সেদিনের সেই রোদ ঝলমলে সকালটা আমাদের আটজনের কেউই তাদের জীবদ্দশাতে কখনোই ভুলতে পারবে না। সেই সময়টাতে, সকাল দিকে হালকা হালকা শীতের ছোঁয়ার অনুভূতি লাগতে শুরু করছে। রদ্দুরটা মিষ্টি না লাগলেও রূদ্র রূপটা নেই। দিনটা ১৯৮৪ সালের  ৩১শে অক্টোবর। লোকে এই দিনটাতে ভারতের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিজের দেহরক্ষীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মৃত্যুর কথা মনে রাখে, কিন্তু ঐ দিনের একরাশ দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে আমাদের আট জনের মনিন্দ্রগড় যাত্রার কথাটাই আমি বেশি করে মনে রেখেছি।
কুঊঊ —- ঝিকঝিক আওয়াজ করা স্টীম লোকোমোটিভের ভারতীয় রেলের রুপকথার যাত্রা তখনো পুরোপুরি থেমে যায়নি, যদিও স্টীম লোকো তুলে দেবার সিদ্ধান্ত ভারত সরকারের তরফে তখন নেওয়া হয়ে গেছে। সেই ক্রান্তিলগ্নে কোনো এক বসন্তের শুরুতে দক্ষিণ পূর্ব রেলওয়ে তাদের স্টীম লোকোমোটিভ সংরক্ষণের জন‍্য এবং সরাসরি সুপারভাইজার পদে কাজ করার জন‍্য জনা চল্লিশ জুনিয়র মেকানিকাল ইন্জিনীয়ার নিয়োগ করলো। একবছর খড়গপুরে শিক্ষানবীশির পরে কর্মসূচির ভিত্তিতে তাদেরকে বিভিন্ন ডিভিশনে বাঁটোয়ারা করে পরবর্তী এক বছরের জন‍্য “অন জব ট্রেনিংয়ে” তাদের জন‍্য নির্দিষ্ট  ডিভিশনে পাঠিয়ে দিল।আমরা আটজন মানে সেই আটজন যারা বন্ধুবান্ধব, ঘরবাড়ি ও পরিবার ছেড়ে রেলের “অন জব ট্রেনিং” সময়ের পুরো একটি বছর বিলাসপুর ডিভিশনের যথাক্রমে ভিলাই, বিলাসপুর, মনিন্দ্রগড় ও স্যাডোলে একই সঙ্গে একই ঘরে কখনো বা মাটিতে শুয়ে, কখনো বা ক‍্যাম্প খাটে শুয়ে রাত কাটিয়েছি। বতর্মানে এই জায়গাগুলো ছত্রিশগড় রাজ‍্যের মধ‍্যে পড়লেও সেইসময় এই জায়গাগুলো মধ‍‍্যপ্রদেশ রাজ‍্যের অন্তর্গত ছিল।বাংলার জল, মাটি ও আবহাওয়ার  সাথে মধ‍্যপ্রদেশের আবহাওয়ার বিস্তর ফারাক। যেমন শুস্ক প্রকৃতি এখানে, তেমনই গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত প্রতিটি ঋতুর  অত্যন্ত প্রখরতা। বাংলা থেকে এসে প্রথমদিকে  মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হয়।
খড়গপুর ও বিলাসপুর দুটো জায়গাতেই সিনিয়র সুপারভাইজারদের অবাধ প্রশ্রয়ে ট্রেনিং সময়কালটাতে আমরা সবাই মিলে প্রায় উড়েই বেড়িয়েছি। দীর্ঘদিন বাদে দক্ষিণ পূর্ব রেলের বিলাসপুর ডিভিশনে স্টীম লোকোতে একগুচ্ছ শিক্ষিত কচি মুখ। শুধু তাই নয়, এরাই তো স্টীম লোকোমোটিভের সরাসরি সুপারভাইজারে নিয়োগের শেষ উত্তরসুরি। আহারে –  এরপরে সারাটা জীবনতো এদের পড়েই আছে রেলের কাঠিন‍্য আর দায়িত্ব নেবার জন‍্য। এই ট্রেনিং সময়টাকে তো অন্তত উপভোগ করুক। রেলের অন জব ট্রেনিং সময়ের প্রতিকুলতা প্রচুর। সেইসব প্রতিকুলতা জয় করে মজা করা, কাজ শেখা আবার ফাঁকিও দেওয়া, সেইসঙ্গে সিনিয়রদের সেসব দেখেও না দেখবার ভান করার মধ‍্যে দিয়ে অবাধ প্রশ্রয় দেওয়া দক্ষিণ পূর্ব রেলের এক অপুর্ব পরম্পরা।রেলওয়ে সার্ভিস কমিশনের লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় সফল হয়ে খড়গপুরে যান্ত্রিক বিভাগের ট্রেনিং স্কুলে সরাসরি সুপারভাইজার পদের ট্রেনিংয়ে আসা লোকো, ক‍্যারেজ ও ওয়ার্কশপ শাখার প্রত‍্যেক সিনিয়ররা, ফোরম‍্যানরা পরম্পরাগত ভাবে আগত জুনিয়রদের এই প্রশ্রয়টা দিয়ে থাকেন। ভারতের অন‍্য রেলগুলিতে এই পরম্পরা আছে কিনা জানা নেই তবে দক্ষিণ পূর্ব রেলে এই ট্রেনিরা পরবর্তীকালে কর্মক্ষেত্রে যে যেই স্তরেই পৌছক না কেন সিনিয়র ও  জুনিয়রদের এই দাদা ভাই সম্পর্কটা পরম্পরাগত ভাবে অবসরের পরেও অটুট থাকে। আজকের দিনে রেলের ভাগাভাগিতেও সেই সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি।
লোকো রানিং রুমগুলোর পরিচালনার ভার তখন স্টীম লোকো ফোরম‍্যানদের হাতে ছিল, তাই মনিন্দ্রগড় ও স্যাডোলে রানিং রুমেই একটা করে ঘর জুটে গেল  আমাদের আটজনের একসাথে থাকার জন্য। বিলাসপুরে থাকার সময় ড্রাইভার ট্রেনিং স্কুলে একটা ঘরে তিন মাসের সমবেত আশ্রয় আর ভিলাইতে প্রথমে অল্প কয়েকদিন রানিং রুম, তারপর সামান্য কয়েকদিন লোকো ইনকামিং অফিসের মেঝেতে শতরঞ্চী বিছিয়ে ও সবশেষে আমাদের একজনের নামে একটা টইপ টু কোর্য়াটারে আমাদের আটজনের নরক গুলজার করা ইতিহাস হয়ে আছে প্রতেকের জীবনে। লোকো ইনকামিং রুমে রাতের বেলায় সাপ ঢোকা কিংবা লাইনে বসে প্রাকৃতিক কাজ সারা, নানা রকমের  রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাই এ জীবনে হয়েছে।
অপরিপক্ক হাতে দুজন পালা করে করে আটজনের জন‍্যে  রান্না করা, বাজার করা ও বাসন মাজতে মাজতে প্রত‍্যেকে কখোন ঘরকন্নায় দক্ষ হয়ে উঠেছি কেউ জানিনা। সন্ধ্যায় গানের আসর বসানো, হৈচৈ , লোকো ও ক্যারেজ সিনিয়ারদের সাথে যৌথ পার্টি খনাপিনা কিসব মজাই না ছিল। তার মধ্যে আলাদা করে ছিল সাইকেলে চক্কর কাটা। সিনিয়রদের ঘরে সদলে উপস্থিত হওয়া। যত্রতত্র উঁকি ঝুঁকি মারা। বাড়িতে পালানোর হিড়িক। একমাএ বিবাহিত বন্ধুর বাড়ি যাবার দিন ঘটা করে দাড়ি কাটা নিয়ে মস্করা। কারো বিয়ের পাত্রীর খোঁজ, বা খাঞ্জা খাঁ নামের ভৃত্য আমদানি মতোন প্রতিটি গল্প নিয়ে আলাদা করে ইতিহাস লেখার মতো মজার ঘটনা আছে।
আপাতত মনিন্দ্রগড়ের সেই দুই মাসের ট্রেনিংয়েই ফিরে যাই। সরগুজা জেলার সম্পুর্ন আদিবাসী অধ‍্যুষিত অতি ছোট্ট জনপদ এটা। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা। সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া কোলফিল্ড অঞ্চলের প্রানকেন্দ্র। মাটির নীচে উন্নতমানের কয়লার ভান্ডার। সেইসুত্রে এখানে রেল যোগাযোগ। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে এক মাসের জন‍্য বিশেষ কারনে ও তার পরবর্তীকালে ১৯৮৮ সালে জুলাই মাসে প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে এই ছোট্ট জনপদেই দুবছরের জন‍্য বয়লার ফোরম‍্যান হয়ে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল। তখন অবশ‍্য অন‍্য চোখে দেখেছি এই ছোট্ট জায়গাটাকে। দুবছর এখানে পোস্টেড থাকাকালীন সবসময় খুব মনমরা ভাবে  কাটিয়েছি, আবার দুবছর পরে পছন্দের ভিলাইতে ফিরে আসার সময়ও মনটা কোথাও ভারি বোধ হয়েছে। যে কোনো জায়গা আর সেখানকার মানুষজনের প্রতি এই আকর্ষণ ও অনুভূতির টান — মানুষের মনটা বোধহয় এইরকমই হয় !
বিলাসপুর থেকে মনিন্দ্রগড়ে সরাসরি যাবার তখন কোন ট্রেন নেই। বিলাসপুর থেকে রাত নটার 36 আপ ভোপাল প‍্যাসেন্জারের এর কয়েকটা কোচ মাঝরাতে অনুপপুরে জংশনে কেটে দুঘন্টা পরে রাতের অনুপপুর – চিরিমিরি প‍্যাসেন্জারে জুড়ে দিত। ভোরে সেই গাড়িই কুঊঊ —- ঝিকঝিক করতে করতে পাহাড় ডিঙিয়ে মনিন্দ্রগড় পৌছে দিতো। গভীর রাতে কিংবা নির্জন দুপুরে কুঊঊ — ঝিকঝিক আওয়াজ করতে করতে পাহাড়ের আড়ালে ট্রেন চলে যাবার শব্দ রূপকথা বলে যেত।  দিনে যেতে হলে বিলাসপুর থেকে 34 আপ ইন্দোর প‍্যাসেন্জারে অনুপপুরে গিয়ে গাড়ি বদল করে দিনের অনুপপুর – চিরিমিরি প‍্যাসেন্জার ধরতে হতো। অনুপপুর থেকে চিরিমিরি যাবার জন‍্য সারাদিনে মাত্র এই দুটো ট্রেন আর সঙ্গী দেহাতি লোকজন সওয়ার। এটাই সেসময় মনিন্দ্রগড় পৌঁছনোর রেল যোগাযোগ। সড়ক পথে যাতায়াত করা আরও করুণ অভিজ্ঞতা। দিনভর অবশ‍্য প্রচুর মালগাড়ি চলতো। ১৯৮৮ সালে বয়লার ফোরম‍্যান হয়ে যখন যোগদান করি সে যাত্রায় স‍্যাডোল থেকে বিকেলে মালগাড়ি চেপেই রাত দশটায় একজন সিনিয়ারের রেল কোয়ার্টারে উদয় হয়েছিলাম।
সে যাই হোক, বিলাসপুরে পে অফিসে দাড়িয়ে আমরা অটজন মাইকে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত‍্যু সংবাদ ও কার্ফু ঘোষনা শুনলাম। সব জায়গা মুহুর্তে জনশুন‍্য হয়ে গেল। সে এক অনিশ্চয়তার পরিবেশ। ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ায়, ঐ দিন ট্রেন চলবে কিনা সেই নিয়ে সারাদিন সংশয়ের মধ্যে কাটিয়ে রাতের গাড়িতে সাধারণ কামরায় চড়ে বাক্স প‍্যাঁটরা নিয়ে পরের দিন কাক ভোরে আটমুর্তি মনেন্দ্রগড়ে নামলাম। দিনের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে।একটাই নীচু প্লাটফর্ম। ভোরের হালকা আলো ফুটে উঠতেই চারিদিকে সৌন্দর্য ঠিকরে বেরোল । দেখা গেল চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়। ঘন জঙ্গলে ভরা পাহাড়। এখানে গরমে, শীতে আর বর্ষায় জঙ্গলের এক এক রকমের রুপ। গরমে জঙ্গল বর্ণহীন তো বর্ষার ছোঁয়ায় বেঁচে উঠার হারিয়ালি। আমলকী, শাল, মহুয়া ও নানান আজানা গাছের ঘন জঙ্গল। জানতে পারলাম যে বাঘ না থাকলেও প্রচুর ভাল্লুক, চিতা ও অন‍্যান‍্য অনেক  জানোয়ার আছে এই জঙ্গলে। স্টেশনের পিছন দিকে লাগোয়া একটা বড় দীঘি। টলটলে জল। দীঘি বা জলাশয়ের বড়ো অভাব এই অঞ্চলে। দীঘির পাশেই অনুচ্চ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা,  প্রসস্ত লন পেরিয়ে সাহেবি বাংলো গড়নে সুদৃশ্য লোকো রানিং রুম। লম্বা বারান্দায় দাঁড়ালে লাইনের ওপারে লোকো শেড দেখা যায়।  দুমাসের জন‍্য সেখানেই একটি ঘরের মেঝেতে রেলের গদি পেতে দিনরাতের  আশ্রয় হলো সবার। উল্টোদিকে লাইন পেরোলেই ছোট্ট লোকো শেড। তার রুপোলি রঙের টিনের চালে কালো রঙে বড়ো বড়ো করে লেখা “হাউজ অফ স্টীল হরসেস”। দূর থেকেই লেখাটা নজরে পড়ে।
তখোনো ওখানে সিংগেল লাইন এবং  সেমাফোর আর্ম সিগনালিং ব্যাবস্থা। সরু সিড়ি চড়ে রাতে সিগনালে বাতি দিত। স্টেশনের সামনের দিকে কিছুটা দুরে লোকালয় ও অত্যন্ত ছোট একটা বাজার। বাজারেই শুরু আর বাজারেই শেষ এই মনিন্দ্রগড় জনপদ। স্টেশনের সামনের দিকে একটা লম্বা আড়াআড়ি ওভার ব্রিজে চড়ে ওপারে ছোট্ট রেল কলোনিতে যেতে হয়। সিড়ি চড়ে ওভার ব্রিজের উপর দাঁড়ালে চারদিকের জঙ্গলে ও পাহাড়ে ভরা প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মন ভরে যায়। খারাপ করা মন নিয়ে কতদিন একা একা এই ব্রিজে চুপ করে দুরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। সকালে আর সন্ধ্যায় ট্রেন আসার সময়টুকুতেই স্টেশনে লোকজনের সমাগম দেখা যায়। বাকি সময় স্টেশন জনশুন‍্য। স্টেশনের সেই জনশুন‍্য রুপও কম আকর্ষণীয় নয়। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা বলে নভেম্বরের প্রথম দিনেই বেশ ঠান্ডা ভাব। এমনিতে শীতে মনিন্দ্রগড়ে ঠান্ডা একটূ বেশীই পড়ে। স্থানীয়রা বলত কিছুকাল আগেও ঠান্ডায় ভোরের দিকে এখানে শিশির জমে বরফ হয়ে থাকত। আমি অবশ‍্য সেটা দেখতে পাইনি, তবে হাড় কাঁপানো শীত পড়তে দেখেছি। চারিদিকে মহুয়া জঙ্গল ঘেরা এই অঞ্চলের বাতাসে মহুয়া ফুলের সুবাস। দেহাতি মানুষ ঘরে ঘরেই নেশার জন‍্য মহুয়া তৈরী করে। ঘরে তৈরী মহুয়া খেয়ে আমার এক স্টাফ রাজেন্দ্রকে বিষক্রীয়ায় মারাও যেতে দেখেছি।
আরও দুই মুর্তিমান বাউন্ডুলে ব‍্যাচেলার ও প্রায় সমবয়সি ক‍্যারেজ সিনিয়র বছর খানেক ধরে পোস্টিং ছিলেন এখানে। অম্লান কুসুম চৌধুরি ও দীপঙ্কর ভট্টাচার্ষ। যেদিন ভোরে পৌছলাম সেদিনই সকালে বাজারে পান্জাবীদের দোকান লুট হলো। এখানেও কার্ফু লাগলো। খাবো কি? অম্লানদাদেরও ছন্নছাড়া অবস্থা। একটা ঘটনার কথা বলি, কোনও একদিন হটাৎ করে বেলা তিনটের সময় অম্লানদার কোয়ার্টারে গিয়ে দেখি অম্লানদা ছটা-দুটো স্টেশন ডিউটি করে ঘরে ফিরে ভাত না রেঁধে কেবল চারটে ডিম ভেজে লাঞ্চ করছে। কি সাহস – সেটা থেকেই আবার কিছুটা আমাকে ভাগ দিতে গেল ! মনটা সবার তখনও এমনটাই ছিল। আর দীপুদা, সেতো আমার পরবর্তীতে দাদা, বন্ধু আশ্রয়দাতা আরো কত কি।  যাইহোক, কার্ফুর মধ্যে  দিনের বেলায় চাল ডাল ফুটিয়ে চলে গেল কোনরকমে। রাতের অন্ধকারে দীপুদা, অম্লানদা একজনের ক্ষেতে গিয়ে গেল। সেখান থেকে ফুলকপি কিনে রাতে সবার রান্না হোল। দেশের এই প্রত‍্যন্ত অঞ্চলেও  ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর এমনটাই অচল ও প্রবল অনিশ্চয়তার ভাব হয়েছিল।
কিছুদিন পরে আমরা আটজন থেকে নয় জনে পরিনত হলাম। আমাদের ব‍্যাচের আরেকজন এখানে এল। সে তখন সদ‍্য বিয়ে করেছে। বাড়ি ভাড়া করে বৌ নিয়ে এল। সকলে হৈহৈ করে ওর জিনিসপত্র ট্রেন থেকে নামানো হলো। গরীবদের হনিমুন করার সুন্দর জায়গা। রেলের লোকেদের তখন কতই বা মাইনে ? আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমি মনিন্দ্রগড়ে পোস্টেড। বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলার পরের দিনই আমি ওখানে বৌ নিয়ে ফিরে আসি। আমাদের প্রথম হনিমুন ওখানেই হয়েছে বলা যেতে পারে। দীপঙ্করদার ও তাই।  অন জব ট্রেনিংয়ে ছয় মাস ভিলাই, তিন মাস বিলাসপুর, দু মাস মনিন্দ্রগড় ও এক মাস স্যাডোলে ছিলাম আমরা। আমি  পরবর্তীকালে এই সব কটা জায়গাতেই  কমবেশি সময় পোস্টেড থেকেছি। প্রত‍্যেক জায়গায় নূতন নূতন মানুষ, নূতন নূতন সম্পর্কের মায়জাল, নানা কষ্ট, নানারকম অভিজ্ঞতা জীবনকে সম্বৃদ্ধ করেছ। তাই আজও সুখ এনে দেয় সেই সময়কার দীর্ঘ চোদ্দ বছরের স্মৃতিমেদুরতা।
আমাদের ব‍্যাচের কল্যান আমাদের সাথে দুদিন মনিন্দ্রগড়ে থেকে গেছে। ১৯৮৪ র ডিসেম্বর মাসে কল্যান আর আমি নয়নপুর থেকে চেরাইডুঙরি হয়ে কানহা জঙ্গলে ঘুরে এবং সেইসঙ্গে  সিনিয়র সুনিল কুমারদার হাউবাগের  বাড়ি হয়ে জব্বলপুর ও খাজুরাহো ঘুরে মনিন্দ্রগড় গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখেছিলাম ভারতীয় রেলের ন‍্যারো গেজের রেল পরিষেবার সেকি ব‍্যাপ্তি ! প্রচার নেই, পয়সা নেই, জিনিসের যোগান নেই তবু শতশত রেলকর্মী দেশ ঘর ছেড়ে খেলনা রেলের যাত্রা অটুট রেখেছে। সেই কোন অতীত থেকে বছরের পর বছর ধরে এই ছোট খেলনা রেলের দৌলতে মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের কতশত গরীব ও গ্রামীণ মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরতা পেয়েছে । ২০১৯ সালে যেদিন দক্ষিণ পূর্ব মধ‍্য রেলের নাগপুর ডিভিশনের সেই ন‍্যারো গেজের রেলের গর্বিত ও স্পর্ধার পরম্পরা অন্ত হোল তখন যেন নিকট জনকে হারানোর ব‍্যাথার অনুভূতি হোল। কল‍্যানের কথা পরে লিখবো কারন ওর সংযোগটা আর একটূ পরে আসবে।
প্রথম দিনে কার্ফুর রাতে চাষির ক্ষেতের ফুলকপি দিয়ে তো মনেন্দ্রগড়ের যাত্রা শুরু হলো। এর আগের স্টেশন বরিডান্ড আর পরেরটা প্যারাডোল। দুটোই জঙ্গল আর উঁচু পাহাড়ের মধ‍্যে। রেলের কাজের কারনে ইন্জিনে চেপে প্রচুর যাত্রা করতে হয়েছে। বরিডান্ড স্টেশন ছাড়লেই লোকো পাইলট ইন্জিনের রেগুলেটর বন্ধ করে দিত। এতটাই নীচু উৎরাই পথ যে গড়িয়ে গড়িয়ে ট্রেন আপনা আপনি মনিন্দ্রগড় চলে আসত। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় শেষ চিরিমিরি প‍্যাসেন্জার এ‍্যাটেন্ড করতে মনেন্দ্রগড় স্টেশনে আমি আর ওসমান আসতাম। এখানে ইন্জিন ওয়টারিং হোত। চড়াই পথে যথাযথ গতি না তুলতে পারলে চাকা পিছলে ট্রেন আর বরিডান্ড পৌছাতে পারতো না। হয় ফিরে এসে আবার গতি বাড়িয়ে চড়াই টপকাতে হোত, নয়তো পিছনে  আর একটা ইন্জিন দিয়ে ঠেলা মেরে ট্রেনকে বরিডান্ড পৌঁছে দিতে হোত। চর্তুদিকে  মহুয়ার মিষ্টি গন্ধের নেশা লেগে যাওয়া নিশী রাতে টিমটিমে আলোর মধ‍্যেই সেসময় প্রায়ই বরিডান্ড স্টেশনের উপর মহুয়া খেতে বুনো ভাল্লুক চলে আসতো। আমি ১৯৯০ সালে মনিন্দ্রগড় ছেড়ে আসার সময় অবধি অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। কুড়ি বছর পরে আমি অবশ্য ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে একবার ফিরে দেখতে সপরিবারে মনিন্দ্রগড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এখন বরিডান্ড স্টেশনের চারদিকে টিউব লাইটের তীব্র সাদা আলো। বাঁধানো স্টেশনে চা ও স্ন‍্যক্সের ঝকঝকে স্টল। ভাল্লুক আসার কোন উপায় অবশিষ্ট রাখেনি রেল। তবে এই উন্নয়ন কিংবা পরিবর্তন হয়েছে বরিডান্ডের আদিম ও বন‍্য রোমান্টিকতার মৃত‍্যু ঘটিয়ে। সেই উঁচু উঁচু পাহাড় ও জঙ্গল আগের মতন খানিকটা থাকলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এখন বরিডান্ড স্টেশনের সর্বত্র । মনিন্দ্রগড়েও এক থেকে তিনটে প্ল‍্যাটফর্ম হয়েছে। সারা দিনে একের বদলে দুটো ট্রেন। রাস্তায় প্রচুর অটো চলছে। হোটেল হয়েছে দু একটা। একটা হোটেলে ৭০০ টাকা দিয়ে বারো ঘন্টার জন্য ঘর নিয়েছিলাম আমি। সেকসান বিদ‍্যুতিকরন হয়েছে। আগে যেখানে বিলাসপুরে ফোন করতে ট্রাঙ্ক কল বুক করতে হোত সেখানে লোকের হাতে হাতে মোবাইল।
মনিন্দ্রগড়ের রাস্তা উঁচু নীচু। ছোট্ট একটা টিলার উপর এখানকার রেলওয়ে ইনিস্টিটিউট। উল্টো দিকে রেলের ছোট্ট হেল্থ ইউনিট। মনিন্দ্রগড়ে বুধবার হাট বার তাই রবিবার নয় বুধবার লোকো শেডে ছুটির দিন। রোজ রাতের ট্রেনে বিলাসপুর থেকে সামান্য রুই বা কাতলা মাছ আাসতো। ভোর ভোর স্টেশন না গেলে পাওয়া যেত না। বুধবার হাটে অতি সামান্য কিছু লোকাল চুনো মাছ আসতো। রেল কলোনির প্রান্তে একটা পোল্ট্রী ছিল। ব্যাটারা বুড়ো মুরগী ছাড়া বেচতোই না। বাজারে মুরগির মাংস পাওয়া যেতো না। কি করা যাবে তাই ই সই। যে আমি, মাছ ছাড়া চলতোই না আমার, এখানে দুবছরের অবস্থান কালে নিরামিষাশী হয়ে উঠলাম ক্রমেই। ১৯৮৭ সালের আগে অবধি সিনেমা হল ছিল না এখানে। ডান্ডা ওয়ালা এ‍্যান্টেনা দিয়ে টিভিও আসতো না। পরে বড় ডিক্স এ‍্যান্টেনা বসিয়ে টিভি চালু হয়। একলা বাঁচার অভ‍্যাস গড়ে উঠলো।
বিশু একদিন হটাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো। রেলের ডাক্তার রানিং রুমে এসে ইনজেকশন দিয়ে গেল কিন্তু তার পরেই দ্রুত অবস্থার অবনতি হোল। সবাই বলল এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে যাও। তখন জানা গেল মনিন্দ্রগড়ের বাজার থেকে বেশ কিছটা দূরে জঙ্গলের মধ‍্যে দিয়ে গিয়ে আমাখেড়া বলে একটা জায়গায় একটা সরকারি হসপিটাল আছে। ছোট্ট হসপিটাল, হাতে গোনা বেড ও ডাক্তার। হাসপাতাল বলে বোঝার কোন উপায় নেই। কিন্তু তারাই বিশুকে মৃত‍্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনলো। পাঁচ বছর পরে আমাখেরার  ঐ হসপিটালেই কোন কারনে আমাকে যেতে হয়েছিল। তখন কোথায় সেই আমাখেড়ার জঙ্গল ! পরিস্কার পিচ বাঁধানো  রাস্তা, হাসপাতালের কলেবর বেড়েছে। আউটডোর সবরকমের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তদের কোয়ার্টার ও বাগান।
সবচেয়ে কাছে ছিল সিদ্ধিবাবা পাহাড়। বর্ষায় পাহাড়ের নীচ দিয়ে মেঘ উড়ে যেত। আসলে দু বছর আমি ওখানে পোস্টেড ছিলাম তো তাই বর্ষার অপরুপ রুপ আমি দেখেছি। মাঝেমধ্যে মেঘে ঢেকে যেত রেল ইনিস্টিটিউটের চুড়া। এক বুধবার সকালে সকলে মিলে চড়লাম সিদ্ধিবাবা পাহাড়ে। পাথর এলোমেলো ভাবে সাজিয়ে ধাপ বেয়ে পাহাড়ে চড়ার ব‍্যাবস্থা। পাহাড়ের চুড়ায় একটা শিব মন্দির। মন্দিরকে ঘিরে সাধুদের আখড়া। স্থানীয়দের অখণ্ড ভক্তি। আমি ২০১০ সালেও ঐ পাহাড়ে সপরিবারে চড়েছি। উপর থেকে নীচের রেললাইন আর জনপদের দৃশ্য সেদিনের মতোন একই ভাবে আজও সমান আকর্ষনীয়।
সেই সময় মন রঙীন ছিল তাই হয়তো মনে হতো গরীবের হনিমুনের জায়গা। অতনু ঠিক করে ফেললো বৌ নিয়ে আসবে। রেল কলোনির গায়ে যুগল প্রসাদ নামে একজন গার্ডের আট বাই আট ফুটের দুকামরা ভাড়া হলো। অ‍্যাসবেস্টের চাল। বাথরুমের চালা নেই। ওদের পিছু নিলাম আমি। ওরা একটা ঘরে আর তার পাশেরটাতে আমি। মাঝে দরজা নেই। আমার AMIE Section A ঐ ঘর থেকেই। আজ ভাবি কত ভালো ছিলাম আমরা সবাই। দরজা বিহীন ঘরে অতনু ও ওর বৌ, আমি। না কেউ প্রশ্ন করেনি, কেউ কটূক্তি করেনি, এতটাই বিশ্বাস ছিল নিজেদের মধ্যে।
সবাই জানি, ন্যারো গেজে কালকা সিমলা শিবালিক এক্সপ্রেসের কথা। এতো পয়সাওয়ালা টুরিস্টদের সখের ট্রেন। কিন্তু ন‍্যারো গেজে গোন্ডিয়া জব্বলপুর সাতপুরা এক্সপ্রেসের কথা কজন জানে ? গোন্ডিয়া থেকে জব্বলপুর ১ আপ আর জব্বলপুর থেকে গোন্ডিয়া ২ ডাউন রোজ চলতো। দুটো রেক চলতো, তার একটাতে আবার এসি চেয়ার কার ছিল। প্রায় ৩০০ কিমির উপর ব‍্যাপ্তি নেটওয়ার্কের এই খেলনা গাড়িগুলোই তখন মধ‍্য ভারতের প্রান্তিক, গরীব আদিবাসীদের একমাএ জীবন রেখা। ঐ খেলনা ট্রেনে আমার প্রথম সফর ১৯৮৪ সালে জুলাই মাসে ট্রেনিং সময়কালে। আমার বয়লার ইন্সপেক্টর গোবিন্দরাও খান্ডেকারের সাথে নয়নপুরে যাচ্ছিলাম। দক্ষিণ পূর্ব রেলের নাগপুর ডিভিশনের বিশাল ন্যারো গেজ সেকসানে কেবল স্টীম লোকোই চলে তখনও। নয়নপুরে ছবির মতো স্টীম লোকো শেড। দুলকিচালে চলা চলন্ত খেলনা গাড়ির উন্মুক্ত জানালা দিয়ে স্টীম ইঞ্জিনের কয়লার গুড়ো চোখে মুখে এসে পড়ছে। স্টীমের মনমাতানো গন্ধ, গাড়ির সেকি দুলোনি, দুপাশে ঘন জঙ্গল, গাছের পাতা ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে মুখে ছোবল মেরে যাচ্ছে, খালি মনে হচ্ছে গাড়ি এখানে বিগরে গেলে জানোয়ার টেনে নিয়ে যাবে। পটে আঁকা ছবির মতোন বৃষ্টি ভেজা ছোট ছোট স্টেশন আচ্ছা সে আচ্ছাকেও রোমান্টিক করে তুলবেই। গোন্ডিয়া থেকে বালাঘাট হয়ে নয়নপুর যাত্রা পথে বর্ষার সৌন্দর্য ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমাকে আবারও নয়নপুর নিয়ে গেল ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে। কল্যান (রায়) তখন নয়নপুর স্টীম শেডে অন জব ট্রেনিং করছে। একরাত নয়নপুরে কাটিয়ে মান্ডালার পথে চেরাইডুংরি হয়ে দুজনে গেলাম কানহা। সেখান থেকে জব্বলপুর ঘুরে হাউবাগে সুনীল কুমার দার বাড়ি ঘুরে সাতনা গেলাম। সাতনার টিএক্সআর দাদারা স্টেশনের প্রথম শ্রেনীর ওয়েটিং রুমে রাতে থাকার বন্দোবস্ত করে দিল। ভোরে বাসে করে খজুরাহো দেখে দুজনে মনিন্দ্রগড়ে ফিরলাম।
ততদিনে অবশ্য উদলকাছাড়ের বিশ্ময় আবিস্কার করে ফেলেছে আমার বন্ধুরা। পাত্র দা করান্জিতে পোস্টিং পেয়েছিল। এটা বিশ্রামপুর লাইনে। তখন কেবল দুটো প‍্যাসেঞ্জার চলতো বিশ্রামপুর লাইনে। একটা ঐ মনিন্দ্রগড় থেকে অন‍্যটা কাটনি থেকে। মনিন্দ্রগড়ের আগের স্টেশন বরিডান্ড। ইন্জিন ঘুরিয়ে বরিডান্ড থেকে বিশ্রামপুর যাত্রা পথে প্রথমে পরে উদলকাছাড় ও তারপর সুরজপুর। চড়াই পথে এই দুই স্টেশনের মাঝে আবার ঘন জঙ্গল। তখন বাঘ না থাকলেও ভাল্লুক আর অন্য জানোয়ার ছিল ভালোই । বিশ্ময় জায়গাটি এই জঙ্গলের মধ্যে উদলকাছাড় স্টেশন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দুরে। লোকো পাইলট কে রিকোয়েস্ট করলে  যাবার সময় ট্রেন থামিয়ে নামিয়ে দিত। ফেরার সময় ফলিং গ্র্যাডিয়েন্ট হতো বলে লোকো পাইলট দাঁড়াতো না। সড়ক পথেও বাইকে করে ও খানিকটা হেঁটে যাওয়া যেত। বন‍্য পরিবেশে বন্ধুদের  নগ্ন বিচরন আজ কেউ ভাবতেও পারে না। মূলত মহুয়া আর আমলকি জঙ্গল। বুনো আমলকী কুড়িয়ে খাওয়া। ওখানে জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা যায়গা আর একটা পরিস্কার পাহাড়ী নদী বয়ে চলেছে। পুরো নদীটা একটা যায়গায় পাঁচ ছয় ফুট উঁচু থেকে হটাৎ করে ফলসে্র মতোন ঝরে পড়ছে। ঐ ফাঁকা জায়গায় পিকনিক হয়। পিকনিক পার্টিদের বিকেল তিনটে বা সাড়ে তিনটের মধ্যে রওনা দিয়ে উদলকাছাড় ফিরতে হতো রেল লাইন ধরে হেঁটে। এখান থেকে ফিরতে দেরি করে ফেললে জানোয়ারের ভয় তো ছিলই আর ট্রেন মিস হলে ফেরার উপায় ছিল না।
কল্যানের আপ্যায়নে আমরা আটমুর্তি কল্যান সমেত 1BBM ধরে চললাম মিশন উদলকাছাড়। লোকো পাইলট নামিয়ে দিল জঙ্গলে। শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে মুরগির মাংস রান্না, ঝর্নায় জলকেলি, পিকনিক সুপার ডুপার হিট। খাবার পরে সবার খেয়াল চাপলো নদীর ওপারে জঙ্গলে যাবার। নদীর ধার ধরে একটা সরু জায়গা পেয়ে সবাই ওপারে চলে তো এলাম, কিন্তু জঙ্গলে সামান্য এগিয়ে বোঝা গেল আর এগোনো ঠিক হবে না ঝোপ ও জঙ্গল ক্রমশ ঘন হচ্ছে, জানোয়ার তাড়া করলে পালানো সম্ভব নয়।
ফেরার পথে বিভ্রাট শুরু হলো। যে জায়গা দিয়ে নদীটা পার করা হয়েছিল সেই জায়গাটা খুঁজেই পাওয়া গেল না। শেষে একটা যায়গায় নদীর মাঝে একটা পাথরে পা দিয়ে সবাই একে একে পার হলো, কিন্তু বন্ধু পত্নীর জন্য ব্যাপার টা সহজ হলো না। ঠিক হলো আমি একহাত ধরবো আর প্রদীপ একহাত ধরবে ওকে নদী পার হতে সাহায্য করার জন্য। অঘটন অপেক্ষা করছিল। আমার হাত ফস্কে বন্ধুর স্ত্রী , আমি ও প্রদীপ সবাই নদীতে ঝপাং। এক কোমরের উপর জল ছিল নদীতে। ডিসেম্বরের ঠান্ডায় গোধুলি বেলায় ভিজে একাকার তিন জনে। বন্ধুর স্ত্রী দেখা হলে আজও প্রথমেই ঐ ঘটনাটার কথা বলে থাকে।
জল থেকে তো উঠে পড়লাম কিন্তু শীতের মধ‍্যে ভিজে কাপড়েই থাকতে হোল, কারন অতিরিক্ত পোষাক নিয়ে কেউতো পিকনিকে ষায় না। ডিসেম্বরের শেষের শীতের বিকেল ততক্ষণে গড়িয়ে প্রায় সন্ধা হয় হয় করছে। ভিজে কাপড়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জঙ্গলের মধ্যে রেল লাইন ধরে সাড়ে তিন কিলোমিটার হাঁটতে হবে। ডেচকি, হাতা, স্টোভ হাতে নিয়ে সবাই মিলে হাঁটা শুরু হলো। গাড়ো অন্ধকার হয়ে গেছে, কিন্তু উদলকাছাড় বহুদুর। সবাই উঁচু স্বরে কথা বলতে বলতে আর বাসন পেটাতে পেটাতে রেল লাইন ধরে চলেছি। জঙ্গলের মধ্যে সামান‍্য খসখস আওয়াজে বারবার সবাই সর্তক হয়ে উঠছি। জানোয়ারের ভয় তো আছেই তার চেয়ে বেশি ভয় ট্রেন না এসে পড়ে আর চলে যায়। তবে তো সবাই গেছি। যাই হোক নিরাপদেই সবাই উদলকাছাড় পৌছলাম । স্টেশন মাস্টার কয়লার উনোন জ্বালিয়ে বসে আছে। ট্রেনও মিস হয়নি শেষ পর্য্যন্ত। তারপর দিন কল্যান রায় দিনের ট্রেনে করে  নয়নপুরে ফিরে যায়।
২০১০ সালে মনিন্দ্রগড়ে গিয়ে শুনলাম জায়গাটা সরকার টুরিস্ট স্পট হিসেবে গড়ে তুলেছে এবং এটা মনেন্দ্রগড়ের অন্যতম সেরা টুরিস্ট আকর্ষণ। টুরিষ্ট বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে  এই জায়গা তার সেই বন‍্য আদিমতার সব আকর্ষন হারিয়ে ফেলেছে।
১৯৮৮ সালের জুনে মনেন্দ্রগড়ে পোস্টিং নিয়ে আসার আগে ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটা আপতকালীন পরিস্থিতিকে এখানে একমাসের জন্য  আসতে হয়েছিল। টিমা নামে একজন ফারারম‍্যান চলন্ত ইন্জিনে বয়লার টিউব ফেটে কর্মরত অবস্থায়  মারা যায়। ঐ ইন্জিন সারিয়ে তোলার জন‍্য ভিলাই থেকে আমাকে নিয়ে আসা হয়। সেদিন এখানকার মানুষদের সেই উষ্ণ অভ‍্যর্থনা সারা জীবনে ভোলা যাবে না। রেল কর্মচারী প্রত‍্যেকেই, কিন্তু আমি সব ঠিক করে দেবো এমন বিশ্বাস ও আনুগত্য ওরা কোথা থেকে পেল ? ওসমান, সাহা, নানদাও, নাওলসাই, রামদাস, জগত সিং, রাম কুমার, বহরনলাল ও প্রতিটি কর্মীদের নাম ধরে ধরে কে কি কাজে দক্ষ আজও মনে করতে পারি। দিন রাত এককরে কি কাজটাই না করেছে ওরা কোনরকম আপত্তি ছাড়াই।
১৯৮৮ সালে যখন ওদের ইনচার্জ হয়েই ফিরলাম তখনতো ওরা সবাই আমার চেনা। এখানে স্টাফেরা সবাই বয়সে আমার চেয়ে প্রায় বারো থেকে পনেরো কেউবা আরো বড়ো। তখনও আমার মধ্যে কলকাতার বিজ্ঞভাব, উন্নাসিক মানসিকতা যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, এই মানুষদের সরলতা, ভালোবাসা, সর্মপন ও সেবা সমস্ত ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে এক আত্মীয়তা গড়ে তুলল। ওরা কেউই আজ বেঁচে নেই কিন্তু আমার মনে আর এই লেখায় বেঁচে থাকুক ওরা।
হোম সিগন্যালের কেবিনের পাশ দিয়ে ছোট একটা নদী বয়ে চলে। নদী না বলে নালা বলাও চলে। রেল লাইন সংলগ্ন চার ফুটের পায়ে চলার ব্রিজ। নদীর গায়েই শ্মশান। এম আর সাহা নামে একজন বয়স্ক বাঙালি মিস্ত্রি ছিল। বাংলার বর্ধমান থেকে ওখানে গিয়ে দুরের একটা গ্রামে খানিকটা জমি কিনে কুড়ে ঘর বানিয়ে সপরিবারে সুখের বাস গড়ে তুলেছিল। ওর নাতির মুখেভাতে ডেকেছিল। ওর ঘরে মোটা চাল দিয়ে তৈরি পাতলা পায়েস, কিন্তু আন্তরিকতার ভরপুর স্বাদে সেটাই অতুলনীয়। বাংলার প্রকৃতিতে সবুজ স্নীগ্ধতা সংবৎসর উপলব্ধ আর বর্ষার সময় ছাড়া ওখানকার প্রকৃতি সুস্ক ও রুক্ষ। বর্ধমানের বঙ্গ সন্তান ঐ সুস্ক ও রুক্ষ পরিবেশকে আপন করে নিয়ে সুখেই ছিল। বয়স্ক লোকটা কিনা ভুতের ভয়ে কাবু। শ্মশানের পাশ দিয়েই হেঁটে যেতে হোত ওর বাড়িতে। সন্ধ্যায় কাজে ফেঁসে গেলে একা কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না। বসে থাকতো শেডে যতক্ষণ অবধি ওর বৌ নয়তো ছেলে ওকে নিতে শেডে আসতো।
সেকেন্ডহাফে আমার বেশীরভাগ দিনই কোন কাজ থাকতো না। তখন নিজের অফিসে বসে বই পড়া আর কখনও কখনও পাশেই দীপঙ্করদার সঙ্গে ক‍্যারেজ সিক লাইনে গিয়ে আড্ডা মারতাম। সেই সময় দীপুদা একমাএ কথা বলার সাথী। দীপঙ্করদা বেশীরভাগ দিনই কাজে ব‍্যাস্ত থাকতো। একলা চলে আসতাম নীর্জন নদীর ব্রিজের উপর। নীচে কুমিরের গড়নে একটা পাথরের দুপাশ দিয়ে জল বয়ে যাওয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। অদ্ভুত ভালো লাগতো। অমোঘ একটা টানে বার বার ছুটে যেতাম ঐ ব্রীজের উপর। হাজার মাইল দুরে থাকা কলকাতা, বাড়ি ও বন্ধুদের জন‍্য মনটা ভার হয়ে যেত।
বয়লারের পুরোনো টিউব প্রায়ই বদল করতে হোতো। ভীষন চাহিদা ছিল বয়লার টিউবের। নূতন টিউব কেটে মজবুত হামান দিস্তা (ওখানকার ভাষায় খলবত্তা) তৈরি হোত। পুরোনো টিউব দিয়ে ম‍্যারাপ বাঁধা হোত। পুরোনো টিউব চেয়ে আবেদন পত্রের ঢের রোজ রোজ লেগেই থাকতো। গুনে গুনে টিউবগুলো দেওয়া আর ফেরত নেওয়া বিরক্তিকর লাগতো। মাঝে মাঝে এক আধটা টিউব ফেরতও আসতো না। বিরক্তি নিয়ে একদিন সব পুরোনো টিউব কনডেম করে ডিএস এইট বানিয়ে একটা  ওয়াগান বুক করে খড়গপুর পাঠিয়ে দিলাম। ওসমান খুব করে অনুরোধ করেছিল এমনটা না করার জন‍্য কিন্তু ওর কথা শুনিনি। অল্প কিছু দিনের মধ্যে বুঝলাম ভুল করছি। স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা একদিন হাজির হলো পুরোনো টিউবের জন‍্য। প‍্যান্ডেল বেঁধে স্কুলে অনুষ্ঠান করবে। সাদর আমন্ত্রণও করলো। পুরোনো টিউবতো তখন নেই। টিউব নেই শুনে বাচ্চারা কেঁদে ফেলে আরকি। বললাম দেখি কি করতে পারি। তারপরের দিন শেডে পৌঁছে দেখি সব বন্ধ। সবার মুখ ভার। জানতে পারলাম গতরাতে ফোরম‍্যান রাজা রাওয়ের সতেরো বছরের ছেলে বিজুরি থেকে বাড়ি ফেরার পথে জঙ্গলের মধ‍্যে লরি চাপা পড়ে মারা গেছে। নদীর পাড়ে শ্মশানে শেষকৃত‍্যর সময় রাজারাও কে দেখে বুকটা মুচড়ে উঠলো। দাহ কাজের পর রাজারাও আমাকে বললো “বাসু কটা টিউব পাঠিয়ে দিও, ছেলেটার অন্তষ্টির কাজে প‍্যান্ডেল বানাতে দরকার পড়বে “। আসলে ডেকরেটার ব‍্যবস্থাতো ওখানে তেমন কিছু নেই। ওসমানকে বললাম বারোটা নূতন টিউব বের করো। রাজারাও আর বাচ্চাদের ভাগ করে দাও। এরপর আর কোন পুরোনো টিউব কনডেম করার কথা ভাবিনি।
জাদুটোনা, ভুতপ্রেত, তুকতাকে গভীর বিশ্বাস এখানকার দেহাতি মানুষজনের। বদরুদ্দিন আমার এক স্টাফ। রেলের খাতায় নাম কিন্তু দিনের পর দিন কাজে অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় নিয়ম উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো যাতে মেজর পেনাল্টি চার্জশিট দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় । ওসমান বলল ভুলেও রিপোর্ট করতে যাবেন না। বদরুদ্দিন এখানকার নামডাকওয়ালা গুনিন। ভুতপ্রেত সিদ্ধ। ভুত তাড়িয়ে, ওঝাগিরি আর তুকতাক করে তার নাকি প্রচুর আয়। ওকে চটানো ঠিক কাজ হবে না। অম্লানদা বলল জয়ন্ত এরা ভয়ংকর। স্বার্থে ঘা লাগলে ঘরে গোখরো সাপ ছেড়ে দেবে । যাইহোক একে আমাকে তাড়াতে হয়নি। একদিন দুপুরে তেমন কাজ নেই। থেরেজার  ইলেকট্রিকাল ইন্জীনিয়ারিং বইটা পড়ছি, ওসমান ওকে নিয়ে হাজির হোল। পেন্নাম ঠুকে দাড়ালো, বিশাল চেহারা, মাথায় জটা, ঢোলা কালো জেব্বা পরা, হাতে গলায় অজস্র নানা রঙের পাথরের মালা, সে স্বেচ্ছা অবসরের আবেদন জানিয়েছে, তার জন‍্য তার টুল ক্লিয়ারেন্স চাই। চুপচাপ ক্লিয়ারেন্স লিখে সই করে দিয়ে দিলাম। আবারও পেন্নাম ঠুকে বিদায় নিল।
অত্যন্ত পরিশ্রমী জগত সিং একদিন বলল সে গ্রামের জোতদার। তার ছেলে আমার বয়সি এবং গ্রামের শরপঞ্চ। এবার লোকসভা ভোটে কংগ্রেস টিকিটে দাড়াবে। আমার মধ্যে সে নাকি তার ছেলেকে খুঁজে পায়। কত বড়লোক সে  কিন্তু মাটির কত কাছাকাছি তার বাস। নানদাওকে একবার ছোলার ডাল রেঁধে খাইয়েছিলাম। এমন ডাল সে নাকি কখনও খায়নি। ফোরম‍্যন রাজা রাও প্রায় প্রতিদান সকালে তার চেম্বারে ডেকে হয় ইডলি নয় ধোসা নয়তো বড়া খাওয়াতো। সঙ্গে কখনো এন ভি রাও কখনো বা গৌরীশঙ্কর। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই কতো কতো মানুষগুলো কে জানে। শুধু একরাশ মন ভালো করা স্মৃতির মনিমুক্তো ছড়িয়ে গেছে জীবনে।
২০১০ সালে ২৪ শে ডিসেম্বর কাক ভোরে মনিন্দ্রগড়ে গিয়ে দেখি স্টেশন চত্বরে অটোর ভিড়। রকমারি দোকান গড়ে উঠেছে স্টেশন চত্বরে। রেল কলোনি যাবার সেই সুন্দর ওভার ব্রিজ যার উপরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম সেটা ভেঙে পড়ে আছে। পায়ে পায়ে হেঁটে একটা হোটেলে ঘর নিয়ে পরিস্কার হয়ে বাজারে বেড়িয়ে পড়লাম। বাজারটা অনেকটা আগের মতোন থাকলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। একটা বাড়ি ভাঙা হচ্ছে। শুনলাম মল তৈরি হবে। বাজারে অটো স্ট‍্যান্ড হয়েছে। সেখান থেকে অটো নিয়ে সিদ্ধবাবা পাহাড় চড়ে বাজারেই ফিরে এলাম। মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে ওসমানের বাড়ি খুঁজে বের করলাম। বৃদ্ধ ওসমান প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও চিনতে পেরে বিহ্বল হয়ে পড়ে।
দুবার স্ট্রোক হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ আমাদের সাথে নিয়ে লোকো শেডে নিয়ে এল। স্টীম শেডটা আর “হাউস অফ স্টীল হরসেস” নয় এখন, সত‍্যিকারের ঘোড়ার আস্তাবল হয়েছে। ঘোড়ার বিষ্ঠা মাড়িয়ে ভিতরে ঢুকলাম। আমার অফিসের ডেইলি পোজিশন ও বয়লার লিস্ট বোর্ড এখনো জ্বলজ্বল করছে। শেডের মেন গেট পার্থেনিয়ামের ঘন জঙ্গলে অবরুদ্ধ। পাশেই দীপঙ্করদার ক‍্যারেজ সিক লাইন নীথর জনমানব হীন। খালি ফাঁকা অফিস ঘর। রেলের আধুনিকরনে এখানে ক‍্যারেজ সিক লাইনের মৃত্যু ঘটেছে। সপরিবারে শেডে ডুকেছিলাম। সবার পায়ে ঘোড়ার বিষ্ঠা মাখামাখি। তাই দুপুরে খাবার পর আবার আসবো বলে ওসমানকে ছেড়ে দিলাম। ফেরার পথে রেল কলোনির পথ ধরলাম। কোন পরিবর্তন হয়নি তবুও অম্লানদা আর দীপঙ্করদার কোয়ার্টার চিনতে পারলাম না।
দুপুরে খাবার পর আবার ওসমানে বাড়ি এলাম। বাড়িতে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। ওমসানের যে ছোট্ট মেয়েটা আমার ঘরে এসে আমার স্ত্রীর হাতে মহেন্দী এঁকে গিয়েছিল তার বৈধ‍ব‍্য চেহারা চোখে দেখতে পারছিলাম না। ওসমানকে নিয়ে চললাম রানিং রুম দেখতে। মেয়ে বলল বাবা রাতে দেখতে পায় না। রাত হলে দয়া করে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। রানিং রুম বর্তমানে রেল সুরক্ষা বলের ফাঁড়ি হয়েছে। দীঘির চারিদিকে ইটের পাঁচিল তুলে দিচ্ছে। সাতদিন পরে এলে আর দেখতে পেতাম না। পায়ে পায়ে নদীর সেই ব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই শ্মশাণ অগের মতোই আছে। তবে সন্ধ্যায় এই শ্মশাণের পাশ দিয়ে যেতে না চাওয়া, ভুতের ভয়ে কাবু সেই এম আর সাহা আর নেই। এই শ্মশাণেই পঞ্চভুতে মিলিয়ে গেছে সে। কুমিরের মতোন সেই পাথরটার দু পাস দিয়ে আজও অবিরাম একইভাবে জল বয়ে চলেছে। বিগত কুড়ি বছর ধরে একই ভাবে তবে আর কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জল বয়ে যাওয়া দেখে কিনা জানিনা।
ফের স্টেশনে ফিরে এলাম। অম্লানদা ও দীপুদাদের টিএক্সআর অফিস একই রকম রয়ে গেছে, তবে বেশিদিন থাকবে না কারন এক নম্বর প্ল‍্যাটফর্ম উঁচু করার কাজ শুরু হয়েছ। প্রত‍্যেক স্টাফের খোঁজ ওসমান দিতে পারলোনা। তবে অনেকেই গত হয়েছে। রামকুমারকে দেখার ইচ্ছে ছিল। জানলাম কয়েক বছর আগে পত্নী বিয়োগের পর থেকে  সে এখন হনুমান মন্দিরের সর্বক্ষনের সেবক। দেখা হবার পর অশীতিপর বৃদ্ধ রামকুমার বারবার করে বলতে লাগল “হে প্রভুজী কেয়া সুন্দর দর্শন হুয়া “, পুজোর প্রসাদ দিয়ে আমার মেয়েকে বলল “আপকা পাপাকা হর বাত হামলোক মানতে থে”, আমকে ভালো ভাবে চাকরি শেষ করার জন‍্য প্রার্থনা করলো।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। একটু বাদেই ফেরার ট্রেন আসবে। বাজারে গিয়ে ওসমানকে পাঁচশো টাকার মিষ্টি কিনে দিয়ে ওকে ওর ঘরে পৌছে দিয়ে হোটেলে ফিরলাম। রাতের খাবার প‍্যাক করে স্টেশনে এসে ট্রেন ধরলাম। ঠিকই করে ফেলেছি আর কখনও ফিরে আসব না। ট্রেন ছেড়ে দিলে দরজায় হাতল ধরে দাঁড়ালাম। আজ আর কুঊঊ–ঝিক — ঝিক করতে করতে গাড়ি রূপকথার যাত্রা করছে না, ইলেকট্রিক ইন্জিন টেনে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িকে। সিদ্ধিবাবা পাহাড় ধীরে ধীরে পিছনে সরে যাচ্ছে। আগে রাতের আঁধারিতে যে সিদ্ধীবাবা পাহাড় সম্ভ্রম জাগাতো, আজ চীনা টুনি বাল্বের সজ্জায় সে তার গাম্ভীর্য ও কৌলিন‍্য দুই  হারিয়েছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার লেকো শেড, বুকিং অফিস সবকিছু পিছনে ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন, শীঘ্রই সামনে চড়াই পার করবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে । নজর ফেরাতে পারছিনা শেষবার চোখে দেখাটা দেখার থেকে। কি আশ্চর্য, শেডের টিনের চালে এখনো যে অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে শেডের টিনের চালের সেই লেখাটা — “হাউজ অফ স্টীল হরসেস”—।
Print Friendly, PDF & Email
Previous articleশুভ জন্মদিন
Next articleবন্ধু
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments