বারোমন্দির ঘাট। বিকেল হলেও বুড়োবুড়ি আর ছেলেমেয়েদের দল এখনো হাজির হয় নি। ভাদ্রমাস শেষ, তবু আকাশ ঘন ছাইয়ের মতো মেঘে ঢেকে রয়েছে, গুমোট আবহাওয়া । সামনে মা গঙ্গা ধীরগতিতে বয়ে চলেছেন আবর্জনা আর কচুরিপানার স্তূপ। নদীর ওই পারে ঝাপসা হয়ে যাওয়া কারখানাগুলি আকাশের দিকে চিমনী তুলে ধোঁয়া ছাড়ছে। আর এপারে বাঁধানো ঘাটের উপর বসে আছে মুরলী , খানিক দূরে তার সাইকেলটি রাখা।
মুরলী দাস বি এ পাস, তার চাকরি পাবার সম্ভাবনা দূর ভবিষ্যতেও নেই। অসুস্থ মা কে দেখতে আর নিজের হাতখরচের টাকা জোগাতে তাকে টিউশনি করতে হয়। আজ তার মন ভালো নেই। সে বেকার ,অথচ তারই ছোটবেলার ক্যারাম খেলার সাথী মিত্তির বাড়ীর মেজ ছেলেটা এখন দিল্লিতে চাকরি করে, বিশাল প্রতিপত্তি। হপ্তাখানেক আগে ছুটিতে বাড়ি এসেছিল, আর ডি-এস-এল-আর ক্যামেরা হাতে বারোমন্দির ঘাটের ছবি তুলতে এসেছিল তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর সাথে।
আর মুরলী নিজে ? বাবা বলেছেন “এবার থেকে পড়াশোনার খরচ নিজে জোগাড় করবে, বুড়ো বাপের হোটেলে আর কদ্দিন ?” এদিকে লেখাপড়ায় এমন কিছু ভাল নয় সে যে ভালো স্কলারশিপ বাগাতে পারবে। আর প্রেম? তার জীবনেও এসেছিল ,আবার আর পাঁচটা বেকার যুবকের মতো সেও স্থায়ী হয় নি।
এরকম নীরস নিরর্থক জীবন কাটিয়ে লাভ কি ? এসব কথাই একা বসে ভাবছিল সে। পুরনো হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সে মনে করল – এবার ওঠা যাক , সাড়ে চারটে বাজতে চলল।
সাইকেলের স্ট্যান্ড তুলতে গিয়ে তার চোখে পড়ল সামনের চাকার টায়ার ফেঁসে গিয়েছে। হায় কপাল ! এখন এই সাইকেল টেনে বাড়ি ফিরতে হবে ? তার বহুদিনের সফরসঙ্গী এই সাইকেল এই খারাপ সময়ে এরকম বিদ্রোহ করে বসবে সে ভাবতে পারে নি। এদিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে , আশেপাশে কোথাও কোন সাইকেল গ্যারেজও খোলা নেই, বিপন্ন চোখে মুরলী এদিক ওদিক তাকায়।
সামনের পুরোনো বটগাছের তলায় একটা চালাঘর, সেদিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল একটা জীর্ণ সাইনবোর্ড, তাতে লেখা –
“ এখানে সকল প্রকার জীর্ন ও পুরাতন দ্রব্যাদি মেরামত করা হয় ”
উপায় না দেখে সেই চালাঘরের ছাউনির তলায় এসে দাঁড়াল মুরলী । দেখতে পেল ঘরের ভিতরে এক সাদা চুলদাড়িওয়ালা বৃদ্ধ , চোখে ঘোলাটে চশমা, পরনে ময়লা থিয়েটারি ধরনের আলখাল্লা। একটা তেলের কুপি জ্বালিয়ে এক মরচে-ধরা পুরোনো ঘড়ি মেরামত করছে। ছোট্ট ঘরের এখানে ওখানে কালিঝুলি মাখা ময়লা কাপড় ,আর লোহা –পেতলের নানানরকম যন্ত্রপাতি।
বুড়ো মাথা তুলে প্রশ্ন করল- “ কি চাই ?”
“ এই সামনের টায়ারটাতে লিক আছে ,কত খরচ পড়বে ? আমার কিন্ত তাড়া আছে।”
“আরে অত ব্যস্ত কেন, অবস্থা বুঝে ব্যাবস্থা করব, টাকার কথা পরে হবে ।
অগত্যা মুরলী একটা টুলের উপর বসল । না ,বুড়ো হলে হবে কি লোকটার পাকা হাত, কি নিপুণ ক্ষিপ্রতায় রেঞ্চ এর পিছনদিক দিয়ে টায়ার খুলে টিউবটা বের করল! আর একটা হাপর দিয়ে টিউবটা ফুলিয়ে বালতির জলে চুবিয়ে দেখতে লাগল কোথায় ফুটো আছে, ডাক্তার যেমন রুগীর নাড়ি-পরীক্ষা করে সেরকম ভাবে । তেলের কুপির আলোয় বুড়োর চশমার কাঁচ, হাতের স্টিলের যন্ত্র চমক দিতে লাগল। আর বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে, ঘরের ভিতরে শুধুই যন্ত্রের ঠুংঠাং আওয়াজ।
সময় কাটাবার জন্য মুরলী বুড়োকে জিগ্যেস করল-
“কদ্দিন ধরে এখানে কাজ করছ ? আগে তো তোমায় দেখিনি !”
বুড়ো চোখ না তুলে উত্তর দিল-
“যবে থেকে আকাশে চাঁদ সূর্য আছে, তবে থেকেই আমি এইখানে কাজ করি, ঠেকায় না পড়লে তো কেউ আমার কাছে আসে না।”
মুরলী বিশেষ অবাক হল না। বুড়ো বয়সে অনেকেই এরকম বাড়িয়ে কথা বলে, সে জিগ্যেস করল “ তোমার নাম কি কাকা ? বাড়ি কোথায় ?”
“ বিশু কর্মকার ”- বুড়ো সাইকেলের টিউবের উপর তালি ঘষতে ঘষতে বলল –“ ছেলেবেলায় কামরূপে থাকতাম, তোমরা যারে এখন অসম নাম দিয়েছ। রোজ হাতির পিঠে চরে পাঠশালে যেতুম, সে ভারি মজার জিনিস। অনেক দেশ দেখেছি গো ।জোয়ান বয়সে গুজরাতে ছিলাম, দ্বারকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেছি। আর মহাদেব আমাকে নিয়ে গেছিল লঙ্কাদ্বীপে ঠিকাদারের কাজ করার জন্য।আহা, অমন সোনার শহর ……… সমুদ্র তারে ছারখার করে দিল।” বুড়ো চোখের জল মুছলো।
মুরলী মাথা নাড়ল, ২০০৪ সালের ভয়াবহ সুনামিতে শ্রীলঙ্কার কি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা সে টিভিতে দেখেছে।
বুড়ো বিড়বিড় করে চলেছে “ আমি হলাম কারিগরের জাত, হেন যন্তর নেই যে সারাতে পারি না। এখন বুড়ো হয়েছি, চোখে ভাল দেখি না, তাই………”
মুরলী একটু আনমনা হয়ে গেল, বুড়োর বকবকানি আর তার কানে পৌছাচ্ছিল না। সে ভাবছিল তার জীবনটাও যদি ফেঁসে যাওয়া টায়ারের মতো আবার মেরামত করা যেত, যদি নতুনভাবে বাঁচতে পারত ! কি ভালোই না হত তা হলে!
তার ঘোর ভাঙল যখন তখনও বুড়ো একমনে বলে চলেছে “ সারা জীবনে অনেক যন্তর ঘাটলাম ,কিন্তু তালা চাবির মতো সরেস জিনিস আর হয় না, এ জগতে হাজার চাবি, হাজার তালা, সব চাবি দিয়ে সব তালা খোলে না, কিন্তু একটা তালার জন্য একটা চাবিই যথেষ্ট ……। খুঁজে পেতে হয়……”
মুরলী চমকে উঠলো। বাংলায় অনার্স পাস মুরলী সলিল চৌধুরীর ‘এক গুচ্ছ চাবি’ পড়েছে, কিন্তু বোঝে নি। আর এই নিরক্ষর বুড়ো মিস্তিরি, সে তার জীবন দিয়ে বুঝেছে!
“এই নাও তোমার সাইকেল ,দেখ সব ঠিক আছে কি না”-বুড়ো সাইকেলটা সোজা করে রাখে।
“কত দিতে হবে ?”-মুরলী পকেটে হাত দিয়ে জিগ্যেস করল।
“তোমার যা ইচ্ছে”, বুড়ো তার যন্ত্রপাতি ঝোলায় গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে “ আমাকে আবার যেতে হবে এক জায়গায়, সময় ফুরিয়ে আসছে।”
দূর থেকে একটা হই-হট্টগোলের আওয়াজ ভেসে আসছে, কারখানার দিক থেকে অস্পষ্ট ঢাকের শব্দ, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের উল্লাস, বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে, আকাশের এক কোণে সাতরঙা রামধনু প্রজাপতির মতো ডানা মেলেছে।
মুরলী মানিব্যাগ খুলে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে দেখল –বুড়ো নেই।
কোথায় গেল ? বটগাছের চারদিকে মুরলী একবার ঘুরে দেখল, বিশু কর্মকারের চিহ্নমাত্র নেই, আর বাইরের সাইনবোর্ডটাও উধাও। হতভম্ব মুরলী দাঁড়িয়ে থাকে।
দূরের কলরব ,ঢাকের শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, রঙিন জামাকাপড় পরা ছেলেমেয়ের দল চলেছে আগে আগে, পেছনে দুজন ঢাকি,তারপর ভ্যানে করে আসছে হাতির পিঠে বসা চতুর্ভূজ বিশ্বকর্মা ঠাকুরের মুর্তি। তার পিছনে একদল লোক হল্লা করতে করতে আসছে- “বাবা বিশ্বকর্মা কি জয়……।”
মুরলীর মনে পড়ল, গত পরশু বিশ্বকর্মা পূজো ছিল। আজ তার ভাসান । সে দেখতে লাগল , কাঁধে তুলে বিশ্বকর্মার প্রতিমাকে কয়েকপাক ঘুরিয়ে ওরা জলে ফেলে দিল, মেয়েরা শাঁখ বাজালো , তারপর সবাই চলে গেল।
বটের ঝুরি বেয়ে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে আসছে। মুরলী তার সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে গতি বাড়াল। গলির মোড়ে চায়ের দোকানের আড্ডা তখন জমে উঠেছে। আজ দুপুরে ভারত সরকার একটি নতুন কৃত্তিম উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়। মুরলীর কানে ভেসে এল –
“ কি দিন পড়ল মাইরি !”
“ সে তোরা যাই বল, পুরাকালে এরকম অনেক ছিল। হরিবংশে লেখা আছে ,বিশ্বকর্মা একরাতের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের জন্য দ্বারকাপুরী নির্মাণ করেছিলেন, রাবণের লঙ্কাও তারই হাতে গড়া, পারবে আজকালকার ইঞ্জিনিয়াররা ?”
“কাকু ,এই বয়েসেও আপনি গাঁজাখুরি গপ্পে বিশ্বাস করেন ?”
“তোরা আজকালকার ছোকরা…কিছুই মানিস না”
মুরলী আর দাড়ালো না। বিশু কর্মকার কোথায় গেছে সে জানে। মা গঙ্গাও জানেন কি ?