গ্রীষ্মের সকাল , গরমের দাপট কিছুটা হলেও কম । বিপ্লব ভোর ভোর বেড়িয়েছে পাঁশকুড়া থেকে । ৭ টা ১০ এর পাঁশকুড়া লোকাল হাওড়ায় ৯ টা নাগাদ পৌঁছে দেয় । হাওড়ায় নেমে অনেক কলকাতাগামী বাসের সারি, তাই গন্তব্যের বাস খুজে পেতে দেরি হওয়াটা স্বাভাবিক । যদিও হাওড়া বা কলকাতা কোনোটাই বিপ্লবের অচেনা নয় । সে তো হাওড়ারই কোনো একটি ডিপ্লোমা কলেজে ৩ বছর পড়াশুনা করেছে , তাই সেই সুবাদে কলকাতা তার খুব একটা অপরিচিত নয়।
তবুও আজ গন্তব্যের ঠিকানাটা বেশ অপরিচিতই লাগছে। ১১ টা নাগাদ পৌঁছালেই হবে, তাই হাতে সময় রয়েছে অনেকটাই। বাস স্ট্যান্ডের কাছের চাএর দোকানে এক পেয়ালা চা নিয়ে ঠোঁটে চুমুক দিতে দিতে যেন তার সাথে আরও কিছু একটার অভাব বোধ করলো সে। আসলে কলেজলাইফে সিগারেটের নেশাটা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এখন সারা দিনটা বাড়িতেই কাটে তার , তাই নেশাটাও বাধ্য হয়েই ছুটি নিয়েছে, আজ তাই নতুন করে নেশাটা না ধরাটাই শ্রেয় মনে হল।
চা শেষ করে দোকানিকে পয়সা মেটাতে মেটাতে জিজ্ঞাসা করলো-“ দাদা মিনটো পার্কের বাস কোনখান থেকে ছাড়বে বলতে পারেন”।
“ ওই তো রাস্তার ধারে দাঁড়ান, অনেক মিনিবাস পেয়ে যাবেন” পান চিবাতে চিবাতে বলল দোকানি।
“আচ্ছা thank you দাদা ” বলে রওনা দিল বিপ্লব। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না , বাস পেয়ে গেলো। অফিসটাইম তাই ভিড়তো স্বাভাবিক। কোনোক্রমে একটা সীট পাওয়া গেল, পথ প্রায় ৩০-৪০ মিনিটের তাই ভিড় বাসে সীট পাওয়াটা কিছুটাতো সৌভাগ্যের, যদিও পড়াশুনা শেষ করার পর গত দেড়বছর বেকারত্বের জীবনে সৌভাগ্যটা তার একটু বেশিই জরুরী হয়ে পড়েছে, নইলে গোটা কুড়ি ইন্টারভিউ-এ বসেও একটা চাকরির মুখ না দেখাটা যেকারো কাছে বড়ই দুর্ভাগ্যের।
পাশে বসা বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল- “ কাকু মিনটো পার্ক কতক্ষণ লাগবে, এলে একটু বলে দিবেন দয়া করে”।
“ হ্যাঁ, আমিওতো ওখানেই নামবো”।
“ও ! আচ্ছা তাহলে তো ঠিক আছে” ভদ্রলোকের প্রত্যুত্তরে বললো বিপ্লব।
বিপ্লবের পরিপাটি করা হাল্কা নীল সার্ট,সুট আর পালিশ করা বুট দেখে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন-“ অফিস যাচ্ছ নাকি? চাকরি-বাকরি কর কোথায় ?”
“ না কাকু, আসলে ICICI Bank এর একটা ইন্টারভিউ আছে চাকরির জন্য”- বিপ্লব বলল।
“ ও, কিন্তু ওটাতো মিনটো পার্ক থেকে হেঁটে আরও ১৫ মিনিটের পথ”- ভদ্রলোক বলল একটু ভ্রুকুচকে।
“ হ্যাঁ আমি তাই হাতে সময় নিয়েই বেরিয়েছি” -হেসে বলল বিপ্লব।
“ তা পড়াশুনা কতদূর ?”।
– “আজ্ঞে Civil Engineering-এ ডিপ্লোমা”- শান্ত গলায় উত্তর দিল বিপ্লব।
ভদ্রলোক কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে একটু ইতস্তত করে বলে উঠল — “ Engineering পড়ে ব্যাঙ্কের চাকরি কেন ভাইপো, আসলে এই দেশ থমকে যাচ্ছে কেন জানো – মানুষ নিজের লাইনে নেই,
– ছেলেরা B.COM পাশ করে পিওনের চাকরি করে, M.PHILL. Complete করে চাকরি নেয় ব্যাঙ্কের কেরানীর , M.A., Engineering শেষ করে সরকারি বা বেসরকারি দপ্তরে কাজ করে খাতাসারার, ফাইল গোছানোর কাজ করে – এই সব কারনেই বুঝলে”।
উত্তর দেবার মত বিশেষ কিছু না পেয়ে বিপ্লব হাসি মাখা মুখ করে বলে- “ ওই চাকরিবাকরি নেই তো… তাই আর কি! হে হে”।
ইতিমধ্যেই গন্তব্য এসে গেলে বাস থেকে নেমে ভদ্রলোক রাস্তা দেখিয়ে বলল-“এই দিক দিকে যাও তাহলে একটু শর্টকার্ট হবে”।
“ধন্যবাদ” – – বলে বিপ্লব এগিয়ে চলল, গ্রীষ্মের রোদ্দুর তার খেলা শুরু করে দিয়েছে, সকাল ১০ টার সময়ই গরম তা বেশ ভালই তের পাওয়া যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে বয়স্ক ভদ্রলোকটির কথাগুলো বিপ্লবের মনে বার বার লক্ষভেদ করতে থাকল।
‘হ্যাঁ তো লোকটা কথাগুলো বেশ ঠিকই বলেছে’ — কিন্তু সে বুঝল না ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ব্যাঙ্কের চাকরি করলে দেশ কেনো থমকে যাবে, তাঁর বর্তমানের থমকে যাওয়া জীবনে যদি কোনো ব্যাঙ্কের চাকরি বা কেরানীর পেশা একটু গতি আনে তবে দেশ গতি হারাবে কোন যুক্তিতে। ডাক্তার, ইঙ্গিনিয়ার, ব্যারিসটার, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাইকে নিয়ে যেমন দেশ, তেমনি তাঁর মত কোটি কোটি বেকাররাও এদেশেরই, সৎ উপায়ে এদের জীবনের গতি দেশের থমকে যাওয়া… মন যেন মানতে পারল না বিপ্লবের।
সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছে ইন্টারভিউ দিয়ে যখন সে বেরিয়ে এল তখন প্রায় বিকাল চারটে, তাড়াতাড়ি করে হাঁটা দিলো বাসস্ট্যান্ডের দিকে,
‘৫ টা ৪০ এর পাঁশকুঁড়া লোকালটা পাওয়া যাবে বোধ হয়’ -মনে মনে ভাবল বিপ্লব।
বাসে উঠে একটা সীট পেয়ে জানালার বাতাসে চোখ মুদলো। মেজাজটা আজ তাঁর ফুরফুরে,ইন্টারভিউ-এ আজ সে উত্তির্ণ,সৌভাগ্যদেবী মাথা তুলে চেয়েছে। চাকরিটা যদিও কেরানীর মাইনে আঠারো -বিশ হাজারের কাযছাকাছি, তো কি হয়েছে মধ্যবিত্ত ঘরে পরের মাস থেকে এই টাকাটার জোগানও কম নয়, আর সর্বোপরি বেকারত্বের ক্ষতটা থেকে রক্তপাতটাতো এবার বন্ধ হবে।
হঠাৎ একদল স্কুল পড়ুয়াদের কথাবার্তার শব্দে তন্দ্রা কাটল বিপ্লবের। ছোট ছোট স্কুল পড়ুয়া খুব জোর ক্লাস ফাইভ বা সিক্সের, তাদের অভিভাবকদের সাথে উঠেছে বাসে, ঘড়িতে ৪ টা ১৫ এদের স্কুল ছুটি হয়েছে এবার বাড়ি ফেরার পালা। বুকে সাঁটা ব্যাজের অর্ধেক লেখাটা দেখা গেল কি যেন St. Cathe…. যাইহোক বোঝা গেল নাম করা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।
অভিভাবকদের মধ্যে চলছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা,সবার হাতে একখানা করে কাগজ, দেখে বোঝাই যাই ওটা পড়ুয়াদের মার্কসীট।
‘হ্যাঁ ঠিক এটা এপ্রিল মাস এই সময়ই তো বাৎসরিক ফল বের হয় আর নতুন শ্রেণীর ক্লাস শুরু হয়’- মনে পড়ল বিপ্লবের।
অভিভাবকদের একজন বলে -“Mathematics-এ আমার সৌম নাইনটি টু, ওর বাবা তাইতো বলে- ওকে হয় ইঙ্গিনিয়ারিং নয়তো Mathe Hnrs. নিয়ে প্রেসিডেন্সি তে, তারপর M.Phill. বা Phd. পরে কোনও কলেজের প্রোফেসর”।
সেই শুনে আরেক অভিভাবক বলে ওঠে “আমার প্রিয়ার ইংলিশ খুব ভাল,আমার ইচ্ছা W.B.C.S”।
পাশের মহিলা একটু গলা নামিয়েই বলল -“আমার ছেলের অতো বুদ্ধি নেই গো, তবে ওর ছবি আঁকার হাত আড় গানের গলা তো জানেনই আপনারা, ওকে ক্লাশ ১২ এর পর বিশ্বভারতীতে ভর্তি করবো, তারপর মুম্বাই এ ওর কাকুর কাছে পাঠিয়ে দেবো, আজকাল আর্ট, কালচার এসব করেও লাখ লাখ ইনকাম জানেন তো”।
সম্মতি জানিয়ে আরেক মহিলা বলে-“ হ্যাঁ এইজন্যই তো আমার মেয়েকে বলি ভালো করে পড়ে একবার IIT-তে সুযোগ পেয়েযা জীবন সার্থক হয়ে যাবে”।
পাশের এক বয়স্ক হয়তো কোন পড়ুয়ার দাদু হবে, বলে ওঠে -“ ঠিকই বলেছেন আপনি, IIT-তে ইঙ্গিনিয়ারিং পড়ানো ছাড়া অন্য কোথাও পড়িয়ে সেরকম লাভ নেই, এই তো আমাড় বড় নাতি গতবছর R.J.Kar- এ মেডিক্যাল এ চান্স পেলো”– বলার সাথে সাথে বিপ্লবের চোখে বাকি অভিভাবকদের মধ্যে কেমন যেন একটা চাঞ্চল্য ধরা পড়ল।
সবাই তো একবাক্যে বলে উঠল–“ না! আপনার নাতি ব্রিলিয়েনট বলতে হবে, ডাক্তারিতে যা সম্মান অন্য কোন পেশাতে নেই দাদা”।
না কথাগুলো যে এরা ভুল বলছেনা এটা বিপ্লব ভালই বোঝে, তাঁর নিজের পিসতুতো দাদা মেডিক্যালের ৩ য় বর্ষের ছাত্র আরেক দাদা বিদেশি কোম্পানির মোটা মাইনের মস্তো বড় ইঙ্গিনিয়ার, বাড়ি এলে গ্রামে তাদের খাতির যে কারোর থেকে বেশি। ছেলেদের সুমধুর ভবিষ্যতের স্বপ্ন চোখে নিয়ে মিনিট দশেক পরেই সবাই যে যার গন্তব্যে নেমে গেল আর কিছুটা হলেও তেঁতো করে দিয়ে গেল বিপ্লবের প্রথম চাকরি পাবার মিষ্টতাকে।
কনট্রাকটার হাঁক দিলো- “ বড়বাজার নামুন…। বড়বাজার…!!”। হাওড়া আর তো মাত্র মিনিট সাতেক।
এই তো বাস হাওড়ার ব্রিজে উঠেছে, বিপ্লব শেষ বারের মতো জানালার বাইরে তাকাল– কলরব মুখরিত গঙ্গার দুই ঘাটের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া জলরাশি আর সন্ধ্যাপ্রায় নীলাভ আকাশের দিকে তাকিয়ে দুটো প্রশ্নই তাঁর মনে জাগল———
তাহলে কেরানী কারা হয়…? আর এই সমসাময়িক শিক্ষিত সমাজ এদের আদৌ সম্মান দেয় কি…! বা দিলেও কারা দেয়…?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা সে পায় আসার সময় বাসে দেখা হওয়া ভদ্রলোকটির কাছ থেকে— “ যারা নিজের লাইনে যায় না…”
আর দ্বিতীয়টির উত্তর পরের মাস থেকে কেরানীর কর্মজীবনে প্রবেশের পরই ধীরে ধীরে সে হয়তো জানতে পারবে।