কোড নেম প্রমিথিউস
তারপরেই প্রশ্নটা ছুঁড়লাম, “আমার শেষ প্রশ্ন, আপনার পালিতা মেয়ের মুখের ছবির সাথে আপনার মৃতা স্ত্রীর মুখের আদল, আর আপনার কানের আকার এত মিলে যায় কি করে? হিসাবমত তো, সে অনাথ। মানে তার মা-বাবা নেই। অথচ তার মুখের সাথে আপনার স্ত্রীর মুখের এতটা মিল? তার ওপর আপনার মতই তার কানের আকার? এতটা মিল বোধহয় কাকতালীয় নয়, তাই না স্যার?”
ঘরের মধ্যে বোমা পড়লেও সবাই এত আশ্চর্য হত না। কিছুক্ষণ যেন সময় থমকে থাকে। বর্ণালীর মুখে তখনও অবিশ্বাস, কিন্তু সমুদ্রের মুখে দোটানা ভাবটা এখন স্পষ্ট। সে একবার তাকাচ্ছে স্যারের মুখের দিকে, আর একবার তাকাচ্ছে তার ফোনে সেভ করে নেওয়া ঝিনুকের মুখের ছবির দিকে। ক্রমশ তার মুখের ভাব পাল্টাচ্ছে।
আর স্যার? স্যারের মাথা নিচু, একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। তারপর যখন কথা বলা শুরু করলেন, তখন আমরা সবাই অবাক হলাম। সেই উত্তেজনাই নেই স্বরে, যেন শান্ত সমুদ্র কথা বলছে বহু যোজন দূর থেকে এক পথভ্রষ্ট নাবিকের সাথে।
“কারন ও আমার নিজের মেয়ে। ঝিনুকের কোশ থেকে ওকে ক্লোন করে টেস্টটিউব বেবি হিসাবে জন্ম দিয়ে নিয়ে এসেছি নিজের কাছে।“ স্যার শান্ত গলায় বলেন।
সবাই মিনিট খানেকের জন্য পাথরের মূর্তি হয়ে যাই। কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না এখন, এমনই আমাদের অবস্থা। ঝিনুক আসলে স্যারের মেয়ে? নিজের? কিন্তু আসলে একটা রেপ্লিকা, একটা ক্লোন?
সমুদ্র এই প্রথম উত্তেজিত হল। তর্জনী উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,“মানে? হিউম্যান ক্লোনিং? আপনি এতদূর নেমে গেলেন শেষ পর্যন্ত?”
স্যার তখন তাকালেন আমাদের দিকে। এই প্রথম আমরা ভয় পেলাম। সেই শান্ত স্বরের সাথে সামঞ্জস্য মিলিয়ে সেই দৃষ্টিটা নেই। তার জায়গায় সেই জ্বলন্ত বহ্নিদৃষ্টিটা দেখতে পাচ্ছি আমরা, একটু আগেই যাকে জুলিয়াসের ঘরে দেখতে পেয়েছিলাম।
স্যার মন্দ্রস্বরে কথা বলা শুরু করলেন, “ও। বাবা হয়ে মেয়েকে ফেরানোর চেষ্টাটা তাহলে অপরাধমাত্র, কি তাই তো সমুদ্র? তাই কিনা, বল না?”
সমুদ্র আমতা আমতা করে কিছু বলতে যায়, স্যার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেন। তারপর বলতে থাকেন ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকিয়ে।
“আমি, ঝিনুক চলে যাবার পর দুমাস অবধি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আমি এই বাগান বাড়িতে বসে থাকতাম। কিন্তু মেয়েকে ফিরে পাওয়ার এই পাগলের মতো নেশা আমাকেও একদিন গ্রাস করবে আমি বুঝতে পারিনি। যতদিনে গ্রাস করেছে ততদিনে আমি অনেকটা এগিয়ে গেছি। বলা হয়নি, আমার মেয়ের একটা ব্লাড স্যাম্পেল আমি আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম ওর ডেডবডি থেকে।
ব্লাড স্যাম্পেলটা থেকেই আমি শুরু করলাম ঝিনুককে আবার নতুন করে বানানোর কাজ। তবে হ্যাঁ, এবারে আমার সমস্ত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জ্ঞান প্রয়োগ করলাম ওকে বানাতে। আমার আসল মেয়ে তো ফিরে আসবে না, তবে যে মেয়েই ফিরে আসুক, তার শরীরে তো আমার, ক্যাসান্দ্রার রক্ত বইবে। আমি জানি আমি চূড়ান্ত অনৈতিক একটা কাজ করেছি, হিউম্যান ক্লোনিং আইনত নিষিদ্ধ। ঈশ্বর আমাকে কোনদিন ক্ষমা করবেন না, আমি সে ব্যাপারেও নিশ্চিত।বহু, বহু চেষ্টা চালানর পর একদিন সফল হলাম আমি। আমি পারলাম আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে। একজন সারোগেট মা’কে ভাড়া করে ওকে প্রতিস্থাপন করালাম ওনার গর্ভে। স্থানীয় হাসপাতালের গাইনিকোলজির একজন প্রফেসর আমার খুব ভাল বন্ধু। ওনার নাম করব না। ওনার সাহাজ্যেই এই কাজটা সম্পূর্ণ হল। ঝিনুকের জন্ম হলো।
আমি বাবা হয়ে আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনি যেখানে জানি যে শুধু আমার নয়, প্রমিথিউসের সমস্ত জ্ঞান আমার মেয়েকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে মৃত্যুর মুখ থেকে। কিন্তু, এবারে আমি আরেকটা কাজ করলাম, যেটা হয়ত ওকে এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে রাখবে। “
আমি কাটা কাটা স্বরে বললাম, “আপনি আপনার আবিষ্কার, অর্থাৎ সেলফ রিজেনারেশনের জেনেটিক এনহ্যান্সমেন্টগুলো ওর জিনোমে জুড়লেন। প্রোজেক্ট প্রমিথিউসের হিউম্যান ট্রায়ালটা করলেন আপনার নিজের মেয়ের ওপর।“ জানিনা কখন নিজের কথার স্বরে এত ঘৃণা চলে এসেছিল। “ছিঃ, স্যার। এতদিন আপনাকে শ্রদ্ধা করতাম, এখনও হয়ত করব। কিন্তু, আপনার এই কাজটা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ছিঃ, বাবা হয়ে মেয়ের ওপর এই অত্যাচারটা করলেন? গিনিপিগ বানালেন শেষে? ও যখন জানতে পারবে, তখন? তখন ও আপনাকে কি চোখে দেখবে, ভেবেছেন?”
“ঝিনুক প্রথম থেকেই জানে।“ স্যারের স্বর যেন অনেক দূর থেকে আসছে।
“মানে?” আমরা তিনজনেই অবিশ্বাসে জিজ্ঞাসা করলাম। “মানে? ও কি করে জানে?”
“ঝিনুককে বড় করেছি আমি নিজে। জন্ম থেকেই কড়া নজরে রাখতাম আমি। হয় আমি, নয় জুলিয়াস। ওর ছয় বছর বয়স অবধি সব দেখভাল আমি নিজে করেছি। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়ত প্রমিথিউসের কাজ ওর শরীরে ঠিকভাবে কম্প্যাটিবল হয়নি। তাই আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মত বেড়ে উঠছে ও।
কিন্তু, আমি যে ভুল ভাবছিলাম, সেটা ভাগ্যই আমাকে একদিন বুঝিয়ে দিল।
একদিন ঝিনুক খেলতে গিয়ে পড়ে গেল খেলার মাঠে। তার হাঁটুটা ছড়ে গেল। আমি কাছেই ছিলাম। ওর কান্না শুনে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলাম। কাছে আসতেই অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, অত বড় কাটা দাগটা এক-দুই সেকেন্ডের মধ্যে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি গিয়ে ওর ব্লাড প্রোফাইল চেক করলাম। যা সন্দেহ করছিলাম দাই। বিটি, সিটি, ইএসার, সব স্বাভাবিকের থেকে দুই-তিন গুন কম, অথচ ওর রক্ত স্বাভাবিক মানুষের মতই জমাট বাঁধছে। অদ্ভুত এক মিরাকল।
ঝিনুকের জন্ম থেকে কোনও রকম রোগভোগ নেই, কোনও রকমের গণ্ডগোল নেই। স্বাভাবিক একটা মেয়ের যে গ্রোথ মাইলস্টোনগুলো হয়, সবকটাই ও একে এক পেরিয়েছে কোনও গণ্ডগোল ছাড়াই। নরমাল আর পাঁচটা মেয়ের মতই ওর পিরিয়ড হয়। ক্লাস এইটে একবার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভাঙল, ১৫ মিনিটের মধ্যেই সেই ভাঙ্গা পা জুড়ে গেল। বুঝলাম, আমি সফল। জুলিয়াস অবশ্য আমাকে বলেছিল, একবার ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু এক্সরেতে পরিষ্কার দেখতে পেলাম, কোনও ফ্র্যাকচার লাইন নেই। ম্যাজিকের মত মিলিয়ে গেছে যেন ঐ ভাঙ্গা হাড়।
ওকে ছোট থেকেই চোখে চোখে রাখতাম। ও যখন ছোট, তখন থেকেই ওকে বোঝাতে শুরু করলাম ওর কি কি ক্ষমতা হতে পারে, কি কি হয়েছে, আর ও যেন ওর ক্ষমতাগুলোকে সবার থেকে লুকিয়ে রাখে। ওকে বাংলা বলা শেখালাম। দেখলাম, দু তিন মাসের মধ্যেই বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে নিল। প্রথমে অবাকই হয়েছিলাম, কিন্তু পরে বুঝলাম, ওর নিউরনগুলোর কোনও ক্ষয় হচ্ছে না, আর তাছাড়া নিউরনগুলোর মধ্যে ক্রস-কানেকশন আর ফায়ারিং রেট স্বাভাবিক মানুষের থেকে আলাদা হবার জন্য ওর ইন্টেলিজেন্স অনেক, অনেক গুনে বেশি।“
এইখানে সমুদ্র একটা প্রশ্ন করল, “আচ্ছা স্যার, ওর জিনোমে তো ইলের জিন ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ইল মাছের যেটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, ভয় পেলে বা রেগে গেলে ইলেকট্রিক শক দেওয়া, সেরকম কিছু কি ওর মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন?”
স্যার খানিকক্ষণ ভাবলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “না, এরকম কিছু দেখিনি। যদিও তোমার এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক, কিন্তু এখনও অবধি আমি সেরকম কোনও শক খাইনি।। খেতেও চাইনা।“
এই প্রথম দেখলাম, সমুদ্রের মুখে মৃদু হাসি। একটু আগেই যে পরিমাণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, সেই উত্তেজনার লেশমাত্রও নেই তার মধ্যে। এর মধ্যে ক্রিস গিয়ে কফি নিয়ে আসল কিচেন থেকে পরিবেশটা খানিক হালকা করতে। বাকি কথা কফি খেতে খেতেই হল।
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৪) ~