটাও ঠান্ডা পড়েনি। সবে নভেম্বর এর মাঝামাঝি। আমাকে দেখেই বললেন, “কতদূর? জলপাইগুড়ি নাকি আলিপুরদুয়ার?” আমি কানে হেডফোন লাগানো থাকায় প্রথমে শুনতে পাইনি। তারপর আমি উঠে বসে বললাম জলপাইগুড়ি।  এরপর ভদ্রলোক নিজে থেকেই আলাপ জমালেন এবং বললেন যে এই রুট এ তিনি মাসে ২-৩ বার যাতায়াত করেন অফিসের কাজে। এরপর আরও অনেক অভিজ্ঞতার কথা তিনি বললেন। আমিও আমাদের কনফারেন্স এবং রিসার্চ নিয়ে গল্প করলাম বেশ কিছু। ভদ্রলোক কিন্তু গল্পগুলো গুছিয়ে বলতে পারেন, কিন্তু গল্পের থিমগুলো বড্ডো বোরিং। সত্যি কথা বলতে কি ওনার গল্পে আমি বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট পাচ্ছিলাম না, কিন্তু নিতান্তই ভদ্রলোক, তাই কষ্ট করে শুনতে থাকলাম। গল্পচ্ছলে অনেক কথা হলো এবং আরো জানতে পারলাম যে ওনার নাকি আমার মতো রাতে ঘুম হয়না। আমি বললাম, “আমার নাহয় হোস্টেলে  থেকে এরকম বাজে স্বভাব হয়েছে, কিন্তু আপনার ব্যাপারটা  কি?” তখন ভদ্রলোক বললেন, “তার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো যে তারপর থেকে তার কোনো রাতেই ঘুম আসে না. চোখ বন্ধ করলেই সে ভয়াবহ দৃশ্য ভেসে ওঠে, সে ঘটনা শুনলে নাকি আমারও রাতে ঘুম আসবে না”। আমার এতক্ষনে ইন্টারেস্ট জেগে উঠেছে, বোরিং গল্পের পর এতক্ষনে মনেহচ্ছে ভূতের গল্প শুরু হবে। এই রাতে শালা এটারই অপেক্ষা ছিল, এরকম unknown লোক এর মুখে এতো রাতে ভূতের গল্প, জাস্ট জমে যাবে। আমি উৎসাহ নিয়ে বললাম তাহলে বলুন শুনি। ভদ্রলোক একটু ইতস্ততঃ করে কিছুক্ষন ভাবলেন, তারপর চাদর তা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে শুরু করলেন,

“অফিসের কাজে আমাকে প্রায়ই জলপাইগুড়ি…………………আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।”

এতক্ষণ একনাগাড়ে গল্পটা শুনে বুঝতে পারিনি যে কখন যেন ঘামতে শুরু করেছি। পদাতিক এক্সপ্রেসের মধ্যে এসিটা কি চলছে না নাকি? কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে আমার। চারপাশে অন্ধকার, নীল নাইট ল্যাম্প এর আলোটা যেন পরিবেশটা কে আরো ভয়ার্ত করে তুলেছে। মাঝে মাঝে লোকের নাক ডাকার আওয়াজ ছাড়া আর কিচ্ছু কানে যাচ্ছে না। একরকম ভয় পেয়েই উঠে টয়লেট থেকে হাত মুখে ধুয়ে একটু জল খেয়ে বার্থে এসে বসলাম। ঘড়িতে দেখলাম রাত ২.৩০. আমি কি তাহলে এই লোকটার গল্পে ভয় পেলাম নাকি?? লোকটার মুখটাও ঠিক করে দেখতে পাইনি। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই সব light off, তার উপর এই লোকটা আবার চাদর জড়িয়ে বসে আছে। আমি আবার লোকটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম বলি যে, “এরপর নিশ্চই সকালবেলা হোটেল এর লোকজন আপনাকে ধরে হাসপাতাল নিয়ে গেলো অথবা মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরালো…যেরকম ভূতের গল্পে হয়ে থাকে আর কি”। কিন্তু ভদ্রলোকের সম্মানার্থে আর কিছু বললাম না। এরপর ভদ্রলোককে অনেক্ষন চুপ থাকতে দেখে আমি এ বললাম, “আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো??” ভদ্রলোক বললেন, “বলবে এই যে এরপর নিশ্চই সকালবেলা হোটেল এর লোকজন আমাকে ধরে হাসপাতাল নিয়ে গেলো অথবা মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরালো কিনা ??? তুমি তো বিশ্বাস করবে না আমি জানি”। আমার জায়গায় থাকলে তুমি বুঝতে। আমি বললাম, “না না আপনি কি বলছেন, আমি পুরোটাই বিশ্বাস করেছি, আমি শুধু জানতে চাইছিলাম যে ছেলেটির মুখটা আপনি দেখেছেন আর মেয়েটার মুখটা দেখেছেন কি??” ভদ্রলোক কোনো উত্তর না দিয়ে কেমন একটা চুপ মেরে গেলেন। মনেহয় তিনি ভাবলেন যে আমি বাজে রসিকতা করছি। যদিও ওনার গল্পে মেয়েটা মুখ ঢেকে কাঁদছিলো, কিন্তু আমি তো শ্রোতা, আমি তো প্রশ্ন করতেই পারি (আপনারাই বলুন আমি কি ভুল ???) এইসব বাজে চিন্তা ভাবনা করছি এমন সময় পাশের বার্থ থেকে রাই উঠে বললো “কিরে অভি এখনো ঘুমাসনি, এতো রাত জেগে কি গল্প করছিস, পারিস ও বটে, বলতে বলতে রাই উঠে টয়লেট এর দিকে চলে যায়। নীল আলোয় আধো আধো ঘুমে রাই কে খুব সুন্দর  দেখায়। এতক্ষণে ভদ্রলোক আবার বলে উঠলেন, “উনি তোমার সাথে আছেন? মানে উনিও কি তোমার সাথে কনফারেন্স যাচ্ছেন”। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “হ্যা, দেখলেন ওকে”?? ভদ্রলোক বললেন, “না মানে…আধো অন্ধকারে তো কাউকেই দেখা যায় না ঠিক করে, কিন্তু কেন বলুন তো” ?

আমি বললাম “সেকি, আজও পেলেন না ওর মুখ টা দেখতে”

ভদ্রলোক কেমন একটি থতমত খেয়ে বললেন, “মানে?? কি বলতে চাইছো কি তুমি ???”

আমি তখন ভদ্রলোকের মুখের সামনে মুখটা নিয়ে গিয়ে বললাম, “দেখুন তো আমার মুখটা চিনতে পারছেন কিনা???”

রামপুরহাট স্টেশন এ ঢোকার মুখে জানলার বাইরের অস্পষ্ট আলোয় ভদ্রলোক পরিষ্কার দেখলেন আজ থেকে ১ মাস আগের সেই রাতে দেখা হোটেলে ঝুলন্ত মৃতদেহের ভয়াবহ মুখটা। পরদিন দুপুরবেলায় নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনের কারশেডে ট্রেন ঢোকার আগে যখন আরপিফ এসে ট্রেনের বগি চেক করছে তখন সে দেখে লোয়ার বার্থে চাদরে ঢাকা একটি মানুষ শুয়ে আছে। অনেক ধাক্কাধাক্কির পরও কোনো নড়নচড়ন না দেখে চাদর সরিয়ে সে দেখে ……… একটি মৃতদেহ, তার চোখ বিস্ফারিত।

আর আমি মানে অভিরূপ সেন, আমি কিন্তু বেঁচে আছি…

ওহ আচ্ছা বুঝেছি। গল্পটা পড়ে আপনি ভাবছেন যে আমি আর রাই হলাম গিয়ে সেই দুজন দম্পতি যারা হোটেলে গিয়ে সুইসাইড করেছিলাম আর সেই ভদ্রলোকটিকে ভয় দেখিছিলাম পরে, তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। আমি রাই কে সত্যি খুব ভালোবাসি, কিন্তু ওই আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতো বলতে ভয় পাই, যদি না করে দেয় তাহলে কি হবে….আবার কি জানেন তো একতরফা ভালোবাসার একটা আলাদা মজা আছে, একটা আলাদা essence আছে…… এই দেখুন ভূতের গল্প থেকে আবার প্রেমে ঢুকে যাচ্ছি কেন!!!!!!

তবে সত্যি বলতে কি জীবনে একটা বাজে কাজের জন্য আফসোস থেকে যাবে………সেদিন রাতে ওই ভদ্রলোকের সাথে ভূত সেজে মস্করা করাটা ঠিক হয়নি….উনি ওই আধো আলোতে আমার মুখটা দেখে যে এতো ভয় পেয়ে যাবেন ভাবতে পারিনি…..ওনার চোখ দুটো almost ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিলো…..উফফ কি ভয়াবহ সে দৃশ্য…..তারপর ভদ্রলোক যে চুপ মেরে গেলেন আর উঠলেনই না…. আমরাও সবাই নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে গেলাম। দার্জিলিং ট্রিপটা জাস্ট অসাধারণ ছিল…আসলে রাই ছিল তো তাই দার্জিলিং কেন দ্বারভাঙা ট্রিপ হলেও অসাধারণ হত……

তবে দুটো ইচ্ছা আছে জীবনে, সেটা হলো যদি আবার কোনো দিন ওই ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয় ক্ষমা চেয়ে নেবো, আর একটা হলো সেই সুরঙ্গনা হোটেলের দোতলার ঘরটা আদৌ আছে কিনা সেটা গিয়ে দেখবো

(পদাতিক এক্সপ্রেস, কলিকাতা ইউনিভার্সিটি এবং নর্থ বেঙ্গল ছাড়া পুরোটাই কাল্পনিক। আর রসায়নে পিএইচডি আর প্রেমটা অলৌকিক)

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকালের মন্দিরা
Next articleমেঘলা দিন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments