বেড়াতে যাবার কথা হলেই শুনি অতদিন ছুটি নিলে নাকি দেশ -এর পাওয়ার প্ল্যান্ট সব বন্ধ হয়ে যাবে । চারিদিকে ঘোর অন্ধকার বিরাজ করবে । এবার আমি খানিকটা বেপরোয়া হয়ে বললাম দেখ নিয়ে যাবে তো চল । নইলে একাই চলে যাব ।
কুইন সিনেমাটা দেখে ইউরোপ দেশ বেড়ানোর রোমাঞ্চতা আমায় বেশ গ্রাস করেছিল । কর্তাকে যতবারই বলি বেড়ানোর কথা উত্তর আসে – অতদিন ছুটি নিলে নাকি দেশের পাওয়ার প্ল্যান্ট সব বন্ধ হয়ে যাবে । চারিদিকে ঘোর অন্ধকার বিরাজ করবে । বড়সাহেবের লালচোখ …তারপর নাকি রুজিরুটিতেও টান পরতে পারে। মধ্যবিত্ত মানুষ চাকুরী গেলে খাব কি ? আর লোডশেডিং র কষ্ট তো হাড়ে হাড়ে টের পাই ।তাই চুপ হয়ে যাই ।
এবার খানিকটা বেপড়োয়া হয়ে বলে বসলাম
– নিয়ে যাবে তো চল , নইলে একাই চলে যাব । ঠোক্কর খেতে খেতে ঠিক ঘুরে নেব ।
এই বয়সে বউ পালালে কি অবস্থা হবে, সেটা বোধহয় বুঝতে পেরে রাজী হয়ে গেল । ছুটিও মঞ্জুর হল ।তারপর দৌড়ঝাপ করে ভিসা , নেটে বসে হোটেল বুকিং ,ফ্লাইট বুকিং ।ঠিক হল এখান থেকে অসলো ,সেখান থেকে প্যারিস আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সুইজারল্যান্ড। ।
আজকাল প্লেনে চড়তে ভয় করে ,যে ভাবে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেনটা মাঝ আকাশ থেকে হাপিস হয়ে গেল । কোন হদিশি করা গেল না । নির্দিষ্ট দিনে দুরুদুরু বক্ষে চেপে বসলাম লুফথানসা বিমানে । গন্তব্য অসলো । মাঝে ফ্র্যাঙ্কফুটে কয়েকঘন্টার বিরাম । প্লেনে অনেকবার চড়লেও ,দোতলা প্লেনে চড়া এই প্রথম । অবশ্য ভেতরে ঢুকে অতিকায়ত্ত ছাড়া আর কিছু ফারাক মনে হল না । সহযাত্রীরা বেশীরভাগই দেশীয় ।সিটে বসতেই মেকি হাসি দিয়ে বেল্ট বাধাঁ হয়েছে কিনা পর্যবেক্ষণ করে গেল এয়ারহস্টেস । দরজা বন্ধ হল । ইঞ্জিন গোঁ গোঁ করছে ।পাইলট ঘোষনা করছে প্লেন ছাড়ার জনে তৈরি । হঠাত দেখি হোস্টেসরা ত্রস্ত পায়ে আমাদের সিটের দিকে আসছে । ব্যাপার কি ! আসলে গোল বেধেছে আমাদের সামনের সিটে । সেখানে বসেছে এক পাঞ্জাবি পরিবার । স্বামী স্ত্রী ও দুটি বাচ্চা । ছোটটি কোলে আর বড়টি প্রায় বছর চারেকের ।।ঐ বাচ্চাটি কিছুতেই সিটে বসে বেল্ট বাঁধবে না । হোস্টেস মহিলাটি অনেক আদর করে সুইটু বলে চকলেট দিয়ে হাড় মেনে গেলেন । ছেলের বাবা বেশ হাট্টাকাট্টা চেহারা , পেসিবহুল হাত দেখে তো মনে হল থাপ্পড় খেলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখার চান্স আছে । তিনি ছেলেকে বসাতে গেলে পরিত্রাহি চিতকার করে ছেলেই উল্টে এক চড় লাগিয়ে দিল , বাবা পিছিয়ে এল । বুঝলাম ওরকম চেহারা শুধু দেখানোর জন্য কোন কাজের নয় । এবার রণক্ষেত্রে নামলেন অপেক্ষকৃত লিকলিকে মা । ছেলেকে খানিক পাঞ্জাবি গালি দিয়ে বেল্ট বেঁধে চেপে ধরে থাকল । ছেলেও সারা প্লেন কাঁপিয়ে হাত পা ছুঁড়ে চিতকার । এরা সব আমেরিকাবাসী । জানি না সেখানে দেশের নাম কতটা উজ্জ্বল করছে নাকি জল ঢালছে । এইসব সোরগোলের মাঝেই মধ্যরাতে আমাদের নিয়ে ডানা মেলল রাতপাখি ।
প্লেনের এই এক মুশকিল আসপাসের সহযাত্রীরা সব মুখে কুলুপ এটেঁ থাকে । এদিক দিয়ে ট্রেন অনেক ভাল । সহযাত্রীদের সাথে বেশ জমিয়ে গল্প করতে করতে যাওয়া যায় । কি আর করি ।যস্মিন দেশে যদাচার …। মুখে সিলোটেপ লাগিয়ে নিলাম। মাঝে মাঝে খাদ্য পানীয় আসতে লাগল । টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমের চাদর জড়িয়ে গেল বুঝতে পারিনি । হঠাত চোখে আলো পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল । এ যে মেঘের রাজ্য । সাদা পেঁজা তুলার মত মেঘ জানলার বাইরে ভিড় করেছে । হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলব। জানলার ফ্রেমে আটকে যাই …
“মেঘলা মেয়ে মেঘেরই সাজ পরেছে।
কার ছায়া তার মনেতে আজ ধরেছে……।
এয়ারহোস্টেস ইশারা করছে জানলা বন্ধ করে দিতে । সবাই ঘুমের দেশে । আলোতে ঘুমের ব্যাঘাত হবে । মন চায় না তাও দিতে হয় । নজরের বাইরে গেলে বেহায়া আমি আবার জানলা খুলে বসি ।
সকাল সাতটায় ফ্র্যাঙ্কফুর্টের মাটি ছুলাম । এলাহি সিকিউরিটি চেক ,দোকানের জানলায় ঘোরাঘুরি ,সব জিনিষের দাম টাকায় হিসাব করে চক্ষু কপালে তুলে ট্রানসিটে সময়টা বেশ কাটল । অসলো ফ্লাইটে দেখি সবাই সোয়টার জ্যাকেট চড়িয়েছে । আমরাই কেবল ফিনিফিনে সুতির জামা পড়ে গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছি । প্লেনের মধ্যে খুব একটা ঠাণ্ডা অনুভব হল না কিন্তু বাইরে বেড়তেই বুঝিয়ে দিল মে মাসে শীত কাকে বলে । লটবহর নিয়ে বাইরে আসতেই দেখি এক গাল হাসি নিয়ে ঋভু অপেক্ষা করছে । এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে করে বাড়ি যেতে যেতেই কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া তার অস্তিত্ব জানান দিল । শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ট্রেনের ভেতর বেশ আরামপ্রদ । ট্রেন ছুটছে দৃশ্যপট দ্রুত পালটে যাচ্ছে । কোথাও উঁচু পাহাড় ,জঙ্গলের সারি ,কোথাও জঙ্গল পাতলা হয়ে চোখের সামনে হাজির হচ্ছে ঘাসবন , কোথাও দিগন্ত প্রসারী মায়াবী ল্যান্ডস্কেপ, কখনো ট্রেন গমগম করে ছুটছে ট্যানেলের মধ্য দিয়ে । আমি জানলায় মুখ চেপে নিষ্পলকে তাকিয়ে আছি কিছু যেন হারিয়ে না ফেলি । আধঘন্টার মধ্যেই পৌছে গেলাম অসলো শহরে । বাড়ীর পথে রিমঝিম বৃষ্টি আমাদের সাথী হল ।
আমদের মধ্যবিত্ত মেন্টালিটিতে বেড়ান মানে বুঝি কোন জায়গায় গিয়ে হোটেলে মালপত্র রেখে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ান । সে ভাবে ভাবতে গেলে নরওয়েতে বেড়ানোর কিছুই নেই । কিন্তু ওখানে যা আছে তা অন্য কোথাও নেই । সে হল প্রকৃতি । প্রকৃতি দু হাতে নিজেকে উজাড় করে সাজিয়েছে ।গুরু গম্ভীর ধ্যা্নমগ্ন পাহাড় ,সুউচ্চ দেবদারু পাইনের অরণ্য আবার কোথাও পাহাড়ের গায়ে ছলাত ছলাত শব্দ তুলে ছুটে চলা নদী । রয়েছে ফুলের বাগান । কৃত্রিমতার কোন স্পর্শ নেই সেখানে । পথের পাশে সামুদ্রিক খাঁড়ি ও লেকের ধারে ফুটে আছে অজস্র রঙবেরঙের ফুল । গন্ধে হার মানলেও রুপে তারা ম্যানিকিওর করা বাগানের ফুলের থেকে কিছু কম যায় না ।
অসলো ছোট্ট ছিমছাম শহর । বাহ্যিক আরম্বরতা নেই । লোকজন কম । উত্তরমেরুর কাছে অবস্থান হওয়ায় বছরের বেশীরভাগ সময়েই এখানে শীত । একমাত্র জুলাই মাসে সর্বাধিক গরম । রাজধানী হলেও অট্টালিকার প্রাচুর্য নেই ।সবুজ উঁচুনীচু পাহাড় ,জঙ্গল ঘেরা ঝলমলে নীল অসলো ফিয়র্ডের মাঝখানে ডজন খানেক পার্ক ,খান চল্লিশেক দ্বীপ ,বিরাট বিরাট লেক আর দুটো নদী নিয়ে গড়ে উঠেছে শহর। অধিবাসীদের নরস বলা হয় ।মধ্যযুগে নরওয়ে ছিল ভাইকিংদের বাসভুমি ।পেশায় তারা ছিল জলদস্যু । হেরল্ড ফেয়ারহেয়ার শক্ত হাতে ভাইকিংদের দমন করে প্রথম নরওয়ের রাজা হন । পরবর্তীকালে নরসরা আস্তে আস্তে খ্রীষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। সত্তর দশকের আগে নরসরা ছোটখাট কাজ আর মাছ ধরেই দিন কাটাত । তারপর নর্থ সি তে খোঁজ মিলল দেদার তেলের । নরওয়েসিয়া পৌছেগেল সমৃদ্ধির শিখরে । অসলো এখন পৃথিবীর ব্যয়বহুল শহরগুলির অন্যতম ।
ছাতা না নিয়ে অসলোর রাস্তায় বেরনো এক ঝকমারি । আকাশ বড়ই খামখেয়ালী । এই দেখি লম্বা গাছগুলোর মাথায় রোদ ঝিকমিক করছে ।পরক্ষনেই পুরু পশমের কাল চাদরে ঢেকে যায় আকাশ ।শুরু হয় প্যানপ্যানে বৃষ্টি আর কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় গা শিরশিরানি । এখনো এদেশের বেশীর ভাগ বাড়িঘর কাঠের তৈরী ।তবে শহরের পশ্চিম দিকে ১৮১৪ সাল থেকে কংক্রীটের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজার বাড়ি (Royal palace ) ।বাড়িটির গঠন শৈলীতে নিওক্লাসিকাল প্রভাব দেখতে পেলাম । পর্যটকরা বেশ স্বাধীনভাবে বাড়িটির আসপাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি একদমই নেই । শুনলাম জাতীয় দিবসে নাকি রাজামশাই বাইরে এসে জনগণের সাথে করমর্দন করেন ।পেছন দিকে রয়েছে সবুজে ঢাকা উন্মুক্ত বাগান । মাঝখানে ছোট্ট জলাশয়ে রাজহাঁসেরা ভেসে বেড়াচ্ছে । রাজবাড়ির সিংহদরজা থেকে ন্যাশনাল থিয়েটার,প্রাসাদ ,পুরানো ইউনিভার্সিটি ,ক্যাথিড্রাল অতিক্রম করে সিটি সেন্টার ইয়রনবেন টরগেট স্কোয়ার (Jernbantorget ) অবধি সোজাসুজি নেমে এসেছে রাজপথ কার্ল জোহান্স গেট ।, মাঝখানে বুলেভার্ডে ফুলের ডালি । নানা রঙের টিউলিপের সমাহার ।দুধারে অজস্র দোকানবাজার ,মল ,রেস্তরা ,হোটেল, পাবে জমজমাট।
স্কোয়ারের মাঝখানে বিরাট ব্রোঞ্জের বাঘ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে । ফটো তোলার উত্তম জায়গা । আমাদের ক্যামেরাও ক্লিক ক্লিক করে উঠল ।১৮৭০ সালে এক নরওয়েজিয়ান কবি তার কবিতা “ sidste sang “ বাঘ ও ঘোড়ার লড়াই বর্ণনা করেছিলেন । যেখানে বাঘ বিপদজনক শহরের প্রতীক আর ঘোড়া শান্ত গ্রামাঞ্চল । সেই থেকেই স্থানীয়রা অসলোকে বাঘের শহর (Tigerstaden ) বলে । নিরিবিলি ,শান্ত ,ভদ্র ,নিয়মমাফিক চালচলন দেখে এ শহরকে কোন দিক দিয়েই বাঘের সঙ্গে তুলনা করতে পারলাম না । এ শহরে চোরছ্যাচড় ,ঠকবাজ বা পকেটমারের কোন উপদ্রব নেই ।বিদেশীরা নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করতে পারে । মায়েরা বেশ সুন্দর একা একা প্র্যামে বাচ্চা বসিয়ে বাসে, মেট্রোতে চলাফেরা করছে । অনেককে দেখলাম কুকুর নিয়ে বাসে চড়ছে ।সামনেই প্রাচীন ঐতিহ্যধারী সেন্ট্রাল স্টেশন । স্টেশন চত্বর ছাড়তেই সমুদ্রের ধারে ধবধবে সাদা অপেরা হাউস । নিচের থেকে ইটালিয়ান মার্বেলের ঢালু রাস্তা ধরে উঠে গেলাম অপেরার ছাদে । ওপর থেকে গভীর নীল অসলো ফিয়ার্ডের মনোমহিনী রুপ না দেখলে বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই ।
অসলো রাদুস (Radhuset) বা সিটি হলের চৌকো বিল্ডিঙের পিছনে দুটি সদৃশ স্তম্ভ অনেক দূর থেকে দেখা যায় । একটিতে বিরাট ঘড়ি টিক টিক করছে অন্যটিতে ৩৮টি বেল প্রতি ঘন্টায় বেজে পুরো জাহাজঘাটাকে মুখরিত করে । ভিতরে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা পেন্টিং ও স্কাল্পচার আছে । এখানেই প্রতি বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতরণের আয়োজন করা হয় । পাসে পিস সেন্টারে অ্যালফ্রেড নোবেলে ও বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত শান্তি পুরস্কার প্রাপকদের কার্যাবলী লিপিবদ্ধ করা আছে । শান্তির প্রতীক সেই অসমসাহসী ছোট্ট মেয়ে মালালা ও কৈলাস সতারথীর কথা পড়তে পড়তে বেশ গর্বিত লাগল । পাশেই বিরাট জাহাজঘাটা থেকে অনবরত ফেরী ছাড়ছে দূরের দ্বীপগুলোর উদ্দেশ্যে । বাতাসে ভেসে আসা রান্নার গন্ধে আর থাকতে পারলাম না ঢুকে পরলাম এক রেস্টুরেন্টে ।উষ্ণ পানীয় সহকারে রাতের খাবার ওখানেই সেরে নিলাম ।
বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে অনেক কিছু আমরা চিরন্তন সত্য বলে জানি । যেমন জানি সূর্য প্রতিদিন সকালে ওঠে সন্ধ্যায় অস্ত যায় । কিন্তু এর ব্যাতিক্রম হল নরওয়ে । ওখানে মধ্যরাতেও সূর্যের দেখা মেলে ।জুন জুলাই দুই মাস অসলোয় সূর্য অস্তমিত হয় না । সারারাত গোধূলির ম্লান আলো বজায় থাকে ।রাতেরবেলা সূর্যের আলো দেখা সত্যিই এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা । বিশ্ব জুড়ে নরওয়ে “নিশিথ সূর্যের দেশ “ নামে পরিচিত । আবার শীতকালে দিনের পর দিন চলে চাঁদ জ্যোৎস্নার একছত্র লীলাখেলা । সুয্যিমামার দেখা মেলে না । সেই সময় কখনো কখনো রাতের আকাশে চোখে পড়ে নাচের ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ানো নানা রঙের আলোকচ্ছটা। লাল, হলুদ, সবুজ, নীলসহ নানা রঙে, নানা আকার-আকৃতি নিয়ে এসব আলো তৈরি করে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য । একে বলে মেরুজ্যোতি (aurora Borealis ) ।আমাদের কাছে এসব বেনিয়ম লাগলেও ওদেশে এটাই নিয়ম । ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার সবই ঘড়ি মেপে করতে হয় । গুডনাইট বলে যখন বিছানায় গেলাম বাইরে খটখটে রোদ ।মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় ।চোখ খুলে বুঝতে অসুবিধা হয় দিন না রাত। ।
সকালবেলা ঘুম ভাঙল পাখির শিসের শব্দে ।তাকিয়ে দেখি জানলার বাইরে পাইন গাছে কতগুলো পাখি কিচিরমিচির জুড়েছে । দেখতে অনেকটা আমাদের দোয়েলের মত তবে সাইজে বেশ বড় ।পাতার ফাঁকে রোদ ঝিকমিক করছে। প্যানপ্যানানি বৃষ্টিটা নেই ।তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পরলাম । যাব বিগডয় ।সেখানে ভাইকিং যুগ থেকে কন-টিকি পর্যন্ত সমস্ত অভিযানের সাজসরঞ্জাম সংরক্ষণ করা আছে বিভিন্ন মিউজিয়ামে ।
প্রশান্ত মহাসাগরের অতল নীল জল । যে দিকে তাকাও রাশি রাশি জল আর উথাল পাথাল ঢেউ । ঢেউয়ের মাথায় ভাসছে মোচার খোলার মত বালসা কাঠের ভেলা । কিন্তু ভেলাটি উল্টাচ্ছে না । জলরাশির বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে আপন গন্ত্যব্যে । ভেলায় সওয়ার ছয়জন নাবিক যার মধ্যমণি হলেন নরওয়েজিয়ান থর হেয়ারডাল । ইতিমধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে ১০০ দিন অতিক্রম করেছে ৭০০০কিমি । দূর দিগন্তে আবছা সবুজ কি যেন নজরে আসছে । তটরেখা । অর্থাৎ ডাঙা । আনন্দে চিতকার করে উঠল সকলে । পেয়েছে পেয়েছে । অবশেষে গন্তব্য । সকলের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে , প্রাগৈতিহাসিক সরঞ্জাম দিয়ে বানানো ভেলা অবশেষে পাড়ি দিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলসীমানা । হ্যা কন-টিকি অভিযানের কথাই বলছি । ১৯৪৭ সালে থর হেয়ারডেল কন-টিকি ভেলায় চেপে পেরু থেকে প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে পাড়ি জমান । তিনি প্রমান করেন হয়তো এইসব দ্বীপপুঞ্জে মানবসভ্যতার আগমণ ঘটে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এরকমই ভেলায় চেপে । সেই থেকে ইতিহাস ,নৃতত্ব , অ্যাডভেঞ্চার ,দুঃসাহসিক অভিযান সবেতেই কন-টিকি এক অবাক করা নাম । ঐ বিশ্ববিখ্যাত ভেলাটি সহ থর হেয়ারডেলের সুদীর্ঘ বর্ণময় জীবনের অধিকাংশ স্মৃতি সংরক্ষণ করা আছে বিগডয়ের কন-টিকি মিউজিয়ামে । ভিতরে হলে বিশাল ভেলাটি সযত্নে রাখা আছে । বিরাট পালে আঁকা দেবতার প্রতিমূর্তি । এই অভিযানে একমাত্র মহিলা সহযাত্রী ছিল টিয়াপাখি লরিটা । লরিটা মধ্যসাগরে এক গগনছোয়া ঢেউয়ের ধাক্কায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভেলা থেকে ।অভিযানে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিষপত্র দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল রক্তে কতখানি অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থাকলে এরকম দুঃসাহসীক অভিযান করতে পারে । সংগ্রশালার এক পাশে অস্কার পুরস্কার নজরে এল ।১৯৫১ সালে কন-টিকি সেরা তথ্যচিত্র হিসাবে অস্কার জিতে নেয় । একজন মানুষ সারা জীবনে যে কত অসাধ্য সাধন করতে পারে তার উজ্জ্বলতম নিদর্শন থর হেয়ারডেল ।
‘আমুন্ডসেনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ৷ আশা করি আপনারা নিরাপদে ফিরে যাবেন৷” ছোট্ট চিরকুট , লিখেছিলেন সর্বশেষ ভাইকিং বংশধর রোয়াল্ড আমুণ্ডসেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী রবার্ট স্কটকে । মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মজবুত জাহাজ ফ্রাম নিয়ে নরওয়েজিয়ান আমুণ্ডসেন যাত্রা করলেন অচেনা দক্ষিনের পথে । গন্তব্য কুমেরু বিন্দু ।বরফ মহাদেশের একপ্রান্তে ফ্রাম নোঙর করে ।সেখান থেকে কুকুর টানা স্লেজ নিয়ে সঙ্গীদের সাথে রওনা দেন আমুণ্ডসেন ।বরফের রাজ্য পেরিয়ে ১৯১১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর রোয়াল্ড আমুণ্ডসেন সর্বপ্রথম দক্ষিণমেরুতে নরওয়ের পতাকা ওড়ান ।দক্ষিণমেরুর বরফ ঢাকা প্রান্তরে কে আগে পৌঁছাবে- আমুণ্ডসেনের সাথে প্রতিযোগীতায় নেমেছিলেন ব্রিটিশ রবার্ট স্কট । তুষার ঝড়ে হারিয়ে যায় স্কটের দল । ত্রিভুজাকৃতি ফ্রাম মিউজিয়ামে সযত্নে সংরক্ষণ করা আছে বিভিন্ন অভিযানে ব্যবহৃত জাহাজ ও সাজ সরঞ্জাম । অভিযানে যেমন আছে আবিষ্কারের আনন্দ , তেমনি অপ্রত্যাশিত সঙ্কট । ফ্রাম দেখেই বোঝা যায় কি মজবুত ভাবে তৈরি করা হয়েছিল জাহাজটি ।কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে পড়লাম পিচ্ছিল ডেকে । দড়িদড়া প্যাকিং বাক্সের স্তুপ পেরিয়ে ঢুকে পরলা জাহাজের খোলের ভেতর ।অতি যত্নে সেই ঐতিহাসিক অভিযানের আবহ ধরে রাখা হয়েছে সর্বত্র ।নাবিকদের থাকার ঘর ,আসবাব , বাসনপত্র ,যন্ত্রপাতি বিনোদনের জন্য পিয়ানো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর দুর্গমতম তথা নির্জনতম মহাদেশ এন্টার্কটিকা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মানুষগুলো কি অক্লান্ত পরিশ্রমই না করেছিল । মিউজিয়াম দেখে আমরাও ক্লান্ত । আপাতত অসলো ঘোরা স্থগিত। সময় হয়ে গেছে অন্য দেশে যাবার । ফিরে এসে বাকীটা ঘুরবো ।
(চলবে )