মোম্বাসাতে অলস দু সপ্তাহ কাটানোর পর, বন্দরে গিয়ে জানলাম যোগ্য কাগজপত্র না থাকলে আন্তর্জাতিক জাহাজে সফর করার ছাড়পত্র পাওয়া যাবে না। সলমন বা মৌরিনের কোনই কাগজপত্র নেই। বাড়লো অন্য এক দায়িত্ব, হন্যেহয়ে মোম্বাসায় খুঁজছি কিভাবে ওদের কাগজপত্র তৈরি করা যায়। একদিন বিকেলে ফিরে দেখি ঘর অন্ধকার, মৌরিন গেছে বাজারে। আলো জ্বালতে দেখি সলমন বিছানায় ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে, অসুস্থ নাকি? জিজ্ঞেস করতে বললো, পা ফুলেছে, কোমড়ে বিষ ব্যাথা, সামান্য জ্বরও, কদিন ধরে প্রসাব করতে অসুবিধে হচ্ছিলো আজ রক্তও বেরিয়েছে।
রাতেই কাছাকাছি এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম সলমনকে। অল্পবয়স্ক ডাক্তারটি সব শুনে বললেন দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে । হাসপাতালে কদিন নানা পরীক্ষা হল। সপ্তাহ খানেক পরে ডাক্তার জানালেন প্রোস্ট্রেটে ক্যান্সার, অত্যন্ত অ্যাডভান্সড স্টেজে, চিকিৎসার কোনই আর অবকাশ নেই, আয়ু বড়ো জোর আরও দুমাস ।
ডাক্তারের কথা শুনে সলোমন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, জানতাম ঈশ্বর একদিন আমার পাপের শাস্তি দেবে, এমন ভাবে এতো তাড়াতাড়ি দেবেন, বুঝতে পারিনি।
স্বান্তনা দিলাম, নিজেকে বা পরিবারকে রক্ষা করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়া, কোনোটাই পাপ নয়।
স্লান হেঁসে সলোমন বলল, তুমি তাই জানো যা আমি বলেছি, আসল সত্যিটা এখনো জান না।
মানুষ মৃত্যুকে সবথেকে বেশি ভয় পায়, আসন্ন মৃত্যুর কথা আগাম জানতে পেরে সলোমন বিস্মিত। ভাবলাম বিস্ময়ের ঘোরে প্রলাপ বকছে। তবুও নিজের কৌতূহল দমন করতে না পেরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, আসল সত্যিটা কি?
সলমন কোনো কথা না বলে হাঁটতে লাগল। ওর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি। আমার প্রশ্নে নির্বাক দেখে মনে মনে ভাবলাম হীরে আর গুপ্তধনের গল্প মিথ্যে এই বলবে হয়তো। তাতো আমি রোজই মনে মনে ভাবি। কিন্তু সলোমন যা বলল শুনে আমার মাটির তালার জমি যেন নড়ে উঠল, বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এতক্ষনে বুঝলাম কেন পাপ করার কথা ও বলছিল।
সলমনের বলে, আজ যা তোমাকে বলব সবই আমার জীবনের সত্য ঘটনা। তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমার মৃত্যু পর্যন্ত একথা কাউকে বলবে না, মৌরিনকেও নয়।পাদ্রীর সামনে গিয়ে স্বীকারোক্তি করার সাহস নেই। মনে করো তোমার কাছেই জীবনের সায়াহ্নে স্বীকারোক্তি করছি।
অভয় দিলাম, যা শুনবো সবই আমার মধ্যেই থাকবে, কেউ জানবে না ।
সলোমন বলতে লাগলো, দীর্ঘদিন দরিদ্রের যাতনা আমাকে অর্থ লোভি করে দিয়েছিলো ঠিক যেমন ক্ষুধার্তের খাদ্যের প্রতি স্বাভাবিক লোভ হয় । মাথায় ঘোরপাক খেত নানা চিন্তা কিভাবে চটজলদি বড়লোক হওয়া যায়, নিষ্কৃতি পাওয়া যায় দরিদ্রের যন্ত্রনা থেকে। খনি থেকে হীরে বের করার প্রক্রিয়া আমার মস্তিষ্কেই আসতেই কুট বুদ্ধি খেলে গেলো, কেন না আরো কজনকে দলে নি, তাতে কাজ তাড়াতাড়ি হবে। চার জনক শ্রমিককে দলে নিলাম। প্রথম থেকেই ছক কষে রেখেছিলাম খানিক হিরে জমলেই পরিবার আর হীরে নিয়ে চম্পট দেব কোন বিদেশ বিভূঁইয়ে যেখানে কেউ আমার খোঁজ পাবে না।
আমার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিলো চারজনই। খানিক হিরে জমতেই সকলে তা ভোগ করতে চাইল। দাবি উঠল আমাদের ভাগ দিয়ে দাও। আমি তো সকলকে ভাগ দেবার জন্য এতো ফন্দী আঁটিনি। সেই সময় হীরে নিয়ে পালতে গেলে ধরা পড়ে যেতাম । অন্য ফন্দী আঁটলাম, হঠাৎ একরাতে সুস্বাদু খাবার, পানীয় নিয়ে পৌঁছলাম একজনের বাড়ি যে রোজই হীরের বখরা চাইছিল কারণ তার প্রতিদিন মদেই অনেক খরচ। সুস্বাদু খাবারের আর মদের লোভ সামলানো ওর পক্ষে মুশকিল জানতাম । খাবারে মেশানো ঘুমের ওষুধে মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে অচেতন করে দিল, এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, ওদের সকলকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে চুপচাপ বাড়ি ফিরলাম। পরদিন ওই পরিবারের মৃত্যুর খবর ছড়াতেই দলের বাকি তিনজনের কাছে রটিয়ে দিলাম শুঁড়িখানায় নিশ্চয় কিছু বেফাঁস বলে ফেলেছে আর গুপ্তচর মারফৎ মালিকের কানে তা চলে যাওয়ায় মালিকদের লেঠেলদের হাতে ওর পুরো পরিবারের মৃত্যু হয়েছে ।
ভয়ে সকলে সিঁটিয়ে গেল কিছুদিনের জন্য। আতঙ্কিত মুসোর বাবা একদিন রাতে এলো জানাতে ও নিজের ভাগের হীরে নিয়ে যত শীগ্র সম্ভব অন্য জায়গায় চলে যেতে চায়। ওকে বললাম রাত বাড়ুক চিরিদিক নিশুতি হলেই ওর ভাগের হীরে আজই ওর বাড়ীতে পৌঁছে দেব ।
মোসের বাবা মানে খনি শ্রমিকদের সর্দার?
আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সলমন বলতে থাকে রাত গভীর হলে ওর ভাগের হীরে আর এক বোতল মদ নিয়ে পৌঁছলাম ওর বাড়ী। হীরে পেয়ে বেজায় খুশী। বললাম হয়তো আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না হীরেকে সাক্ষী করে একসঙ্গে এক গ্লাস হয়ে যাক, ওর বৌকেও আমন্ত্রণ জানালাম। আমার অভিসন্ধির বিন্দুমাত্র আঁচ না করে দুজনেই তীব্র্র ওষুধ মেশানো সুরা পান করে অচৈতন্য। কোমরে গোঁজা ছোরা দিয়ে ওদেরকে শেষ করে, হীরাগুলো আর ঘুমন্ত মোসেকে কোলে করে অন্ধকারে মিলিয়ে যাই । সেদিন ভোর রাতেই বাইবেল আর মৌরিনকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দি ওর আত্মীয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মনে মনে ভাবছিলাম কাকে বিশ্বাস করে এই পথ পাড়ি দিয়েছি, এতো নিজের স্বার্থে মিথ্যাচার বা খুন কোনটাই করতে পেছপা হবে না। যতই মৃত্যুপথযাত্রী হোক, ঠিক করলাম ওর দেয়া আর কিছু খাওয়া চলবে না।
মোসেকে বাঁচিয়ে রাখলে কেন? ওকেও তো শেষ করে দিতে পারতে?
কি করে ওকে মারবো ওতো আমারই রক্ত, সলমন ডুকরে ওঠে।
আমার সারা শরীরে যেন এক শৈতপ্রবাহ বহে গেল, মানে? তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
মোসের মায়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল যা কেউ জানতো না। মোসে যখন পাঁচ, টাইফয়েডে ওর মা মারা যায়। ওর কথিত বাবা আবার বিয়ে করে। ইচ্ছে ছিল মোসেকে আমার সঙ্গেই রাখি কিন্তু পারিবারিক শান্তি বজায় রাখতে তা আর পারি নি।
যাই হোক মোসেকে রেখে ফেরবার সময় মনে একটা খটকা লাগে। মনে পড়ল অচৈতন্য হওয়ার আগে মোসের বাবা জড়ানো শব্দে বলছিলো কাকে যেন বলেছে আজ হীরের ভাগ পাবে। ফিরে বাড়ির হাল দেখেই বুঝলাম কি হতে পারে। আমার আর মৌরিন দুজনের জীবন বিপন্ন। পালালাম।
তুমিই যদি সকলকে খুন করে থাকো তাহলে তোমার বাড়িতে কারা হামলা করল?
চলবে …………