সকাল থেকেই প্রতিমা খুব ব্যস্ত। অন্য রবিবারের থেকে এই রবিবার সকালটা আলাদা। আজ তার অনেক কাজ, ঘর গোছানো, রান্না করা, মধুমিতাকে তৈরী করা। মধুমিতা তার ছোট মেয়ে। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই দুই মেয়েকে প্রায় একা হাথেই মানুষ করেছে প্রতিমা। বড় মেয়ে মধুশ্রী যেমন সুন্দরী তেমনি ঘরের কাজে পটু। তার বিয়ে নিয়েও তাই সমস্যা হয়নি। বর বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে চাকরি করে, ভালো মাইনে, যাকে বলে আদর্শ জামাই। ছোটটাকে নিয়েই তার যত সমস্যা। পড়াশোনায় ভালো, Ph. D. করছে, কিন্তু গায়ের রংটাই যে মেরে দিলো। এই নিয়ে ১০টা সম্মন্ধ ভেস্তে গেল শুধু গায়ের রঙের জন্যে। ভগবান করে আজ যেন পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে যায় তাকে। মেয়েটার একটা বিয়ে দিতে পারলেই প্রতিমা নিশ্চিন্ত।
পাশের ঘরের বারান্দায় রোদে ল্যাপটপ নিয়ে বসে কাজ করছে মধুমিতা। পরের সপ্তাহে একটা সেমিনার আছে তার। বিকেলে তো কোনো কাজ হবে না। তাকে দেখতে আসবে। মধুমিতার কোনো উৎসাহ নেই সেই ব্যাপারে। ওই তো এসে বিচারকের দৃষ্টি নিয়ে তার গায়ের রঙের খোটা দিয়ে চলে যাবে পাত্রপক্ষ। ছোটবেলার থেকেই তো শুনে শুনে কান পঁচে গাছে তার। তার জন্মের পর নাকি দিদা প্রচন্ড কান্নাকাটি করেছিল, ঠাকুমা মাকে এসে কথা শুনেই গেছিলো যে ঠিকমতো বাদাম দুধ খেলে এই দিনটা দেখতে হতো না, আত্মীয়রা সবাই চুপিচুপি বলেছিল “এবাবা !!! হাসপাতাল এ পাল্টে যায়নি তো? এই মেয়ের বিয়ে দেবে কি করে?” । এককথায় যাকে বলে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছিলো পুরো পরিবারে । একমাত্র খুশি হয়েছিল তার বাবা; মাথা উঁচু করে বলেছিলো “আমার মেয়ের মতো সুন্দরী কেউ নেই, একদিন এই মেয়েই আমার মাথা উঁচু করে দেবে।” আজ বাবা থাকলে হয়তো এই পাত্রপক্ষের সামনে ইন্টারভিউ পর্বগুলোর হাত থেকে বেঁচে যেত সে। কিন্তু মায়ের মন রাখতে বারবার রাজি হয়ে যায় পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। তারা তার হাটাচলা , চেহারা, চুল, গৃহকর্মে নিপুণতা সব কিছু নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নাকচ করে চলে যায় । এসব এখন আর নতুন লাগে না তার ।
“তুই আবার রোদে গিয়ে বসেছিস? এই মুসুরের ডাল বাটাটা মাখ, রোদে পোড়া ভাবটা যদি একটু কমে। ” – মায়ের গলা শোনা গেল তার ঘরের দরজা থেকে।
অন্য দিনের মতো আজ প্রতিবাদ না করে মেখে ফেললো মুসুরের ডাল বাটা, কাঁথা স্টিচের শাড়িটাও পরে সেজে নিলো। আয়না নাকি মেয়েদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কিন্তু আয়নার দিকে তাকাতে তার কোনোদিন মন চায়না। দিদিকে মা আসতে না করে দিয়েছে, পাছে তার পাশে আরো কালো লাগে তাকে। পাত্রপক্ষ এলো ৪৫ মিনিট লেট্ করে। ছেলের মা, দিদি ও পাত্র নিজে এসেছে । ছেলেটি উচ্চ শিক্ষত, IIT থেকে পড়াশোনা করা, দেশবিদেশের নানান বই পড়া তার শখ। মধুমিতার সাথে বই আর পুরনো দিনের সিনেমা নিয়েই তার আলোচনা চললো অনেক্ষন। অর্পণ যখন তার বইয়ের আলমারিটি দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করে, মধুমিতা তাকে পাশের ঘরে নিয়ে যায় তার bookshelf দেখাতে। কথা বলতে বলতে মধুমিতার মনে হতে থাকে, এতটা মনের মিল থাকতে পারে কখনো দুটো মানুষের মধ্যে?
পাশের ঘরে লুচি মাংসের প্লেট নামিয়ে মিষ্টির প্লেট হাথে তুলে এই সুযোগে অর্পণ এর মা প্রতিমাকে বললেন “Mrs. Debnath, আমরা কিন্তু প্রথমেই বলেছিলাম আমাদের প্রকৃত সুন্দরী মেয়ে চাই। আমাদের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, বড় চাকরি , তার সাথে মানানসই হতে হবে তো? আপনি যদি ফোন এ বলে দিতেন মেয়ের গায়ের রং কালো, আমরা কষ্ট করে আসতামই না। আমাদের সময়ের তো একটা দাম আছে? ” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মধুমিতা শুনতে পায় সবটা, লজ্জায় অর্পণ এর মাথা নিচু হয়ে যায়, কিন্তু মায়ের কথার প্রতিবাদে একটি কথাও সে বললোনা। প্রতিমা অপরাধীর মতো মুখ করে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের কাছে। রাগে ঘেন্নায় গা রিরি করে ওঠে মধুমিতার, তার শিক্ষা দীক্ষা, পড়াশোনা, গুণগুলির কোনো মূল্যই কি তাহলে নেই?
“আপনারা তাহলে আসতে পারেন। বৃথা কথা বাড়িয়ে আপনাদের ও আমাদের সময় নষ্ট করার মানে হয় না । নমস্কার। ” ; হঠাৎই ফোঁস করে বলে ওঠে মধুমিতা।
মিষ্টির প্লেট নামিয়ে রাগ করে বেরিয়ে যায় অর্পনের পরিবার, এখনো মুখ ফুটে কিছু বললনা অর্পণ নিজে।
*******
এই ঘটনার একসপ্তাহ হয়ে গাছে। মায়ের সাথে সেই থেকে তার কথাবার্তা বন্ধ, মেয়ের এই মুখোরাপনার খবর রটে যাওয়ার ভয়ে মা প্রায় শয্যাশায়ী , দিদিকে ডেকে পাঠানো হয়েছে মা কে সামলাতে। ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি তে বসে কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করছে মধুমিতা, যখন হঠাৎই তার ফোনটা ভাইব্রেট করতে শুরু করে। অচেনা নম্বর, অর্পণের গলা। অনেক্ষন ধরে ক্ষমা চায় তার মায়ের ব্যবহারের জন্যে, দেখা করতে চায় একদিন। আরেকটি সুযোগ দিতে মন চাইলো মধুমিতার। সেই থেকে অফিসের পাশের কফি শপে প্রায়ই আসতে শুরু করে অর্পণ। সময় চেয়ে নেয় মাকে বোঝানোর জন্যে , প্রতিশ্রুতি দেয় তাদের এই ভালোলাগাকে পরিণতি সে দেবেই।
একদিন এসে বললো যদি মধুমিতা তার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় তাহলে সে হয়তো তার মাকে বুঝিয়ে বলতে পারে। কিন্তু তার পরিবার যে অপমানটা করেছিল তাকে? তারবেলা? আবার কোনো উত্তর ফুটলো না অর্পনের মুখে। যে জীবনসঙ্গী তার জন্যে রুখে দাঁড়াতে পারবে না, গলা উঁচু করে তার পক্ষে কথা বলতে পারবেনা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার যার শিরদাঁড়া নেই, এমন জীবনসঙ্গী পাওয়ার থেকে একা থাকাই ভালো মনে হলো তার । নিজের ভাগের কফির বিলটা চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো কফিশপ থেকে। ট্যাক্সি ধরে বাড়ীর দিকে রওনা হলো।
ট্যাক্সির রিয়ারভিউ মিররে হটাৎই দেখতে চোখ পড়লো নিজের প্রতিচ্ছবির উপর। ঝাপসা চোখে ভালোকরে দেখলো নিজেকে । হঠাৎ মনে পড়লো ভুলে যাওয়া একটি দিনের কথা। সে তখন ক্লাস টুতে, খুব ভালো নাটক করতো, টিচাররা খুব প্রশংসাও করতো, কিন্তু Snow white নাটকে তাকে অডিশন দিতে দেয়া হলো না। সেইদিনও অনেকটা আজকের মতোই মেঘলা ছিল। তার বাবা তাকে সেইদিন আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিলো , “মা, অন্যের চোখে নিজের মর্যাদা কখনো খুঁজিস না। অনেকে ভালোবাসার আগে নিজেকে ভালোবাসতে শিখিস। মনে রাখবি তুই অনন্যা, কারণ তোর মতন পৃথিবী তে আর কেউ নেই। যে তোর বাইরের রূপ কে ছাপিয়ে ভিতরের সৌন্দর্য কে দেখতে পাবে, সেই বুঝবে তোর আসল কদর ” । মেঘ সরে গিয়ে হঠাৎ যেন একটু রোদ উঠলো। থমথমে মুখের আধার কেটে অল্প হাসি ফুটলো। ঠিক করলো আর কারোর জন্যে কোনোদিন হীনমন্যতায় ভুগবে না সে, নিজের নিয়মে, নিজের মতো করে সাজিয়ে তুলবে নিজের জীবনটাকে, ঠিক যেমন তার বাবা চেয়েছিলো।
********
সেই দিন বাড়ি ফিরে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় সব fairness ক্রিম, ফোন তুলে যোগাযোগ করে নিজের ছোটবেলার সেই বন্ধুগুলোকে যাদের সাথে একদিন একটা নাটকের group করবে ভেবেছিলো মধুমিতা। আজ পাঁচ বছর পর নানান ব্যর্থতা, নানান সমালোচনা পেরিয়ে আজ তাদের দলটির বেশ নাম হয়েছে। তার প্রতিভার কদর সে পেতে শুরু করেছে। নাটকের সাথে সাথে নিজের রিসার্চ শেষ করে সে এখন পোস্টডক্টরাল ফেলো, সাথে একটি কলেজের পার্ট টাইম লেকচারার ও। নিজেকে যেন নতুন করে খুঁজে পেয়েছে সে আবার। প্রতিমাও ছেলে খোঁজার অনেক ব্যর্থ অনুরোধের পর এখন মেনে নিয়েছে যে এই মেয়ের আর বিয়ে হবে না। কিন্তু মধুমিতা মুখে যাই বলুক, তার সরল কল্পনাপ্রবণ মনটি জানতো, কেউ না কেউ ঠিক একদিন তার বাইরের খোলসটাকে উপেক্ষা করে ভিতরের মনটাকে দেখে পাবে।
একাডেমিতে তাদের দল প্রথমবার পারফর্ম করার সুযোগ পেয়েছে। ডিরেক্টর পিনাকীদা খুব খুঁতখুঁতে মানুষ, তাই রিহার্সালের পিছনে অনেকটা সময় দিতে হচ্ছে আজকাল ।এক ফাঁকে হঠাৎ পিনাকী দা এসে মধুমিতা কে বললো “চল , এক কাপ চা খেয়ে আসি ” । মধুমিতার কলেজের সিনিযার পিনাকী দা, লেখক এবং লেকচারার। কলেজ লাইফ থেকে নাটকে তার ছিল খুব ইন্টারেস্ট। বহুযুগ একটি নাটকের দলের সাথে যুক্তও ছিল, মনমালিন্য হওয়ায় তা ছেড়ে দেয়, এখন তাদের দলের ডিরেক্টর। আজ সকাল থেকেই তাকে একটু অন্যমনস্ক লাগছিলো, চা খেতে খেতে হঠাৎ তাকে প্রপজ করে বসে। মধুমিতা প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে, “ভেবে দেখো পিনাকীদা, পরে সারাজীবন কালো বৌ নিয়ে আফসোস করবে না তো? “
সেইদিনের পর দুদিন চলে গাছে, পিনাকীদাও আর সেই থেকে কিছু বলেনি। প্রত্যাখ্যান অবশ্য মধুমিতার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে , তাও যেন মনের মধ্যে কোথাও একটা কুয়াশা জমে ছিল। রিহের্সালের শেষে যখন সে বাড়ি ফেরার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে , পিনাকীদা তাকে স্ক্রিপ্টের একটি নতুন কপি দিয়ে বললো “কিছু চেঞ্জেস করেছি, আজ রাতেই খুলে দেখিস।” বাড়ি ফিরে স্ক্রিপ্টের কপিটা খুলতেই তার থেকে পড়লো একটি কাগজ। না, চিঠি নয়, তাতে মুক্তোর মতো হাথের লেখায় লেখা শুধু কয়েকটি লাইন।
“এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে, হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি……..”
মনের ভিতরের কুয়াশাটা হঠাৎই উধাও হয়ে গেল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে দেখে নিলো ভালো করে একবার, সত্যি তো, কি সুন্দর তার চোখ দুটি, এই গায়ের রং ছাপিয়ে নিজেও লক্ষই করেনি কোনোদিন। ড্রয়ার থেকে কাজলটা তুলে ভালো করে বুলিয়ে নিলো দুচোখে, দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। পড়ন্ত বিকেলের বসন্তের হাওয়ায় পাশের গাছটিতে বসা কোকিলটির সাথে গলা মিলিয়ে, প্রাণ খুলে গেয়ে উঠলো সেই গানটি ….”কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ” ।