সকাল নটার সময় চিতু গড়িয়ার বোরাল মোরের বাসস্টপে দাঁড়িয়েছিল। গায়ে একটা বেশ পুরনো কিন্তু কাচা চেক সার্ট আর বেশ পুরনো একটা জিনস, কাজের দিনে এটাই সে পরে। পুরো নাম চিত্তরঞ্জন কিন্তু পাড়ায় বন্ধু বান্ধবদের আড্ডায় সে বহুদিন হোল চিতু হয়ে গেছে। কামালগাজীর দিকে একটা ছোট্ট টালির বাড়ীতে থাকে, বাবা মা কয়েক বছর আগে দেহ রেখেছেন। ঘরে মানুষ বলতে বউ মনোরমা আর তাদের বছর দেরেকের ছেলে ডাব্বু। অবশ্য এতেই শান্তি নেই কারণ বউটা আবার পোয়াতি হয়ে গেছে, আট মাসে চলছে। সব দিক থেকে চিতু জেরবার হয়ে আছে। আজ সকালেও এই বাসস্টপে দুবার মোবাইল বেজেছে … গোপালের ফোন, এই সাত সকালে তাসের আড্ডায় ডাক। বিরক্ত হয়ে চিতু মোবাইলটা সাইলেন্ট করে পকেটে রেখেদিল।
চিতু এবার একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল, নটা দশ। যখনই চিতু কাজে বার হয় এই সময়েই যায় আর বাসে যা ভিড়। অবশ্য ভিড় বাস বলে চিতুর কোন প্রবলেম নেই, বরং সে ভিড় বাসই বেশি পছন্দ করে। আজও তাই, প্রথম দুটো বাস সে ছেড়ে দিল, নটা দশেও সেরকম ভিড় নেই, বাঙালী বাবুদের বোধহয় অফিসে যাওয়ার গা-ই তাতে না। প্রায় সাড়ে নটার সময় একটা দুশো আটাশ এলো, বেশ ভিড়, চিতু আর অপেক্ষা করলো না … গেটের ঝুলন্ত লোকটাকে অনায়াসে টপকে ভেতরে ঢুকে গেল, তারও এবার কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
******
বাসের ভেতরে একেবারে জ্যাম প্যাক্ট। চিতু অবশ্য কলকাতার ছেলে, ভিড়ে অভ্যস্ত, সে ওর মধ্যে দিয়েই পিছল মাছের মতো একটা সিটের একটু পিছনে নিজেকে সেট করে নিল। একটু ঠাসা হলেও জায়গাটা ভালো, বাসের মধ্যে অনেকটা দেখা যাচ্ছে। বাসের মধ্যে ঠাসা ভিড়, সিটের দুটো রো-র মধ্যে অসংখ্য মানুষ এ ওর গায়ের ওপর ভড় রেখে যে যার নিজের চিন্তায় মগ্ন। চিতুর ঠোঁটে একটু চতুর হাঁসি খেলে গেল। সে নিজেই নিজের মনেমনে নিজের পিঠটা চাপড়ে দিল।
কিন্তু এবার কাজের ব্যাপার। চিতু সতর্ক দৃষ্টিতে নিজের আশেপাশে তাকাল … হু, মন্দ নয়। একদম সামনেই দুজনের আগে সাদা সার্ট আর কালো প্যান্ট পরা একজন দাঁড়িয়ে আছে, দেখলেই মনে হয় বেশ সরেস মাল, এদের জন্যই তো চিতুর সকালটা আলো হয়ে থাকে। ঠিক তার পাশেই আরো একজন মোটা চওড়া গোঁফ-ওয়ালা একজন দাঁড়িয়ে আছেন জানলার দিকে মুখ করে, সেও খারাপ নয়, এই ব্যাবসায়ে সব সময়ে জামা কাপড় দেখলেই চলে না, সঠিক জড়িপ একমাত্র পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই করা সম্ভব। এদিকে চিতুর আশেপাশে বেশ কয়েকজন গড়িয়া কলেজের ছাত্র দাঁড়িয়ে ওয়ার্ল্ড কাপের ওপর কথা বলে যাচ্ছে, কোন দিকে খেয়াল নেই। চিতু এদের দিকে সেরকম নজর দেয় না, যখন কাঁচা ছিল তখন এদের ওপর হাত সাফাই পরীক্ষা করতো। কিন্তু এদের মাল সরিয়ে লাভ হয় না, পঞ্চাশ একশো টাকার বেশি পার্সে থাকে না তাই একটু হাত পাকতেই চিতু মানুষকে অবসার্ভ করে কাজে এগোয়, এগুলো সবই গুরুদেবের শিক্ষা।
বাসটা সবে এগুতে শুরু করেছে, গড়িয়া ব্রীজের কাছে আসতেই বেশ কয়েকটা অ্যায়সা ঝাঁকুনি মারলো যে বাসের ভিড়টা বেশ থিতু হয়ে গেল। গড়িয়া বাজারের পর দু একজন নামলো উঠলো আর চিতু মাছের মতো এদিক সেদিক করে ঠিক সেই সাদা সার্টের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
******
নিজের পজিশান ঠিক মতো নিয়েই চিতু একবার নিচের দিকে সামনের লোকের হিপ পকেটের দিকে চকিতে তাকাল। আঃ, সে এক স্বর্গিয় অনুভূতি। ছেলেটা বোধহয় নতুন চাকরীতে ঢুকেছে, ডান হাতে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ নিয়ে ওপরের হ্যান্ড রেস্টটা ধরে আছে, বাঁ হাতটা দিয়েও হ্যান্ড রেলিং ধরা, হিপ পকেটটা মোটা একটা পার্সে উঁচু হয়ে আছে। যদি ওই ব্যাগের আর্দ্ধেকটাও টাকায় ভর্তি থাকে তাহলেও চিতুর আর আজকে কাজের দরকার হবে না, এই একটা কাজেই বাজি মাত। আর পাশের সেই মোটা মতো গুঁফোবাবু, বয়স তো পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে তাও কি উজবুক দেখ, একটা বিশাল মাপের মোবাইল ফোন হিপ পকেটে। চিতুর অভিঞ্জতায় একটু বেশি বয়সের মানুষেরা অনেক সাবধানি হয়, তাদের পকেট সাফাই বেশ ঝকমারির ব্যাপার। কিন্তু এই পাবলিকের তো সেরকম কিছু সতর্কতা আছে বলে মনে হয় না। চিতুর এই রকম একটা বড় মোবাইলের কতদিনের শখ, দাম অন্তত হাজার চল্লিশ তো হবেই। চিতু মনে মনে একবার ঈস্টদেবকে স্মরণ করে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো।
বাস এর মধ্যে গড়িয়ার পাঁচ নম্বর স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে গুটি গুটি নাকতলার দিকে চলেছে। এটাও একটা গাড্ডা, শিকার যদি পাঁচ নম্বরেই নেমে যেত তাহলে আজকে আফসোসের সীমা থাকতো না, যাক ভাগ্য আজ চিতুর দিকেই যাচ্ছে। সে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে ভদ্রলোকের গায়ের ওপর এসে পরলো, এটাও গুরুদেবের কাছ থেকেই শেখা, “অপারেশানের আগে শিকারকে অন্যমনস্ক করে দাও”। মোটা গুঁফো ভদ্রলোক বোধহয় পাশ থেকে একটু ভার অনুভব করছিলেন, অল্প একটু কেশে খেঁকিয়ে উঠলেন – “একটু সোজা হয়ে দাঁড়ান দাদা, এই গরমে গায়ের ওপর পরবেন না”।
চিতু এসব আগেও শুনেছে, বেশ মোলায়েম ভাবে বললো – “কিছু মনে করবেন না, যা ভিড়। পিছন থেকে কে ধাক্কা দিয়ে গেল”।
মোটা ভদ্রলোক আর কিছু বললেন না, নিজের মনে একটু গজগজ করলেন – “কন্ডাকটার গুলোও হয়েছে সেরকম, এতো ওভার ক্যাপাসিটি করে ফেলে …”।
চিতু তার জায়গা ছেড়ে নরলো না, এটাই বেস্ট পোজিশান, সমস্ত অ্যাঙ্গেল থেকে ওদের দুজনার হিপ পকেট দুটো একদম আড়াল হয়ে আছে, তার ওপর আবার ঠিক পাশেই গোটা তিনেক কলেজ স্টুডেন্ট এসে কোন প্রোফেসরের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করছে, কথার শব্দে কানে আর কিছু ঢুকছে না। বাস ততক্ষণে বেশ কিছুটা এগিয়ে রাণীকুঠির মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, চিতু একবার দূর্গা স্মরণ করলো, অপারেশানটা যদি টালিগঞ্জের মোড়ের আগে হয়ে যায় তাহলে মন্দ নয়, সট করে ওখানে নেমে পরবে কারণ ওই মোড়ে বেশ কিছু পাবলিক ওঠানামা করে।
বাসটা ছাড়তেই চিতু তৈরী হোল। সাদা সার্ট পরা ছেলেটা তখন বাঁ হাতে ব্যাগটা ধরে ডান হাতে মোবাইলে কারোর সাথে কথা বলছে, ছাত্ররা ঠিক তার বগলের তলায় দাঁড়িয়ে ফেস বুক চেক করতে করতে নানা কথা বলছে, চিতু খুব সূক্ষ্ম হাতে মোটা পার্সটা হিপ পকেট থেকে তুলে নিজের প্যান্টের ডান পায়ের একটু তলার দ্বিতীয় পকেটে ঢুকিয়ে দিল। তার প্যান্টটা অনেকটা মিস্ত্রিদের মতো, সেখানে সাইড পকেটের তলায় আরো দুটো পকেট আছে দুদিকে। এই কাজের মধ্যেও ও ছেলেটার গায়ের ওপর চাপ সরাল না, এতে বোঝার সেন্সটা আরো কমে যায়। মিনিট দুয়েক কেটে গেল, ছেলেটা এখনো কথায় মগ্ন, চিতু নিশ্চিন্ত হোল … কিছুই বোঝেনি। চতুর চোখে সে এবার পাশের মোটা গুঁফোর হিপ পকেটের দিকে তাকাল, ভদ্রলোক নিশ্চিন্তে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। বাসের স্পীড দেখে বোঝা যাচ্ছে সামনে আর একটা স্টপ আসছে, চিতু আর বেশি রিস্ক নিতে পারছে না, যা করার এই স্টপেই করে নেমে যেতে হবে। সে আশেপাশে একটু তাকাল, দু একজন জানলার ফাঁক দিয়ে কিছু দেখতে চেস্টা করছে মানে কিছু লোক নামবে। চিতু ছাত্রদের পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট গলির রেখা দেখে এক পা সাইডে সরে গেল, তারপর তার বাঁ হাতটা একটা ছোট্ট আর্কে ঘুরে গেল আর আঙুলের ফাঁকে ম্যাজিকের মতো সেই মোবাইল। বাসটা জাস্ট স্ট্যান্ডে ঢুকছে, চিতু ওই অল্প স্পীডের মধ্যেই লাফিয়ে নেমে গেল।
******
রাস্তায় নেমেই চিতুর কিছু একটা মনে হোল, বাসটাও তো আস্তে আস্তে স্টপেই এসে থামলো … আর বাসের মধ্যে যেন কিসের একটা গন্ডগোল? বেশ কয়েকটা উচ্চ কন্ঠের চিৎকার … ঠিক না? চিতুর বুকটা ধক করে উঠলো, এর মধ্যে ওই ছেলেটা যদি টিকিট কাটতে যায় তাহলেই তো চিত্তির। ও কি করবে ভেবে কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর মাথার মধ্যে কেমন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল, চিতু ভিড়ের মধ্যেই দৌড়ে একটা অটোর সাইডের সিটে বসে পরলো। যাক, অন্তত হাজরার মোড় অবধি শান্তিতে যাওয়া যাক, ততক্ষণে বাসটা অনেক পিছনে পরে থাকবে।
সকাল সোয়া দশটার সময় টালিগঞ্জ থেকে হাজরার মোড় অবধি যাওয়া অবশ্য অত সোজা নয়, আনোয়ার্সা রোডের মোড় আসতেই মিনিট পনের বেরিয়ে গেল, তারপর অবশ্য একটু ফাঁকা রাস্তা পেয়ে অটো আর মিনিট দশেকে চিতুকে হাজরার মোড়ে নামিয়ে দিল।
হাজরার মোড়ে নেমে চিতু একটু দম নিল, বুকের মধ্যেটা তখনও ধুকধুক করছে। বাপরে, আর একটু হলেই হয়েছিল, নির্ঘাত রাম পেটাই। ডান দিকের নিচের পকেটে সেই মোটা পার্স আর বাঁ পকেটে সেই গাবদা স্মার্টফোন। চিতু ওদুটোর দিকে এখন আর তাকাল না, সোজা রাস্তার বাঁ ধারের একটা চায়ের দোকানে মাটির খুরির চা আর একটা লেরো বিস্কূট নিয়ে খেতে শুরু করলো আর মনে মনে ভাবতে লাগলো কোনদিকে যাওয়া যায়। এই এরিয়া খুব একটা সেফ নয়, বলা যায় না ওই দুই মক্কেল কোথায় নেমেছে, এইসব জায়গা খুবই বিজি, এদিকে এসে যেতেও পারে।
চা শেষ হতেই চিতু রাস্তার ধার থেকে একটা হাওড়াগামী বাসে উঠে পরলো, ওদিকটাই সেফ, অফিসবাবুরা আর যাই হোক হাওড়ায় যাবে না।
******
কলকাতার রাস্তার যা অবস্থা, বিশেষ করে ওই স্ট্র্যান্ড রোড, বড়বাজার … এইসব জায়গাগুলো, তার ওপর প্রাইভেট বাসের সেই ঢিকির ঢিকির যাওয়া, বাস হাওড়ায় পৌঁছতে বারোটা বেজে গেল। চিতুর অবশ্য ভালোই হোল, এই সময় লোকাল বা দূর পাল্লার সেরকম কোন ট্রেন নেই, বিরাট স্টেশানটা কেমন আলস্যে পরে আছে, প্রায় ফাঁকা। দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রুপে মানুষ জমে আছে, বেশ কিছু কুলি লাল ফতুয়া পরে এক জায়গায় বসে বিড়ি খেতে খেতে গল্প করছে, বেশ কিছু ভিখিরি এদিক ওদিক ছড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে প্ল্যাটফর্মে শুয়ে আছে।
চিতু দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনের ঘেরা বসার যায়গায় গিয়ে ধপাস করে একটা ফাঁকা সিটে বসে পরলো। আঃ, কি শান্তি, চারিদিক ফাঁকা, এবার সে নিরাপদে তার আজকের রোজকারগুলো একটু নাড়াচাড়া করতে পারে।
প্রথমে সেই মোটা চামড়ার পার্স। প্রথম খাপে বেশ কিছু লেখা কাগজ, ভিসিটিং কার্ড … চিতুর ভুরু কেমন কুঁচকে গেল। ধ্যাত, কিছু পাত্তি আছে কি নেই। দুরুদুরু বুকে দ্বিতীয় খাপ, দুটো আঙুল ঢুকিয়ে চিতু কিছু বার করলো, পাট করা একটা ছোট্ট রিসিট। আবার হাত ঢোকাল, হাত বার করেই তৃপ্তি, পাট করা দুটো পঞ্চাশ আর দুটো একশো টাকার নোট। যাক, কিছুতো এলো।
একটা সিট বাদ দিয়ে তার পরের সিটে কেউ একজন এসে বসলো। চিতু একবার ঘার ঘুরিয়ে দেখলো, মোটা মতো দাড়িগোঁফ কামান একটা লোক, মাথায় একটা বাদামী টুপি, হাতে একটা পাটকরা ম্যাগাজিন। চিতু পাত্তা না দিয়ে এবার পার্সের তৃতীয় খাপে আঙুল ঢোকাল, আবার পাটকরা কিছু উঠে এলো। কেমন যেন অন্যরকম দেখতে কয়েকটা কাগজ, টাকা বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু ভারতের তো নয়, কোথাকার রে বাবা। একটা খুলতেই চিতুর বুকটা ধক করে উঠলো, এ তো সে দেখেছে, তাদের সাট্টার ঠেকে মাঝেমাঝে বাংলাদেশ থেকে একজন এগুলো নিয়ে আসে, আমেরিকান ডলার। ভারতের টাকায় অনেক দাম, এখানে একশো ডলারের নোট পাঁচটা রয়েছে। চিতুর বুকটা এবার একটু ফুলে উঠলো, এগুলো বিক্রি করেই সে বেশ কিছু পেয়ে যাবে, তার ওপর আরো কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোটও ডলারের সাথে রয়েছে। চিতুর ঠোঁটে একটা হাসি আবার খেলে গেল। পাশের লোকটা দুবার খুকখুক করে কেসে উঠলো, চিতুর মনে হোল লোকটা বার কয়েক আর চোখে তার দিকেই তাকাচ্ছে। সে কেয়ার করলো না, কে না কে, তাছাড়া কোন প্রমান তো নেই।
যাক, আজকের দিনটা সার্থক, চিতু এবার বাঁ পকেট থেকে সেই গাবদা মোবাইলটা বার করলো, একদম নতুন স্যামসাং মোবাইল। সেই ঝকঝকে মেশিনটার ওপর চিতু আদরের হাত বোলাচ্ছিল, আঃ ছুঁয়েও কত আনন্দ। কিন্তু একটা ঝামেলা, মোবাইলটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক, চিতু কয়েকবার চেস্টা করেও খুলতে পারলো না। ঠিক এই মুহুর্তে হঠাৎ দুম করে মোবাইলটায় একটা ইনকামিং কল চলে এলো, স্ক্রীনের ওপর “অনির্বান গুহ” নামের কারুর নাম ভেসে উঠলো।
চিতু কেমন ভ্যাবলার মতো ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকলো, এবার কি করবে। রিসিভ করা তো সম্ভব নয়, সে ব্যাস্ততায় ফোনের সিমটাও বার করতে ভুলে গেছে, অবশ্য তার কাছে সিম ট্রে বার করার পিনও নেই। এগুলোর জন্য পাড়ার পানুর কাছে যেতে হবে, সে চোরাই মোবাইলের এদিক সেদিক করতে ওস্তাদ।
চিতু কেমন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, ঠিক কানের পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো – “নিজের বড় মোবাইলটা না থাকলে কিন্তু বড় অসুবিধে হয়”।
চমকে চিতু পাশে তাকাল, সেই মোটা মতো ভদ্রলোক কখন ঠিক তার পাশের সিটটায় এসে বসেছে, তার দিকেই কেমন জ্বলজ্বলে দৃস্টিতে তাকিয়ে আছে। চিতুর বুকটা একটু কেঁপে গেল কিন্তু সেও এই লাইনে ভেটারেন, গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললো – “আপনি কে বলুন তো?”
ভদ্রলোক একটু পাশে ফিরে পকেট থেকে কি একটা বার করে মুখে সেঁটে আবার এদিকে ফিরলো, চিতুর মুখের রক্ত নেমে গেল, বাসের সেই মোটকা গোঁফওয়ালা লোকটা তবে গোঁফটা বোধহয় নকল। গোঁফটা আটকাতেই লোকটার গলার স্বরও পালটে গেল, বেশ বাজখাই গলায় বললো – “কি, চেনা গেল?” বলেই পকেট থেকে একটা কার্ড বার করলো … অনির্বান গুহ, ইন্সপেক্টর, সোনারপুর থানা। বেশি বাক্যব্যায় না করে অনির্বান চিতুর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর দিয়ে আনলক করে একটু ব্রাউজ করে নিয়ে বললো – “হাতটা ভালোই পাকিয়েছিস। তবে টালিগঞ্জেই বুঝে গিয়েছিলাম যে মোবাইলটা গেছে তাই ওখানেই নেমে থানায় গিয়ে লালবাজারে টেলিফোন করে সিম কার্ডের টাওয়ারটা ট্র্যাক করতে বলেছিলাম। ভাগ্যিস সিমটা সরাতে পারিস নি, তাই তো অনেক ঘুরে তোকে খুঁজে পেলাম”।
চিতু নির্বাক, লোভে পরে আজ মোবাইলটা তুলে নিয়ে কি ফ্যাসাদ রে বাবা। বুকটা ঢিবঢিব করছে, সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে হাত জোর করলো – “ভুল হয়ে গিয়েছে স্যার, বাড়ীতে বড় অভাব …”।
গুঁফো লোকটা ঠান্ডা দৃস্টিতে ওর দিকে তাকাল – “নাটক না করে পাশে বসে পর”। চিতু শান্ত ভাবে তাই করলো, গোঁফের পাশে আঠায় একটু চুলকে লোকটা আবার বললো – “বাড়ীতে পোয়াতি বউ আর একটা বাচ্চা, বছর দুয়েকের জন্য জেলে গেলে সংসার বাঁচবে তো?”
চিতু এই রকম সিচুয়েশনে আগেও পরেছে, গলাটা প্রফেশানাল অ্যাকটরের মতো কাঁপিয়ে বললো – “সব ভেসে যাবে স্যার, চারিদিকে ধার, এবারটা ছেড়ে দেন”।
মোটা অনির্বান গুহ একবার চারিদিকে চতুর ভাবে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললো – “পার্সে কত আছে?”
-“স্যার, পুরো গোনা হয়নি”।
ওই নিচু গলাতেই অনির্বান শাসিয়ে উঠলো – “শয়তানি করিস না। আমি প্রায় আধ ঘন্টা তোর পাশে বসে আছি, সব দেখেছি। ডলারগুলো বার কর”।
চিতু বাহানা না করে পার্সটা বার করে অনির্বানের হাতে দিয়ে দিল, হাতের কলার মতো মোটা মোটা আঙুল দিয়ে ও ঝপাঝপ টাকাগুলো বার করে ফেললো, ডলার আর কয়েকটা একশো টাকার নোট পকেটে পুরে পার্সটা চিতুর কোলে ছুঁড়ে দিল। চিতু অবাক, এ পুলিশ অফিসার না অন্য কেউ, পকেট মারির টাকা বেমালুম নিজেই গাপ করে দিল। চিতু হাবলার মতো বসে কিছু ভাবছিল, মোটা অনির্বান উঠে দাঁড়িয়ে বললো – “আমার ফোনে একটা মিসড কল মার জলদি”। চিতু নির্বাক ভাবে তাই করলো, অনির্বান সেটা ফোনে সেভ করে বললো – “তাহলে তো সাথে এটাই কথা থাকলো, যা ঝারবি তার ভাগ আমারও থাকবে। রাজি?”
চিতুর না বলার উপায় নেই, সে মাথা নারলো। অনির্বান আবার বললো – “গুলগাপ্পা মেলা মারিস না, আমি আবার সোনারপুর এলাকার পেটি রোড ক্রাইম সেলেই আছি। তোদের অনেকের ঠিকানা আমার কাছে আছে, রাস্তায় কিছু করে পালাতে পারবি না, খবর আমার কাছে আসবেই। তোর নাম্বারটা আমার কাছে রইল, তোর আর একটা কাজ হবে তোদের আর যারা এই লাইনে আছে তাদের কয়েকজনের নাম আমার কাছে পাঠাবি। কয়েকটাকে ধরতে পারলে আমার প্রোমোশানটা তাড়াতাড়ি হবে। কি ঠিক আছে?”
চিতু বাধ্যের মতো মাথা নারলো, অনির্বান “কয়েকদিন বাদে আবার ফোন করছি” বলেই উল্টো দিকে ফিরে হেঁটে আট নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওদিক দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। চিতু নেতিয়ে ওই সিটেই বসে রইল, তার ইনডিপেন্ডেন্ট প্রফেশানের তো তেরোটা বেজে গেল, শুধু তাই নয়, শালা পুরো মালটাই খেয়ে গেল। ধ্যাত, এ কি গেরো।