সে অনেক দিন আগেকার কথা। তখন খুব সুন্দর একটি দেশ ছিল। দেশের রাজা ছিলেন দয়ালু এবং সত্যবাদী। তিনি ছিলেন মহাবীর এবং সমস্ত রকমের যুদ্ধ ও বিদ্যায় পারদর্শী। পিতা মাতাকে তিনি খুব ভক্তি করতেন। ভ্রাতা ভগিনীদের তিনি খুব স্নেহ করতেন। আর সমস্ত প্রজাকে নিজের পরিবারের লোকেদের মতই আপন ভাবতেন। তিনি কখনও মিথ্যে কথা বলতেন না। তাঁর রাজত্বে কোনো অনাচার ছিল না। এই জন্যে ঈশ্বর তাঁকে এবং তাঁর রাজত্বের সমস্ত প্রজাদের খুব ভালবাসতেন। আর প্রজারা সত্যময় ও পবিত্র জীবনযাপনে অভ্যস্থ ছিলেন বলে সত্য, মঙ্গল ও সুন্দরের দেবতা শিব তাঁদের ওপরে প্রীত ছিলেন।

আচার ব্যবহার ও শিল্পের দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদে প্রজারা সকলেই ছিলেন বিনয়ী। আর শিক্ষক-পণ্ডিতরাও ছিলেন অহংকারহীন এবং সহজ সরল। তাঁরা ঘুষ নিয়ে অন্যকে চাকরি পাইয়ে দিতেন না বা নিজেদের কু প্রবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্য রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের ‘পা’ চাটতেন না, কিম্বা অন্য নারীদের প্রতি প্রলুব্ধ  দৃষ্টিতে তাকাতেন না। দেশের রাজা, পণ্ডিত ও শিক্ষকদের দেখাদেখি প্রজারাও অনুরূপ নৈতিক আর্দশে জীবন যাপন করতেন। তারাও কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না। সমস্ত কাজে, কথা বার্তায় তাঁরা স্বচ্ছতা বজায় রেখে চলতেন। কোনও রকমের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতেন না। আর মনে মনে কোটি কোটি দেব আর ঋষির বংশধর হিসাবে গর্ব অনুভব করতেন। তখন রাজা ছিলেন বলশালী, সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং ন্যায় পরায়ণ। ফলে সমাজে কোনো অশান্তি ছিল না। অপসংস্কৃতি ছিল না,ছিল না ব্যভিচার।

সেইজন্যে একজন নারীও অসতী ছিল না। রাজার দেখাদেখি প্রতিদিন প্রজারাও ঈশ্বরের উপাসনা করতেন, যোগ-প্রাণায়াম অভ্যাস করতেন আর দুঃখের কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্য নির্মোহ জ্ঞানের অভ্যাস করতেন। এবং সেইসঙ্গে ভক্তিযোগ এবং রাজযোগের অনুশীলন করতেন। তাঁরা কখনও প্রতিবেশীদের হিংসা করতেন না। শিশু, কিশোর, বালিকা, যুবক-যুবতি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বিশেষে সমস্ত নারী পুরুষ নির্ভয়ে যে যার কাজ করতেন। তাঁরা কেউই বিষয় সম্পত্তির লোভ করতেন না কিম্বা নাম যশের ও কাঙাল ছিলেন না। ঈশ্বরের ভালোবাসা আর করুণায় দেশের সমস্ত মানুষ খুশি ছিল।

কিন্তু ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শয়তানের মনে খুশি ছিল না। তিনি ঈশ্বরের মতন হতে চেয়ে – প্রজাদের কাছ থেকে পুজো পাবার অভিপ্রায়ে নানা পরিকল্পনা করলেন। কয়েক হাজার বছরের চেষ্টায় তিনি তৈরি করলেন নানা শক্তিশালী অনুচর। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনুচর – লোভ, হিংসা, অহংকার, অধর্ম, মিথ্যা, পাপ, কামনা প্রমুখকে সেই দেশে পাঠালেন। আর বললেন, যে করেই হোক প্রজাদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে সেখানে বাসা বাঁধতে হবে আর সেখানেই বংশবিস্তার করতে হবে। শয়তানের আদেশ মত তাঁর আনুচরেরা এক একজন প্রজাকে টার্গেট করে তাদের মনের ভেতরে ঢোকার চেস্টা করল। কিন্তু কি আশ্চর্য, সকলেই ব্যর্থ হল।

প্রজারা সকলেই গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতেন। তার ক্রিয়াতে এবং উপনিষদের জ্ঞান তাদের জাগ্রত মনের চারিদিকে বর্মের মত অধিষ্ঠিত থাকায় শয়তানের অনুচররা বিফল হল। তারা দ্রুত শয়তানের কাছে এসে প্রকৃত ঘটনা জানল। শয়তান তখন তাদের আদেশ দিলেন – দিনে নয়,রাত্রিবেলা যখন প্রজারা ঘুমাবে তখন তাদের মনের ভেতরে ঢুকতে হবে। সেইমত অনুচরেরা আবার তাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য গমন করল। কিন্ত খুব বিস্ময়ের ব্যাপার শয়তানের অনুচরেরা এবারও ব্যর্থ হল। প্রজারা ঘুমালাও ঈশ্বরের বিরট সত্তার স্পর্শ তাদের রক্ষা করলেন। এরপর শয়তান একটি নতুন পরিকল্পনা করলেন। তিনি অনুচরদের ডেকে বললেন-প্রজারা যখন খাদ্যদ্রব মুখে তুলবে ঠিক সেই সময় খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রথমে তাদের পাকস্থলীতে এবং তারপরে মনের মধ্যে পৌঁছতে হবে।

শয়তানের আদেশ মত তার অনুচররা এবার খাদ্যকণার রূপ ধরল এবং প্রজাদের খাবারের সঙ্গে মিশে গেল। সাধারণ প্রজারা এই সব ফন্দী ফিকিরের কথা একদম জানতেন না। খাবার গ্রহণ করবার সঙ্গে সঙ্গে পাপ , হিংসা, মিথ্যা, আহংকার কামনা প্রমুখ শয়তানের আনুচরেরা নির্দিষ্ট প্রজাদের মনে পৌঁছে গেল। যাদের খাবারে তাঁরা মিশে ছিল, তারা সকলেই তখন কেমন যেন বদলে গেলেন। তার ফলে কিছু মানুষ হয়ে উঠল ঘুষখোর, মদ্যপ। কিছু নারী হয়ে উঠল, মিথ্যুক, উচ্ছৃঙ্খল, আসতী। কিছু পুরুষ হয়ে উঠল দালাল, গুণ্ডা, অপহরণকারী এবং নারীপাচারকারী। কিছু পন্ডিত শিক্ষক – অধ্যাপক হয়ে উঠলেন অন্যায়-অধর্মের দাস। চারিদিকে গজিয়ে উঠল পাপাচার গ্রস্ত হোটেল ,বার, নাইট ক্লাব, বোল্ড রিলেশন ক্লাব। মিথ্যা কালোবাজারি, ভণ্ডামি, শোষণ, দুর্নীতি আর  ব্যভিচারে ভরে উঠল দেশ।

এমন সময় প্রতাপমত্ত শয়তান রাজার বেশ ধারণ করে মাথায় দামী মুকুট পরে, ঈশ্বরের কাছে গিয়ে বললেন – দেখো, আমি তোমার ধর্মরাজ্য ছারখার করে দিয়েছি। আমি তোমার চেয়েও শক্তিমান। এবার সমস্ত মানুষ আমার বশীভূত হবে। তুমি কিছুতেই আমাকে পরাজিত করতে পারবে না। শান্ত বিনয়ী ঈশ্বর সব শুনে বললেন – আমি তো তোমাকে পূর্বেও বহুবার হারিয়েছি। সে সব কথা কি তুমি ভুলে গেছো ? শয়তান বললেন – না না ভুলিনি, কিন্তু এবার আমার সৈনরা অনেক বেশি শক্তিশালী। লোভ, মিথ্যা, হিংসা, কামনা এবার খুব শক্তিমান।

স্থিতধী ঈশ্বর বললেন – আমিও তো ওদের বিরুদ্ধে প্রবল শক্তিমান পুণ্য, সত্য, অহিংসা, ধর্ম, নির্বাসনা প্রমুখ সৈন্য প্রেরণ করেছি। ঐ দেখো সংসারে কী ভীষণ যুদ্ধ চলছে ! আসলে আমিই ওদের মধ্যে আছি নানাভাবে নানা রূপে। পূর্বকালে আমিই শিব রূপে সত্য হয়েছি, বুদ্ধ রূপে আমিই হয়েছি অহিংসা, রাম রূপে আমি হয়েছি শান্তি, কৃষ্ণ রূপে আমিই হয়েছি ধর্ম, জাহ্নবী রূপে আমিই হয়েছি পুণ্য আর শ্রীরামকৃষ্ণ রূপে আমিই হয়েছি কামিনী কাঞ্চন ত্যাগী নির্বাসনা, দুর্গা রূপে আমিই হয়েছি দুর্গতিনাশিনী আবার সারদা রূপে আমিই হয়েছি স্নেহদায়িনী জগৎমাতা আর তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যই আমিই হয়েছি দুর্ভেদ্য গায়ত্রী। আমিই হয়েছি বেদ- উপনিষৎ। আমিই হয়েছি যজ্ঞ, আমিই হয়েছি প্রার্থনা, আমিই হয়েছি অগ্নি, আমিই হয়েছি মহাজ্ঞান। …

শয়তান তবু হুংকার দিয়ে বলে উঠল – হয়েছে, হয়েছে। এবার থামো, যতই কর, তুমি কিন্তু আমাকে মারতে পারবে না। আমি তো তোমার মহাজ্ঞান চুরি করেছি। আমিও তোমার মত মৃত্যুকে জয় করেছি। শান্ত ঈশ্বর ধীর কণ্ঠে বললেন – কিন্তু শয়তান, তোমার রুচিই তোমার নিয়তি। তুমি কোনোদিন মানুষের বিবেকের চোখে ধূলো দিতে পারবে না। সত্যজ্ঞানী মানুষ চিরকাল তোমাকে ঘৃণা করবে। পুনরায় শয়তান হুংকার দিয়ে বলে উঠল – আমি ছল করে মানুষের বিবেক ভুলিয়ে দেব। ঈশ্বর বললেন এইবার তুমি মহামূর্খের মতন কথা বললে। জানি, তুমি অনেক রত্নাকর তৈরি করবে। আর আমি সব রত্নাকরকে ঋষি বাল্মীকি বানাবো।

 

 

~ ঈশ্বর ও শয়তানের দ্বন্দ্ব ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleএকটি আক্ষেপ
Next articleমধুচন্দ্রিমা ক্ষণে
Gopal Chandra Bayen
Assistant Professor, Ramakrishna Mission Vidyamandira, Belur Math, Howrah, West Bengal and Writer Hobby: Recitation, Acting, singing
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments