কোড নেম প্রমিথিউস
ইতিমধ্যেই আমরা বিশাল সম্মান পাচ্ছিলাম। খালি হাতে অতগুলো সন্ত্রাসবাদীর মোকাবিলা করে সবাইকে ঘায়েল করার জন্য রীতিমত পাবলিসিটি হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ক্রিস বুদ্ধি করে একটা ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠিয়েছিল লাইটহাউসের মধ্যে থাকা রেডিও থেকে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পুলিশ জেটি এসে আমাদের উদ্ধার করে। সেখান থেকেই হাসপাতালে সোজা আমাকে যেতে হয়। বাকিদের চোট খুব বেশি ছিল না। ওরা কমবেশি বিধ্বস্ত ছিল, কিন্তু এমনিতে অক্ষতই ছিল। তবে, মিডিয়ার সামনে কেউই আসল ঘটনার একটা ঘটনাও ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করিনি। বলেছিলাম, একটা উড়ো ফোনে ওদের হুমকি শুনে আমরা চলে এসেছিলাম এই দ্বীপে, তারপর গেরিলা পদ্ধতিতে (সমুদ্রের আইডিয়া, যদিও আমার আর বর্ণালীর বক্তব্য ছিল এই গাঁজাখুরিটা ধোপে হয়ত টিকবে না) যুদ্ধ করে, ঝিনুককে উদ্ধার করি। স্যার আমাদেরকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, তাই সত্য গোপন করতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা। আর তার থেকেও বড় কথা, সব কিছু জেনে ফেলতে নেই। কিছু জিনিস না জানা থাকাই ভালো।
ট্যাবলেটটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হয়ে যাবারই কথা, অত কড়া ডোজের সালফিউরিক অ্যাসিডে লোহা, সিমেন্ট ক্ষয়ে যায়, পাথর তো দুরের কথা। গ্রানাইট পাথরের ট্যাবলেট হবার দরুন ক্ষয়ের হাত থেকে এতদিন বেঁচে ছিল পাথরটা। তবে অ্যাসিড পড়ার দরুন লেখাগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পাথরের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটা স্যার বোটে করে ফেরার সময় ইজিয়ান সাগরেই ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।
আনন্দের কথা এটাই, যে স্যার আবার ফিরে আসবেন আমাদের দেশে। ঝিনুকের গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলেই ফিরে আসবেন উনি। আমাদের উনি তাই জানিয়েছেন। খবরটা শুনে সবাই খুব খুশি হয়েছিলাম, যদিও সমুদ্র, স্যার আমার বেডের সামনে থেকে সরে যাওয়ার পর, আমার মেজাজটাই বিগড়ে দিয়েছিল আমাকে ভেংচিয়ে, “এখনও এক বছর, কলির কেষ্ট।“
বলাই বাহুল্য, ইঙ্গিতটা কার দিকে ছিল, বলে দিতে হবে না।
এই কয়েকঘণ্টা হল ছাড়া পেয়েছি হাসপাতাল থেকে। আপাতত স্যারের বাড়িতে বেড রেস্ট আরও হপ্তা চারেকের। তারপর বাড়ি ফিরব। গ্রিস সরকার আমাদের জন্য আমাদের ভিসা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই থাকতে পারছিলাম। নয়ত আজই ছিল আমাদের চলে যাবার দিন।
ভোরবেলা তখন। গাড়িটা ঝিনুকই চালাচ্ছিল। ও যে ভাল ড্রাইভার সেটা জানতাম না। যদিও ক্রিস, গ্রিস থেকে ফেরার দিন আমাকে বলেছিল। কলেজে পড়ার সময়ই মাঝে মাঝেই ও ক্রিসের গাড়ি নিয়ে পালাত গাড়ি চালানো শেখার জন্য। সেটা ক্রিস ভয়ে বলত না স্যারকে। পরে স্যার জানতে পেরে খুব রেগে গেলেও ওর লাইসেন্সের জন্য ওকে অ্যাপ্লাই করতে বলেন। আর এখন তাই ফুল লাইসেন্সড হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে ও।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই আমি ঝিনুককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিভাবে ও সেই বিদ্যুৎশিখা তৈরি করেছিল। কিন্তু, ও হাজার চেষ্টা করেও তখন কি ঘটেছিল মনে করতে পারেনি। ও বলেছিল, সেই অবস্থায় ও কি করে সেই অসম্ভব সম্ভব করেছিল, তা ওর জানা নেই। আমার ব্যক্তিগত মতামত, সেই প্রচণ্ড বিপদের সময় হয়ত প্রচুর পরিমাণে অ্যাড্রিনালিন রাশ হয়েছিল বলেই এই কাজটা করতে পেরেছিল সে। কিন্তু এটা আমার মতামত, সঠিক ব্যাখা জানা নেই আমারও। বিদ্যুৎশক্তিকে একটা কুড়ি বছরের মেয়ে কিভাবে নিজের তালুবন্দি করতে পেরেছিল, জানতে হয়ত এই সভ্যতার আরও হাজার বছর লেগে যাবে…
এই কয়েকদিনে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল আমাদের মধ্যে। আমার যত্ন, দেখাশোনা সব ঐ করত। সমুদ্র, বর্ণালী আড়ালে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসত, কিন্তু আমি গা করতাম না। স্যারও খুব একটা কিছু মনে করতেন না।
আমরা ফিরছিলাম সাগরের পাশের সেই ড্রাইভটা ধরেই। হঠাৎ করেই একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার। সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুককে বললাম, “একটু গাড়ি থামাবে প্লিজ?”
স্বাভাবিকভাবেই সে আপত্তি করে, “পাগল নাকি? এখানে দাঁড়িয়ে তোমার কি করার আছে? হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা না? চল, ঘরে চল। মানে একটু সুস্থ হতেই আবার পাগলামি শুরু।“
“জাস্ট পাঁচ মিনিট। একটু পার্সোনাল কাজ আছে।“ আমি মিনতি করলাম।
ঝিনুক দোনোমোনো করে বলল, “আচ্ছা পাঁচ মিনিটই কিন্তু। তারপর কিন্তু আমি নিতে চলে আসব।“
“আচ্ছা, আসিস।“ আমি হাসিমুখে বললাম।
ডানহাতে গাড়ির দরজা খুলে নামলাম। বেশিদূর যেতে হল না। দেখলাম, বিচের ওপরেই একটা বালির পাহাড় বানিয়ে তার পাশে বসে আছে সেই জিপসি আর তার পাশেই তার কাঁধের ওপর বসে রয়েছে জাইফন।
বিচের এই দিকটা নির্জন। তার ওপর ভোরবেলা। কেউ কোথাও নেই। আমি জিপসির পাশে গিয়ে বসলাম।
জিপসি আমার হাতের দিকে তাকাল। তারপর মৃদু হেসে বলল, “তাহলে মিঃ সেনের কিছু হয়নি। ফাঁড়াটা তোমার ওপর দিয়েই গেছে।“
“কি করে জানলে?” আমি আরও একবার অবাক হলাম।
“এটা জানার জন্য ভবিষ্যৎ দেখতে হয় না। খবরের কাগজে তোমাদের সবার বড় করে ছবি বেরিয়েছে। দুদিন আগেই চোখে এসেছে আমার। ওরা অবশ্য তোমাদের বলা গল্পটাই লিখেছে, বাস্তবে কি হয়েছে, লেখেনি, তাই না?” শেষ কথাটা বলার সময় জিপসি সোজা আমার চোখের ওপর চোখ ফেলে।
আজ সন্দেহটা দৃঢ় হয়। কে এই জিপসি? কি করে সে সব জানে? কি করে সে বলে দিচ্ছে, যে আমরা যা বলেছি, সব সত্য নয়? আমরা সত্য গোপন করেছি, সেটা সে কি করে জানল?
জিপসির সেই উজ্জ্বল নীল চোখদুটো দেখতে দেখতে হঠাৎই সেই রাতের কথা মনে পড়ে যায় আমার। ঝিনুকের চোখও তো এরকম জ্বলছিল।
হঠাৎ ঘটনাগুলো একসূত্রে গাঁথা পড়তে থাকে। এত সঠিক ভবিষ্যৎবাণী, সেই এক নীল চোখ, স্যারের ঘরে থাকা সেই ছবির মুখটা, আর তার সাথে এই অমোঘ আকর্ষণ তার ভবিষ্যতের প্রতি, মানুষের প্রতি।
আস্তে আস্তে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখি, আমার দেখাদেখি জিপসির মুখেও হাসি ফুটেছে। অমলিন, সুন্দর এক হাসি।
জিপসি আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, “যাক, চিনতে পেরেছ তাহলে।“
“কিন্তু, মানে, তুমি আসল? মানে বেঁচে আছ এখনও?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। শ্রদ্ধায় মাথা আপনা হতেই নত হয়ে এল আমার।
“হ্যাঁ। আমি এখনও বেঁচে আছি। এবং হয়ত আজীবন বেঁচে থাকব।“ জিপসি হাসতে হাসতে বলে, “এটাই তো এই অমরত্বের সাজা, অয়ন। যাকে জন্ম দিয়েছি, তাকে নিজের চোখের সামনে বড় হতে দেখা, এবং একটা সময় তার মৃত্যুও আমাকে দেখে যেতে হবে। অথচ আমি মরতে পারব না। এই চক্রবাক থেকে আমার কখনোই বেরোনো হয়ে উঠবে না।“
“আচ্ছা, কি করে তুমি মানুষের জন্ম দিলে বল তো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
জিপসি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। আমি রেগে গিয়ে বললাম, “বলবে না তাহলে?”
“উঁহু, সব জেনে ফেলতে নেই।“ জিপসি মুচকি হেসে ভোর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল। আকাশের রং ফিকে হচ্ছে আস্তে আস্তে। “আর তাছাড়া, হাতে সময় কমে এসেছে অয়ন। আমাকে ফিরতে হবে। কাজেই আর মাত্র দুটো প্রশ্নের উত্তর দেব।“
“বেশ। আমার প্রথম প্রশ্ন এটাই যে, তুমি এত যুগ আগে কি করে এগুলো আবিষ্কার করলে?” আমি বিস্ময়ে বললাম। “এগুলো তো আমরা আজ জানছি। তোমরা কি করে এতকিছু এত আগে জেনে গেলে? এগুলো ম্যাজিক নাকি?”
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ২০) ~