আজ আবার মাধুকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। এই নিয়ে বার পনেরো হল। আসে-দেখে চা মিষ্টি খায় ,আর পরে খবর দেব বলে চলে যায়।প্রথম প্রথম মাধুর মা লতিকাদেবী সেই অপেক্ষা য় থাকতেন। এখন বুঝে গেছেন যে, এইরকম বললে আর আসে না। খুব গরিব ঘরের মেয়ে মাধু ওরফে মাধবী। সবাই মাধু বলেই ডাকে। মাধুরা দুই বোন, এক ভাই। ভাই শঙ্কর, ক্লাস নাইনে পড়ে। সবচেয়ে ছোটবোন জবা, ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। মাধু মাধ্যমিক পাশও করতে পারেনি। মাধুর বাবা বিনয় বসু একটি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতেন। মাধুর টেস্ট পরীক্ষার আগের দিনই একটি দূর্ঘটনায় ওনার দুটি পা কাটা যায়। এখন তিনি বিছানায় পড়ে থাকেন। মাধুই সংসার এর কাজ ও বাবার দেখা শোনা করে। বাবার অ্যাক্সিডেন্টের জন্য তার পরীক্ষাটা দেওয়া হয়ে ওঠেনি। মাধুর সব বন্ধুরা এখন কেউ চাকরি করে, কারো বা বিয়ে হয়ে গেছে। মাধুর মা একটি বেসরকারি নার্সিং হমে আয়ার কাজ করে, শিফট এর ডিউটি । মাধু সকাল বিকাল দুবেলা বাচ্চাদের পড়ায়। বাচ্চাগুলোও গরিব ঘরেরই ছেলে-মেয়ে। কারো বাবা রিক্সা চালায়, কেউবা দিন মজুরি করে। তাই ওরা যা টাকা দেয় মাধু তাই নেয়। মাধু নিজেও পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো ছিল। এখনও স্কুলে দিদিমনিরা ওর নাম করে। বাবার দুর্ঘটনা জন্য পরীক্ষা দিতে না পারায় ভেবেছিল পরের বার প্রায়ভেটে পরীক্ষাটা দিয়ে দিবে। অর্থের অভাবে আর হয়ে ওঠেনি। ভাই বোনের পড়াশোনা নিজেই দেখে মাধু। কারন টিউশনের টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ওদের নেই। আজকাল মাধু খুব হীনমন্যতায় ভোগে। পথে ঘাটে বান্ধবীদের সাথে দেখা হলে অস্বস্তি তে পড়ে যায়। এখন কি করছিস? বিয়ে করছিস না কেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে ওর অস্বস্তি হয়। তাই বান্ধবী দের দেখতে পেলে ও এড়িয়ে যায়। এখন ওদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ বাইরের লোককে একথা বলতে ওর খুব সংকোচ হয়। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের কিছু টাকা পেয়েছিল। তার বেশিরভাগটাই বাবার চিকিৎসায় খরচা হয়ে গেছে। এবারকার সম্বন্ধ এনেছেন পারার এক দিদা। একদিন বাড়িতে এসে গল্প করছিলেন মাধুর মায়ের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গেই জিজ্ঞেশ করেন, “হ্যাঁগো, তোমার মাইয়াডার বিয়া দিবানা?” মাধুর মা বলেন, “অনেক তো দেখছি মাসিমা, কেউ পছন্দ করেনা, কারো বা পছন্দ হয় তো দেনা পাওনাতে আটকে যায়। বাড়ির অবস্থা তো দেখছেন!”, “তা কেমন পোলা চাও?” লতিকাদেবী ঝট করে উত্তর দেন, “মেয়েটাকে খাওয়াতে পরাতে পারলেই হল। এখানে তো দু’বেলা ভালো করে খাওয়াও জোটেনা। তার ওপর ওর বাবার চিকিৎসে আছে। ছেলে মেয়ে দু’টার পড়াশোনা আছে।” সব শুনে দিদা বললেন, “হগল কথাই শুনলাম। আমি একটা কথা কই শোনো। আমার নজরে এক পোলা আছে। তা পোলার আগেও একবার বিয়া হইছিল। একডা চার বছরের মাইয়া রাইখ্যা বউডা মইরা গেছে। হেই পোলার এক বিধবা মা আছে। সংসার এ আর কেউ নাই। কিছু জায়গা জমি আছে। পোলা হাটবারে দোকান করে। সায়া, ব্লাউজ, ছোটো পোলাপানদের জামা কাপর বেচে। তা পোলার বয়সও হইছে। তা চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশ তো হবেই। ওদের কোন দাবি দাওয়া নাই। আমাদের মাধুর ও তো বয়স কম হইল না।” লতিকা দেবী নীরবে মাথা নাড়ান আর সম্বন্ধটাতে সায় দেন। আজ তাদেরই আসার কথা। মাধু আজ খুব ভোরে উঠেছিল। তারপর ঘরের কাজকর্ম করে টিউশন পড়িয়ে এখনি রান্না ঘরে ঢুকল। সকালে বাবা ছাড়া বাড়ির সবাই চা মুড়ি খেয়েই প্রাতরাশ সারে।আজকে লতিকাদেবী ছুটি নিয়েছেন। প্রতিদিনের মতো আজও মাধু বাবার জন্যে দুটো রুটি বানিয়ে দিল। বাবাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে জলখাবারের পরে। আজকাল বাবা রাতে ভালো করে ঘুমায়না। “কি এত চিন্তা করো বলতো?” মাধুর প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেন, “মাধুমা, আমার জন্য তোদের জীবনটা এমন হয়ে গেল!” বিনয়বাবুর পাণ্ডুর গালে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নিজের অজান্তেই। মাধু পরম মমতার সাথে আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে বলে, “বাবা চিন্তা করছ কেন? ভগবান তো সব কিছু ভেবেই রেখেছেন। তুমিই তো বলো তার মর্জি ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না। তিনি যা করেন সব মঙ্গলের জন্যই করেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।” রান্না তে আজ ভাত, পাতলা করে মুসুরির ডাল, পুঁই চচ্চড়ি, আলু ও কুমড়ো দিয়ে রাঁধল মাধু।আজকাল বাবার রাত্রে ঘুম হয়না। বাবার ঘুমের জন্য পাড়ার এক ডাক্তার যিনি বাবাকে দেখেন, সবাই যাকে নরু ডাক্তার নামেই চেনে, উনি সব গরিবেরই ডাক্তার। যে যা দেয় উনি তাই নেন। বাবাকে উনি একদিন দেখে বললেন, দিনের পর দিন ঘুম না হলে তো শরীর খারাপ হয়ে যাবে। তারপর কি চিন্তা করে একটা ওষুধ লিখে দিয়ে বলেন দোকান থেকে কিনে নিতে। ঐ ওষুধই মাধু দু-একদিন পরপর বাবাকে রাতে খাওয়ায়। মাঝে-মাঝে লতিকাদেবী সংসার এর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে থাকেন, বলেন মেয়েটাকে নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখো। একপয়সাও জমা করোনি বিয়ের জন্য। কেউ যদি বিনি পয়সায় নেয় তবেই দিতে পারবো। সাতকুলে কেউ নেই সাহায্য করার মতো। আজকাল যারা মাধুকে দেখতে আসে সবাই বয়স্ক মানুষ। তাও তারা বাড়িতে এসে ঘরের চারিদিকে দেখে, কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে, জীর্ণ আসবাবপত্র, হাতে সেলাই করা বেডকভার কেটে জানালা দরজার পর্দা বানানো হয়েছে। এসব দেখে তারা আর্থিক ব্যাপারটা বুঝে নেয়। তখন দেখাটা যেন গৌণ হয়ে যায়, মাধু সব বোঝে আর ভাবে এদের অবস্থা তো অত খারাপ নয়, তবে কেন ওরা পন চায়? আজকাল মাধুর মাঝে মাঝে খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয়। ও জানে, ও মরে গেলে একটা পেট কমবে, কিন্তু বাবার খুব কষ্ট হবে। বাবাকে কে দেখবে? মাধুর মা মাধুকে কখনো কখনো বলেন যে মরতে পারিস না? কত লোক মরে, তোর মরন হয়না। সারাজীবন গলগ্রহ হয়ে থাকবি লজ্জা করেনা? মাধু বোঝে মা এটা বহু দুঃখে বলে। তবুও ওর খুব কান্না পায়। এমন তো নয় যে মাধু দেখতে খুব খারাপ। মাধুর রঙ কালো বলা হলে ভুল হবে। মাজা রঙ, চোখ, নাক, মুখ, সবই ভালো। মাথা ভর্তি চুল ও আছে। মাঝারি গড়ন তবুও কেন ওকে পছন্দ করেনা, সবাই টাকাই দেখে। পাড়ার কিছু বখাটে ছেলে ওকে দেখে পেছনে লাগার চেষ্টা করেছিল। মাধু পাত্তাই দেয়নি। বাজারে গেলে মাঝে মাঝে দেখে পাড়ার এক মস্তান গোছের ছেলে মাধুকে ফলো করে। ওর একটা হাত নেই, তাই ওকে হাত কাঁটা জগা বলেই সবাই ডাকে। অনেকে ওকে বেশ ভয়ও পায়। ছেলেটা নাকি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। মাঝে মাঝে জেল ও খেটে আসে। একদিন মাধুকে একা পেয়েই ওর পথ আটকায়। তারপর বিনীত হয়ে বলে, “মাইরি বলছি মাধু, তোমাকে আমি হ্যেব্বি ভালবাসি, বিয়েও করতে চাই। তুমি বললেই আমি সব রকম খারাপ কাজ ছেড়ে দেব।” সেদিন মাধু কোন রকমে পালিয়ে বেঁচেছিল। তারপর থেকে শঙ্করকে ছাড়া কোথাও বেরোয়না। ভাইকে সাথে দেখতে পেলেই ছেলেটা দূর থেকে ওকে দেখে, কাছে আসে না। মাধুর মা ডাক দিলেন , “হ্যাঁরে বেডকভারটা বদলাতে হবে তো কোথায় আছে? “ মাধু বাস্তবে ফিরে আসে। আজ পাশের বাড়ির কাকিমার থেকে একটা তাঁতের শাড়ী চেয়ে এনেছে। পাত্রপক্ষের সামনে এটা পরেই বসবে। মাধু যখনি ঐ কাকিমার কাছে শাড়ী চেয়েছে , খালি এই গোলাপি শাড়ীটাই দেবে। কাকিমার কাছে একটা হলুদ রঙের তাতের শাড়ী আছে। মাধুর ওটা খুব পছন্দ কিন্তু চাইতে লজ্জা করে। শাড়ীটা বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। তবুও দেবার সময় বারবার বলে,“হ্যাঁরে যত্ন করে পড়বি ছিঁড়ে না যেন।” মাধুর খুব খারাপ লাগে। কাকিমার আলমারি ভর্তি সুন্দর সুন্দর শাড়ী তাও মনটা এইরকম। মাধুর মা মিষ্টি আনিয়েছে পাড়ারই এক দোকান থেকে। মাধুর খুব খারাপ লাগে ওদের এই মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য যে টাকাটা খরচা হচ্ছে তাতে মাধুদের ঘরে দু’দিনের সব্জির খরচা উঠে আসে। কিন্তু বারে বারে এইরকম খরচ করেও কিছুই লাভ হয়না। মাধু খুব সুন্দর করে সাজলো। গোলাপি শাড়ীর সাথে কালো ব্লাউজ, আর ইমিটেশনের কানের দুল ও চেন পড়ল। হাতে দু’গাছি চুড়ি, কপালে ছোট্ট গোলাপি টিপ, চুল একটা বিনুনী করে বাঁধল। নিজেকে ভাল করে ছোট্ট আয়নাটায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, বড় মিষ্টি দেখাচ্ছে। মাধু কাল রাতে খুব কেঁদেছে আজকের জন্য। সে ঠিক করে নিয়েছে, যদি আজ পছন্দ না হয়, তবে কি করবে। অজান্তেই দু‘ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গালে। ওরা এসে গেছে। বাবার ঘর থেকেই মাধু ওদের আওয়াজ পাচ্ছিল। ছোট্ট মেয়েটা দৌড়ে এসে মাধুর হাথ ধরে টানছে। মাধুর খুব ভালো লাগছিল মেয়েটাকে। বড় মিষ্টি স্বভাবের। মেয়েকে দেখার জন্য ওরা ওই ঘর থেকেই তাগাদা দিচ্ছে। মাধুর মা এসে বলে গেলেন, “আয় এ ঘরে।” বাচ্চা মেয়েটা হাত ধরে ওই ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাধুকে। যেতে যেতেই মাধু আড়চোখে বাবার টেবিলে রাখা ঘুমের ওষুধটাকে একবার দেখে নিল।