উনিশশো ছিয়ানব্বই সালের সল্টলেক সেক্টর ফাইভের কথা ভাবলে “গত শতক” কথাটার মধ্যে যে লম্বা সময়ের ব্যঞ্জনা আছে, সেটা বেশ বোঝা যায়| যাতায়াতের সাধন বলতে অটো আর ২১৫ নম্বর বাস; সন্ধ্যের পরে বাসের বদলে রাস্তায় শেয়াল দেখার গল্প খুব শোনা যেত| দুপুরের খাওয়ার জন্য বিনা দ্বিধায় ঢুকে পড়তে হত “ঝুপস ইন্”-এ; ত্রিপল বা দরমায় ছাওয়া ঝুপড়ি দোকানগুলোতে তিনথাক ইঁটের ওপর কাঠের তক্তা পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল| নোনাজলের আঁশটে গন্ধ ঝেড়ে ফেলে ‘সাদা কলার’-দের জন্য সদ্য সেজে ওঠা সেক্টর ফাইভের সঙ্গে মোটেই মানানসই ছিল না সস্তার এই ভাত-ডাল-তরকারি-ঝোলের ব্যবস্থা।

অফিসে দুপুরে খাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা হল বিবেকবাবুর উদ্যোগে| চিলেকোঠার ঘরটা নাইটগার্ড নিশিকান্তর রান্নাঘর হয়ে গেল| কোনও দিন ডাল-ভাত-আলুপোস্ত, কোনও দিন মাছের ঝোল-ভাত, কখনও বা পরোটা মাংসের আয়োজন করত নিশিকান্ত| ব্যবস্থা ভালই ছিল, তার চেয়েও ভালো ছিল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রকমারি খাওয়ার সুযোগ| অচিরেই অফিসের সবাই নিশিকান্তর খদ্দের হয়ে গেল; তবে বিনা প্রশ্নে নয়, গুণমাণ, দরদাম, নিশিকান্তর বিবেচনার অভাব ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন সহ| দুপুরে একটা বাজতে না বাজতেই রান্নাঘরের দরজায় সবাই জড়ো হত আর নিশিকান্ত একটা একটা করে প্লেট বাড়িয়ে দিত সবাইকে। খুব জরুরি কাজ ফেলে খেতে আসায় সবারই একটু তাড়া থাকত প্লেট হাতে পাওয়ার আগে পর্যন্ত; কাজটায় হাত লাগানোর আগে খাওয়াটা সেরে না নিলে সারাদিনে আর খাওয়ার সুযোগ হবে না। তারপরে অবশ্য প্লেট হাতে পেলে মেনুতে ব্রাহ্মী শাকের অভাবটা টের পাওয়া যেত। টাইম কলের জল বা কেরোসিনের লাইনের মত না হলেও একটু ঠেলাঠেলি বা মন্তব্য চালাচালি হতই; না হলে লাইন দেওয়ার মজা কি রইল! মূল উদ্যোক্তা হিসেবে বিবেকদা একটু সুবিধে নিতেন মাঝে মাঝে।

এমনই একদিন দুপুরে, বিবেকদা হুড়মুড় করে এসে পড়লেন জটলার মধ্যে। তারপরেই ঠেলাঠেলি করে সবার সামনে পৌঁছলেন। আর তারপরেই তাড়া লাগলেন নিশিকান্তকে। পেছন থেকে কেউ বলল – “কি দাদা, এত তাড়াহুড়ো কিসের?”

প্রশ্নের জবাব সবসময় তৈরি থাকত বিবেকবাবুর – “খুব খিদে পেয়েছে রে ভাই; নাড়ি ছেড়ে গেল প্রায়|”

“সে তো আমাদেরও পেয়েছে।”

“সিনিয়র সিটিজেন না হলেও তোমাদের গুরুজন তো বটে|”

হালকা সুরে এমনধারা আরও দুএকটা কথা চালাচালির পরে অবধারিত ভাবে পেছন থেকে প্রশ্ন উড়ে এল – “আপনার কি অফিস এলেই খিদে পেয়ে যায়?”

এবার বিবেকবাবু দার্শনিক ভঙ্গিতে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন – “না ভাই, খিদে পায় বলেই অফিস আসি|” খুব সম্ভবতঃ এর চেয়ে নির্মম সত্যি কথা অধিকাংশ অফিস-করিয়ে মানুষের জীবনে নেই|

তরল আলোচনাতেও বিবেকবাবু সিদ্ধ ছিলেন। একদিন বিকেলে চায়ের সময় হাজারো কথার মাঝে এসে পড়ল ওল-এর প্রসঙ্গ; ম্যাড্রাস, সাঁতরাগাছি, বুনো, দেশী, সবকিছু নিয়ে সুচিন্তিত মতামতে আসর গরম হতে লাগল। গরম আর চুলকুনি একে অন্যের হাত ধরে চলে, সঙ্গে ওল আছেই; তাই কথা বাড়তেই থাকল| অনেক তর্কবিতর্কের পরে বিবেকবাবুর বক্তব্য – “ওল রান্নার সময় বাড়িতে আগে ‘ঢোল কোম্পানির মলম’ দেওয়া হত, এখন ‘বি-টেক্স’টাই বেশি চলে।” এরপরে আর কথা চলেনা তাই চায়ের কাপে ওলের তুফান শেষ হল এখানেই|

সব অফিসেই বিবেকবাবুদের মত দু’একজন থাকেন। খুব কাছ থেকে দেখেও এঁদের ধাঁচটা ঠিক বোঝা যায় না; বুদ্ধিমান, বিবেচক, রসিক, সেয়ানা, করিৎকর্মা ইত্যাদি বহুরকম মতামত বাতাসে ভেসে বেড়ায়| বিপদের দিনে, সে অফিসেই হোক বা পারিবারিক হোক, পাশে থেকে লড়াই দেখলে এঁদের চরিত্রের দুর্বোধ্যতা ভালোভাবে মালুম পড়ে কিন্তু মতভেদ থেকেই যায়|

আমাদের কোম্পানির মত ছোট বা মাঝারি জায়গায় বড়-মেজ-সেজ-ছোট সাহেবদের আসাযাওয়া লেগেই থাকে। এঁদের সম্বন্ধেও সঠিক ধারণা করা মুশকিল; কারণ অধিকাংশই বাঁশবনের শেয়ালরাজার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখেন| কথা শুনলে মনে হয় ‘ফর্বস’ এর পাতা থেকে উঠে আসা কেউকেটা, নেহাৎ না বলতে পারেননি বলে এখানে জয়েন করেছেন| কিছুদিন পর থেকেই ধীরে ধীরে কঙ্কালটা বেরোতে থাকে; ঝুরঝুরে হয়ে ভেঙ্গে পড়ার আগেই অন্য কোম্পানি থেকে হাতে পায়ে ধরে ডেকে নিয়ে যায় – অন্তত তাই শোনা যেত চাকরি ছাড়ার সময়|

যাইহোক সাহেবদের আসাযাওয়া লেগে থাকায় ফেয়ারওয়েল দেওয়াটা আমাদের অফিসের মোটামুটি নিয়মিত ব্যাপার ছিল| সবাইকেই আমরা ছোট্ট একটা কিছু উপহার দিয়ে বিদায় জানতাম; সিঙাড়া-মিষ্টির ব্যবস্থা থাকত| বাতাসে সিঙাড়ার গন্ধ নিয়ে বেশ কয়েকটা লম্বা ‘সামান্য কিছু’ শোনার পর বিবেকবাবুর ছোট্ট ‘অনেক কিছু’ শুনতে ভালই লাগতো|

একবার এক সাহেব চলেছেন ছেলেমেয়ের পাহাড় প্রমাণ পড়াশুনোর কথা ভেবে বাড়ির কাছে চাকরি নিয়ে, পর্বত প্রমাণ সমস্যা পেছনে ফেলে| সবাইকে সবরকমের ‘কথা দেওয়া’র পরে সাহেব কথা রাখার ব্যবস্থা করে উঠতে না পারায় পাওনাদার আর খদ্দের দু’পক্ষই বিরূপ হয়ে আছে| সমাধান না হওয়া কোনও সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা করলে সাহেবের বাঁধা উত্তর ছিল – “আমার জুতোটায় পা গলিয়ে দেখুন, ফোস্কার জ্বালা বুঝতে পারবেন”।

স্বাভাবিক ভাবেই ফেয়ারওয়েল বক্তৃতায়, সেসব কথা উহ্য আছে| সাহেব যে কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাই সেটার প্রমাণ রাখতে ব্যস্ত। সব শেষে বিবেকবাবুর বক্তব্য – “সাহেবের অনুপস্থিতিতে অফিসের কাজ করা মানে মে মাসের দুপুরে খালি পায়ে রাস্তায় বেরনো| ওনার ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলানোর চেষ্টা করলেই পেরেকের খোঁচা আর ফোস্কার জ্বালা বোঝা যাবে|”

আরেক সাহেবের তর্জনগর্জন যত ছিল তত বর্ষাতেন না| সাহেব খুব চাইতেন সবাই তাঁর কাছে এসে সমস্যার কথাগুলো বলুক, সমাধান তিনি করে দেবেন| তাঁর নিজের কথায়, বিপদ-আপদ-সমস্যা থেকে কর্মচারীদের আগলে রাখাই তাঁর কাজ, ২৪ ঘণ্টাই তিনি সবাইকে সাহায্য করার জন্য তৈরি থাকেন| শুরুর দিকে সবাই সাহেবের কাছে যেত সমাধান চাইতে; তবে পরের দিকে কাজের কাজ হত না বলে কেউ মুখ খুলত না| সেই সাহেব চলেছেন বর্ষাকালে| ফেয়ারওয়েলে বিবেকবাবুর দু’কথা – “সাহেব ছিলেন মাথার ওপর ছাতার মতো; সহজলভ্য  ফোল্ডিং ছাতার মতো অফিসের ছোট বড় সবাইকে রোদ-জল থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে গেছেন| প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টিতে ছাতা উল্টে শিক ভেঙ্গে যাওয়ায় এখন গাছতলাই ভরসা|”

আরেক সাহেব কারিগরী ব্যাপারে প্রচন্ড দক্ষ কিণ্তু বাণিজ্যিক ব্যাপারে একেবারেই আনকোরা| লেনদেন-এর খাতা না মেলাতে পারায় অনেক জরুরি কথা সাহেব বুঝিয়ে উঠতে পারতেন না তাঁর উপরওয়ালাদের| শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বলতেন – “বিনিয়োগ থেকে লাভ আসবে, কিন্তু সবাই এমন করে যেন দান করছে|” বিনিয়োগ আর দানের যাঁতাকলে পড়ে সাহেবের অনেক নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা কাজে লাগেনি, সঙ্গে বাণিজ্যিক গচ্চাও ছিল| শীতের সময় ফুলকফির সিঙাড়া আর নলেন গুড়ের সন্দেশ সহ এই সাহেবের বিদায়ী সভার আয়োজন হল| বিবেকবাবু বক্তব্য পেশ করলেন – “শীত পড়েছে, কিণ্তু কাঁথা নেই| লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার আগে খোঁজ নিতে হবে কোথায় কম্বল দান হচ্ছে|”

জুতো, ছাতা, কাঁথার পরে স্বাভাবিক ভাবেই সবার প্রশ্ন ছিল – “মশাই, নিজের ফেয়ারওয়েলে কি বলবেন?”

বিবেকবাবুর উত্তর- “মোল্লা নাসিরুদ্দিন আর তার গাধার কথা| বুড়ো গাধাটাকে মারধর করেও কোনও কাজ হত না| শেষে তাকে বিক্রি করতে মোল্লা গেল নিলামখানায়| নিলামের শেষে দেখা গেল সবচেয়ে বেশী দর ডেকে মোল্লাই কিনে নিয়েছে গাধাটাকে| কারণ মোল্লা নাকি জানতই না গাধাটার এত গুণ আছে; যেগুলো নিলামদার সবিশেষ বর্ণনা করেছিল নিলামের সময়, আর যা শুনে দাম উঠেছিল চড়চড় করে”।

সত্যি বিবেকবাবু দের বোঝা দায়|

 

~ অফিসের গল্প – বিবেকবাবু  ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleStrength Lies Within
Next articleTender Touch of Ma
SUBHAMOY MISRA
জন্ম আর বড় হওয়া অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় হলেও কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর চাকরির সুবাদে এখন হাওড়ার বাসিন্দা। দেওয়াল পত্রিকায় লেখা শুরুর পরে স্কুল কলেজের পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বই পড়া, নাটক দেখা, গান শোনারও নেশা আছে। পেশাসূত্রে লব্ধ অভিজ্ঞতা লেখার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে আছে মনের মধ্যে।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments