PART-2
আজ শনিবার । কাল আমি আর দাদা যাব মিস্টার সেনের বাড়ি । এর মধ্যে দাদা অনেকবার বেরিয়েছিল বাইরে খোঁজ-খবর নিতে । একদিন বারাসাত ও গেছিল শুনলাম, কিন্তু মিস্টার সেনের বাড়ি নয় ।
রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমার ঘরে এসে দাদা বলল, ‘ঘটনাটার অন্ধকার পরিষ্কার হয়ে যাবে বুঝলি । কয়েকটা খটকা মনে থাকছে কিন্তু আশা করি সেগুলো খুব একটা বেশি ঘটনার হেরফের করতে পারবে না । তুই কাল তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিস । কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বো । ওকে আর বেশি প্রশ্ন করলাম না । আমিও কালকের জন্য সাসপেন্স টা আর নষ্ট করতে চাইলাম না । মনের মধ্যে অনেক সন্দেহ ও কৌতূহল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন আমার বেশ তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গলো । উঠে দেখি দাদা বেশ খোশমেজাজে চা খাচ্ছে । মানে দাদা প্রস্তুত । আমরা রেডি হয়ে মিস্টার সেনের বাড়ি পৌঁছালাম সাড়ে দশটা নাগাদ । মিস্টার সেনের বাড়ি ঢুকতেই বসার ঘরে দেখলাম নতুন মুখ । শুনলাম তখনও অনুপ রায় আসেননি ।
দাদা আর আমি চেয়ারে গিয়ে বসলাম । রামুদা গরম কচুরি আর চা নিয়ে এলো আমাদের জন্য । সেসব না খেয়াল করেই দাদা নিজের মতন প্রশ্ন শুরু করে দিল, ‘নমস্কার,আপনি কি…(বলে লম্বা একটা টান দিয়ে) ধৃতিমান?
সামনের ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ! আমি ধৃতিমান গাঙ্গুলী’
বেশ সুপুরুষ এই ধৃতিমান গাঙ্গুলী, বয়স ওই তিরিশ এর কাছাকাছি হবে, সাদা-কালো চেক শার্ট আর ব্লু জিন্স এর সাথে যত্ন করে ছাঁটা দাড়ি । লম্বায় দাদার মতো হবে।
ধৃতিমান বাবু নিজে থেকেই বললেন, ‘আমি একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে সেলস এক্সিকিউটিব হিসাবে কাজ করি।’
‘রনজয় বাবুর মৃত্যুর রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?
ধৃতিমান স্মার্টলি বললেন, ‘সেদিন রাতে আমি শহরের বাইরে ছিলাম কিছু আর্জেন্ট কাজ পড়ে গিয়েছিল।’
দাদা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি জানতেন যে সেদিন রাতে রনজয় বাবু আপনাকে হুমকি দেওয়ার জন্য আসছিলেন?’
ধৃতিমান বাবু বললেন, ‘না সে খবর আমি পরে পাই । ইনফ্যাক্ট আমি পৌলোমী কে অনেকদিন আগে থেকেই বলেছিলাম এই সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কথা কিন্তু ও শোনেনি, ও ছাড়তে পারেনি আমায় । বাধ্য হয়ে আমি কথা বলা বন্ধ করে দিই তারপর শুনি এই ঘটনার কথা।
‘আপনি কি তাহলে পৌলোমী দেবীকে ভালোবাসতেন না?’ হঠাৎ দাদার এই প্রশ্নে একটু ঘাবড়েই যান ভদ্রলোক, তারপর নিজেকে সামলে বলেন, ‘অবশ্যই বাসতাম । কিন্তু আমি চাইনি আমার জন্য ওদের ঝামেলা হোক।
‘ও আই সি! ধন্যবাদ মিস্টার গাঙ্গুলী । আপনি এবার আসতে পারেন আমার যা জানার তা জানা হয়ে গেছে।’
মিস্টার গাঙ্গুলী নমস্কার জানিয়ে উঠে গেলেন । দাদা ধৃতিমান বাবুর সাথে কথা বলার মাঝেই অনুপ রায় এসে গেছেন।
এরপর ঘরে এলেন মিস্টার অনুপ রায় । দেখে বেশ শান্ত প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হল । স্কাই ব্লু শার্টের সাথে ব্ল্যাক প্যান্ট । ফর্মাল ভাবে চুল দাড়ি কাটা । দেখেই বোঝা যায় জেন্টলম্যান।
দাদা অল্প হেসে বলল, ‘বসুন মিস্টার রায় । আপনারই তো অভাব বোধ করছিলাম এতদিন।
‘আসলে অফিসের কিছু কাজে ব্যস্ত ছিলাম এই কদিন । তাই সময় হয়ে ওঠেনি।’ মিস্টার রায় বললেন।
‘আচ্ছা! মিস্টার রায় আপনার সাথে মিস ঋদ্ধিমার সম্পর্কটার এই যে নতুন এক দৃষ্টান্ত, সে ব্যাপারে আপনার কি বলার আছে? যতদূর জানি আপনি রনজয় বাবুর বন্ধু।’
অনুপ রায় একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘ঋদ্ধিমা কে প্রথম আমি দেখি আমার বন্ধু অর্থাৎ রনজয়ের শেষকৃত্যের দিন । সেদিন বেশি কথা হয়নি ওর সাথে । তারপর ওর সাথে আবার দেখা রূপসার শেষকৃত্যের দিন । মানসিক ভাবে ঋদ্ধিমা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছিল । আমি তখন ওকে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করি সেই থেকেই আমাদের এই বন্ধুত্ব।’
দাদা একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করল, ‘একটা ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করছি মিস্টার রায় । আপনাদের সম্পর্কটা ঠিক কতটা গভীর?’
মিস্টার রায় বেশ থতমত খেয়ে বললেন, ‘ঋদ্ধিমা সাথে যেদিন আবার দেখা হয় ও দেখি দৌড়াতে দৌড়াতে আমার কাছে এলো। এসে বলল “তোমার খোঁজ কতদিন ধরে করছি, তোমার কোন ধারনা আছে? সেদিন শেষবারের মতো একবার দেখাও করলে না।” আমি কিছু বুঝতে না পেরে বলি “আমি তোমার খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু তুমি মনে হয় খুব ব্যস্ত ছিলে বলে আর আমি সেরকম অপেক্ষা করিনি।” তারপর যা হলো সেটা আমার কাছেও অনেকটা গল্পের মতো মিস্টার ব্যানার্জি । ঋদ্ধিমার মুখে শুনি ও নাকি আমায় ভালোবেসে ফেলেছে । এতদিন অনেক খোঁজ করেছে কিন্তু কোনো খোঁজ পায়নি । তার পরেই ওর সাথে আমার বন্ধুত্বটা বারে এবং এখন ব্যাপারটা অনেকটা প্রেমের পর্যায়ে পড়েছে । কিন্তু এর সাথে খুনের কি সম্পর্ক, মিস্টার ব্যানার্জি?
দাদা একটু হেসে বলল, ‘ধৈর্য্য রাখুন মিস্টার রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন । আগে সকলকে ঘরে একসাথে হতে দিন।’
দাদা উঠে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘গেট রেডি অ্যাসিস্ট্যান্ট । উই আর অ্যাবাউট টু বিগিন দ্যা শো।’
তারপর দাদা রামুদা কে বলল সবাইকে একসাথে গেস্ট রুমে আসতে। মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে সবাই এসে উপস্থিত । দাদা দেখে নিল সবাই উপস্থিত কিনা…তারপরে শুরু হলো দাদার সেই মুগ্ধ করা কেস সলভিং যা আমি সারা জীবনে ভুলবো না।
দাদা উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, ‘প্রথমেই সকলকে জানিয়ে দিই, যেহেতু আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, ঘটনার তদন্ত চলাকালীন আমি পুলিশের সাথে যোগাযোগ সাধারণত রাখি না। কিন্তু তদন্ত শেষে আমি কিন্তু পুলিশকে জানাতে বাধ্য।
তখনই ধনঞ্জয় বাবু একটু জোর গলায় বলে উঠলেন, ‘এর মধ্যে পুলিশ কেন? পুলিশ তো নিজের কাজ করছে? পুলিশকে কি না টানলেই নয়?’
এতদিন ভদ্রলোকের যা ব্যাবহার দেখেছি এটা তার বিপরীত। দাদা বলল, ‘আহা! আপনি এত অধৈর্য্য হচ্ছেন কেন মিস্টার সেন? আপনার মনে হচ্ছে পুলিশের আশঙ্কাটা একটু বেশিই।
ধনঞ্জয় বাবু খুব রেগে গিয়ে জোর গলায় বলতে লাগলেন, ‘কি যা তা বলছেন মিস্টার ব্যানার্জি, আমার আবার পুলিশের আশঙ্কা কেন থাকবে? ভুলে যাবেন না আপনাকে আমিই ডেকেছি।’
দাদা এবার নিজের পুরো মেজাজে বলল, ‘আস্তে মিস্টার সেন আস্তে! এখনই এত উত্তেজিত হলে হবে?’
আমরা সবাই আশ্চর্যের মত পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করছি কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না । দেখি মিস্টার সেন পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছছেন।
তখনই দাদা বলে উঠল, ‘ঘাম মোছার অভ্যাসটা করে নিন মিস্টার সেন জেলে গিয়ে আবার আপনাকে সেটাই করতে হবে।’
‘কি উল্টোপাল্টা বলছেন মিস্টার ব্যানার্জি? আপনি জানেন আপনি কার সাথে কথা বলছেন?’
দাদা দৃঢ় গলায় বলল, ‘হ্যাঁ জানি মিস্টার সেন । একজন নেতা যে দিনের বেলায় ভালো মানুষের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায় এবং রাতের বেলায় যিনি ড্রাগস-এর স্মাগলিং দলের মাথা হয়ে কাজ করে । যিনি কিনা নিজের পলিটিক্যাল ইমেজ বাঁচানোর জন্য নিজের ছেলের খুন করতে পারে, তাও আবার বৌমা সাথে হাত মিলিয়ে । আমি লোক লাগিয়ে ছিলাম আপনার ওপর নজরদারি করার জন্য । যেমন ভাবা ঠিক তেমনি খবর চলে এলো । প্রায় রাতে আপনি বের হন এবং গিয়ে ওঠেন রামকৃষ্ণ মঠের পিছনে যে পুরনো মিলটা আছে সেখানে । আমার লোক এও খবর দেয় যে সেখানে যাদের দেখেছিল তারা নাকি এই এলাকার সব থেকে বড় এবং সাংঘাতিক গুন্ডাদের দল যাদের চারিদিকে এই দুনম্বরি ব্যবসার বিখ্যাত জাল ছড়িয়ে আছে । আশা করি আপনি সেখানে হাওয়া খেতে যান না মিস্টার সেন।’
মিস্টার সেন চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন এবং বাড়ির প্রতিটা সদস্যের মুখ সাদা হয়ে গেছে । তখনই পৌলোমী দেবী বলে উঠলেন, ‘এসব আপনি কি বলছেন? আমি এর মধ্যে কোথা থেকে এলাম? আমাকে আপনারা ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।’
দাদা তাকে থামিয়ে বলল, ‘আপনি চুপ করুন পৌলোমী দেবী, আপনি জানতেন না সেদিন ধৃতিমান শহরে ছিল না? তাও আপনি রনজয়কে সেই খবরটা দেন নি কারণ আপনি তো আগে থেকেই মিস্টার সেনের সাথে হাত মিলিয়ে ফেলেছিলেন । মিস্টার সেন বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলেকে দিয়ে আর এই দুনম্বরি ব্যবসা চালালে ওনার নাম বেরিয়ে আসবে এবং ওনার পলিটিক্যাল ইমেজ যে নষ্ট হয়ে যাবে । তাই তিনি সেদিন রাতে রনজয় বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের লোকদের খবর দিয়ে দিলেন রাতের মধ্যে কাজ সেরে ফেলার জন্য । আর ঠিক তাই হলো।রাতের মধ্যে কাজ সমাপ্ত এবং পরের দিন খবর ছড়িয়ে গেল রাজনৈতিক রেষারেষির ফলে অন্য দলের লোকেরা নাকি রনজয়কে মেরে ফেলে।’
আমি অবাক হয়ে দাদার কথা শুনছিলাম আর শুধু ভাবছিলাম একটা মানুষ এতটা কি করে নিচে নামতে পারে? এদিকে দাদা এবার চেয়ারে বসে বলল, ‘এখানেই শেষ নয় মিস্টার সেন । রূপসা হয়তো আপনাকে কথা বলতে শুনে নিয়েছিল । তাইতো ডাক্তার দেখিয়ে নতুন কড়া ডোসের ওষুধ খাওয়াতে লাগলেন যাতে মেয়েকে লোকে পাগল ভাবে এবং ওর কথা কেউ বিশ্বাস না করে । আমি ডাক্তারের কাছে খবর নিয়ে দেখেছি যে ওর ওষুধ পাল্টানো হয়েছে আর সেই শিশিটা আপনার ওষুধের সাথে হুবহু মিলে যায় । আর আপনিও তো এমনই অ্যালজাইমার এর ওষুধ খান । পাল্টাপাল্টি করাটা আপনার কাছে কোন ব্যাপার না। একবার পাল্টে ফেললে কেউ আর সন্দেহ করবে না । আমি সেটা সেদিন আপনার ঘর সার্চ করতে গিয়ে খেয়াল করি । আপনার টেবিলের নীচে পড়ে আছে খালি অ্যালজাইমার এর ওষুধের বোতল । তখনই আমি সন্দেহ হয় । আমি গিয়ে রূপসার ঘরে সকলের নজর এড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া ওষুধের শিশি থেকে একটা ওষুধ তুলে নিই । পরে খোঁজ করে দেখি হ্যাঁ, দুটো এক ওষুধ । বুঝলাম এ আপনারই কাজ।’
ধনঞ্জয় বাবু আর স্থির থাকতে পারলেন না, ‘হ্যাঁ..হ্যাঁ..হ্যাঁ, আমি মেরেছি রনজয়কে এরকম ভাবে এসব কাজ চালালে আমার ইমেজটা নষ্ট হয়ে যেত এবং ও অনেকবার আমাকেও ধমক দিয়েছিল ঋদ্ধিমাকে বারণ করার জন্য যাতে ও কোন খবর বাইরে না বের করে । কিন্তু আমি তো আর সেটা কখনোই করতে পারিনা সন্দেহ এসে পড়তো আমার উপর । তখনই আমি পৌলোমী সাথে কথা বলি ও আমার কথায় রাজি হয়ে যায়।
দাদা বলল, ‘এতে যে আপনাদের দুজনেরই লাভ । আপনার ইমেজও বজায় থাকল এবং পৌলোমী দেবীর অবৈধ সম্পর্কের কাঁটাও দূর হয়ে গেল । কিন্তু ধৃতিমানও যে সম্পর্ক ভেঙে দিলো এই খবর শুনে যাতে ওর উপর সন্দেহ না পরে । হাসব্যান্ডও গেল এবং প্রেমিকও।’
পৌলোমী দেবী কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পরল । তারপর মিস্টার সেন আবার বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ আমি আমার মেয়েকে পাগল বানানোর চেষ্টা করেছিলাম ঠিকই কিন্তু আমি ওর খুন করিনি।’
‘জানি মিস্টার সেন আপনি আপনার ছোট মেয়েকে মারেননি । রূপসার খুনি যিনি, তিনি খুব একটা সুস্থ মস্তিষ্কের নন, এদিকে আপনি যে বড় চালাক।’ দাদার কথায় ঘরের নিস্তব্ধতা যেন আরও বেড়ে গেল।
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘সুস্থ মস্তিষ্কের নন, বলতে?’
‘ঋদ্ধিমা ম্যাডাম বাকিটা আপনি বলবেন না আমি বলব?’
ঋদ্ধিমা তোতলাচ্ছিল, ‘মানে আমি কি বলব আবার? আমি কেন আসছি এর মধ্যে?’
দাদা বলল, ‘আচ্ছা তার আগে একটা প্রশ্ন আছে আপনার জন্য । আপনি জীবনে সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসেন?’
‘হঠাৎ এসব প্রশ্নের কোন মানেই হয়না মিস্টার ব্যানার্জি।’
দাদা মজার সুরেই বলল, ‘আহা! আপনি বলুন না । আমি আসছি এরপর মূল অধ্যায়ে।’
একটু সময় নিয়ে ঋদ্ধিমা সেন বললেন, ‘ছোটবেলায় মাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতাম।’
‘খুনও?’ বেশ কৌতুহলী গলায় দাদা বলল।
‘মানে? এসব আপনি কি বলছেন মিস্টার ব্যানার্জি । প্রচন্ড রেগে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ঋদ্ধিমা ।
দাদা শান্ত ভাবে বলল, ‘আপনারও দেখছি মেজাজ আপনার বাবার মতনই হয়েছে । থাক আপনাকে কিছু বলতে হবে না । আমি বলছি বাকিটা।’
দাদা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, ‘ইটজ্ আ কেস অফ সাইকো লাভ কিলিং, মিস ঋদ্ধিমা সেন । আপনি আপনার ছোট বোনকে খুন করেছেন । সেদিন রাতে আপনি অফিস থেকে আটটা নাগাদ বেরননি । আপনি বেরিয়েছিলেন সাতটা নাগাদ । আমি আপনার অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখেছি । আপনি আটটার মধ্যে বাড়ির গলির মুখে এসে অপেক্ষা করেন । আর আপনার ভাগ্য সেদিন এতটাই ভাল ছিল যে লোডশেডিং হয়ে গিয়েছিল আর তাতে আপনার কাজেও আরও সুবিধে হয়েছিল । আপনি যথারীতি অপেক্ষা করছিলেন আপনার বোনের জন্য কারণ আপনি জানতেন সেদিন রামুদা আনতে যাবে না এবং এটাই ছিল আপনার মোক্ষম সুযোগ । তারপর রূপসা আসতেই আপনি অতি সূক্ষ্ম ভাবে পিছন থেকে এসে মাথায় এত জোরে মারলেন যে আপনার বোন বেশিক্ষণ চিৎকার করারও সুযোগ পায়নি । কিছুক্ষণের মধ্যেই সে প্রাণ হারায় এবং আপনি গন্তব্য স্থান থেকে উধাও।’
এসব শুনে ঋদ্ধিমা সেন দেখি প্রায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছে । পুরো ঘটনাটা যে এরকম ভাবে ধরা পড়বে সে আশা করেনি । রামুদা জল নিয়ে এলো, তখনই হঠাৎ অনুপ রায় বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কিসের জন্য এই খুন, মিস্টার ব্যানার্জি?’
দাদা একটু হালকা হেসে বলল, ‘কারণটা যে আপনি মিস্টার রায়।’
হোয়াট? বেশ আশ্চর্যের সাথে চেঁচিয়ে উঠলো অনুপ রায়।
দাদা বলল, ‘না এ কোন প্রতিশোধের আগুন, না কোনও সম্পত্তির ভাগ । এ যে এক ভালোবাসার খিদে মেটানোর জন্য করা হত্যা।’
আমি নেহাত চেয়ারে বসে সব শুনছিলাম, দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় আমিও অজ্ঞান হয়ে যেতাম ।
দাদা বলতে থাকলো, ‘তাহলে একটু খোলসা করি ব্যাপারটা মিস্টার রায় । ঋদ্ধিমার আপনাকে পছন্দ হয় রনজয়ের শেষকৃত্যের দিন এবং সেদিন তিনি ব্যস্ত থাকায় আপনার খোঁজ নিতে ভুলে যান । কিন্তু তার যে আপনাকে বেজায় পছন্দ হয়ে যায় । অনেক চেষ্টা করেও আপনার খোঁজ পায় না সে । তাই তিনি মাথা খাটিয়ে এই চিন্তায় পৌঁছান যে, আপনাকে পেতে গেলে দরকার আবার সেই একই দৃশ্যকল্প যেখানে আপনাকে প্রথম দেখে ছিলেন , তাই তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, আবার একই দৃশ্যকল্প তৈরি করতে হবে, তার জন্য দরকার মৃত্যু । যেমন ভাবা তেমন কাজ । সবচেয়ে দুর্বল ছিল রুপসা, যাকে হত্যা করলে সন্দেহ গিয়ে চাপবে বাবার উপর, কিন্তু একটা ছোট ভুল যে তিনি করে ফেলেছেন । সমস্ত কিছু ঠিকভাবে করলেও একটা জিনিস তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন, তা হল মিস ঋদ্ধিমার রুমালে লেগে থাকা রক্তের দাগ, যেটা আমি সেদিন খেয়াল করি যখন আমি ঋদ্ধিমার ঘরে যাই এবং দরজার পাশে ফেলে রাখা জামাকাপড় গুলো লক্ষ্য করি । দেখে বুঝলাম বেশ রিসেন্ট দাগটা । সন্দেহ জাগে সেদিনই তারপর তো একে একে শুধু সরল গুলো মেলানো।’
এরপর পুলিশ এসে নিজেদের মতন কাজ করতে লাগল । দাদা অলরেডি খবর দিয়ে রেখেছিল । ওরা আসার পর দাদা নিজের পারিশ্রমিক নিয়ে বেরিয়ে চলে এলো । আমি আর দাদা বাড়ির পথে রওনা দিলাম ।
আমাদের গলির মোড়ে একটা চায়ের দোকানে বসলাম আমরা । দাদা দুটো চা অর্ডার করল । চা খেতে খেতে দাদার এই বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না, বলেই ফেললাম, ‘ওয়ান মোর কেস অ্যাডেড টু দ্যা লিস্ট নাকি?’
দাদা হেসে বলল, ‘সে সব ঠিক আছে । কিন্তু বড্ড খারাপ লাগছে রুপসার জন্য, বেচারী মেয়েটা এত কিছুর মধ্যে প্রাণ হারালো।’
আমারও মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল কথাটা ভেবে, এতক্ষণ খেয়ালই করিনি কথাটা । দাদা আবার বলে উঠলো, ‘ভালোবাসা, এ যে এক নিষ্ঠুর খেলা রে । কেউ খেলে প্রাণ নিয়ে কেউ আবার হৃদয়ে নিয়ে । দিনের শেষে ভালোবাসার জন্য কত মানুষ মারা যাচ্ছে জানিস, শুধু জীবিত থাকে শরীরটা।’
হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বাড়ি চলে এলাম।
ও হ্যাঁ! আমার নামটাই তো বলা হয়নি.
নমস্কার,
আমি,
অনুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
৫ই এপ্রিল,২০২০
~ অন্তর্ঘাতী কে? ~