কৃষ্ণকলিদের কথা
অনেক দিন পরে তোমাকে নিয়ে লিখছি। তোমাকে নিয়ে এটাই শেষ লেখা আমার। না,শুধু তোমাকে নিয়ে নয়, আমিও জড়িয়ে আছি এর সাথে। আগে ভাবতাম শুধু ডায়রির পাতায় নয়, জীবনের পাতায়ও তোমায় নিয়ে লিখব; অনেক অনেক গল্প। ‘আমাদের’ একটা গল্প হবে, বিশ্বাসের ভিতের ওপর সাজিয়ে তুলব ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ আমরা দু’জন মিলে। তোমাকে ঘিরেই বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি। তা আর হলো না | সব মিথ্যে। সেই ভুল ভাঙল যেদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল সব স্বপ্ন, তুমি কত অনায়াসেই আমাকে ছেড়ে চলে গেলে; অন্য কারো হাত ধরে। কারণ ছিল শুধু আমার গায়ের রং, কালো যে আমি। তোমার ভাবনাকে আর সকলের চেয়ে এখানেই আলাদা মনে হয়েছিল আমার। আমাকে ভুল প্রমাণ করলে তুমি।
সেদিনও আকাশের মুখ ভার ছিল।কোনো এক অজানা ঝড়ের আশঙ্কায় প্রকৃতিও ছিল শান্ত হয়ে। এক অদ্ভুত প্রশান্তি। তোমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমাদের সেই প্রথম দেখার জায়গায়, ছোট্টো এক বাগান, এক বড় দীঘির পাশে। ওখানেই প্রায় দেখা করতাম। অনেকদিন পরে তোমাকে দেখব বলে এক অন্যরকম অনুভূতি ছিল মনে।
সেই অনুভূতি কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে পাল্টে গেল চোখের জলে। এক চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম,” কেন?” আর শব্দ বেরোলো না আমার গলা দিয়ে।
তুমি বলেছিলে, “তোমার মতো মেয়েকে আমি ভালোবাসব? ভাবো কি করে? আমার পাশে আর যাই হোক তোমাকে মানায়না।”
-“আমায় ভালোবাসনি তুমি?”
-“না বাসিনি। টাইমপাস করেছি। নিজের মুখটা দেখেছো আয়নায়? কালো মেয়ে, আমার সাথে তোমাকে নিয়ে চলতেও লজ্জা হয়।”
একটু পরেই নামল বৃষ্টি। অঝোর ধারে। আমার চোখের জল মিশে গেল প্রকৃতির জলের সাথে।
কিছু বলতে পারিনি তোমাকে সেদিন। একছুটে চলে এসেছিলাম। এক অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করেছিলাম; আমার সবচেয়ে কষ্টের জায়গায় আঘাত করলে তুমি। বিশ্বাস হচ্ছিলনা। এই সেই তুমি?
হেরে গেলাম আমি, আমার ভালোবাসা; জয় হল তোমার অভিনয়ের। আচ্ছা, ভালোবাসার অভিনয় কি এতোই সহজ ছিল তোমার কাছে? এক মুহূর্তের জন্যেও কি মনে পড়েনি আমাদের একসাথে কাটানো সময়গুলো? কতো রাত কেটেছে চোখের জলে ভেসে।
থাক এসব কথা। তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো। আর আমি? আমি তো আছি; ভালোই আছি; নিজের মতো করে আছি।
কালো মেয়েদের যে কোনো কিছুরই অধিকার নেই! না আছে ভালোবাসার অধিকার, না আছে ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার। বিয়ের পিঁড়িতেও তাদের কদর কম, বাবা-মায়ের চিন্তার এক বড় কারণ মেয়ের চাপা গায়ের রং। বড়ই অদ্ভুত, তাই না?
জন্ম থেকেই ফর্সা-কালোর যাঁতাকলে পিষে গিয়েছি আমি। কালো বলে সব সময় মনে হতো বাড়ির লোকেরা অন্য নজরে দেখছে। সেই মনে হওয়াটা জোরালো হলো যখন আমার এক ফুটফুটে ভাই হলো। ভাইকে আমি ভীষন ভালোবাসি। একে ছেলে তার ওপরে ফর্সা; বাড়ির সকলের নয়নমণি। আমি হিংসা করিনি কখনো সেই জন্য। তবে কষ্ট হতো খুব। ভাইয়ের জন্মদিন বেশ ঘটা করে পালন করা হতো বাড়িতে। সারাবাড়ি সাজানো হতো বেলুন দিয়ে,আলোয়। কতো লোকজন আসত ঐ দিন! বেশ মজা হতো। আমার জন্মদিন কেউ মনে রাখতো না,শুধু মা ছাড়া। মায়ের হাতের পায়েসই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় উপহার। একমাত্র তুমি আমার জন্মদিনের দিন আমার প্রিয় জুঁই ফুল দিয়েছিলে,সাথে ছোট্ট উপহার। আমার কাছে সেটা অনেক অনেক দামি ছিল। এখনো সেই ফুল আমার এই ডায়রির পাতার ভাঁজে সযত্নে রয়েছে। তুমি এসব ভুলে গেছো তাই না?
বাড়ির লোকেদের চোখেই যখন আমি ছিলাম বিরক্তির কারণ, ভালোবাসা থেকে হয়েছিলাম বঞ্চিত, তখন অন্যরা যে এর ব্যতিক্রম হবে সেটা ভাবাই ছিল আমার ভুল। ” কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ” কবির কাব্যেই রয়ে গিয়েছে সীমাবদ্ধ। বাস্তবের আঙিনায় সেটি অলীক কল্পনা বই নয়। বড় নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন এই সমাজ। সেখানে কালো মেয়েদের নিজেদের মনের মতো করে সাজতে নেই, রাঙিয়ে দিতে নেই নিজের ইচ্ছেকে; সেখানেও এক অদৃশ্য মাপকাঠি।
গাত্রবর্ণের তুলনায় তাকে হতে হয় জর্জরিত, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। প্রতিনিয়ত চলে তার স্বত্ত্বাকে হত্যা করার চেষ্টা। এতো বিধির বিধান নয়, এ সমাজের বিধান! মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, নিম্নমানের ভাবনার, মানসিকতার ফসল এই সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব।
তোমরা বাহ্যিক সৌন্দ্যর্যের সাধক। মনের সৌন্দ্যর্য যে অনেক বেশি, সে খোঁজ কজন পায়? শুক্তির ভিতরে যেমন মুক্তা থাকে, পরম যত্নে, সকলের অলক্ষে। মনও ঠিক তেমনই, ধরা দিয়েও না দেয় ধরা। কজন পারে সেই অতল সাগরে ডুব দিতে?
যতই কালো হই, ‘কালো মেয়ে’-র তকমা গায়ে লাগুক; যতই নিজের ইচ্ছেকে সাজাতে বাধা পাই না কেন, আমাদের মনকে আমরা ঠিক সাজিয়ে নেবো, মনের মতো করে। স্বপ্নের জাল বুনব নিভৃতে, সেখানে থাকবে শুধু আমার অধিকার। সেখানে কোনো ফাঁকি নেই, না আছে কোনো খাদ, না আছে তোমাদের ব্যাঙ্গের হাসি। ভাগ্যিস মনের কোনো রং হয়না, হলে হয়তো সেখানেও আসত বাধা।
এতো শুধু আমার কথা নয়, আমার মতো ‘কালোমেয়ে’দের জীবনের জলছবি। আমরা এভাবেই ভালো আছি, ভালো থাকব। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। যার জন্য আমি নতুন ভাবে বাঁচতে শিখলাম। আমার ‘আমি’টাকে নতুন রূপে, নতুন ভাবে খুঁজে পেলাম।
সমাপ্ত