ভাদ্র মাসের কোন একদিন তামস প্রভাতবেলায়,
অবিরত ধারাসম্পাতে বুঝি সৃষ্টি মাতিছে খেলায়।
মাধুকরী ব্রত পালনে সেদিনও পথে ভগবন বুদ্ধ,
কিন্তু প্রকৃতি তাঁহার পথটি বারেবারে করে রুদ্ধ।
রাজ প্রামাণিক উপালী তাঁহার বর্ণটি নমোশুদ্র,
পথের পার্শ্বে নাপিত কুটীর জীর্ণ এবং ক্ষুদ্র।
সেই কুটীরেরই অলিন্দখানি ততোধিক বিক্ষত,
তথাপি সেথায় দণ্ডায়মান রাজগুরু তথাগত।
এমত সময় কক্ষ হইতে উপালী বাহিরে আসি’,
হেরি’ ভগবনে, কপোল তাঁহার অশ্রুতে বাণভাসি।
কহিলেন তিনি-“হে তথাগত, আমি ত’ নিম্ন জাতি,
মোর দুয়ারেতে রাজগুরু যেন নিশীথে দীপের ভাতি।”
“কি হেতু আপনি এমত ধারণা পোষণ করেন ভদ্র !”
হাসেন বুদ্ধ-“তথাগত সনে কেহ নন কভু ক্ষুদ্র।”
অবশেষে থামে বরিষণধারা–ধীর পদে জ্ঞানী পথে ,
পিছনে চলেন নাপিত উপালী প্রশ্নের ঝুলি সাথে।
“প্রভুর পথ কি ক্ষৌরকারের অনুসরণের যোগ্য”!
“বুদ্ধ মার্গ সকলের তরে”-জবাব দিলেন প্রাজ্ঞ।
মার্গ অর্থ কি পিচ্ছিলপথ নাকি নির্বাণলাভ পন্থা,
উথালপাথাল উপালী হিয়ায় আবেশ শতেক চিন্তা।
সংশয়ী তিনি -“ক্ষৌরকারের জিজ্ঞাসা এবে প্রভু,
শ্রমণের এই জীবনমার্গে সে কি স্বীকৃত কভু !”
“সৌগতমার্গ সবার জন্য” –বুদ্ধের স্মিত হাসি,
“সবার উপর মানুষ সত্য,বর্ণে কি যায় আসি’!
শ্রমণত্বের সকল গুণই আপনার আছে আর্য,
অষ্টাঙ্গিক মার্গ আলোকে উজল জীবন সূর্য।”
উপালী চিত্ত বিকম্পিত আনন্দ সংকোচে,
এবার বুঝি বা নির্ভীক অতি–শেষ প্রশ্নটি রচে।
“উরুবেলাগ্রামে তরুতলে বসি যে অপর্যাপ্ত বোধি,
লভিয়াছিলেন নিশাকালে এক রাজপুত্র সুধী,
সেই সিদ্ধার্থ যিনি আজি কিনা মহাজ্ঞানী প্রভু বুদ্ধ,
তাঁহার ন্যায় চিত্ত ত’ মোর নহে কোনরূপ শুদ্ধ।
আমি এক দীন ক্ষৌরকার অজ্ঞানী অতিশয়,
তথাপি কিরূপে লভিব প্রজ্ঞা–হিয়া মাঝে সংশয়।”
দৃঢ়তার সাথে কহেন বুদ্ধ-“ অসম্ভবটি কিসে !
আপনিও সেই বোধির আধার হইবেন অনায়াসে।”
চমৎকৃত নাপিত উপালী তথাগত বাণী শ্রবণে,
এমন কথা ত বলেন নি তারে সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণে।
দরবিগলিত নয়ন দুখানি–হৃদয় করে যে নৃত্য !
“সামান্য এক ক্ষৌরকার–লভিবে কি সে বুদ্ধত্ব ! “
তাঁহার প্রশ্নে ভগবন আঁখি অপরূপ জ্যোতিময়,
উপালীর প্রতি প্রদান করেন অনন্ত বরাভয়।
“বুদ্ধত্বে সকলেরই আছে অভিন্ন অধিকার,
ব্রাহ্মণ সাথে চণ্ডালে সেথা নাহি কোন অবিচার।
আপনি উপালী এই জন্মেই হইতে পারেন বুদ্ধ”,
কহেন তাঁহারে প্রভু তথাগত-“চিত্ত হউক ঋদ্ধ।”
তথাগত সাথে উপালী প্রবেশি’বেণু্বণ মহাবিহারে,
ত্রিশরণ মন্ত্রে বৌদ্ধভিক্ষু পরদিন রবিকরে।
তপস্যারত শ্রমণ উপালী জীবন উদ্ভাসিত,
সন্দেশ লভি’ মগধাধিপতি বিহ্বল বিষ্মিত।
মাসাধিককাল বুঝি বীত প্রায়–নৃপতি বিম্বিসার ,
আহ্বান তিনি করেন বুদ্ধে–মাধ্যাহ্ণিক আহার।
পরিকরগণ ছিলেন যাঁহারা কেহই নহেন ব্রাত্য,
বিম্বিসার মহামতি বুঝি দেব তথাগত ভৃত্য।
ভক্ত নরেশ কণ্ঠে সদাই উদ্বোধিতের স্তুতি,
হতবাক তিনি লভি’ সত্বর রাজগুরু সম্মতি।
পূর্বে গুরুর স্বীকৃতি লাভ ঈষৎ বিলম্বিত,
বুদ্ধ কি তবে শিষ্যের প্রতি এইক্ষণে অতি প্রীত !
সঠিক দিনে বেনুবণ মঠে যতেক ছিলেন শ্রমণ,
দেব তথাগত সাথে উপাগত–রাজার আবাসে ভ্রমণ।
সবার অগ্রে বুদ্ধ স্বয়ং–ঠিক পিছনেই উপালী,
গৈরিকধারী মুণ্ডিতকেশ নয়নে চমকে বিজলী।
কনকপাত্র ভৃঙ্গার মাঝে সুরধুনী পূত নীরে,
ধৌত করেন মগধ নরেশ তথাগত পদ ধীরে।
অতিথিবৃন্দ মুগ্ধ সকলে তথা সভাসদগণ,
হেরিয়া প্রতাপী বিম্বিসারের অনিন্দ্য গুরু বরণ।
তৃপ্ত বুদ্ধ রাজন সেবায়–কণ্ঠে স্বস্তি বচন,
কিন্তু তাঁহার ইশারায় বুঝি অন্য কিছুরই যাচন।
প্রকৃতপক্ষে গুরুর আদেশ–যাচন কথাটি ভ্রান্তি,
দণ্ডায়মান উপালী পিছনে–মানসে অসীম শান্তি।
একদা যে দীন উপালী ছিলেন রাজার ক্ষৌরকার,
অবারিত আজি তাঁহার জন্য বেণুবিহারের দ্বার।
অবিকম্পিত মন্দ্রস্বরে কহেন পরম জ্ঞানী,
“বুদ্ধের সেবা করেন যিনি বুদ্ধভ্রাতারও তিনি।”
দেব ইঙ্গিত উপালীর প্রতি-“ইনিও বৌদ্ধভ্রাতা”,
গুরুর আদেশে তৎপর ত্বরা অজাতশত্রু পিতা।
আপনার করে ভৃঙ্গার নীরে ধৌত উপালী চরণ,
বুদ্ধের ন্যায় তাঁহারেও নৃপ করেন সাদরে বরণ।
অনন্ত জ্যোতিপুন্জের বলে নয়নে অসীম প্রজ্ঞা,
মধুর ভাষ্যে বুঝি বুদ্ধের সকলের প্রতি অনুজ্ঞা।
“দেশাধীপ যাহা করেন তাহা মন্ত্রীরও করণীয়,
শ্রমণ যাঁহারা সমাগত হেথা সমভাবে বরণীয়।
হে অমাত্য,পরিজন তথা প্রিয় সভাসদগণ,
রাজকর্মের অনুবর্তনই ত’ যথার্থ অনুশাসন।”
সভাস্থলে সমবেত যত বন্ধু,বিদ্বজন,
ত্যজিলেন সবে নতমস্তকে আপন সিংহাসন।
পদবন্দনা সর্ব অগ্রে তথাগত ভগবনে,
তদপরে সাধু উপালী তথা অন্য অন্য শ্রমণে।
রাজদূত যত কোশল, কান্চি, লিচ্ছবি,তথা শাক্য
বিম্বিসারের রাজসভা ছিল সবারই সেদিন লক্ষ্য।
সবাকার প্রতি পরম জ্ঞানীর একটিই ছিল ভাষ্য,
“আপনারা সবে হেরিলেন হেথা এক অপরূপ দৃশ্য।
মগধে যা আজি আচরিত তাহা কেন নহে অন্যত্র !
মানবে মানবে এই ভেদাভেদ কি হেতুক হায় মিত্র !
মগধের রাজগেহে আজি পালিত যে রাজধর্ম,
তাহাই হউক সমাজের বিধি নবীন জ্ঞানের বর্ম।
বহন করুন আপন আপন রাজ্যে এহেন বার্তা,”
বুদ্ধের বাণী নিমেষেই বুঝি সবার হৃদয় হর্তা।
“বর্ণে বর্ণে দ্বেষ বিদ্বেষ সমাজেই অভিষিক্ত,
শ্রদ্ধাহীনতা একে অন্যেরে সততই করে রিক্ত।
সবার উপর মানুষ সত্য–নহে কেহ নীচ উচ্চ,
সকলের তরে সকলের প্রাণ–জাতি কি বর্ণ তুচ্ছ।
মানবে মানবে নেই ভেদাভেদ–জ্ঞানের পরম দৃষ্টি,”
মনুষ্যত্বের জয়নির্ঘোষে মুখরিত সারা সৃষ্টি।
অহিংস এক আন্দোলনের পাটলিপুত্র রক্ষী,
আলোড়িত হয় ভারতবর্ষ–ইতিহাস আছে সাক্ষী।
সেদিনের সেই বুদ্ধ ভাষ্য দেশবাসী বিষ্মৃত,
ভেদাভেদ আর হানাহানি মাঝে মানবতা পরাভূত।
কত সহস্র বর্ষ অতীত তথাপি কালের মন্দিরা,
যাহার ধ্বনিতে হ্দয়ে আজিও বহে মাধুরীর ধারা।
ছন্দমালায় সাজালেম দেব কাহিনীটি অনুপম,
অধীর হিয়ায় আসুক শান্তি–বুদ্ধং শরণম।