গত কয়েক হপ্তা ধরে কাজের এত চাপ যে রোজই প্রায় শুতে শুতে ভোর হয়ে যাচ্ছে । আর তার উপর শুক্রবারগুলোয় কিভাবে যে ডবল কাজ জমে যাচ্ছে সে রহস্যের সমাধান করতে মনে হয় স্বয়ং শার্লক হোমসও পারবে না । যথারীতি এই শুক্রবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি । আমরা যারা কর্পোরেটে কাজ করি (সে যত উঁচু পোষ্টের হনুই হোক না কেন) তাদের আর তাদের ক্লায়েন্টদের সম্পর্কটা অনেকটা সার্কাসের বাঘ আর রিং মাস্টারের মত । মানে যতই গর্জন করি আর যাই করি আল্টিমেটলি সেই রিং মাস্টার থুরি ক্লায়েন্টের চাবুকে উঠবো, বসবো ,এমনকি হাজার কষ্ট হলেও আগুন জ্বালানো সরু রিংয়ের মধ্যে দিয়ে গলে খেলা দেখাব । যাকগে এসব কথা বলে লাভ নেই, যেমন চলছে তেমনই চলবে । তা এই শুক্রবারও ক্লায়েন্টের আবদারে গতানুগতিক কাজের মধ্যে ইনোভেশন আনতে গিয়ে নিজেকে ইলাস্টিকের মত স্ট্রেচ করে রাত কাবার করে ফেললাম । ভোরবেলার দিকে একটু ঢুলু ঢুলু ভাব আসছিল দেখে ল্যাপটপটা স্লিপ মোডে রেখে, সকাল ৮টা থেকে ৮-১৫ র মধ্যে তিনখানা অ্যালার্ম দিয়ে, শুতে গেলাম এই প্রার্থনা করে যেন সকালে ঘুমটা ঠিক সময়ে ভাঙে আর আমি চটজলদি কাজটা শেষ করে পাঠিয়ে দিয়ে আমার উইকএন্ডটাকে মার্ডার হওয়া থেকে বাঁচাতে পারি। শুয়ে তো পড়লাম ঘুম আসছে দেখে, কিন্তু শোয়ার সাথে সাথেই সেটা যেন বেমালুম উবে গেল । এদিকে ঘন্টা দুয়েক পরেই আবার উঠতে হবে, না হলে ফুল কেস খাবো । এটা সেটা ভাবতে ভাবতে চোখটা একটু লেগে এসেছিল , হঠাৎ ফোনের ইমেল অ্যালার্টে ফের ঘুমের ১৩টা বেজে গেল । মানে কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কি, তখন একটা আলপিন পড়ার শব্দেও ঘুম ভাঙতে পারে । ঘুমটা আর হবে না, এই ভেবে ফের আলো জ্বালিয়ে বসে পড়লাম ল্যাপটপের সামনে। বাইরে তখনও ভালো করে দিনের আলো ফোটে নি। ল্যাপটপটা অন করতে করতে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম কে মেল পাঠাল এইসময় । দেখি অফিশিয়াল নয় ,এসেছে একখানা পার্সোনাল মেল এবং সেন্ডার এর নামের পাশে লেখা আছে ‘অভিরূপ দে’। অভি আমার ছোটবেলার বন্ধু। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে আমরা একসাথে পড়াশুনা/খেলাধুলো করেছি ক্লাস টুয়েলভ অব্দি । তারপর আমি নিলাম স্ট্যাটস আর অভি নিল আর্কিওলজি । সেই থেকে যোগাযোগ কমে এসেছে। তাও কলেজে পড়াকালীন দুএকবার স্কুলের রি-ইউনিয়নে দেখা হয়েছিল । তখনই ইমেল আইডি,ফোন নাম্বার আদানপ্রদান হয়েছিল । যদিও তারপরেও তেমন একটা যোগাযোগ হয়নি । এতদিন পর ইমেল পেয়ে তাই একটু অবাকই হয়েছিলাম । হয়ত ফোনে ট্রাই করেছে, কিন্তু আমি ব্যাঙ্গালোর আসার পর যে নতুন নাম্বার নিয়েছি, সেটা মনে হয় ওর কাছে নেই। দেখলাম একটা রামায়ন সাইজের মেল, অতক্ষণ মোবাইলে সেটা পড়া বিরক্তিকর বলে, মোবাইলটা পাশে রেখে ল্যাপটপেই মেল-বক্সটা খুলে নিলাম। অভি লিখেছে,
“ভাই দেবু,
আমার মেল পেয়ে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছিস । ভাবছিস এত বছর পরে কিভাবে আমার হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল । নাহ, তোর সন্দেহটা অমুলক নয়। একটা বিপদে আমি পড়েছি আর সেটার কথা এমন একজনকে জানাতে চাই যে আমায় অন্তত অবিশ্বাস করবে না। জানিনা তুইও বিশ্বাস করবি কিনা । তাও তোকে আমি যতটুকু চিনি তাতে মনে হয় তোর বিশ্বাস হলেও হতে পারে। গোড়া থেকে না বললে কিভাবে কি হল সেটা বুঝতে অসুবিধে হতে পারে,তাই একটু ডিটেলেই লিখছি ;
আজ থেকে মাসখানেক আগে একদিন অফিস ফেরত,আমার এক পুলিশ বন্ধুর সাথে দেখা করতে লালবাজার গেছিলাম। সে আমার কলেজের বন্ধু, আর্কিওলজি নিয়ে পড়াশুনা করলেও বাড়ির অভাব অনটনের জন্যে মাস্টার্স না করে পুলিশে যোগ দেয় । সেই বন্ধুর সাথে প্রায় একবছর পরে দেখা হওয়ায় একথা সেকথায় বেশ অনেকটা সময় বেরিয়ে গেছিল। যখন লালবাজার থেকে বেরলাম তখন আশপাশের দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে । আমার ফ্ল্যাট হাওড়ার দাশনগরে। অনেকটা পথ, তাই বাইক নিয়েই এসেছিলাম । ব্রেবর্ন রোডটা কিছু একটা কারণে বন্ধ থাকায় আর রাতের এইসময় রাস্তা ফাঁকাই থাকবে এই আশায় ; রবীন্দ্র সরণি, এমজি রোড হয়ে সোজা হাওড়া ব্রিজে উঠব ভাবলাম। বাইক স্টার্ট দিয়ে সবে যখন টেরিটি বাজারের মুখটায় এসেছি, এমন সময় দেখি রাস্তার ধারে এক চাইনিজ বয়স্ক ভদ্রলোক তার পুরনো ইয়েজদিটাকে স্টার্ট করার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই সেটা আর স্টার্ট নিচ্ছে না। রাস্তায় গোনাগুন্তি কিছু গাড়ি চলছে । দোকানপাট সবই প্রায় বন্ধ। সুতরাং মেকানিক পাওয়ার ক্ষীণ আশাটুকুও নেই। একজন বয়স্ক লোক এই সময় বিপদে পড়ে অসহায় দেখে আমি নিজের বাইকটা সাইডে দাঁড় করিয়ে, ভদ্রলোকের দিকে পায়ে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম আমি কোন হেল্প করতে পারি কিনা । তিনি তাঁর বাইকটা দেখিয়ে ইশারা করতেই আমি ভালো করে সেটাকে দেখতে লাগলাম । কিছুক্ষণ লড়াই করার পর নিজে থেকেই সেটা স্টার্ট নিল । ভদ্রলোক খুব খুশি হয়ে আমায় থ্যাঙ্কস বলেই চললেন । এই ধন্যবাদ দেওয়ার পালা শেষ হলে উনি পকেট থেকে একটা ছোট্ট কারুকার্য বাক্স বের করে আমায় দিয়ে বললেন,
-“ টেক ইট বাবু , টোকেন অফ থ্যাঙ্কস”
আমি তো কিছুতেই নেব না, আর উনি দিয়েই ছাড়বেন । উনি বলছেন,
-“ আমাদের ধর্মে বলে,কেউ সাহায্য করলে তাকে কিছু না কিছু দিতেই হয় ,আপনি প্লিজ না করবেন না” ।
-“ আরে না না এসব আবার ক্যান, আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তাকেও হেল্প করতাম, আর তাছাড়া আমি তো কিছুই করিনি। গাড়ি আপনার নিজে নিজেই স্টার্ট নিল”
-“সে হোক, তবু আপনাকে নিতে হবে, আপনি না থাকলে আজ আমি খুব বিপদে পড়ে যেতাম” ।
এভাবে আরও কিছুক্ষণ চলার পর একরকম জোর করেই আমায় উনি বাক্সটা ধরিয়ে দিলেন । অজানা একটা লোকের থেকে কিছু নিতে মন চাইছিল না, তাও ওই বয়স্ক ভদ্রলোকের জোরাজুরিতে নিতেই হল। দুজন দুজনকে বিদায় জানিয়ে বাইকে স্টার্ট দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । বাড়ি ফিরে বাক্সটা আমার স্টাডি রুমের টেবিলে রেখে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন ঘুম থেকে ওঠার পর বাক্সটার কথা একদম ভুলেই গেছিলাম। দিনের শেষে অফিস থেকে ফিরে একটা গল্পের বই নিয়ে স্টাডি টেবিলে বসতেই চোখ গেল বাক্সটার দিকে । সেটাকে হাতে তুলে নিলাম ভাল করে দেখব বলে ।বাক্সটা কাঠের তৈরি । ঊপরে সুন্দর করে একটা ড্রাগনের মুখ খোদাই করা আছে । আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টে কাজ করার দৌলতে প্রায়ই কিছুনা কিছু হিস্টোরিকাল জিনিস ঘাঁটতে হয় । এই বাক্সটা হাতে নিয়েই বুঝেছিলাম, এটা বেশ পুরনো এবং এদেশীয় জিনিস নয়। এক্স্যাক্টলি কত পুরনো তা জানতে গেলে কিছু টেস্ট করতে হবে যেটা প্রপার ইকুইপমেন্ট ছাড়া সম্ভব না । যাইহোক সেটাকে খুলে দেখতে গিয়ে দেখি, সেটার ভিতরে রয়েছে এক বান্ডিল রঙিন কাগজ । ভালো করে দেখে বুঝলাম অগুল হল এক ধরনের ‘স্টিকি নোট’, সেগুলর ওপরে আবার বিভিন্ন জন্তু জানয়ারের ছবি আঁকা। গিফট হিসাবে জিনিসটা সত্যিই খুব সুন্দর । মনে মনে ঠিক করলাম আগামীকাল অফিস থেকে ডেটিং মেটিরিয়ালগুলো নিয়ে এসে বাড়িতেই টেস্ট করে দেখব এই জিনিসগুলো ঠিক কত পুরনো । তার পরেরদিন যথারীতি অফিস থেকে ডেটিং মেটিরিয়ালগুলো নিয়ে এলাম । রাতে টেস্ট গুলো শুরু করলাম, ডেটিং সলিউসনে কাঠের বাক্স আর একটা স্টিকি নোট চুবিয়ে কিছুক্ষণ পর সেগুলো তুলে নিলাম । তারপর বাক্সটা একটা র্যাকে শুকোতে দিলাম আর স্টিকি নোটটা একটা কাঠের কেসের উল্টোদিকে সেঁটে দিলাম । ঘণ্টা দুয়েক পর যখন দুটোই পুরপুরি শুকিয়ে এসেছে তখন আমার বাকি টেস্টগুলো এক এক করে করা শুরু করলাম। সব শেষে যা দেখা গেল তাতে করে বাক্সটা এবং সেই কাগজের স্টিকি নোটগুলো কম করে ৪০০-৪৫০ বছরের পুরনো । অথচ আমরা জানি স্টিকি নোট প্রথম তৈরি হয় ১৯৬৮ সালে আমারিকায় । তার মানে চাইনিজরা আরও আগেই এ জিনিস তৈরি করে ফেলেছিল , কি আশ্চর্য ! আমার তো ভেবেই আনন্দ হল যে এত পুরনো একটা ভিনদেশি জিনিস আজ আমার কাছে । এতদিন শুধু অফিসের কাজেই এসব পুরনো জিনিস ঘেঁটেছি । নিজের বলতে এরকম কিছুই ছিল না । ওহ হ্যাঁ বলতেই ভুলে গেছি, ওই স্টিকি নোটগুলো আমি ভালো করে দেখেছি, আর তারপর সেগুলর উপরে আঁকা ছবিগুল নিয়ে পড়াশুনা করে বুঝেছি যে এগুল আসলে চাইনিজ হরস্কোপের সিম্বল । যাইহোক, বাক্সের মধ্যে ওই স্টিকি নোটগুলো সব রেখে দিয়ে বাক্সটা আমার স্টাডি টেবিলের ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দিলাম ।
তার পরের সপ্তাহে শনিবারের ঘটনা । ছুটিরদিন, তাই সকালে ওঠার ব্যপারও নেই। বেলা ১০টা নাগাদ বউ এসে ঠেলা দিয়ে বলল ,
“ওঠ , অতনু এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে” ।
অতনু আমার কলেজের বন্ধু । আশুতোষ কলেজে পার্ট-টাইম লেকচারার হিসাবে পড়ায় । মাসে একবার করে আসে আমার বাড়ি । হাল্কা গল্প, হাসিঠাট্টা , দুয়েক দান দাবা খেলা এসব চলে আর কি। সেদিনও একই কারনেই আসা । ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বসলাম আড্ডা দিতে । কথা বলতে বলতে অতনু একবার ওয়াশরুমে যাবে বলে উঠতেই চোখ গেল ওর মাথার পিছনে । সেখানে একটা ছোট্ট মেডিকাল প্যাচ লাগানো । ও ফিরে আসার পর ওকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,
“আর বলিস না ভাই, গত সপ্তাহে এক রাতে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম । হঠাৎ যেন মনে হল মাথার পিছনে কেউ খুব জোরে কিছু একটা দিয়ে মারল, আমিও সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। অথচ গোটা বাড়িতে আমি একাই ছিলাম । দরজাও বন্ধ ছিল । সুতরাং আমায় অন্য কারো মারা কোন চান্সই নেই । জ্ঞান ফিরতে মাথার পিছনটা হাত দিয়ে বুঝলাম কিছুটা চুল উঠে গেছে আর সেই জায়গাটা রক্তে ভিজে । চট করে মোবাইলে আমার এক বন্ধুকে কল করতে সেই এসে আমায় ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে আমার ফাস্টএইড করিয়ে নিয়ে এল । ডাক্তার বলল কনকাশন । রোদে বেশি ঘুরেছি বলে নাকি ওরকম হয়েছে । এসবক্ষেত্রে এইধরনের ব্যাথা নাকি আচমকাই ওঠে, মনে হয় যেন কেউ মাথার পিছনে সজোরে বাড়ি মারল । আর তারপর হয়ত পড়ে গিয়েই আমার মাথায় ওই আঘাতটা লেগেছে” ।
তারপর আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর অতনু সেদিনকার মত বাড়ি চলে গেল । এরপর আমি নিজের স্টাডির দিকে পা বাড়িয়েছি কি আমার বউ সুনন্দা এসে বলল,
-“কোথায় যাচ্ছ?ও ঘরে এখন তোমার যাওয়া হবে না”।
-“কেন”?
-“কেন মানে? কি রকম নোংরা করে রেখেছ তার খেয়াল আছে? তোমার আর কি, তুমি এদিক ওদিক সব ছড়িয়েছিটিয়ে রাখ, আর আমি গুছিয়ে মরি”, বেশ রেগেই বলল সুনন্দা ।
-“আরে থাক না, কি দরকার, আবার আমি দরকারি জিনিস খুঁজে পাব না”, একটু হেসে বললাম আমি ।
-“থামো তো তুমি”।
বলে সে নিজে ঘর পরিষ্কার করার সরঞ্জাম নিয়ে আমার স্টাডির দিকে রওনা দিল । কি আর করা, অগত্যা আমিও গেলাম পিছু পিছু । হেল্প না করলে আবার সেই নিয়ে আগামী কয়েকবছর ধরে খোঁটা দিয়ে যাবে । কয়েক ঘন্টা ধরে সমস্তরকম প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে ঘর গোছান যখন প্রায় শেষের দিকে ঠিক তখন চোখ গেল একটা কাঠের কেসের উল্টোদিকে লাগানো একটা গ্রুপ ফটোর দিকে । তেমন অসাধারন কোন ছবি সেটা নয়,কিন্তু একটা বিশেষ কারনে সেটা সেসময়ে চোখে পড়ল । কারণটা আর কিছুই না, সেই ছবিটা আমাদের কলেজের লাস্টদিনের, আর সেখানে অতনুর ছবিও আছে। কিন্তু এই অব্দিও সব ঠিকই ছিল, খালি ছবিতে অতনুর মুখটা যেন আশ্চর্যরকমভাবে লাল হয়ে আছে, যেন কেউ রক্ত ঢেলে দিয়েছে । অদ্ভুতকান্ড, এখানে রক্ত কোনভাবেই আসতে পারেনা। তাহলে হয়ত আমার কাজের কোন কেমিক্যাল সলিউশন পড়ে এমনটা হয়েছে ।
-“কি গো? কি দেখছ অমন করে?” বৌ এর কথায় চমকে উঠলাম ।
-“হুম!! না না কিছুনা, চল খুব খিদে পেয়েছে, খেতে দাও”।
– “চল”।
তখনকার মত ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে খেতে চলে গেলাম। তারপর অন্যান্য টুকটাক কাজে ব্যাস্ত হয়ে যাওয়ায় আর মাথায় থাকল না জিনিসটা । রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আবার স্টাডিতে ফিরতেই মাথায় এল দুপুরের কথা। শেল্ফ থেকে কাঠের কেসটা নিয়ে ভাল করে লক্ষ করতে থাকলাম । হঠাৎ খেয়াল হল অতনুর ছবিটা যেখানে আছে ঠিক তার উল্টোদিকটাতেই আমি সেদিন সেই স্টিকি নোটটার এজ টেস্ট করছিলাম। ঠিক মাথার উল্টোদিকে । আরে, আজ সকালেই তো দেখলাম অতনুর মাথায় একখানা চোট এবং সেটাও বেশ অদ্ভুতভাবেই লেগেছে । তবে কি ওই স্টিকি নোটগুলোর কোন অদ্ভুত ক্ষমতা আছে? নাহ এও কি আজকের যুগে সম্ভব? কিন্তু মাথায় যখন একবার ব্যাপারটা ঢুকেছে তখন যাচাই তো করে দেখতেই হচ্ছে। কিন্তু কার উপর আর কিভাবে?
আমার গিনিপিগ (মানে যার উপর পরীক্ষাটা করব) পেতে বিশেষ অসুবিধে হল না । আমরা যে এপার্টমেন্টে থাকি সেইখানকার সিকিউরিটি গার্ডটা মোটেই সুবিধের নয় । এমনিতে বিল্ডিঙের লোকজন দেখলেই সেলাম ঠুকবে, নমস্তে স্যার,নমস্তে ম্যাডাম করবে । কিন্তু সুযোগ পেলেই ব্যাটা ঠিক মেয়েদের দিকে খারাপ চোখে তাকাবে । আবার ব্যাপারটা এমন ক্যামফ্লেজড ওয়েতে করে যে কোনভাবেই তাকে সন্দেহ করা যাবে না । আমার চোখে প্রথম পড়েছিল যখন ও সুনন্দার দিকে ওইভাবে তাকায় । আমরা একটা পার্টি থেকে ফিরছিলাম । বাড়ি ঢোকার সময় একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম গাড়ির চাবিটা অন্ধকারে পড়ে যাওয়ায় । চাবিটা তুলে এগিয়ে যেতে গিয়ে দেখি মালটা সুনন্দার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন ক্ষুধার্ত বাঘ এক হরিনের দেখা পেয়েছে। আমি যে পেছনে আছি সেটা মনে হয় বুঝতে পারেনি । সুনন্দাও এগিয়ে থাকার জন্যে কিছু টের পায়নি । তারপর আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে এমন ভাব করল যেন কত সাধু পুরুষ। সেদিন দেখার ভুল আর নিজেকে বৌয়ের প্রতি ওভার পসেসিভ ভেবে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু পরেও কয়েকবার অন্য মেয়েদের দিকে ওকে একইভাবে তাকাতে দেখেছিলাম । সোসাইটিতে এ নিয়ে এক-দুজনের সাথে কোথাও বলেছিলাম । কিন্তু কেউই ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ মানতে চায়নি । আমার মনে হল একে জব্দ করার এইটাই সুযোগ । যদি সত্যিই সেই নোটগুলোর কোন ক্ষমতা থাকে তাহলে এর উপর পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে । কিন্তু প্রব্লেমটা হল ছবি । এই দারোয়ানের ছবি পাই কোথা থেকে? সেটাও ভেবে একটা উপায় করলাম । একদিন সুনন্দা র সাথে বাজারে বেরলাম যখন , আমি ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়লাম মিটার বক্স চেক করার নাম করে । তারপর সুনন্দা এগিয়ে যেতে যখন মালটা আদেখলার মত ওকে দেখতে থাকল, তখন টুক করে থামের আড়াল থেকে দারোয়ানটার একটা ছবি মোবাইলে তুলে নিলাম। সুনন্দাকে টোপ হিসাবে ব্যাবহার করার জন্যে মাথা গরম হয়েই ছিল, তাই বাজার থেকে বাড়ি ফিরে আর কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের স্টাডি গেলাম আর সেখানে ওই স্টিকি নোট ভরা বাক্সটা বের করলাম। এরপর সেখান থেকে একটা নোট বের করলাম আর মোবাইলে দারোয়ানের ছবিটা বের করে মোবাইল স্ক্রিনে ওই নোটটা একবার সাঁটিয়ে কিছুক্ষণ রেখে তুলে নিলাম । কিন্তু মনেমনে এত ভয় পেলাম যে বাইরে দেখার আর সাহস হল না ।
বিকেলবেলায় সুনন্দা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল,
-“শুনেছ কাণ্ড?”
– “কি হয়েছে? হাঁপাচ্ছ কেন?” যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম ।
-“ আমাদের বিল্ডিঙের ওয়াচম্যানটা মারা গেছে । কি করে কি হল কেউ জানে না । দুপুর বেলায় ২ তলার কার্ত্তিক দা নিচে নামতে গিয়ে দেখে ওয়াচম্যান মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে আছে, আর মুখটা চেনা যাচ্ছে না প্রায়” ।
-“কেন? কি হয়েছে মুখে?”
– “কপালটা পুরো ক্ষতবিক্ষত । যেন কেউ কপালের উপর থেকে মুরগির ছাল ছাড়ানোর মত করে চামড়াটা তুলে নিয়েছে। উফ,কি ভয়ানক ব্যাপার”।
-“তুমি নিজে দেখলে নাকি? আমি যাবো একবার”?
-“নাহ আমি দেখতে পাইনি, পুলিশ বডি নিয়ে গেছে। এখন গিয়ে কিছু পাবে না দেখতে। সবাই বলাবলি করছিল, সেখানেই শুনলাম”।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে নিজের স্টাডিতে ফিরে এলাম । কিছুটা ভয়ই পেলাম বলতে পারিস । এরপর পুলিশ এসে বহুবার বহু লোককে জেরা করেও কিছু বের করতে পারল না। সবার বাড়ি তল্লাশিও করল ওয়ারেন্ট এনে। কিন্তু কিছুতেই খুনিকে ধরা গেল না, খুন বলছি কারণ পুলিশের শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল যে কেউ বা কারা দারোয়ানটাকে মেরেছে । শেষমেশ পুলিশ হার মানল । আর অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু দেখিয়ে কেস ফাইল বন্ধ করে দিল।
কিন্তু আমি যেন তাও নিশ্চিত হতে পারছিলাম যে এসব কিছু ওই স্টিকি নোটের জন্যেই হয়েছে কিনা । তাই ঠিক করলাম আরো একটা পরীক্ষা করব । কিন্তু আবারও সমস্যা একটাই, কে হবে সেই লোক যার উপর আমি পরিক্ষাটা করব ? কিন্তু কি অদ্ভুত এবারও আমার সাবজেক্ট পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না । আমাদের এপার্টমেন্টের উল্টোদিকের বিল্ডিংটায় এক বেয়াড়াগোছের মাঝবয়সী ভদ্রলোক থাকেন। বেয়াড়া বলছি কারন ওনার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে । সেটা হল মাঝরাতে উঠে নিজের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে “বৃন্দাবনি সারাঙ্গ” বা “ভীমপলাশি” গোছের রাগ উছচস্বরে গাইতে থাকেন । অবাক হচ্ছিস তো? ঠিক এইটাই হয় , ভদ্রলোক মধ্যাহ্নের রাগ মধ্যরাত্রে গেয়ে থাকেন । আর সেখানেই বিরক্তি । এমনিতে গলা বেশ ভালই । তাই ভাবলাম এনাকে একটু অল্পের উপর দিয়ে শিক্ষা দিয়ে দেখি । যদি সাকসেসফুল হই তাহলে মেনে নেব, সত্যিই এই নোটগুলোর স্পেশাল পাওয়ার আছে । কিন্তু এখানেও প্রব্লেম । ভদ্রলোককে তো নামে চিনি না বা আলাপও হয়নি কখনও । এখন এইরকম একজনের ছবি কিভাবে পাব? অজানা অছেন লোকের তো হুট করে ছবি তোলা যায়না । অনেক ভেবে একটা উপায় করলাম । একদিন বিকেলে এমনিই ঘুরতে ঘুরতে ওই বিল্ডিঙের ওই ফ্লোরে চলে গেলাম যেখানে সেই ভদ্রলোক থাকেন । তারপর আন্দাজ করে ওনার ফ্ল্যাটটার সামনে গিয়ে বাইরের নেমপ্লেট থেকে নামটা নোট করে নিলাম। ভদ্রলোকের নাম ‘যতীন ঘোষ’ । বাড়ি এসে ল্যাপটপে ফেসবুক খুলে নামটা লিখে সার্চ দিতেই শ-খানেক রেজাল্ট এল । এগুলর মধ্যেই আমি আমার সেই লোকটিকে খুঁজে পেলাম যাকে আমি চাইছিলাম । মনে যেটুকু আশঙ্কা ছিল , পাব কি পাব না সে ব্যাপারে , এখন আর সেটাও রইল না । ওনার প্রোফাইল থেকে একটা পছন্দসই ছবি নিজের ড্রাইভে ডাউনলোড করে রাখলাম। তারপর সেদিন মাঝরাতে যখন ব্যালকনিতে এসে উনি রাগ ‘মুলতানি’ ধরলেন, আমিও ল্যাপটপে ওনার ছবিতে ওনার গলার ওপর দিয়ে আলতো করে একখানা স্টিকি নোট বুলিয়ে দিলাম । ভদ্রলোক সেইসময় সবে ‘আলাপ’ থেকে ‘জোর’ এ ঢুকেছেন, হঠাৎ যেন তার গলাটা কুকুরের চেঁচানির মত শোনাল, যেন কেউ গলাটা জোরে চিপে দিয়েছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উনি থেমে গেলেন । আবার একটু বাদে গাইতে যেঁই শুরু করেছেন , আমিও ওমনি আবার ঠিক ছবিতে গলার জায়গাটার উপর দিয়ে আরও একবার আলতো করে নোটটা বুলিয়ে নিলাম । এবার আবার ওই কুকুরের ভয়ার্ত চিৎকারের মত আওয়াজ উঠল ওনার গলা দিয়ে । ভদ্রলোক ভয় পেয়ে গান থামিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন । আমি মনে মনে যারপরনাই খুশি হলাম । বার বার মনে হতে লাগল আমি এখন ভগবান , আমি যা চাইব তাই হবে , আমি যা খুশি তাই করব। কেউ আমার কিস্যু করতে পারবে না ।
এরপর থেকে ভাই আমি অন্য মানুষ হয়ে উঠলাম । যে কিনা নিজের পরিবার আর কাজ ছাড়া কিছু বুঝত না এদ্দিন, সেই হঠাৎ অন্ধকার জগতে পা বাড়াল ।মাঝরাতে কলকাতার নিষিদ্ধ স্ট্রিট রেসিঙে গিয়ে টাকার বাজি ধরতে শুরু করলাম ।সঙ্গে করে ওই নোটগুলোও নিয়ে যেতাম । আর নানা অছিলায় যারা বাইক রেস খেলবে তাদের ছবি নিয়ে রাখতাম মোবাইলে । আমি যার উপর টাকা লাগিয়েছি তার হারার চান্স দেখলেই ওই স্টিকি নোটগুলো কায়দা করে বের করতাম । বেশিরভাগ সময়তে প্রতিপক্ষকে হাল্কা আঘাত দিলেই কাজ হয়ে যেত, কিন্তু সেরকম কঠিন প্রতিপক্ষ দেখলে তাকে মেরে ফেলতেও আমার হাত কাঁপত না । এভাবে আমি অল্পদিনেই বড়লোক হয়ে গেলাম । যে আমি কোনদিন মদ ছুইনি, সেই আমিই রোজ বাড়ি ফিরে মদ খাওয়া শুরু করলাম ।
এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝে গেছিস যে ওই স্টিকি নোটের ব্যাপারটা আমি কাউকে জানাইনি, এমনকি সুনন্দাকেও না । কিন্তু আমার এই অদ্ভুত পরিবর্তনে যদি কেউ সবথেকে বেশি চিন্তিত হল তো সে সুনন্দা । রোজই আমায় বোঝাতে লাগল, মদ খেও না । ওসব খেয়ে কি হবে? কিন্তুও আমি তো তখন নিজের মধ্যে নেই যে বুঝব, আর পেটে দু পাত্তর পড়ার সাথে সাথে আমি একটা জানোয়ার হয়ে উঠতাম। বৌকে খিস্তি করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতাম । আমার বৌ, যাকে আমি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি, তার সাথেই আমি এমন দুর্ব্যাবহার শুরু করলাম যা কেউ নিজের চরম শত্রুর সাথেও করে না । সবকিছু মাত্রা ছাড়াল যেদিন আমি মোটা টাকার বিনিময়ে বাইরের একটা লোক এনে সুনন্দার ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলাম । আমার এরকম আচরণে স্তব্ধ হয়ে গেল সুনন্দা । মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ পর্যন্ত করল না যখন আমার আনা সেই লোকটা ওকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেল । আমিও বাইরে বসে মদ খেতে থাকলাম । আধ-ঘন্টাখানেক পর লোকটা আমায় টাকা দিয়ে চলে গেল । টাকাগুলো সোফায় রেখে আরেক গ্লাস ঢালতে গিয়ে দেখি আলুথালু বেশে সুনন্দা এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে,
-“ কেন এমন করছ?” যন্ত্রের মত বলল আমায়,ওর চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে কান্নার জল ।
– “ আমি যা খুশি করব, তুই বলার কে?”
-“ মদ খেতে তোমায় কত বারন করেছি, মদ খেলে তুমি আর নিজের মধ্যে থাকনা । কি এমন হল তোমার যে তুমি এরকম পাল্টে গেলে?”
-“ আমার যা খুশি আমি তাই করব, কেউ আমায় আটকাতে পারবে না”
-“আমি তোমায় এমন করতে আর দেব না, অনেক সহ্য করেছি, আর না। তোমায় আজ বলতেই হবে কি হয়েছে তোমার যে তুমি এমন পাল্টে গেছ ।”
-“ তুই আটকাবি আমায়? তুই? একটা সামান্য মেয়েছেলে আমায় আটকাবে?”
এরপর আরও কিছুক্ষণ চলল আমাদের সেই ঝগড়া । বিশ্বাস কর ভাই এর আগে কখন এরকম ঝগড়া আমাদের হয়নি। মদের নেশায় তো ছিলামই, তার উপর ক্রমাগত সুনন্দা বলছিল ও আমায় পাল্টে তবেই ছাড়বে । আমার পৌরুষে ঘা লাগছিল বারবার । মাথায় আগুন উঠে গেল,
-“তুই আমায় পাল্টাবি, তবে রে শালী………”
বলেই ছুটে গেলাম আমাদের শোয়ার ঘরে । সেখান থেকে আমাদের বিয়ের এ্যালবাম খানা বের করলাম । তারপর সেখান থেকে কনের বেশে সুনন্দার একটা ছবি নিয়ে আমার স্টাডি থেকে সেই বাক্সের মধ্যে রাখা স্টিকি নোট থেকে একটা বের করে ছবিতে লাগিয়ে এমন টান মারলাম যে সুনন্দার ছবিটার মাথার জায়গাটা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল । এরপর সেগুলো ওখানেই ফেলে রেখে বাইরের ঘরে ,যেখানে সুনন্দা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল সেখান, ফিরে এলাম । আর আসার পরই যেন আমার হুঁশ ফিরল । দেখি মেঝেতে রক্তারক্তি হয়ে পড়ে আছে সুনন্দার প্রাণহীন (থুরি মুণ্ডহীন) দেহটা আর মাথাটা পড়ে আছে সোফার উপর । এত আকস্মিক আমি কাজটা করেছি যে বেচারি মুখ দিয়ে আওয়াজটুকুও বের করতে পারেনি । সুনন্দার এইরকম অবস্থা দেখে বুঝলাম কি ভুল আমি করে ফেলেছি । ওর দেহটা জড়িয়ে ধরে পাগলের মত সারা রাত কাঁদলাম । কিন্তু আর কেঁদে কি লাভ । যাকে আমি এত ভালবাসতাম, যে আমায় তার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালবাসত, তাকেই কিনা আমি নিজের হাতে খুন করলাম । শোকে, অনুতাপে আমি পাগলের মত হয়ে উঠেছি । কি করব কিছুই ঠিক করতে পারছিনা । সুনন্দা কে মেরে ফেলেছি দুদিন হল । অনেক ভেবে আজ একটা উপায় করেছি । বেশি সময় আমার হাতে আর নেই । মড়া পচা গন্ধে গোটা ঘর ভরে উঠেছে । আমার সুনন্দার ডেডবডিটার পাশে বসেই তোকে এই মেলটা লিখছি । ওহ হ্যাঁ ভাবছিস নিশ্চয়ই কি উপায় বের করেছি, সেটা পরে জানতে পারবি । জানিনা বিশ্বাস করলি কি না । তবে তোকে জানাতে পেরে খুব হাল্কা লাগছে । মেলটা ঠিক গুছিয়ে হয়ত লিখতে পারলাম না,নিজগুনে ভুলত্রুটি মার্জনা করে দিস । আমার সবকিছুই কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল রে ভাই । নাহ আর কথা বাড়াব না , বিদায় বন্ধু , বিদায়।
ইতি,
অভিরূপ”
মেলটা পড়াকালীন আমার বৌ কখন জানি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । মেলটা পড়া শেষ করে ওর দিকে ঘুরে যা পড়লাম সেটা বলতে যেতেই ও বলল,
-“ আমি শেষ কিছুটা পড়েছি, তাতে যেটুকু বুঝলাম, তাতে আমার খুব ভয় করছে গো। তুমি প্লিজ এক্ষুনি তোমার বন্ধুর যেখানে বাড়ি সেখানকার লোকাল থানায় কল কর” ।
আমারও মনে হল এটাই করা উচিত। আমি আর দেরী না করে নেটে দাশনগর থানার নাম্বার যোগাড় করে সেখানে কল করলাম । তারপর পুরো ঘটনাটা ওনাদের জানাতেই ওনারা অভিরূপের বাড়ির এক্স্যাক্ট ঠিকানাটা জানতে চাইলেন । কিন্তু সেটা তো আমার কাছে ছিল না । তখন ওনারা একটা মেল আইডি দিয়ে আমায় বললেন মেলটা একটু ওনাদের ফরোয়ার্ড করতে আর তারপর “দেখছি কি করা যায়” বলে ফোন রেখে দিলেন । আমিও ওনাদের কথা মত মেলটা ফরোয়ার্ড করে দিলাম । এদিকে এইসব পড়ে তো আমার কাজের কথা মাথাতেই নেই । বেলা যখন প্রায় ১২টা তখন একটা কল পেলাম দাশনগর থানা থেকে । ওরা অভিরূপের মেল আইডি থেকে ওর আইপি ট্রেস করে ওর বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পায় । সেখানে গিয়ে তারা সুনন্দার মাথা কাটা লাশটা পায়। আর ওদের বেডরুম থেকে অভিরূপের ডেডবডিটাও উদ্ধার করে । অভিরূপের দেহে কোন আঁচড় ছিল না । খালি কপালের কাছে একটা মাংসপিণ্ড ঝুলছিল আর সেখান দিয়েই যা রক্ত বেরনোর বেরিয়েছে । মাংসপিণ্ডটা এমনভাবে ঝুলছিল যেন সেটা শরীরের অংশ নয়, কেউ স্টিকি নোটের মত আঠা দিয়ে ওখানে সেঁটে দিয়েছে । তবে ওনারা অভিরূপের বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেখান থেকে কোন চাইনিজ বাক্স বা স্টিকি নোট পাননি । নাহ,অভিরূপের মৃত্যুটা রহস্যই থেকে যাবে মনে হচ্ছে।
এরকম একটা ঝড় চলে যাওয়ার পর সবে যখন একটু নিজের অফিসের কাজের কথা আবার ভাবতে শুরু করেছি, ঠিক তখনই বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠল । দুপুরে খেয়েদেয়ে বৌ ঘুমতে গেছে তাই আমাকেই গিয়ে দরজাটা খুলতে হল । দেখি কুরিয়ারের লোক। আমায় একটা পারসেল ধরিয়ে সাইন করিয়ে চলে গেল । পার্সেলটা নিয়ে ঘরে ঢুকে বুঝলাম সেটা এসেছে হাওড়া থেকে । উপরে সেন্ডারের নাম নেই । আশা-আশঙ্কা নিয়ে খুলে দেখি ড্রাগনের মুখ আঁকা খুব সুন্দর একটা চাইনিজ বাক্স আর বাক্স খুলতেই আমার চোখ কপালে, এ যে ঠিক সেইরকম স্টিকি নোট, যার কথা অভিরূপ মেলে লিখেছিল । দেখলাম তাতে একটা ছোট্ট চিঠিও আছে। সেটা হাতে নিয়ে পড়তেই আমার মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল আর আমি ধপ করে আমার চেয়ারে বসে পড়লাম । যা লেখাছিল তাতে তা কিছুটা এইরকম;
“ভাই দেবু,
মেলটা আশা করি এতক্ষণে পড়ে ফেলেছিস । তোর ঠিকানা আমি আমাদের স্কুলের নিশিথের কাছ থেকে যোগাড় করেছি। সময় বেশি নেই আগেই বলেছি। এখানে আর বেশি কিছু লিখে তাই সময় নষ্ট করব না। উপায়টার কথা মেলে লিখিনি । আমি এই দুদিনে গোরুখোঁজা করে সেই চাইনিজ লোকটাকে খুঁজে পেয়েছিলাম । তার মুখে শুনলাম এই বাক্স আর ওর মধ্যে থাকা নোটগুলো অভিশপ্ত । এমনিতে কোন অসুবিধে নেই । কিন্তু যে ওই নোটের ক্ষমতা দেখে লোভে পড়বে, সেই সব হারাবে । কিন্তু বাক্সটা নিজের কাছে থাকা অব্দি ইহকাল থেকে মুক্তিও পাবে না। আবার বাক্সটা এমন একজনকে দিয়ে যেতে হবে যে তার উপকার করেছে । অন্যথা বাক্স আবার তার কাছে ফিরে আসবে । তুই ছাড়া এই মুহূর্তে কারো কথা মাথায় এল না । তুই আমায় মাধ্যমিকের সময় অঙ্কে পাশ করতে হেল্প না করলে হয়ত আজ আমার চাকরি-বাকরি কিছুই হত না । তাই তোকে আমি এই বাক্সটা দিয়ে গেলাম, খালি বাক্সের মধ্যে থেকে একটা নোট রেখে দিলাম যেটা আমায় ইহকাল ত্যাগ করতে সাহায্য করবে । মনে রাখবি লোভ করেছিস কি মরেছিস । তাই এই বাক্সটা পেয়েই যত্ন করে হয় লুকিয়ে দিবি আর নয়ত কাউকে গিফট করে দিবি । নোটের ক্ষমতা যাচাই করতে গেলেই ওটার লোভে পড়বি আর তাহলেই সব শেষ।
ইতি,
অভিরূপ”
এখন ব্যাপার হল এই পুরো ঘটনাটা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে একবার দেখিই না পরীক্ষা করে স্টিকি নোটগুলো সত্যিই কাজ করে কিনা । কিন্তু, সমস্যা একটাই, কার উপর করব পরীক্ষাটা ? আছে নাকি আপনাদের চেনা কেউ ? থাকলে চট করে তার ছবিটা পাঠিয়ে দিন দেখি আমায় ।