এক গৃহস্থের বাড়িতে একটি হংস দম্পতি বসবাস করে। সকাল থেকে সারাদিন তারা নন্দী পুকুরের কালো জলে সাঁতার কেটে বেড়ায়, ডুবে ডুবে গুগলি, শামুক খায়, অন্য হাঁসের বাচ্ছাদের সাথে খেলা করে। কখনো গাছের ছায়ায় পালকে ঠোঁট গুঁজে বিশ্রাম নেয় কখন পা গুটিয়ে জলে ভেসে থাকে। সন্ধ্যা নামার আগেই আবার যে যার বাসায় ফিরে যায়। এমনি করেই তাদের দিন যায়।
হংসী প্রায়ই রাতে একটি করে ডিম দেয় আর ভোর হতে না হতেই গৃহস্থ এসে ডিম নিয়ে চলে যায়। হংস দম্পতি অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখে আর মনে মনে খুবই কষ্ট পায়।এভাবে গৃহস্থ তাদের সব ডিম নিয়ে চলে গেলে তো ডিম ফুটে কোনদিনও তাদের বাচ্ছা হবে না, তারা স্বপ্ন দেখে, কবে নন্দী পুকুরের ঠাণ্ডা জলে তারাও তাদের বাচ্ছাকে নিয়ে খেলা করবে, ঠোঁট দিয়ে তার কচি কচি পালকের জল ঝেড়ে দেবে, বড় করবে, মুখে তুলে খাইয়ে দেবে গুগলি, শামুক।
এরই মধ্যে একদিন হয়েছে কি গৃহস্থের ছেলে স্কুলে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল। স্কুল থেকে খবর এল। গৃহস্থ হ্ন্ত দন্ত হয়ে পাড়ার দু এক জনকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলের দিকে দৌড় দিল। গৃহস্থের স্ত্রী দাওয়ায় বসে খুব কান্নাকাটি করছে, পাড়ার কয়েকজন মহিলা এসেছেন তাকে সান্তনা দিতে। সন্ধ্যা নেমে এল। বাড়ীর সদর দরজা হাট করে খোলা। হাঁসেদের ঘরের দরজা ও সেদিন বন্ধ করা হল না। সকলেরই মন মেজাজ খুব খারাপ। বাড়িতে আলোও জ্বালান হয় নি।
হংস মনে মনে ভাবল এই সুযোগ পালিয়ে যাবার। হংসীকে জানাল তার মনের কথা। হংসীর পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মন সায় দিচ্ছিল না। গৃহস্থের বাড়িতে এমন বিপদ,এই সুযোগে পালিয়ে যাবে? আহা, ছেলেটার না জানি কী হয়েছে? এই তো প্রতিদিন বিকালবেলা উঠানে খেলা করে, ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়, নন্দীপুকুরে স্নানও করতে যায় মাঝে মাঝে। হংস তখন তাকে বোঝাল, যে এমন সুবর্ণ সুযোগ আর কোন দিনও আসবে না, তাদের বাচ্ছা ফোটানোর স্বপ্নও অপূর্ন থেকে যাবে চিরদিন। বাচ্ছার কথায় হংসীর মন নরম হল। সুযোগ বুঝে সন্ধ্যার অন্ধকারে দুজনে বেড়িয়ে পড়ল। মাঠ ঘাট পেরিয়ে সারারাত চলতে চলতে অবশেষে একটা ঝোপের সন্ধান পেল তারা। আড়াল আবডাল খুঁজে নিয়ে দুজনে সেখানেই আশ্রয় নিল।
ভোরবেলা হংসী একটি ডিম দিল। মহানন্দে দুজনে মিলে খড় কুট জোগাড় করল, তার উপর হংসী ডিমে তা দিতে বসল। হংস বেড়ল খাবারের সন্ধানে। অনতি দূরে মাঠের একধারে একটা পুকুর পেল। অনেক দূর পর্যন্ত জন বসতি নেই তাই পুকুরে অন্য কোন হাঁসও নেই। হংস নিজে পেট ভরে ছোট মাছ, গুগলি এসব খেয়ে ফেরার সময় হংসীর জন্য নিয়ে এল। রোজ হংস সকালে পুকুরে চলে যায় বিকালে হংসীর জন্য খাবার নিয়ে ফেরে। এভাবেই বেশ সুখে দিন কাটতে লাগল। নতুন জায়গায় নতুন বাসায় নতুন ভাবে বাঁচার স্বাদ পেল তারা। এ এক অখণ্ড স্বাধীনতা ।
কিছুদিন পর ডিম ফুটে একটা বাচ্ছা হাঁসের জন্ম হল।
তাকে দেখে হংস আর হংসীর তো আনন্দ আর ধরে না। কী সুন্দর দেখতে। নরম তুল তুলে শরীর, লাল লাল ঠোঁট ,কচি কচি পালক, কি মিষ্টি দেখতে।দুজনে মিলে তার গা পরিষ্কার করতে লাগল। এত দিনে তাদের স্বপ্ন পূরন হল। দিন কয়েক পর থেকে তিন জনে মিলে সেই পুকুরের জলে সাঁতার কাটত, খাবার খেত, খেলা করত আরও কত কি। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে বাচ্চাটি। খুব সুখে দিন কাটছে তাদের। এরমধ্যে একদিন হল কি,সকাল বেলা হংস পরিবার সেই পুকুরে গিয়ে দেখে কয়েকজন লোক সেই পুকুরের জল মেশিন লাগিয়ে তুলে ফেলছে।সেদিন আর তাদের পুকুরে নামা হল না।
পরদিন সকালে এসে দেখল একদম তলায় একটু জল পড়ে আছে, সব মাছও ধরে নিয়ে গেছে, সেদিনের মত পাঁকে মুখ গুজে গুজে অল্প একটু খাবার পেল তারা কিন্তু প্রচণ্ড রোদের তাপে দু একদিনের মধ্যেই পুকুর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আশেপাশে আর কোন পুকুর ডোবা না থাকায় হংস পরিবার খুব বিপদে পরল। খাবার আর জলের তীব্র অভাব দেখা দিল। হংস ভাবল দূরে কোথাও নিশ্চয় অন্য কোন পুকুর থাকবে তাই হংসী আর বাচ্ছাকে রেখে বেড়িয়ে পড়ল অন্য পুকুরের সন্ধানে। সন্ধান পেলে ফিরে এসে তাদের সেখানে নিয়ে যাবে। হংসীর মন এতে সায় দিল না তবু একটা কিছু তো ব্যবস্থা করতেই হব তাই হংসকে বাধা দিতেও পারল না।
এভাবে একদিন, দু দিন, তিন দিন কেটে গেল। হংস এখনও ফিরল না। অজানা আশঙ্কায় হংসীর মন অস্থির হয়ে উঠল। তবে কি হংসের কোন বিপদ ঘটল? এদিকে বাচ্ছাকে নিয়ে একা ঝোপের বাইরে বেরনোর সাহস পেল না হংসী, খাবার আর জলের অভাবে তাদের শরীর আবসন্ন হয়ে আসতে লাগল। এভাবে আরও একদিন কাটল, হংস ফিরল না।অন্য কোন উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে বাচ্ছাকে নিয়ে সাহসে ভর করে হংসী বেড়িয়ে পড়ল খাবারের সন্ধানে। লোক চক্ষু এড়াতে রাতের অন্ধকারকে বেছে নিল সে। সারারাত চলতে চলতে কোনরকমে ভোরবেলা একটি গ্রামের দেখা পেল। যত এগোতে লাগল ততই আনন্দ আর আশঙ্কায় হংসীর মন চঞ্চল হতে লাগল। সকাল হলে সে বুঝতে পারল এতো তার সেই পুরন গ্রাম। সেই বাউড়ি পাড়া,সেই নন্দী পুকুর, একটু এগোলেই ডান দিকে বাঁক ঘুরে গৃহস্থের বাড়ী। অন্য হাঁসেরা তখনও পুকুরে আসে নি।
কি করবে ভেবে উঠতে পারল না। হংসের জন্য মনটা কেঁদে উঠল, গৃহস্থের বাড়ীতে বন্দী হয়ে গেলে তো হংসের সাথে আর কোন দিনও দেখা হবে না। হংস যদি বেঁচেও থাকে তবুও আর কোন দিনও তাদের খুজে পাবে না। অসহায় মা বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু নিরাপদ নিশ্চিত আশ্রয়ের আশায় ধীরে ধীরে গৃহস্থের বাড়ীর দিকে পা বাড়াল। সদর দরজাটা কাত করে খোলা,বাড়ির ভিতর থেকে গৃহস্থের ছেলেটার পড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে হংসী সোজা চলে এল তাদের পুরন ঘরের সামনে,দরজাটা এখনও বন্ধ, উকিঁ ঝুঁকি মারতেই মনে হল ভিতরে কে যেন আছে। তবে কী… তাইত… এযে হংস মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ হংসই বটে। পুকুরের সন্ধান করতে করতে হংস এই গ্রামেই ধুকে পড়ে। পাড়ার লোকেরা আগেই হংস দম্পতির হারিয়ে যাওয়ার খবর জানত। দেখতে পেয়েই হংসকে ধরে তারা গৃহস্থের বাড়ীতে দিয়ে যায়। সেই থেকে সে বন্দী, এমনকি পুকুরেও যেতে দেয় না পাছে আবার পালিয়ে যায়। সব শুনেও সেই বন্দী জীবনে প্রবেশ করার জন্য হংসী বাচ্ছাকে নিয়ে দরজার বাইরে অপেক্ষা করে রইল।