“ নমঃ সূর্যায়ঃ শান্তায়ঃ সর্বরোগে নিবারণে আয়ু আরোয়োগ্য মাইশ্বর্যম দেহি দেবাহঃ জগৎপাতে। ”
” ওঁম হ্রীম হ্রাম সাঃ সূর্যায়ঃ নমঃ। ”
সুনীল দাস দেখেন, উপেন্দ্র সরকার কর-জোড়ে পূর্ব দিকে সূর্যের দিকে চেয়ে একমনে সূর্যস্তব করে চলেছেন। ওনার সঙ্গের লাঠিটা পাশে সিমেন্ট বাঁধানো বসার বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো। এখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। ভোরের আলো ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। যদিও ভোরের আলো এমনকি সকালের সূর্যের মুখ এই তপোবন আবাসন থেকে দেখতে পাওয়া যায় না। ঢেকে রাখে দুটো পাশাপাশি হাই রাইজ কুড়ি তলার বিল্ডিং, অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় – এই তপোবন আবাসনের গা ঘেসে পূর্বদিকে।
সুনীল বাবুর হাতেও একটা লাঠি আছে। গত দু’বছর ধরে ব্যবহার করছেন। উনি তিয়াত্তর পেরিয়ে চুয়াত্তরে পড়লেন তিন’মাস আগে। উপেন্দ্র বাবুকে দেখলে বোঝাই যায়না ওনার বয়স আশি। লাঠি যদিও সাথে রাখেন অভ্যাসের বশে, কিন্তু এখনোও হাঁটেন গটগটিয়ে – লম্বা লম্বা পা ফেলে। ফর্সা দেখতে, চামড়া সেরকম কুঁচকোয়নি বয়স অনুযায়ী, মাথার চুল সাদা হলেও – টাক পড়েনি, চিরুনি দিয়ে এখনোও চুল আঁচড়ান। সেই তুলনায় সুনীল বাবু ছয় বয়সের ছোট হলেও, মাথায় টাক পড়ে গেছে, লাঠি থাকলে সুবিধা হয় হাঁটতে।
সুনীলবাবু খেয়াল করেছেন, স্তব করার সময়ে একটি গভীর প্রশান্তি তাঁর মুখমণ্ডলে লক্ষ্য করা যায়।
উপেন্দ্র বাবু বলেন, ” সুনীলবাবু, আমার সাথে রোজ সূর্যস্তব করুন সকালে – অনুভব করতে পারবেন বয়স অনেক কমে গেছে, নিজের ভিতর একটা আলাদা এনার্জি পেতে শুরু করবেন। আমাকে আমার বাবা সূর্যমন্ত্র শিখিয়েছিলেন সেই ছোট্ট বয়সে, তখন থেকে আমি রোজ সকালে সূর্যস্তব করি। ”
উপেন্দ্রবাবু অনেকবার বুঝিয়ে দিয়েছেন সুনীলবাবুকে – এই সূর্যমন্ত্রের অর্থ।
” হে ভগবান সূর্য ! আপনি সমগ্র মহাবিশ্বের উপর শাসন করেন এবং শান্তি এবং স্বাস্থ্যের ভাণ্ডার হিসাবে কাজ করেন। আপনিই সেই ব্যক্তি যিনি সমস্ত রোগ দূর করেন এবং পুরো বিশ্বকে পুনরুজ্জীবিত করেন। আমি আপনাকে দীর্ঘায়ু, সম্পদ এবং স্বাস্থ্য দিয়ে আশীর্বাদ করার জন্য ধ্যান করি। ”
” আমি মহান সূর্য জগদিশ্বরকে তাঁর ঐশরিক অনুগ্রহের জন্য প্রণাম জানাই। ”
এছাড়াও উপেন্দ্রবাবু রোববারে গায়ত্রী মন্ত্র পড়েন। মাঝে মাঝে ১২ টা সূর্যমন্ত্র উচ্চারণ করেন। তারও অর্থ উনি সুনীলবাবুকে বলেছেন।
” ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ। ”
( বাংলা অনুবাদ : “আসুন আমরা সেই স্বর্গীয় সূর্যদেবের সর্বশ্রেষ্ঠতাকে পূজা করি, ঈশ্বর এর সেই শক্তি যে সবকিছুকে আলোকিত করে, যিনি সবকিছুকে পুনরায় সৃষ্টি করেন, যার থেকে সবকিছু অগ্রসর হয়, যার কাছে সবকিছু অবশ্যই ফিরে যাবে, যাকে আমরা আমাদের উপলব্ধিকে তাঁর পবিত্র আসনের দিকে আমাদের অগ্রগতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে আবাহন করি।” )
উপেন্দ্রবাবু এও বলেছিলেন একবার যে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গায়ত্রী মন্ত্রের অনুবাদ করেন এইভাবে :
” যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে পৃথিবী আকাশ তারা,
যাঁ হতে আমার অন্তরে আসে বুদ্ধি চেতনা ধারা
— তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি। ”
১২ টা সূর্যমন্ত্রও মাঝে মাঝে উনি জপ করেন। উপেন্দ্রবাবু বলতেন, এই ১২ টা সূর্যমন্ত্র সকালে সূর্য নমস্কার করার ১২ টা পোজের সাথে জড়িত।
” ওঁম মিত্রায় নমঃ
ওঁম রবি নমঃ
ওঁম সুরিয়ায় নমঃ
ওঁম ভানবে নমঃ
ওঁম খাগয়া নমঃ
ওঁম পুশনে নমঃ
ওঁম হিরণ্ণ গর্ভয় নমঃ
ওঁম মরিকায়ে নমঃ
ওঁম আদিত্যায় নমঃ
ওঁম সবিত্রায় নমঃ
ওঁম অর্কায় নমঃ
ওঁম ভাষকরায় নমঃ ”
ওনার বাড়িতে যখন যান মাঝে মাঝে সুনীলবাবু, দেখেছেন চান করে জপ করছেন উনি :
” ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম । ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্ । ”
(এর মানেও জানেন সুনীলবাবু — জবাপুষ্পের মত লোহিত বর্ণ, অন্ধকারনাশক মহাদ্যুতিবিশিষ্ট সর্ব্বপাপবিনাশক কশ্যপপুত্র সূর্য্যকে প্রণাম করি। )
উপেন্দ্রবাবুর সাথে তো দু’এক বছরের পরিচয় নয়, দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে ওনাদের দুজনের গলায় গলায় বন্ধুত্ব, সকালে একসাথে হাঁটা এই আবাসনের ভিতরে। যখন এই তপোবন আবাসন রেডি হয় বসবাসের জন্য তখন থেকে। এই দীর্ঘ পনেরো বছরে সুনীলবাবু ধীরে ধীরে প্রায় সমস্ত সূর্যমন্ত্রই শিখে নিয়েছেন বারবার শুনতে শুনতে উপেন্দ্রবাবুর থেকে।
উপেন্দ্রবাবু প্রায়ই দুঃখ করে বলেন ” সংস্কৃত ভাষাটা, যে ভাষার সঙ্গে হিন্দুদের যাবতীয় ধর্ম-কর্ম-পুজো-বিয়ে এমনকি শ্রাদ্ব জড়িত, সে ভাষাটাই আস্তে আস্তে প্রায় অবলুপ্তির পথে। আজকের দিনে টোল আর নেই প্রায়, সংস্কৃত-চর্চাও উঠে গেছে। আমাদের সময়ে সংস্কৃত ভাষা স্কুলে কম্পালসারি ল্যাংগুয়েজ ছিল, সবাইকে এক বছর অন্তত পড়তে হতো। এখন এটা অপশনাল সাবজেক্ট। কিন্তু কেউ পড়ে না, কারণ টিচারই নেই পড়ানোর। কিছু কলেজ অথবা ইউনিভার্সিটিতে যদিও সংস্কৃত ভাষা অপশন রেখেছে, কিন্তু সেটা নাম-কা-ওয়াস্তে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ধীরে ধীরে শিকড়হীন হয়ে গেল একটি জাতি, একটি ধর্ম। কিন্তু কেউ তার প্রতিবাদ করল না। ”
দেখতে পান ওনাদের আর এক সঙ্গী রবি মুখার্জীকে হেঁটে আসতে, মুখে মাস্ক। করোনার প্রকোপ যদিও অনেক কমে গেছে, কিন্তু নিজেদের সাবধানতার জন্য মাস্ক এখনো সবাই পড়েন। রবিবাবুর বয়স পয়ষট্টি, এখনোও লাঠির দরকার পড়েনি। রোজ সকালে ওনারা তিনজন এখানে মিলিত হন। উপেন্দ্রবাবুর সূর্যস্তব হয়ে গেলে তিনজনে পুরো আবাসনটা কয়েকটা চক্কর মারেন, তারপর এখানে বসে আড্ডা গালগপ্পো।
সূর্যস্তব হয়ে গেছে উপেন্দ্রবাবুর। মুখটা এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে আছে যেন।
রবিবাবু এগিয়ে এসে বলেন, ” কালকের সন্ধ্যার প্রথম নিউস শোনার পর আমার প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিলো না। প্রায় সেইসময়েই উপেন্দ্রবাবুর ফোন পেয়ে বুঝলাম সব সত্যি – যা শুনছি, যা দেখছি নিউসে। উপেন্দ্রবাবুর বাড়ি থেকে ফেরার পর সারারাত আনন্দে ঘুমোতেই পারিনি। কখন ভোরে আপনাদের সাথে দেখা হবে সেটা ভাবতে ভাবতেই কখন জানি শেষ রাতে চোখ জড়িয়ে আসে। ”
সুনীলবাবুও বলতে থাকেন, ” আমারও একই অবস্থা, সারা রাত আনন্দে ঘুমোতে পারিনি। আমি সারারাত এটাই ভেবেছি উপেন্দ্র-দার সাথে কখন দেখা হবে আর বলবো – এবার তিন মাস পরেই উপেন্দ্র-দা আপনি আবার ভোরের সূর্যের কিরণ গায়ে মেখে মনের শান্তিতে সূর্যস্তব করতে পারবেন, যেমন বারো বছর আগে করতেন। আমরাও আবার মুক্ত হাওয়া মনের সুখে সেবন করে সূর্যের নরম হলুদ আলো গায়ে জড়িয়ে সকালে হাঁটতে পারবো। ”
আদ্রতা মেশানো গলায় উপেন্দ্রবাবু বলেন, ” আজ আমার মানসের কথা খুব মনে পড়ছে। অল্প কয়েকমাসের জন্য মানস পারলো না এই আনন্দের সংবাদ জেনে যেতে। কতই বা বয়স হয়েছিল ওর, আমাদের এই গ্রুপ এর মধ্যে সবথেকে ছোট। মাত্র ঊনষাট বছর বয়স। করোনা ছিনিয়ে নিলো ওকে। সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ ও নিয়েছিল। শেষের দিকে আমাকে প্রায়ই বলতো, উপেন্দ্র-দা – আপনার বয়স হয়েছে, আপনাকে এতো দৌড়-ঝাঁপ করতে হবে না এখন। আমি রবি-দাকে নিয়ে কোর্টে হিয়ারিং এটেন্ড করবো, আমাদের উকিলবাবু জয়ন্ত হালদার আর চরণ দে মহাশয়ের সাথে। কোর্টে হিয়ারিংও তো কম হয়নি, সাত বছরে সুপ্রিম কোর্টেই প্রায় তিরিশের উপরে। এছাড়া প্রথমদিকে কলকাতাতে হাই কোর্টে যেতে হতো। ”
তিনজনেই দেখতে পান, আবাসনের প্রেসিডেন্ট প্রশান্ত দত্ত আসছেন ওনাদের দিকে – সাথে বেশ কয়েকজন।
প্রশান্ত দত্ত এগিয়ে এসে বলেন, ” উপেন্দ্র-দা, আপনাদের তিনজনকেই অসংখ্য অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ আমাদের এই তপোবন আবাসন এসোসিয়েশনের তরফ থেকে। আপনাদের এই বারো বছরের প্রচেষ্টা, এতদিনের দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাওয়া একটুও মনোবল না হারিয়ে, জোকের মতো আঁকড়ে লেগে থাকা – সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা প্রথমে অনেকেই শুরুতে আপনাদের এই লড়াইতে এক শক্তিশালী বিল্ডারের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে যোগ দিতে চাইনি। আপনারা তিনজনে প্রথমে সবার ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়েছেন, ভালো উকিল জোগাড় করেছেন, সমস্ত লিগাল প্রয়োজনীয় পেপার জোগাড় করেছেন। আপনারা একটা টীম তৈরী করেছেন, পরে আপনাদের এই টীমে মানস-বাবুও যোগ দেন। আমরা মনে হয় কিছু ডোনেশন অর্থ-সাহায়্য ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি। ”
প্রশান্ত দত্তর সাথে যারা এসেছিলেন, তারাও সবাই একে একে অভিনন্দন জানাতে থাকেন এই তিনজনকে।
প্রশান্তবাবু আবার বলতে থাকেন, ” আপনারা নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন খবরের মাধ্যমে – সুপ্রিম কোর্ট তিন মাসের মধ্যে এই অর্ধসমাপ্ত টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলতে বলেছেন। আমাদের এই আবাসন এসোসিয়েশন কে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে বলেছেন। একটা স্পেশাল টীম তৈরী করা হবে – যারা ইনভেস্টিগেট করবে কি করে এই বিল্ডিং কন্সট্রাকশনের প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। আচ্ছা উপেন্দ্রবাবু, আমি যতদূর জানি – এই দীর্ঘ সময়ের আইনের লড়াইতে আপনাদের অনেক খরচ হয়ে গেছে নিজেদের তরফ থেকে। কিছু অর্থ সাহায্য এই আবাসনবাসীরা করেছেন মাঝে মাঝে। কিন্তু আপনারা নিজেদের থেকে অনেকটাই খরচ করেছেন আমি জানি। আপনার কাছে নিশ্চয়ই হিসেব রাখা আছে। এখন বিল্ডারের তরফ থেকে আমরা এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবো। ”
এবার উপেন্দ্রবাবু একটু হাসলেন। কেউ বলবেন, হাসিটা কৃতঞ্জতার। কেউ ভাববেন, ভাসমান স্রোতে খড়কুটো খুঁজে পাওয়ার। ওনার হাসি একই সঙ্গে অস্পষ্ট, করুণ ও মৃদু দেখায়। আজ এতদিন পর্যন্ত্য ওনারা একবারও খোঁজ নেননি – কি করে এতবড়ো লিগাল লড়াইয়ের এতো বছর ধরে খরচ চলেছে। প্রথমদিকে ওনারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডোনেশন হিসেবে নিতেন কিছু সাহায্য। কিন্তু বুঝতে পারেন ধীরে ধীরে – এটা পুজোর চাঁদা নেওয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। মন থেকে খুব একটা কেউ দিতে চান না, একটা বাধ্য-বাধকতা যেন। অস্বীকার করবেন না উপেন্দ্রবাবু, কয়েকজন বেশ মনোবল যোগাতেন। সময় পেতেন না বলে হয়তো পুরোপুরি ওনাদের সাথে সাথে চলতে পারতেন না – কিন্তু বেশ সাহস যোগাতেন। এরকম কতিপয় লোকের থেকেই ওনারা পরের দিকে কিছু অর্থসাহায্য নিতেন। বাকিটা ওদের চারজনের জমানো টাকা থেকে চালানো হয়েছে এই যজ্ঞের খরচ। প্রশান্তবাবুর কি উচিত ছিল না এই আবাসনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আর একটু বেশি উদ্দ্যোগ নিতে, সবাইকে মিলিত করতে এই লড়াইয়ের জন্য। পরে যেন এই লড়াইটা উপেন্দ্রবাবু-সুনীলবাবু-রবি-মানসের নিজেদের হয়ে গিয়েছিলো – এই আবাসনের জন্য নয়। তবে জয়ন্তবাবু আর চরণবাবুর প্রতি ওনারা চির-কৃতঞ্জ। ওনারা না সাহায্য করলে কোনোদিন এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারতেন না। ওনারা ওনাদের পারিশ্রমিকও পুরোপুরি নেননি, যতটা খরচ ততটাই নিয়েছেন। ওনাদের কাছে এটা যেন একটা চ্যালেঞ্জের মতো হয়ে গিয়েছিল।
ধীরে ধীরে উপেন্দ্রবাবু বলেন, ” প্রশান্তবাবু, টাকাটা বড় কথা নয়। হ্যাঁ, আমাদের চারজনেরই অনেকটাই খরচ হয়েছে, সত্যি। কিন্তু, সেটা বড় কথা নয় – আজ যে আমরা আমাদের এই দীর্ঘ লড়াই জিততে পেরেছি – এতেই আমাদের মন একটা আলাদা আনন্দে ভরে যাচ্ছে। মন এতটা উদ্বেল বহুদিন বোধহয় হয়নি। আগে আমি হিসেব রাখতাম। এখন বয়স হয়ে গেছে, তাই বিগত কয়েক বছর ধরে রবি এই দায়িত্বটা নিজে থেকে নিয়েছেন। আগে টাকাটা পাওয়া যাক, তারপরে হিসেব-পত্তর করা যাবে। আমাদের উকিলবাবু দুজনের প্রাপ্য ফিস প্রায় পুরোটাই বাকি আছে। ”
” ঠিক আছে এসব নিয়ে পরে কোনো একসময় ডিটেল্সে কথা বলা যাবে। যেটা জানাতে এসেছি, আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি এই রোববার সন্ধেবেলায় এই আবাসনের প্রাঙ্গণে আপনাদের চারজনের সম্মানে একটা ছোট করে অনুষ্ঠান রাখতে। সময়টা পরে সবার সুবিধা অনুযায়ী ঠিক করে নেয়া যাবে। যদিও এটা পরম দুঃখের বিষয়, মানসবাবু আজ আমাদের মধ্যে নেই। ওনার স্ত্রী এবং মেয়ে এখানেই আছেন, ওনার স্ত্রীকেই আমরা সম্মান জানাবো। ”
দৃঢ় গলায় উপেন্দ্রবাবু বলেন, ” এটা খুবই ভালো প্রস্তাব, প্রশান্তবাবু। তবে আমার কিছু বলার আছে। প্রথম কথা – জয়ন্তবাবু এবং চরণবাবু মহাশয় দুজনকে অবশ্যই আপনাদের তরফ থেকে নিমন্ত্রণ করবেন এবং পারলে দু’এক দিনের মধ্যেই খবর দেবেন। কারণ ওনারা খুব ব্যাস্ত থাকেন আর তাছাড়া কলকাতা থেকে এখানে আসতে হবে। ওনাদের সাহায্য এবং মানসিক প্রেরণা দেওয়া – ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। দ্বিতীয় কথা – সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী যে ক্ষতিপূরণের টাকাটা পাওয়া যাবে, তার থেকে উকিলবাবু দুজনের প্রাপ্য ফিস মিটিয়ে দিয়ে এবং আমাদের চারজনের যে এক্সট্রা টাকাটা খরচ হয়েছে সেটা মিটিয়ে দেওয়ার পরেও – আমার হিসেবে প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা বেঁচে যাবে। সেই টাকাটা মানসবাবুর ফ্যামিলিকে দেওয়ার প্রস্তাব রাখি। ওনাদের মেয়ে তিথি এখনও থার্ড ইয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে এবং টাকাটা ওনাদের সাহায্য করবে এই কঠিন সময়ে। এই ঘোষণাটা প্রশান্তবাবু করবেন ঐ দিনেই অনুষ্ঠানের সময়। কি সুনীলবাবু, রবিবাবু – ঠিক আছে তো ? ”
” একদম ঠিক প্রস্তাব, উপেন্দ্রবাবু। ” সুনীলবাবু, রবিবাবু – দু’জনেই একসাথে বলে ওঠেন।
প্রশান্তবাবু একটু দ্বিধাগস্ত ভাবে বলেন, ” উপেন্দ্রবাবু, ঘোষণাটা করার কি খুব দরকার আছে ঐ দিন ? আমরা টাকাটা পেয়ে নিই। তারপর একদিন বসে ঠান্ডা মাথায় সব হিসেব চুকিয়ে তারপর আলোচনার মাধ্যমে একটা ডিসিশন নেওয়া যেতে পারে। এখানে আবাসনে যারা থাকেন তাদের প্রত্যেকেরই একটা বক্তব্য থাকতে পারে বাকি টাকাটার ব্যাপারে। কারণ এটা দেওয়া হচ্ছে এই তপোবন আবাসন এসোসিয়েশন এর নামে, ক্ষতিপূরণ বাবদ। ”
গম্ভীর গলায় এবার উপেন্দ্রবাবু বলেন, ” না প্রশান্তবাবু, আপনারা যদি আমার দেওয়া প্রস্তাব না মানেন – তাহলে আমাদের পক্ষে এই অনুষ্ঠানে আসা সম্ভব হবে না। ”
আবাসনের যেকজন প্রশান্তবাবুর সাথে এসেছিলেন তাদের অনেকেই বলতে থাকেন, ” প্রশান্তবাবু, উনি যা বলছেন একদম ঠিক। মানসবাবু ওনার চাকরি কামাই করে, স্ত্রী-মেয়েকে একলা রেখে কতবার দিল্লি – কলকাতা দৌঁড়েছেন আমরা দেখেছি। ওনার ফ্যামিলির এই বিপদের দিনে আমাদের উচিৎ ওনাদের পাশে দাঁড়ানো। উপেন্দ্রবাবু ঠিক প্রস্তাব দিয়েছেন। ”
প্রশান্তবাবু চাপের মুখে পরে যান, বলেন, ” ঠিক আছে তাহলে, রোববারে আমরা অনুষ্ঠানটা করবো – উপেন্দ্রবাবুর প্রস্তাব মেনে। দু’একদিনের মধ্যে সব ঠিক করে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে। চলি তাহলে, উপেন্দ্রবাবু – সুনীলবাবু – রবিবাবু। ভালো থাকবেন সবাই। ”
*****
সকাল থেকেই মুখ ভার আকাশের। গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে আছে আকাশ। মাঝে মাঝেই পশলা পশলা বৃষ্টি। এরকম আবহাওয়াতে কেন জানি না উপেন্দ্রবাবুর হয়তো একটু বৈরাগ্য ভাব এসে যায়। বৈরাগ্য শব্দটা বোধহয় ঠিক হল না, উদাসীনতা। ঠিক উদাসীনতাও নয়, আসলে ওনার মন তখন একটু নড়ে যায়। হিসেবমাপা রুটিন এবং প্রথাগত কাজের বাইরে জীবনটা তখন মনকে হয়তো একটু চঞ্চল, একটু উদাসীন করে দেয়।
কিছুদিন ধরেই মনটা একটু উতলা হয়ে আছে। তার মধ্যে আজকে এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে বাইরে হাঁটতে যাওয়া যাবে না। ঠিক করলেন সূর্যস্তব বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেরে নেবেন।
” নমো মিত্রায় ভাবনবে মৃত্যোর্মা পাহি
প্রাজিষ্যংবে বিশ্বহেতবে নমঃ।
সূর্যাদভবন্তি ভূতানি সূর্যেনপালিতানি তু
সূর্যে লগং প্রাপিনুবন্তি যঃ সূর্যঃ সোহহমেব চ।
চক্ষুর্ণ দেবঃ সবিতা চক্ষুর্ণউত পর্বতঃ।
চক্ষুর্ধাতা দধাতু নঃ। ”
( বাংলা অনুবাদ : ” মিত্রকে নমস্কার, ভানুকে নমস্কার; তুমি আমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করো মার্কণ্ড।
প্রকাশশীল বিশ্বের কারণকে নমস্কার।
জীবগণ সূর্য থেকে উৎপন্ন হয়, সূর্যের দ্বারা পালিত হয়।
যিনি সূর্য, তিনিই আমি।
সবিতা তেজস্বরূপ বলেই তিনি আমাদের চোখ। তিনি কালস্বরূপ বলেও আমাদের চোখ।
সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর আমাদের চোখ দান করুন। ” )
সূর্যস্তব শেষ করে হাতের তালু মুখের উপর বুলিয়ে চোখ খুলতেই দেখতে পান, সুনীলবাবু কখন নিঃশব্দে এসে বসে আছেন চেয়ারে। সাথে আরও দু’জন। একজন রবি মুখার্জী, আলাপ আছে। আরেকজন মুখচেনা। একবার আলাপ হয়েছিল – মানস সেন, অনেক ছোট ওনাদের থেকে।
সুনীলবাবু দু’বছর হল টেলিকম বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন, ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন জেনারেল বিভাগে। তখন থেকেই ওনারা রোজ সকালে একসাথে মিলিত হন পার্কে এবং একসাথে হাঁটেন, গল্প-গুজব করেন। উপেন্দ্রবাবু আট বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। উনি কলকাতা পুলিশে কাজ করতেন, ডিআইজি পোস্টে ছিলেন।
অবশ্য ওনারা এই তপোবন আবাসনে তিন-চার বছর হল এসেছেন। কলকাতা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে এটা একটা মাঝারি শিল্পাঞ্চল শহর। এই আবাসনের অনেকেই এখানকার ইস্পাত কারখানাতে কাজ করেন। কেউ কেউ ইস্পাত কারখানাকে জড়িয়ে কিছু গজিয়ে ওঠা মাঝারি সাইজের কোম্পানিতে কাজ করেন। ইস্পাত কারখানার নিজস্ব টাউনশিপ আছে। অবশ্য যারা এখানে বাড়ি কিনেছেন তারা সবাই ধীরে ধীরে এখানে এসে থাকতে শুরু করেন। যদিও এই আবাসনটা শহরের কোলাহল থেকে একটু বাইরে, তবে শহরটা বেশি বড় নয় বলে – সবকিছুই পাওয়া যায় কয়েক কিলোমিটার এর মধ্যে।
তপোবন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা আবাসন। পঞ্চাশটি ডুপ্লেক্স দুই কামরার ফ্ল্যাট, রান্নাঘর-বসার এবং খাওয়ার ঘর সহ, একফালি জমি সামনে এবং পিছনে। সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ। পূর্বদিকে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে একটা খালি জমি। পশ্চিমদিকে একটা ছোট মাঠ বাচ্চাদের খেলার জন্য। আবাসনের চারদিক ঘিরে হাঁটার রাস্তা, মাঝে মাঝে সিমেন্টের বাঁধানো বসার জায়গা। এই তিন বছরে আবাসনের কমিটি থেকে ইউক্যালিপ্টাস তার সাথে বেশ কিছু নানা ধরণের ফুলের গাছও লাগানো হয়েছে। তাছাড়া সবাই কিছু না কিছু ফুলের সবজির গাছও লাগিয়েছেন নিজেদের জমিতে। শহর থেকে কিছুটা দূরে এই আবাসনটা, আশে পাশে সেরকম কোনো বড় বিল্ডিং নেই। তাই বেশ খোলামেলা – বেশ হাওয়া খেলে এখানে – ভোরের সূর্যের নরম আলো থেকে বিকেলের অস্ত যাওয়া পর্যন্ত্য সবসময় আলোয় আলোকময় হয়ে থাকে পুরো আবাসনটা – যেন একটা স্বর্গীয় পরিবেশ।
কলকাতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে এই শহরটা। খুব একটা চাহিদা নেই এখানে জমি বাড়ির। যেহেতু শহরটা ইস্পাত কারখানার লোকজনকে ঘিরে এবং এতদিন পর্যন্ত্য অবসর নেওয়ার পর সবাই শিকড়ের খোঁজে নিজেদের ভূমিতে অথবা কলকাতা অথবা অন্য কোনো বড় শহরে চলে যেতেন বাড়ি করে। তপোবন আবাসন প্রথম প্রজেক্ট ড্রিমটেক বিল্ডারের। বেশ বড় বিল্ডার কলকাতার। প্রথম প্রজেক্ট বলে অল্প লাভে ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করেন ড্রিমটেক বিল্ডার।
কলকাতাতে ফ্ল্যাটের দাম অনেকের সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়াতে, ধীরে ধীরে ইস্পাত কারখানার এমপ্লয়ীদের মধ্যে উৎসাহ আসে এই শহরে পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়ার। প্রথম প্রজেক্টে সাফল্য পেয়ে ড্রিমটেক বিল্ডার এর মধ্যে আরো একটা প্রজেক্ট নামিয়ে ফেলেছে। শোনা যাচ্ছে আরো দু-একজন বিল্ডারও এখানে শহরের থেকে বেশ কিছুটা বাইরে নতুন আবাসনের কমপ্লেক্স বানানোর চেষ্টায় আছে। এখানে এখন রীতিমতো ফ্ল্যাট এবং জমির চাহিদা বেশ বেড়ে গেছে।
তপোবন আবাসনের প্ল্যান অনুযায়ী পূর্বদিকের যে খালি জমিটা আছে সেটা এই আবাসনের এরিয়ার মধ্যে। আবাসনবাসীরা সবাই জানেন এই জমিটা খালি থাকবে চিরকাল। খোলামেলা হাওয়া, সূর্যের আলোর প্রাচুর্যতার ঘাটতি হবে না কোনও দিন।
কিছুদিন আগে থেকে দেখা যায় কিছু লোকের আনাগোনা ঐ খালি জমিতে। মাপজোক সার্ভের যন্ত্রপাতি নিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ড্রিমটেক বিল্ডারের লোকজন ওরা। উপেন্দ্রবাবুর মনে খটকা লাগে। ঐসময় আবাসনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মনোজবাবু। ওনাকে বলেন একটু খোঁজখবর নিতে, উনি খুব একটা পাত্তা দেন না। বলেন, হয়তো ফাইনাল মেজারমেন্ট করছেন ওনাদের সাব-কন্ট্রাক্টরদের বিল মেটাতে। উপেন্দ্রবাবু খুঁতখুঁত করতে থাকেন, ” বুঝলেন সুনীলবাবু, আমার ঠিক মন সায় মানছে না। কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। ড্রিমটেক অফিস আর কতদূর, একবার খোঁজ নিয়ে আসলেই হতো। এই মনোজবাবুরা সব নিজেদের নিয়ে ব্যাস্ত। আমরা নিজেরা যেতে পারি, কিন্তু এখানকার প্রেসিডেন্টকে নিয়ে গেলে ভালো হতো। দেখি আর কিছুদিন। ”
কয়েকমাস পরেই দেখা যায় ড্রিমটেকের বুলডোজার, এক্সকাভেটর, টিএমআর (ট্রাক মাউন্টেড রিগ) আর লোকজনের ভিড় মাথায় হেলমেট পরিহিত – ওই পূর্বদিকের খালি মাঠজুড়ে। রাতারাতি অ্যাসবেসটস শিট দিয়ে ঘিরে ফেলেছে খালি মাঠের অংশটা। আবাসনের পূর্বদিকের দেয়াল ভেঙে শুরু করে দিয়েছে পাইলিং টিএমআর সহযোগে। উপেন্দ্রবাবু বলেন সুনীলবাবুকে, পাইলিং করছে মানে এখানে নিশ্চয়ই বহুতল কিছুর প্ল্যান আছে এই কোম্পানির। চিন্তার বিষয়।
উপেন্দ্রবাবু, সুনীলবাবু উদ্দ্যোগ নিয়ে মনোজবাবুকে নিয়ে ড্রিমটেকের অফিসে যান। ভাগ্যক্রমে ড্রিমটেকের চেয়ারম্যান প্রতীক আগরওয়াল সেদিন উপস্থিত ছিলেন। উনি জানান, ঐ জমিতে কুড়ি তলার দুটো টাওয়ার কনস্ট্রাক্ট হবে। প্রায় আড়াইশো ফ্ল্যাট হবে, বুকিং শুরু হয়ে গেছে।
মনোজবাবু বলেন, ” কিন্তু ঐ জমিটা তো আমাদের আবাসনের এরিয়ার মধ্যে। ”
প্রতীকবাবু জানান, ” হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু জমিটা ড্রিমটেক কোম্পানির। ”
এবার উপেন্দ্রবাবু বলেন, ” কিন্তু আমাদের বাড়ির প্ল্যানের সাথে আবাসনের একটা প্ল্যান দেওয়া হয়েছিল, আর তাতে ঐ খালি জমিটা দেখানো আছে আবাসনের এরিয়ার মধ্যে। আপনারা যদি ওখানে কুড়ি তলার দুটো টাওয়ার বানান, তাহলে ভেবে দেখেছেন আমাদের কি অবস্থা হবে ! কোনও সূর্যের আলো আমরা পাবো না। টাওয়ার দুটো পুরোপুরি পূর্বদিকের আলো হাওয়া ব্লক করে দেবে। মনে হবে যেন আমাদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। ”
প্রতীকবাবু একটু যেন বিরক্ত হয়েই বলেন, ” দেখুন ঐ খালি জমিটা ড্রিমটেক কোম্পানির। আগের প্ল্যানে কিছু দেখানো হয়নি বলে ঐ জমিটা আবাসনের হয়ে যেতে পারে না। আমরা লোকাল অথরিটি থেকে আইন অনুযায়ী প্ল্যান অনুমোদন করিয়ে তবেই কাজে হাত দিয়েছি। ”
উপেন্দ্রবাবু বলেন, ” মানছি আপনি আইন অনুযায়ী সমস্ত অনুমোদন নিয়ে কাজে হাত দিয়েছেন। কিন্তু আপনাদের কি উচিৎ ছিল না আমাদের একটু আগে জানানো। আপনাদের মাথায় কি আসেনি যে ঐ জমিতে যদি এত উঁচু টাওয়ার বানানো হয় তাহলে আমাদের কতটা অসুবিধা হতে পারে, যেখানে কয়েক মিটার দূরেই আপনাদের কোম্পানিরই বানানো ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটগুলো। ”
প্রতীকবাবু এবার বেশ কাটা কাটা ভাবে বলেন, ” দেখুন, আমরা সব কিছু আইন অনুযায়ী এগোচ্ছি। কোম্পানি আপনাদের ফ্ল্যাটগুলো জলের দরে বিক্রি করেছে। ঐ প্রজেক্টে কোম্পানির কোনও লাভ হয়নি, বরং লোকসানই হয়েছে। ”
উপেন্দ্রবাবু ছিলেন পুলিশের ডিআইজি। বোধহয় এবার নিজেকে সামলাতে পারেন না। একটু গম্ভীর স্বরেই বলেন, ” দেখুন প্রতীকবাবু, আপনাদের কোম্পানি একটা উদ্দেশ্য নিয়েই কম দামে ফ্ল্যাটগুলি বিক্রি করে – সেটা যেমন আপনি জানেন, আমরাও জানি। তার সাথে এই উঁচু টাওয়ার বানানোটা মিশিয়ে ফেলবেন না। ”
একটু বেপরোয়া ভঙ্গিতেই, যেন একটু হুমকির সাথেই এবার প্রতীকবাবু বলেন, ” এই টাওয়ার বানানোর জন্য কমপ্লিট করার জন্য যা দরকার কোম্পানি তাই করবে। আপনারা ফালতু ঝামেলা পাকাবেন না। ”
উপেন্দ্রবাবু ঠান্ডা শীতল গলায় বলেন, ” আপনি ভুল বুঝছেন আমাদের। এই হুমকিটা দেওয়ার খুব একটা দরকার ছিল না। আমরা কোনও ঝামেলা পাকাতেও আসিনি। যাইহোক, যা করছেন সেটা মানবিক হিসেব অনুযায়ী আপনার কোম্পানি ঠিক করছে না। আমরা আবাসনবাসীদের সাথে কথা বলে দেখি বাকিদের কি মতামত। ”
সবাই বেরিয়ে আসেন ড্রিমটেক অফিস থেকে। সবাই মিলে ঠিক করেন মনোজবাবু একটা মিটিং ডাকবেন সামনের রবিবারে।
মিটিং ডাকা হয়েছিল। কিন্তু কারুর থেকেই সেরকম কোনও উৎসাহ দেখা গেলো না। প্রায় প্রত্যেকের একই সুর। এতবড় বিল্ডারের সাথে কিছু করা যাবে না। প্রায় সবাই বলতে থাকেন ঐ খালি জমিটা বিল্ডারের। আবাসনের প্ল্যানে জমিটা দেখানো থাকলেও, ছোট্ট করে লেখা আছে – ঐ খালি জমিটা ড্রিমটেক কোম্পানির অধীনে। উপেন্দ্রবাবু উপদেশ দেন – একজন ভালো উকিলের সাথে কথা বলে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। ঐ জমিটা কোম্পানির হলেও ওরা এত উঁচু টাওয়ার বানাতে পারে না – যাতে এই আবাসনবাসীদের হাওয়া-আলো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কেউই সেরকম ভাবে গা করলো না। কেউই আইনের ঝামেলায় যেতে চায় না।
সুনীলবাবু এই বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় চলে এসেছেন পরেরদিন উপেন্দ্রবাবুর বাড়ি। সাথে নিয়ে এসেছেন রবি আর মানসকে।
সুনীলবাবু বলেন, ” আপনি নিশ্চয়ই চেনেন রবিবাবু আর মানসকে। দুজনেই আমাদের থেকে অনেক ছোট। কালকে মিটিংএ আমরা সেরকম কারুর সাড়া না পেলেও, রবিবাবু আর মানস আমার সাথে কাল রাতে দেখা করেন। ওনারাও আপনার সাথে সহমত। কোনো একজন ভালো উকিলের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ আমাদের। রবিবাবু এখানকার কলেজের অধ্যাপক। আর মানস কাজ করেন সানি বিল্ডার্স এন্ড ডেভেলাপার্স কোম্পানিতে। সানি বিল্ডার্সও ড্রিমটেক কোম্পানির মতো একটা হাউসিং প্রজেক্ট শুরু করেছে এখানে। মানস আগে কলকাতাতে ছিলেন এই কোম্পানিতে। মানস এখানে বাড়ি কিনেছেন বলে, নিজে থেকে এখানে পোস্টিং নিয়ে চলে এসেছেন। ”
এর মধ্যে ভিতর থেকে চা এসে গেছে। সন্ধ্যাবৌদিও ( উপেন্দ্রবাবুর স্ত্রী ) এসে যোগ দিয়েছেন এই আলোচনাতে।
সন্ধ্যাবৌদি চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ” কালকে রাতে উনি একদম ভেঙে পড়েছিলেন। আজ সকাল থেকেই দেখি আনমনা। এখন আপনাদের দেখে মুখে একটু হাসি ফুটেছে। কালকে তোমার উকিলবাবুর সাথে কি কথা হয়েছে সেটা ওনাদেরকে বলো। ”
” আমার এক জানাশোনা উকিল কলকাতায় থাকেন, চরণ দে। ওনার সাথে কাল রাতে আমার কথা হয়েছে ফোনে। সবকিছু জানাই বিস্তারিতভাবে। উনি কিছু পেপার জোগাড় করতে বলেছেন। এই আবাসনের প্ল্যান ছাড়াও, আমাদেরকে জোগাড় করতে হবে এই জমির দলিল – কিভাবে সেটা হস্তান্তর হয়েছে ড্রিমটেক কোম্পানির সাথে। আর তাছাড়া এই নতুন টাওয়ারের প্ল্যান, অনুমোদন পেপার – আরও কিছু দলিলের কথা বলেছেন, আমি নোট করে রেখেছি। এইসব পেপার নিয়ে ওনার সাথে দেখা করতে হবে। তারপর উনি এখানে একদিন আসবেন সাইট দেখতে। এর মধ্যে উনি ওনার সিনিয়র জয়ন্ত হালদারের সাথে কথা বলে রাখবেন। তবে উনি একটা কথা জানিয়েছেন, ড্রিমটেক বড় বিল্ডার। একটু ভেবেচিন্তে, সব পেপার চেক করে তবেই উনি এগোবেন এবং কেস ফাইল করার ব্যাপারে ঠিক করবেন। আমি কাল রাত থেকে একটু চিন্তায় পড়ে গেছি এতসব পেপার দলিল জোগাড় করার ব্যাপারে। তবে এখন আপনাদেরকে দেখে আমি আবার বেশ বল-ভরসা পাচ্ছি। কালকে রাতে আমার মনটা একটু ভেঙে গিয়েছিলো। ”
মানস সেন বেশ উৎসাহভরা গলায় বলেন, ” আপনি চিন্তা করবেন না একদম উপেন্দ্রবাবু। আমরা সবাই আপনার সাথে আছি। আস্তে আস্তে দেখবেন অনেকেই আমাদের সাথে যোগ দেবেন। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি প্রথমে কোনো উট্কো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কেউ একজন উদ্দ্যোগ নিয়ে শুরু করলে বাকিরা ধীরে ধীরে যোগদান করে। আর দলিল পেপার জোগাড় করা নিয়ে আপনি বেশি চিন্তা করবেন না। সব পেপার হুট্ করে জোগাড় করা যাবে না, আমি জানি। আপনি আমাকে লিস্টটা দেবেন, কি কি দলিল লাগবে। আমি আরেকটা বিল্ডার কোম্পানিতে কাজ করি, আমার পক্ষে হয়তো খুব একটা অসুবিধা হবে না – রাইভাল কোম্পানির পেপার জোগাড় করতে। আমি আমার কোম্পানির থ্রু দিয়ে চেষ্টা করবো। ”
উপেন্দ্রবাবু আদ্রতা মেশানো গলায় বলেন, ” মানস, আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন তো। আমি এখন বেশ মনের জোর পাচ্ছি। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে। আমার পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, এই কেস-টা কিন্তু সহজে মিটবে না। কারণ ড্রিমটেক ওদের এতবড় ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান ড্রপ করতে পারে না সহজে। বেশ অনেক টাকাই খরচ হতে পারে আমাদের। জানিনা, কতটা আবাসনবাসীরা সাহায্য করবেন। ”
এবার সুনীলবাবু বলেন, ” আপনি প্রথমে এতো চিন্তা করবেন না। আগে আমরা সব পেপার-দলিল জোগাড় করি। উকিলের পরামর্শ নিই। আবার আমরা আবাসনবাসীদের সবার সাথে ঘরে ঘরে গিয়ে কথা বলবো। ”
তিন বছর লেগে যায় এরপর সমস্ত পেপার-দলিল জোগাড় করে – কেস ফাইল করতে হাই কোর্টে। মানস খুব দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছেন সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র জোগাড় করতে। কিছুটা রিস্কও নিয়েছিলেন উনি। সুনীলবাবু, রবিবাবু বার বার করে সমস্ত আবাসনবাসীদের বাড়িতে গিয়ে আলোচনা করেছেন, বুঝিয়েছেন। কিছু সজ্জন ব্যক্তি ওনাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। অনেকেই এগিয়ে এসে নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী অর্থসাহায্য করেছেন, মনোবল জুগিয়েছেন। কিন্তু যেটা উপেন্দ্রবাবু, সুনীলবাবুরা আশা করেছিলেন – এই আবাসন এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সবাইকে নিয়ে এগিয়ে এসে ওনাদের সাথ দেবেন, সেটা হয়নি। যেন এটা এই চারজনের নিজস্ব লড়াই।
যাইহোক উপেন্দ্রবাবুরা নিজেরাই সমস্ত উদ্দ্যোগ নিয়ে এগিয়ে চলেন। উপেন্দ্রবাবু অনেকবার কলকাতা গিয়ে উকিলবাবুদের সাথে কথা বলেছেন, সুনীলবাবুকে সাথে নিয়ে গেছেন। উকিলবাবুরা অনেকবার এই শহরে এসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে কেসটাকে সাজিয়েছেন।
খুব সাহায্য করেছেন এই উকিলদ্বয়। ওনারা উপেন্দ্রবাবুদের সবসময়ে মনোবল জুগিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন। জয়ন্ত হালদার মশাই বারবার উপেন্দ্রবাবুদের বলেছেন – সবচেয়ে বড় পসিটিভ পয়েন্ট আমাদের পক্ষে। তপোবন এবং টুইন টাওয়ারের প্ল্যান দুটো স্টাডি করে জানিয়েছেন – দুটো প্রজেক্টের মধ্যে মাত্র আট মিটার দূরত্ব। কোনো হাউসিং প্ল্যানিং কমিটি এটা অনুমোদন করতে পারেন না। এটা যে কোনো হাউসিং প্রজেক্টের সেফটি রুলের বিরুদ্ধে পরে। নিশ্চয়ই ড্রিমটেক কোম্পানি আর হাউসিং প্ল্যানিং কমিটির মধ্যে একটা ‘ আন্ডার দি টেবিল ‘ ব্যাপার ঘটেছে।
জয়ন্ত বাবু বলেন, ” আমি এই পয়েন্ট-এর উপরই বেশি জোর দেব। ”
উপেন্দ্রবাবুর মাঝে মাঝে মনে হতো – জয়ন্তবাবু এই কেসটা যেন একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন।
হাই কোর্টে প্রায় তিন বছর কেস চলে। প্রায় চৌদ্দটা শুনানির ডেট পরে। বেশিরভাগ শুনানি এটেন্ড করেছেন উপেন্দ্রবাবু আর সুনীলবাবু কলকাতাতে গিয়ে। রবিবাবু আর মানসের কলেজ আর অফিস ছিল। তাই ওনাদের যতটা পারেন বিরত রাখতেন কলকাতা যাওয়ার থেকে।
হাই কোর্ট উপেন্দ্রবাবুদের পক্ষেই রায় দেন। আদেশ দেন ড্রিমটেক কোম্পানিকে এই প্রজেক্ট বন্ধ করতে, দুটো টাওয়ার ভেঙে ফেলতে বলেন। যেটা জয়ন্ত বাবু বলেছিলেন, মাত্র আট মিটার দূরত্বের ব্যাপারটা দুটো প্রজেক্টের মধ্যে – সেটাই প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় ড্রিমটেক-এর বিরুদ্ধে। সাথে জুড়ে যায় – অপর্যাপ্ত আলো এবং হাওয়া-বাতাসের অভাব দেখা দেবে তপোবন বাসীদের জন্য। হাই কোর্ট জানান – হাউসিং এবং প্ল্যানিং কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজশ করে ড্রিমটেক এটা নির্মাণ করছে। এটা অবৈধ নির্মাণ।
ততদিনে টাওয়ার দুটো প্রায় পনেরো তলা পর্যন্ত্য উঠে গেছে।
হাই কোর্টের আদেশ শুনে উপেন্দ্রবাবুরা বেশ আনন্দিত হয়ে পড়েন। কিন্তু জয়ন্ত বাবু জানান, এখনই আনন্দিত হওয়ার কিছু হয়নি। ড্রিমটেক এতো সহজে ছাড়বে না। ওরা সুপ্রিম কোর্টে যাবে।
জয়ন্তবাবু ঠিক আন্দাজ করেছিলেন। ড্রিমটেক সুপ্রিম কোর্টে এপ্রোচ করে। প্রায় সাতবছর হিয়ারিং চলে। তিরিশের উপর শুনানির ডেট পরে। এতদিন পর্যন্ত্য যে কতিপয় আবাসনবাসীরা উপেন্দ্রবাবুদের সাথে ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেরই মনোবল ভেঙে যায়। অর্থসাহায্যও কমে আসে। কিন্তু একমাত্র ব্যাতিক্রম উপেন্দ্রবাবুরা চারজন আর উকিলদ্বয়। উকিলবাবুরা বলেন আমাদের এখন আর পারিশ্রমিক দিতে হবে না, যতটা কেস চালানোর জন্য জরুরি ততটাই জোগাড় করুন। এইসময় থেকে প্রায় পুরো খরচটাই উপেন্দ্রবাবুরা চারজন মিলে সামলান ওনাদের জমানো পুঁজি থেকে। প্রথমদিকে উপেন্দ্রবাবু আর সুনীলবাবু শুনানির সময় দিল্লি যেতেন।
কিন্তু কিছুদিন পরে রবিবাবু বলেন, ” আপনাদের দুজনের বয়স হয়েছে, প্রায় সময় সময়ের অভাবে রিজারভেশন পাওয়া যায়না ট্রেনে। এখন থেকে আমি আর মানস যাবো দিল্লিতে শুনানির সময়। আমারও অবসর নেওয়ার সময় প্রায় হয়ে গেছে। ”
ওনারা দু’জন এরপর থেকে দিল্লি যেতেন। মানসের অনেক অফিস কামাই হয়েছে।
ড্রিমটেক অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাকি নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। যারা ফ্ল্যাট বুক করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই দাবি করেন ওনাদের অ্যাডভান্স ফেরত দিতে। ড্রিমটেকের আর একটা প্রজেক্ট তখন শুরু হয়েছিল। সেখানে অনেককে নতুন ফ্ল্যাটের অফার দেয়, কিছু লোককে অ্যাডভান্স ফেরত দিতে বাধ্য হয়।
এর মধ্যে এসে যায় করোনা। শুনানির দিন বার বার শিফট হতে থাকে। গতবছর শেষের দিকে আবার নতুন করে শুনানির ডেট দেওয়া হয়। বোঝা যাচ্ছিলো আর কিছুদিনের মধ্যেই ফাইনাল ভার্ডিক্ট এসে যাবে সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে।
কিন্তু এর মধ্যেই একটা অঘটন ঘটে গেলো। মানস পড়লেন করোনার প্রকোপে, সেকেন্ড ওয়েভের সময়। দুদিনও সময় দিলেন না মানস। হাসপাতালে দিতে না দিতেই দু’দিনের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। হার্টের প্রব্লেম ছিল, সুগারও বেশি ছিল। উপেন্দ্রবাবুরা জানতেন না এসব। পরে ওনার মেয়ে তিথির থেকে জানতে পারেন। উপেন্দ্রবাবু বেশ কয়েকদিন বাড়ি থেকে বেরোতে পারেননি, নিজের মনে গুমরে গুমরে কাঁদতেন। সুনীলবাবু, রবিবাবু এসে সান্ত্বনা দিতেন।
একটু অবস্থা ঠিক হলে, জুলাই মাসের প্রথম দিকে শুনানির ডেট পরে।
রবিবাবু বলেন, ” আপনাদেরকে আর যেতে হবে না এই বয়েসে। আপনাদের যাওয়াটা রিস্ক হয়ে যাবে। আমি একাই এবার যাই। ”
ফেরত এসে রবিবাবু আশার আলো দেখান।
জয়ন্তবাবু আগস্টের শেষে জানান, ফাইনাল শুনানির দিন ঠিক হয়েছে একত্রিশে আগস্ট। কিন্তু উনি বলেন কারুর যাওয়ার দরকার নেই।
সন্ধেবেলায় সেই এতদিনের প্রতীক্ষার অবসান হলো, জয়ন্তবাবুর ফোন পেয়ে।
উপেন্দ্রবাবু সাথে সাথে ফোন করেন সুনীলবাবু, রবিবাবুকে। মানসের মেয়ে তিথিকেও ফোন করে আনন্দসংবাদটা জানান।
সুনীলবাবু, রবিবাবু খবর পেয়ে সাথে সাথে দৌঁড়ে আসেন উপেন্দ্রবাবুর বাড়ি। নিয়ে আসেন সাথে করে তিথি আর তার মাকে। গমগম করে চলছে নিউস। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন, সবার চোখ দিয়ে গড়াতে থাকে অশ্রুধারা। প্রায় এক দশকের লড়াইয়ের অবসান হলো আজ।
নিউজে বলে চলেছে – It was the relentless pursuit of justice over a decade by a group of senior citizens that resulted in the Supreme Court’s order for demolition of the illegal 20-storey twin towers of a real estate group in an industrial town near Kolkata.
সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, হাউসিং এবং প্ল্যানিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজস করে ড্রিমটেক সংস্থা এই বহুতল নির্মাণ করছে। অবৈধ এই নির্মাণ নিয়ে হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ সঠিক। তাই হাই কোর্টের বহুতল ভাঙার রায়কেই কার্যকর রাখলো সুপ্রিম কোর্ট।
এছাড়া তপোবন আবাসন সংঘঠনকে ক্ষতিপূরণ বাবদ এক কোটি টাকা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন শীর্ষ আদালত।
যারা এই বহুতলে ফ্ল্যাট বুক করেছেন এবং এখনো টাকা ফেরত পাননি অথবা অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করা হয়নি পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে, তাঁদের সবাইকে ১২ % সুদ সহ অবিলম্বে টাকা ফেরত দিতে হবে।
আরও নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট, হাউসিং কমিটির তত্বাবধানে আগামী তিন মাসের মধ্যে এই ভাঙার কাজ শুরু করতে হবে, সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করে। সমস্ত খরচ বহন করবে ড্রিমটেক কোম্পানি। নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট, একটা বিশিষ্ট টিম গঠন করা হবে এই পুরো ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করার জন্য। কারা কারা জড়িত এরকম একটা অবৈধ নির্মাণ কাজের অনুমতি দেওয়ার জন্য।
সারা রাত ধরে উপেন্দ্রবাবু একটা কথাই ভেবেছেন, আজ যদি মানস ওনাদের মধ্যে থাকতেন – সবচেয়ে বেশি খুশি, আনন্দিত বোধহয় উনিই হতেন।
‘ বিধাতাই লিখে রাখেন কার সাথে কার হবে দেখা। কেউ জানে না কবে কখন কার সাথে গিয়ে মিলবে জীবন। তবুও থেকে যায় একটি চাওয়া, মনের মতো বন্ধু পাওয়া। ‘
কেন জানি না, উপেন্দ্রবাবুর আজ মনে ঘোরাফেরা করতে থাকে বারবার রবিঠাকুরের কিছু উক্তি বন্ধুত্ব সম্পর্কে :
” আমরা বন্ধুর কাছ থেকে
মমতা চাই,
সমবেদনা চাই,
সাহায্য চাই
ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই। ”
” গোলাপ যেমন একটি বিশেষ
জাতের ফুল,
বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ
জাতের মানুষ। ”
*****
নোট : নিচের এই ছবিটা আপনাদের নিশ্চয়ই পরিচিত। কিছুদিন আগে হয়তো দেখেছেন HT, TOI অথবা অন্য কোনো নিউস পেপারে। এটা সুপারটেকের দ্বারা নির্মিত অর্ধসমাপ্ত ৪০ তলার টুইন টাওয়ার নয়ডাতে। ৩১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেন এই অবৈধ নির্মাণের ভাঙার জন্য। এই অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নিকটবর্তী আবাসনের চারজন – UBS Teotia (80, retired as DIG in CRPF), S K Sharma (74, retired as Deputy Director – General in Telecom deptt), Ravi Bajaj (65) and M K Jain (59)। দশ বছরের উপর ছিল এই চারজনের একনিষ্ট লড়াই। এনাদের মধ্যে সবার কনিষ্ঠ M K Jain আজ আর নেই, করোনা কেড়ে নিয়েছে ওনাকে। এই ঘটনার ভিত্তিতেই ‘এক দশকের লড়াই ‘ গল্পটা লেখার একটা প্রয়াস।