সেদিন ছিল আমার কলেজের প্রথমদিন । স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর এ এক অদ্ভুদ স্বাধীনতা আমার কাছে, শুধু আমার কেন , আমার মনে হয় অনেকের কাছেই তা সত্যি । মনের কোথাও যেন নিজেকে বড় বলে অনুভব করতে লাগলাম । প্রথমদিকে বেশ নার্ভাস ছিলাম । নতুন জায়গা , নতুন বন্ধুবান্ধব , নতুন কিছু অভ্যেস – সবই নতুন । এসবকিছুর সাথে নিজেকে কতটা মানিয়ে নিতে পারব , আদৌও মানিয়ে নিতে পারব কিনা – তা নিয়ে একটা ভয় কাজ করত আমার মনে ।

কলেজে প্রথম দু’ দিন যাওয়ার পর মনে হয়েছিল এরচেয়ে ঢের ভালো ছিল স্কুল , স্কুলের বন্ধুবান্ধব , সেখানকার পরিবেশ -কেন যে চোখের পলকে সেদিনগুলো শেষ হয়ে গেল….আমি ভাবতাম আর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতাম । তারপর ধীরে ধীরে এসকল জিনিসের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা কবে যে দূর হয়ে গেল তা বুঝতেও পারলাম না আর এও বুঝতে পারলাম না যে সে সকল জিনিসের সাথে আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম না সে সকল জিনিস আমার সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়েছিল, নাকি মানিয়ে নেওয়াটা ছিল দু’তরফ থেকেই…।

মনে পড়ে কলেজের প্রথম বছরে শীতের এক সকালে আমি কলেজ ক্যান্টিনে বসে জানালা দিয়ে আসা রোদের মিষ্টতার সাথে চায়ের কড়া মেজাজ উপভোগ করছিলাম । তখন বাজে প্রায় পৌনে ন’টা । ক্যান্টিনের রবীন্দ্রসংগীত সেই শীতের সকালে আমাকে এক গভীর ভাবনার জগতে নিয়ে গিয়েছিল, দৃষ্টি আমার বাইরের দিকে । হঠাৎ অনুভব করলাম কি একটা ঠান্ডা জিনিস টেবিলের উপর রাখা আমার হাতটাকে ধরে বারকতক ঝাঁকাচ্ছে । সেই ভাবনার জগৎ নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে গেল, আমি চমকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম পারমিতা রীতিমতো আমার পাশে দাঁড়িয়ে থর্ থর্ করে কাঁপছে।

ওহ্, পারমিতার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই একবার। পারমিতা আমার এক সহপাঠী এবং একজন সিনসিয়ার ছাত্রী , গম্ভীর কিছুটা , খুব একটা কথা হয় না ওর সাথে কিন্তু পড়া সংক্রান্ত যেকোন সাহায্যের দরকার হলে আমরা ওর কাছে যেতাম । আমি তৎক্ষনাৎ হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললাম , ” কি ঠান্ডা তোর হাত ! বস্ বস্ চেয়ারে , তোর জন্য একটা চা কিংবা কফি বলি ? ” ও কাঁপতে কাঁপতে বলল , ” না, না, আমি অর্ডার দিয়ে এসেছি ” – বলে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলতে এসেছে দেখে আমি কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। তারপর ও বলতে শুরু করলো , ” আজ ন’ টার লেকচার ক্লাসটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে যে, আমায় কেউ জানায়নি ….শীতের মধ্যে আমাকে সেই কত সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হল…”। পারমিতার বাড়ি কলেজ থেকে প্রায় দু’ঘন্টার বাস রাস্তা। আমি বললাম , ” হ্যাঁ, আমাকেও কেউ জানায়নি, এসে শুনলাম…। ”

তারপর মিনিটখানেক দু’জনেই চুপ । আমি বুঝতে পারলাম না আর কি বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় ওর সাথে , ও একজন ভালো স্টুডেন্ট , পড়াশুনা ছাড়া আর কিছুতে কি আগ্রহ থাকবে ওর ? কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো। ইতিমধ্যে পারমিতার চা এসে পৌঁছল টেবিলে । আমি আবার নিজের কাপে চুমুক দিতে লাগলাম। পারমিতা চায়ের প্রথম চুমুকের পর বলে উঠল ” রামুদা চা-টা ঘ্যামা বানায় কিন্তু , তাই না শ্রীময়ী ? ” ” ঘ্যামা” শব্দটা আমরা যারা সাধারন স্টুডেন্ট তারাই বলে থাকতাম। যাইহোক , ওর মুখে ‘ ঘ্যামা ‘ শব্দটা শোনার পর ওর সাথে কথা বলার অস্বস্তিটা একটু হলেও কমেছিল । আমি মাথা নেড়ে বললাম ” সত্যিই , যা বলেছিস….”। তারপর ওর প্রথম চা বানানোর অভিজ্ঞতা, সেই চায়ের তিক্ত স্বাদ , কোথায় কোথায় ভালো চা পাওয়া যায়, কফি কোথায় ভালো বানায়, আমাদের রামুদার চায়ের কদর সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া দরকার – এরকম হাজারও কথায়, ঠাট্টায় আমরা দু’জনে এতটাই মজে গিয়েছিলাম যে কখন পরের লেকচার ক্লাসটা শেষ হয়ে গিয়ে তার পরের প্র্যাক্টিকাল ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছিল তা খেয়ালও করিনি।

হঠাৎ যখন খেয়াল হল তখন দু’জনেই দৌড় লাগালাম ক্যান্টিন থেকে। তারপর সেই প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের টিচার সকলের সামনে বেশ গুছিয়ে মার্জিত শব্দ ব্যবহার করে আমাদের যেভাবে অপমান করেছিলেন তাতে তখন দু’জনেরই ভেতরে অগ্নিদাহ হতে শুরু করেছিল ঠিকই, পরে যদিও সেকথা মনে করে আমরা অশ্রু ঝড়িয়ে হেসেছিলাম প্রচুর। এভাবেই আরও ছোটখাটো কিছু ঘটনার পর পারমিতার সাথে আমার ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। আরও কয়েকজন যেমন অন্বেষা, পাপিয়া এরাও কেউ পারমিতার বন্ধুত্বের আকর্ষনকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। একসাথে বসে আড্ডা দেওয়া , প্রায়ই ক্লাসে ঢুকতে দেরি হওয়ার জন্য টিচারদের বকা খাওয়া, কারও মন খারাপ হলে তাকে হাসানোর শত চেষ্টা, কলেজের শেষে আশেপাশে ঘুরতে যাওয়া, বাড়ি ফিরতে দেরি হলে বাবা- মায়ের কাছে বকা খাওয়া, সবশেষে পড়াশুনা করে প্রত্যেক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার চেষ্টা – সব মিলিয়ে শুধু আমার নয় আমাদের চারজনেরই জীবন পরিপূর্ন হয়ে উঠেছিল।

কলেজের শেষ দু’বছরে আমি আর পারমিতা হোস্টেলে একটা রুম শেয়ার করে থাকতাম। পারমিতার বন্ধুত্বের গুনে আমিও কিছুটা সিনসিয়ারিটি অর্জন করেছিলাম, আর সেজন্যই পারমিতার অনুপস্থিতিতে কয়েকজন সহপাঠী মাঝে মধ্যে আমার কাছেও আসতো ক্লাসনোটস্ নিতে আর পড়া বুঝতে। ওদেরকে ছোটখাটো পড়ার বিষয় বোঝানোর সময় মনে মনে এক অদ্ভুদ আনন্দ পেতাম। এভাবে, আরও পড়তে হবে , আরও জানতে হবে , আরও সিনসিয়ার হতে হবে – এসবের নেশা বাসা বাঁধল আমার মস্তিষ্কে। এক বিপুল পরিবর্তন এসেছিল আমার মধ্যে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম বটে, কিন্তু ব্যাপারটাকে উপভোগও করছিলাম একইসাথে।ধীরে ধীরে কলেজের সকলে আমাকে চিনতে শুরু করলো আর আমি একটু একটু করে হারিয়ে ফেলতে লাগলাম আমার নিজের ‘ আমি ‘কে।

শেষেরদিকে ওদের সাথে সময় কাটানোর চেয়েও কেন জানিনা বেশি আগ্রহ পেতাম আমার বাকি সহপাঠীদের সাথে পড়াশুনা, কেরিয়ার সংক্রান্ত বিষয় আলোচনা করার মধ্যে। এভাবে পারমিতাদের সাথে আমার মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল, মনে করেছিলাম ওরা বুঝি আমার প্রগতিকে ভালোচোখে দেখছে না। শেষ দু’মাস ওদের সাথে আমার একটাও কথা হয়নি, এমনকি একই রুমে থেকে পারমিতার সাথেও নয়। আমাদের চারজনের একসাথে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দেওয়া আর হতো না, কোনো আনন্দ-কষ্ট শেয়ার করাও নিষ্প্রয়োজনের খাতায় নাম লিখিয়েছিল, আর ক্লাসও মিস্ হতো না আমার , ওদের সাথে টিচারের কাছে একসাথে বকা খাওয়াও হয়ে ওঠেনি আর।

আমি তখন বাবা-মা, স্কুলের টিচারদের কাছে গর্বের বিষয়, আর আমার চোখে একটাই স্বপ্ন- আরও আরও সাফল্য অর্জন করার। কলেজের শেষদিনে আমার সাথে পারমিতা, অন্বেষা, পাপিয়া কারোরই দেখা হয়নি, কারণ আমি ছিলাম তখন টিচার্স রুমে টিচারদের বিদায় জানতে এবং তাঁদের আশীর্বাদ কুড়োতে ব্যস্ত। হোস্টেলে ফিরে দেখলাম পারমিতা ততক্ষনে ওর সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমার কেন জানিনা খারাপ লাগলো কলেজের শেষদিনে ওকে দেখতে না পেয়ে। যাইহোক, আমিও নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রুমটা আরেকবার চেক্ করে নিতে গিয়ে দেখলাম পারমিতার খাটের নীচে একটা ডায়েরি পরে আছে। সম্ভবতঃ সেটা পারমিতার। অন্যের ডায়েরি পড়ার কুভ্যেসটা আমি কখনই ছেড়ে উঠতে পারিনি। সবকিছু গুছিয়ে হোস্টেল ছেড়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার সময় ওর ডায়েরিটা খুলে পড়তে লাগলাম। অনেককিছুই জানতে পারলাম যা এতদিনের নিয়মিত দেখাসাক্ষাতেও জেনে ওঠা হয়নি। ওর আসল বাড়ি জলপাইগুড়ি। গাড়িদুর্ঘটনায় একইসাথে ওর বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর দশ বছরের ছোট পারমিতা মানুষ হয় কলকাতায় জ্যেঠু-জ্যেঠিমার কাছে। হৃদয় বিদারক কিছু কবিতাও দেখলাম মাঝের কয়েক পাতায়….মনে হল ওরই লেখা….ওর এ গুনও আমার অজানা ছিল। একটা পাতায় দেখলাম আমাকে নিয়েও বেশ কিছু অংশ লেখা আছে , তা আমি সরাসরিই তুলে ধরলাম–

” আমি ভেবেছিলাম যে পড়াশুনা ছাড়া আর কিছুই নেই যা আঁকড়ে ধরে বাবা-মাকে হারানোর দুঃখ ভুলে সারাজীবন কাটাতে পারব। একেবারে একা হয়ে পড়েছিলাম, কষ্ট হত নিজের একাকীত্বটাকে মেনে নিতে,পড়াশুনা ছাড়া আমার এ কষ্ট ভাগ করার মত কাউকে খুঁজে পাইনি। কলেজে আসার পর শ্রীময়ী, অন্বেষা , পাপিয়া আরও কয়েকজনকে দেখতাম সবার সাথে কথা বলতে, বেশ হাসি ঠাট্টা করতে, মজা করতে , সাথে অল্পস্বল্প পড়াশুনাও করতে,সকল দুঃখকে পেছনে ঠেলে প্রাণখুলে নিজের জীবনটাকে উপভোগ করতে। কলেজে শ্রীময়ী আমার প্রথম বন্ধু। প্রথম ওর সাথে আড্ডা দেওয়া, টিচারদের কাছে বকা খাওয়া, কলেজ অনুষ্ঠানে যোগদান করা,নতুন জীবনের প্রথম শ্বাস নেওয়া সব ওরই হাত ধরে শুরু করেছিলাম-এজন্যই ওকে আমার সবথেকে কাছের মনে হতো। ওদের সাথে থাকলে মনে হত আমি আর একা নই। আজ সময় অনেক এগিয়ে গেছে।

শেষ কয়েকমাস যাবৎ অনেক কথাই জমে রয়েছে আমার মনে শ্রীময়ীকে বলার জন্য শুধু একটিমাত্র সুযোগের অভাবে। অপেক্ষায় ছিলাম আমি। কিন্তু সেই বন্ধুত্বের হাত, সেই পুরনো শ্রীময়ীকে আর কখনো খুঁজে পাইনি। অন্বেষা, পাপিয়াও শুনলাম অন্য দলে ভিড়েছে। আর আমি পড়ে রইলাম আবার সেই আগের মতো একা। শুনেছিলাম চিরস্থায়ী বলে কিছুই হয় না, সবই সাময়িক – ঠিক তেমনই হয়তো আমার একাকীত্বহীনতা, আমার আনন্দ….।”

আমি ডায়েরীটা বন্ধ করে দিলাম। রাগ হলো নিজের উপর। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, পড়াশুনা তো শুধু আমাকে সাফল্য দিতে পেরেছে কিন্তু সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাকে সত্যিই খুশি রাখতে পেরেছে কি ? শুধুই ছুটে গেছি পরীক্ষায় ভালো নম্বরের লোভে, বাবা-মা, টিচারদের কাছে বাধ্য ছাত্রী হওয়ার আশায়, একাই অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার নেশায় ….ভুলে গিয়েছিলাম যে পড়াশুনা,কেরিয়ার এসবই জীবনের একটা অংশমাত্র। পড়াশুনার পাশাপাশি আরও অনেক ছোট ছোট জগৎ আছে যেখানে পাশ-ফেল, হার-জিত এসবের ভয় থাকে না, থাকে কিছু পাগলামি, কিছুটা নিজেদেরকে চেনার সুযোগ, কিছুটা সবার সাথে বাঁচার ইচ্ছে, আর কিছুটা ব্যাখা করা যায় না। যাদের নিয়ে আমার কলেজজীবন শুরু করা , যাদের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, সুখ-দুঃখগুলো ভাগ করে প্রতিরাতে শান্তিতে ঘুমানো, যাদের সাথে কাটানো সময় আমার সত্যিকারের কলেজস্মৃতি বানিয়ে রেখেছে, আজ তাদের থেকে এতদূরে চলে গিয়েছি যে আজ সহস্র চেষ্টা করলেও ওদের একইসাথে একইভাবে একই জায়গায় ফিরে পাব না আর। ভেবে চোখে জল এল।

আমি চোখ মুছে ডায়েরির একেবারে প্রথম পাতায় লেখা পারমিতার কলকাতার ঠিকানায় ট্যাক্সি ঘোরাতে নির্দেশ দিলাম ড্রাইভারকে। প্রায় ঘন্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে পারমিতার বাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে অবাক হয়ে এসে দাঁড়ালো পারমিতা আমার সামনে। ডায়েরীটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে ‘Sorry’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলাম না। তারপর আমরা দুজনেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুধুই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম।

 

~ কলেজের দিনগুলি ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleআমার মেজো কাকা
Next articleবিরহ
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments