কোড নেম প্রমিথিউস
“তোমার নিশ্চয়ই সবাই জানো একটা মানুষের গড় আয়ু 70 বছর। এবং এই 70 বছরের মধ্যে কতবার সে রোগে আক্রান্ত হয়, তোমরা নিশ্চয়ই জানো। আর এটাও জানো যে, তার মধ্যে কিছু কিছু রোগ অবশ্যই প্রাণঘাতী। যেমন স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার। এগুলোকে যদি একবার সম্পূর্ণরূপে দূর করা যায়, তাহলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন অনেক, অনেক বেশি ভাল করে দেওয়া সম্ভব।
হাইনরিখ আর আমার, আমাদের দুজনেরই চিন্তাভাবনা কনভার্জ করল একটা জায়গায়। একটা বিশেষ মাইথোলজিকাল ক্যারেক্টারের ওপর।“ স্যার ছবিটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললেন, “চিনতে পেরেছ তোমরা? এর কথাই বলছিলাম।”
আমি আর বর্ণালী মাথা নাড়লাম। বললাম, “না স্যার, ছবির এই মানুষটা কে? হারকিউলিস?”
সমুদ্র কিন্তু স্যারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। স্যার স্মিত হেসে বললেন, “ না, হল না। সমুদ্র, তুমি নিশ্চয়ই চিনেছো?”
সমুদ্র চাপা স্বরে উত্তরটা দিল,”হ্যাঁ স্যার, এর নাম প্রমিথিউস।“
“ঠিক চিনেছো।“ স্যার একদৃষ্টে ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই প্রমিথিউস। গ্রীক পুরাণের প্রমিথিউস। টাইটান ল্যাপেটাস, আর ক্লিমেনের ছেলে। প্রমিথিউসের ভাইদের মধ্যে তোমরা এপিমেথিউস আর অ্যাটলাসের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী প্রমিথিউসই প্রথম মানুষ গড়েছিল। এছাড়া আরও অনেক গল্প আছে প্রমিথিউসকে নিয়ে। তাতে আর গেলাম না আমি।
তোমরা নিশ্চয়ই প্রমিথিউসের আগুন আনার গল্পটা পড়েছ। প্রমিথিউসের একটা বিশেষ ক্ষমতা ছিল। সে ভবিষ্যৎ দেখতে পারত। তো সে একদিন দেখল যে, দেবরাজ জিউস মানুষের সাথে অন্যায় করবে, মানুষকে সে আগুনের ব্যবহার শিখতে দেবে না বলে। এই কাজটা তার একদমই বরদাস্ত হল না। তাই সে কায়দা করে মানুষের জন্য আকাশ থেকে আগুন চুরি করে আনলো। এথেন্সবাসী তার এই সাধু উদ্দেশ্যকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য রিলে রেসের প্রচলন করলো, যেখানে জ্বলন্ত মশালটা, যে রিলে কমপ্লিট করে তার হাত থেকে পরের জনের হাতে চলে যায়। বুঝতেই পারছ অলিম্পিকসের একদম প্রথমের ইভেন্টটার কথা বলা হচ্ছে, যেটা আজও চলে আসছে।
যাই হোক, জিউস এটা একদমই সহ্য করতে পারলেন না। উনি প্রমিথিউসকে শাস্তি দিলেন এই বলে, যে সে রোজ বাঁধা থাকবে ককেশাস পর্বতমালার ওপর থাকা সবথেকে উঁচু পাথরটায়। রোজ একটা ঈগল আসবে, আর রোজ তার লিভারটা ঠুকরে ঠুকরে খাবে। ঈগল জিউসের প্রতীক। কিন্তু জিউস যেটা ভুলে গিয়েছিলেন, সেটা হল যে, প্রমিথিউস একজন টাইটান। তাই যতবার ঈগলটা প্রমিথিউসের লিভার খেয়ে যেত, রাতারাতি সেই আধখাওয়া লিভারটা আবার আগের মত হয়ে যেত। এভাবেই হয়ত চলত, কিন্তু একদিন হারকিউলিস এসে সেই ঈগলটাকে মারে, আর প্রমিথিউস মুক্ত হয়।“
আমরা তখনও যেন একটা ঘোরের মধ্যে। মনের মধ্যে হাজারো রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সবথেকে বড় প্রশ্ন এটাই যে, পুরানের সাথে এই গবেষণার সম্পর্ক কি?
হঠাৎ করেই স্যারের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। স্যার ফোনটা ধরে ওপাশে কারোর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। দেখলাম, স্যারের চোখে মুখে একটা হাসি আর আনন্দের ভাব ফুটে উঠেছে। ফোনটা শেষ হতেই বর্ণালী জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার স্যার? ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া গেছে?”
স্যার স্মিত হেসে বললেন, “হেলেনিক জেন্ডারমির ওপর অতটাও ভরসা নেই, তবু এখানকার ডিসিপি যিনি, উনি আমার ভাল বন্ধু। উনি এখন ফোনে জানালেন, যে একটা সলিড লিড পেয়েছেন উনি ঝিনুককে খুঁজে পওয়ার। তাই কাল,আমাকে একবার ডেকেছেন সকালে। কালকে অপারেশন করে হয়ত উনি কিডন্যাপারদের খুঁজে বের করতে পারবেন। যদি ঝিনুককে পাওয়া যায়, তাহলে তো কথাই নেই। তাহলেও তোমাদের ছাড়ছি না। যতদিন আছ, তোমরা আমার অতিথি। পুরো গ্রিস ঘুরিয়ে আনব তোমাদের।“
আমি কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু স্যার, আপনার গবেষণার কথা?”
স্যার শান্তভাবে বললেন, “আচ্ছা, কাল ঝিনুককে ফিরিয়ে আনি। তারপর তোমাদের সব বলব। কেমন? কিন্তু একটা শর্ত আছে।“
“কি স্যার?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমাকে কথা দাও, যে গবেষণার কথা আমি তোমাদের বলব, সেটাকে তোমরা গল্প হিসেবেই নিও। নিয়ে ভুলে যেও।“ স্যারের গলায় যেন মিনতির সুর।
আমরা তিনজনে একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। এ কিরকম শর্ত? তারপর সমুদ্র গলা খাঁকড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে স্যার, তাই হবে।“
স্যারের গলায় সেই আগের আত্মবিশ্বাস শুনলাম।“ হতেই হবে। মা আমার ঠিক ফিরে আসবে আমার কাছে।“
সমুদ্র আর বর্ণালী বেশ উৎফুল্ল হয়েই বলল, “বেশ স্যার। তাই যেন হয়।“
আমিও সায় দিলাম, কিন্তু মন যেন বলছিল, যে ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে না।
তিন
বিকেলে বেরিয়েছিলাম স্যারের বাগানবাড়ীটা থেকে। বর্ণালীর পার্স এই কিছুক্ষণ আগে এক স্থানীয় চোরের কাছে থেকে উদ্ধার হয়েছে। দুজন কনস্টেবল এসেছে বর্ণালীর খোঁজে। তার পার্সটা তাকে গিয়ে আইডেন্টিফাই করে আসতে হবে। বর্ণালী তাই বেরিয়েছে। সঙ্গে ক্রিসও গেছে শোফার হিসাবে। আজ সকালে স্যারের সাথে সমুদ্রও গেছে পুলিশের কাছে, কারন স্যারের প্রেশারের রোগ। হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে, দেখার লোক কম। এর মধ্যে রইলাম পড়ে আমি। যেহেতু আমার হাতে কিছু কাজ ছিল না, আর তাছাড়া, ঝিনুককে পাওয়াই যাবে, তাই আর বেশি চিন্তা করার কিছু ছিল না বলে স্যারের বাড়ি থেকে মিনিট দশেক দূরেই বিচের পাশের ড্রাইভটার রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম।
ড্রাইভের পাশে দিয়ে যখন হাঁটছিলাম, তখন রাস্তার দুপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। বিকেল আটটা তখন। বলা হয়নি, যেহেতু গ্রিস, গ্রিনিচের থেকে দুঘণ্টা মতন এগিয়ে, তাই এখানে গ্রীষ্মকালে আটটা, সাড়ে আটটাতেও সূর্য অস্ত যায় না। সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। গাড়িগুলো বেশ দ্রুতগতিতেই বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। বিচে অনেক ছেলেমেয়ে ফুটবল নিয়ে বিচ ফুটবল খেলছে। দূরে তাদের বাবা-মা রা সেই খেলা দেখছেন। কেউ কেউ ছাতার তলায় সানস্ক্রিন লোশন মেখে শুয়ে আছেন। দূরে দু তিনজন অত্যুৎসাহী যুবককে দেখলাম কোস্টাল গার্ডকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন জলে নামতে দেবার অনুমতি দেবার জন্য। কিন্তু গার্ডের মুখ দেখে মনে হল না, বিনা কাঞ্চনে তিনি ওদের কথায় কর্ণপাত করবেন বলে। ব্যস্ত জীবনের চিহ্ন চারদিকে। কাছেই ইজিয়ান সাগর আছড়ে পড়ছে তীরে। বালির ওপর হেঁটে যাওয়ার জন্য যে পায়ের ছাপগুল পড়েছিল, সেগুলো মুছে যাচ্ছে নিমেশেই।
এত কিছুর মধ্যেও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল যে মানুষটা, সে হল, মিটার বিশেক দূরে, একটা পাথরের ওপর বসে থাকা বুড়ো এক জিপসি। এই গ্রীষ্মের মধ্যেও সে গায়ে খুব পুরনো একটা আলখাল্লা গোছের জামা, আর পরনে ফাটা জিনস পড়ে বসে আছে। জিপসির বয়স হয়েছে। হাত বলিরেখায় ভর্তি হয়ে গেছে, নীল শিরা-উপশিরাগুলো ফুটে উঠেছে হাতের ওপর করা ট্যাটুগুলোর নীচ থেকেও। বোধহয় বহুদিন রোদে- জঙ্গলে ঘুরেই ওনার গায়ের রং এত তামাটে বর্ণ ধারন করেছে। জিপসির বয়স বলা মুশকিল, কেননা তার মুখটাকে জরা খুব একটা আক্রমণ করেনি। কিন্তু, সমুদ্রের মত নীল চোখদুটো যেন বহুদূরের কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে সবসময়, অন্তত দেখে তো আমার তাই মনে হল। মাথার চুল অবিন্যস্ত, কাঁধ অবধি নেমে এসেছে সেই চুল। এককালে হয়ত সে খুব শক্তিশালী ছিল, এখন বয়সের ভারে অল্প নুয়ে গিয়েছে।
জিপসির পাশে একটা ঝোলা ব্যাগ। হাজার একটা তাপ্পি তাতে, আর তার পাশে একটা খাঁচা, যাতে একটা নাম না জানা, লাল হলুদ পালকের বড় পাখি। খুবই এক্সোটিক দেখতে সেই পাখিটাকে, এরকম পাখি আগে দেখিনি কখনও।
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৬) ~