সেই যে, যখন আমার যুবা বয়স, নতুন কাজে ঢুকেছি। যখন আমার কত আশা- নতুন নতুন দেশ দেখব, মানুষ চিনব আর প্রাণ ভরে আমার প্রিয় বিষয় জানব, সেই সময়ের কথা বলছি। কী আমার প্রিয় বিষয়? ইতিহাস গো ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব।
আমি ত তখন আর আজকের মত পরিপক্ব নই, তখন আমার বুকে তাজা শ্বাস। আমি চলেছি নিজের দেশেরই এক প্রত্যন্ত জনপদে। বাড়ি থেকে দূরে, নিজের চেনা জায়গা থেকে দূরে। আমার বাড়ি, আমার পাড়া, মা, বাবা সবাইকে রেখে। নতুন দেশ দেখার উদ্দীপনা নিয়ে।
গাড়ি চলেছে ত চলেছে-আমিও চলেছি। অচেনা পথঘাট দুচোখে আমার এঁকে দিচ্ছে মায়াজাল। আর যে বাঁকটায় আমার গাড়িকে থমকে দাঁড়াতে হল, আমিও সেই বাঁকেই থমকে গেলাম তখন।
কেন থমকে গেল আমার যাত্রা? সে ত অনেক কথা। সেখানে পুলিশে আটকে রেখেছে রাস্তা। একটি কিশোরীকে কিছু নরাধম ধর্ষকাম সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে। প্রাণ দিতে হয়েছে সেই কিশোরীকে পথের ধারে। রক্ষীরা তাই করছে বিধিবদ্ধ কার্যক্রম।
দৃশ্যটা চোখে দেখার ইচ্ছা ছিল না মোটেই, তবুও কি খেয়ালে নেমেছিলাম গাড়ি থেকে। নেমে যাঁর দিকে চোখ গিয়েছিল, তিনি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত এক মহিলা আধিকারিক। বয়স্কা দায়িত্বশীলা মহিলা দেখে হয়েছিল সম্ভ্রম। দূর থেকে হাত দিয়ে নমস্কার করেছিলাম। তিনিও প্রতিনমস্কার সেরেছিলেন সংক্ষেপে।
আমার কর্মস্থল সেই অকুস্থল হতে বেশি দূর ছিল না, অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরে যখন ছাড়া পেলাম, নিজের শিবিরে গিয়ে বিশ্রাম।
পরের দিন বিকেলবেলা। আমাদের যখন কাজকর্মের কথা চলছে, এলেন গত দিনের সেই ভদ্রমহিলা। এ অঞ্চলে তিনি আমার মত শহুরে লোক অনেকদিন বাদে নাকি দেখেছিলেন। খবরাখবর এসেছিলেন নিতে। সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন গত দিনের আমাদের যাত্রার ব্যাঘাত ঘটার জন্য।
যে মেয়েটির সর্বনাশ হয়েছিল- সে ছিল তার দৃষ্টিহীন বাবার একমাত্র অবলম্বন। একটা মানুষের জগৎ তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে গেলে সে মানুষের গতি কোথা হবে ভেবে ভেবে যখন খানিকক্ষণ কেটে গেছে, সেই মহিলা অফিসার সস্নেহে মাথায় হাত রেখেছিলেন। সেদিনের মত বিদায় নেবার আগে।
রোখ চেপে গিয়েছিল ওঁর। তদন্তের শেষ অবধি দেখার তীব্র চিকীর্ষা বারবার ওঁকে আনত টেনে এই স্হানটাতে। আসতেন আমার কাছেও সাক্ষাৎ করতে কাজের মাঝে। একটা মমতা যেন দেখেছিলাম কর্তব্যনিষ্ঠার মাঝে। কিভাবে যেন হয়ে গিয়েছিলাম আবিষ্ট। আমারও মনে হত দুষ্কৃতীরা সাজা পাক। নারীকে লাঞ্ছনা করার জন্য উচিত শাস্তি হোক- আমি নিজেও মনের ভেতর থেকে চাইতাম তোলপাড় করে। সেই মেয়েটির বিক্ষত দেহখানা বারবার পড়ত মনে, উঠত চোখে ভেসে। কি আর করব, তখন আমার বয়সটা ত কাঁচা। কি করে মান বাঁচবে নারীদের- নানা কথা ভেবে তোলপাড় হয়ে যেত মাঝে মাঝে মস্তিষ্ক আমার।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে একদিন পেলাম এক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। দশ বিশ নয়, কয়েকশো বছর পুরনো। কালো পাথর খোদাই। তার দিকে তাকিয়ে কাব্য করে হাতে নিয়ে বললাম
‘ কৈছে রখলুঁ লাজ তোহারি
কামিনী সমাজ পালিকা’
কি করে কাব্যটা মেলাব আর মাথায় এল না। আজও ত এল না। কৈছে রখলুঁ লাজ তোহার-
পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটা হাতে আসে নি শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক। পরীক্ষার আগেই নাকি কিভাবে দেহসৎকার হয়ে গিয়েছিল সুকৌশলে। শুনেছিলাম অপকর্মীদের একজন নাকি উচ্চপদের হোমরা চোমরা কারো ছেলে। সেই হোমরা চোমরা গো, যারা আমাদের জন্য সব কিছু ঠিক করে দেয়। ঠিক করে দেয় চলাফেরার রাস্তা, জীবনের দরদাম, আমাদের দেশের চলার পথের হদিস- মানে হর্তা কর্তা, সেই হোমরা চোমরা। অত বড় কর্তাব্যক্তির ছেলে যখন, তাকে ত দোষী প্রমাণ করতে দেওয়া যাবে না। কি বল?
কিন্তু হাল না ছেড়ে, আমার পরিচিত সে ভদ্রমহিলা গোঁ ধরে চালিয়ে যেতে চাইছিলেন অনুসন্ধানটা। বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল।
বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল। তাই মাসুল গুনতে হল। কি ভাবে? এখনও বুঝলে না ? খবরের কাগজে খবর হয়ে। কে নাকি অতর্কিতে হত্যা করে দিয়ে চলে গেছে বলে খবরটা বেরিয়েছিল কাগজে।
আমি তখন ভাবছিলাম বারবার খবরটা পড়ে- কি গতি হবে ওঁর তনয়ার? একরত্তি মেয়েটার কে হবে অবলম্বন? পারবে কী ও নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করে বাঁচতে এখানে? মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিকে জিজ্ঞাসা করে কোনো উত্তর ত পেলাম না।