কোড নেম প্রমিথিউস
“আস্তে, বন্ধু, আস্তে। আমি যা শুনেছি, তোমার শরীরটা এখন ভালো যাচ্ছে না।“ হাইনরিখ চোখ টিপল। “বেশি উত্তেজনা কিন্তু তোমার স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ কিন্তু। যাই হোক, ওসব পুরনো কথা ছেড়ে কাজের কথায় আসি। প্রমিথিউসের নিজের হাতে লেখা ট্যাবলেট, সেটা কোথায়?”
স্যার বললেন রুদ্ধস্বরে, “আগে আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাই। তারপর তোমার ট্যাবলেটের কথা।“
হাইনরিখ হাহা করে হেসে উঠল। তারপর হাসতে হাসতেই বলল, “তোমার কি মনে হয়, তুমি এখানে নেগোশিয়েশনের জায়গায় আছ? আটটা বন্দুক তোমার দিকে তাক করা আছে। তুমি একটাও টুঁ শব্দ করবে, প্রত্যেকটা গুলি তোমাদের প্রত্যেকটা স্কাল বোন টুকরো টুকরো করে বেরিয়ে যাবে। কাজেই নিজের ভাল চাও তো পাথরটা দিয়ে যাও।“
স্যার খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। রাগে কোনও কথা বেরোচ্ছিল না ওনার মুখ থেকে। তারপর মাথা ঠাণ্ডা করে বললেন, “ঠিক আছে, অয়ন, স্যুটকেসটা দিয়ে দাও। আর হাইনরিখ, ঝিনুককে এখানে দিয়ে যাও।“
হাইনরিখ একটা ক্রূর হাসি হাসল। আমি স্যারের হাত থেকে স্যুটকেসটা নিয়ে হাইনরিখের দিকে এগোতে থাকলাম। মাঝপথে গিয়ে আমি কেসটা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হাইনরিখ এগিয়ে এল আমাদের দিকে, তার হাতের লুগারটা তখনও আমাদের দিকে পয়েন্ট করা। আমার একদম সামনে দাঁড়িয়ে এসে সে তাকাল আমার দিকে। তারপর কেসটা হাতে নিয়েই পিছিয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে।
আমি চিৎকার করে বললাম, “আমরা তো আমাদের কথা রাখলাম। এবার ঝিনুককে ফিরিয়ে দাও।“
হাইনরিখ হাহা করে হেসে উঠল। তারপর ক্রূর হাসি হেসে বলল, “ঝিনুক? কে ঝিনুক? আমাদের কাছে কোনও ঝিনুকই নেই। আমরা তো শুধু তোমাদের বাজিয়ে দেখছিলাম। তোমাদের নিয়ে তো আমাদের কোনও কাজ নেই। আমার কাজ শুধু এই পাথরটা আর তোমার মেয়েকে নিয়ে।“ কথাটা বলেই হেসে উঠল সে।
স্যার চিৎকার করে উঠলেন, “এসবের কি মানে? শেষে বিশ্বাসঘাতকতাটা করেই ফেললে তাহলে, হাইনরিখ?”
হাইনরিখ মাটিতে একদলা থুতু ফেলল। তারপর এগিয়ে এসে স্যারের কলার ধরে বলল, “বিশ্বাসঘাতকতা? সেটা তো তুমি করেছিলে, সেন। যখন বললাম, এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা কোটিপতি হতে পারি, শুধু পেটেন্ট নিলেই হবে, তুমি বেঁকে বসলে। বললে, এই প্রযুক্তি শুধু মানুষের কল্যাণের কাজেই ব্যবহার হবে। তাই তো আমাকে যোগাযোগ করতে হল বিদেশি এজেন্টদের সাথে। তারপর তুমি যখন সেই সব কাগজ পড়ে ফেললে, আমার আর কোনও রাস্তা বাকি রাখলে না। বাধ্য করলে তোমাকে বাঁচিয়ে না রাখার জন্য। আর তারপর যা যা ঘটল…তুমি আমাকে পাঠালে জেলে।
কি জীবন কাটিয়েছি জেলে, আমিই জানি। একটা চিঠি লিখতে দিত না ওয়ার্ডেন। অন্ধকার একটা দশ বাই দশ সেলে বিশ বছরের জন্য বন্দী। প্রায় প্রত্যেকদিন বন্দিদের সাথে মারপিট, এই করেই দিন গুজরান। শেষে একদিন যখন জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে এলাম, তখন দেখি দুনিয়া আর আগের মত নেই। আমি ক্রিমিন্যাল বলে আমার সমস্ত গবেষণার জিনিস ল্যান্ডরোভারের খাদ্য হয়ে গেছে। আমার পরিবার আমাকে ত্যাজ্য করেছে। সব তোমার জন্য সেন। সব তোমার জন্য।
কিন্তু দেখ, আমি আবার উঠে দাঁড়িয়েছি সেন। আর তাই তুমি আমার কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছ নিজের মেয়েকে, তাই তো সেন?” হাইনরিখ বিষাক্ত একটা হাসি হেসে বলে।
স্যার অতিকষ্টে বললেন, “আমি আমার মেয়েকে চাই হাইনরিখ। আর তার জন্য আমি সব রাস্তা বেছে নিতে রাজি আছি, সব। কিন্তু তোমাকে আমি আর কোনও ক্ষতি করতে দেব না আর। তুমি আর কারোর জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারবে না।“
হাইনরিখ হাসতে হাসতে বলল, “তাই, সেন? হাসালে বন্ধু, হাসালে। এখনকার আমি আর বিশ বছর আগের আমির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। আর, তুমি কি ভাবছ, আমি কিছুই জানি না?” তারপরই সে স্যারের কানের কাছে এসে বলল, “আমি কিন্তু জানি, তুমি তোমার গবেষণায় সফল অলরেডি। ঝিনুক তোমারই গবেষণার ফসল, তাই না?“
সবাই চমকে উঠল কথাটা শুনে। আকাশ থেকে পড়লেও এতটা ধাক্কা লাগত না। কি করে জানল হাইনরিখ? তবে কি আমাদের মধ্যেই কোনও গুপ্তচর আছে হাইনরিখের?
আমি চিৎকার করে উঠলাম, “শয়তান, তুমি সেটা জানলে কি করে?”
হাইনরিখ ছেড়ে দিল স্যারকে। স্যার মাটিতে বসে হাঁপাতে লাগলেন। ক্রিস সঙ্গে সঙ্গে স্যারের কাছে এসে দাঁড়াল ওনার কিছু হয়েছে কিনা দেখার জন্য।
তারপর, আমাদের দিকে ফিরে হাইনরিখ বলল, “শোন মিঃ চৌধুরী, কোনও পরিকল্পনা করতে গেলে সবার আগে প্রপার প্ল্যানিং দরকার হয়। তোমাদের স্যার, মিঃ সেনকে তিলে তিলে শেষ করার জন্য আমাকে সেনের হাঁড়ির খবর বার করতে হত। তাই জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার পর এখানে চলে আসি। এই দ্বীপটাতে আমার ঘাঁটি তৈরি করি। এখানে বসেই আমার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিই আমি। জনমানবহীন হবার সুবাদে এখানে কাজ করার কোনও অসুবিধা হত না। লাইটহাউসের লোকগুলোকে টাকা দিয়ে হাত করাটা এমন কিছু কঠিন ছিল না।
আমিই পরপর দুজন ভাড়া করা লোককে চাকর সাজিয়ে পাঠাই মিঃ সেনের বাড়িতে কাজ করার জন্য। ওরা দু তিন মাস কাজ করেছিল সেনের বাড়িতে, কিন্তু তার মধ্যেই যা করার করে এসেছিল। সেটা হল, ঐ বাগানবাড়ির বিভিন্ন কোণে গোপন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন ফিট করে আসা। ওতেই আমি সেনের গতিবিধির ওপর নজর রাখলাম। যদিও মিঃ সেনের গোপন ল্যাবটা কোথায় আমি ঠিক জানতাম, কিন্তু একটা আন্দাজ করতে পারছিলাম যে ওটা এখন ওখানে থাকবে না। এককালে তো আমিও ওখানে কাজ করতাম, ২০ বছর পরেও আমার ভয়ে সেন ঐ ল্যাব সরিয়ে আনবে এটাই স্বাভাবিক ছিল।
তাই আমি অপেক্ষা করছিলাম সুদিনের। তারপর যেদিন সেন বাড়িতে বলাবলি শুরু করল যে ও পাকাপাকিভাবে দেশে বাড়ি ফিরে যাবে, তখনই কাজ এগিয়ে আনতে হল। কারন ও দেশে ফিরে গেলে তো আমার প্রতিশোধ নেওয়া হয় না। এতগুলো বছর অপেক্ষা করেছিলাম, আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। একটা ফলস কল দিয়ে মেয়েটাকে বাইরে আনতেই আমার লোকেরা ওকে কিডন্যাপ করে।
কিন্তু, তারপরে মেয়েটা কি করে পালাল, সেটাই আমার কাছে রহস্য ছিল প্রথমে। কিন্তু, তারপরে তোমরা যখন ঘরে আলোচনা শুরু করলে, বুঝলাম, কি ব্যাপার। তুমি অমরত্বের শেষ ধাপটাও পেরিয়ে এসেছিলে জেনে বেশ ভালই লাগছিল। আর এরকম একটা লাইভ হিউম্যান স্যাম্পল…… কয়েকশ কোটি ডলারের সমান।“ হাইনরিখের চোখ দুটো জ্বলে উঠল যেন। “তাই তো ফোন করলাম তোমাকে, আর বাকিটা তো জানই।“
আমরা দাঁতে দাঁত চিপলাম। ক্রিস ঠিকই বলেছিল। আমরাই ওর পাতা ফাঁদে পা দিয়েছি। এবার ও আমাদেরকেই টোপ হিসাবে ব্যবহার করবে ঝিনুককে ডেকে আনার জন্য। ইশ, কি বোকা আমরা… একবারও মনে হল না, যে কি করে হাইনরিখ এত ভাল করে জানতে পেরেছিল কখন প্রফেসর বেরোন, কখন ঝিনুক বেরোয়? আবার আমাদের ঝিনুককে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেবার সঙ্গে সঙ্গে ফোন কলের সময়টাও? এতটাও কাকতালীয়? ইস।
সমুদ্র একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল। তারপরেই সমুদ্র একটা তীব্র হুইসল দিয়ে বলে উঠল, “ক্রিস, রাইট নাউ।“
তারপরেই সমুদ্র পকেটে হাত দিয়ে দ্রুত বার করে আনল পিস্তলটা। ঐ তীব্র চিৎকারে কয়েক মুহূর্তের জন্য হাইনরিখ আর তার দলবলও চমকে গিয়েছিল কিছুক্ষনের জন্য। আর সেই মুহূর্তের সুযোগে পরপর ফায়ার করতে থাকল ওরা।
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৭) ~