সাদা কালো – Episode 1 : click here
।২।
সোনালি! একি সেই একই সোনালি? সকাল বিকেল যাকে পদা দেখেছে পিঠে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে, বারান্দায় জামা কাপড় শুকো দিতে, কুকুর নিয়ে ছাদে ঘুরতে? একি সেই সোনালি যাকে রাস্তার মোরে ওর ভাইএর সাথে দাঁড়িয়ে মাঝেসাজেই ফুচকা খেতে দেখা যায়? ভাল লাগতো আগে ঠিকই, কিন্তু এ তো সাক্ষাৎ পরী! কি করে পদা একে আগে দেখেনি? শারী পরলেই মেয়েদের এত ডাগর ডোগর দেখায়? হাজার প্রশ্নের এই ঝর সামলাতে পদা যখন জুঝছে, তার সমস্ত সুবাস নিয়ে এগিয়ে এলো সোনালি। মিষ্টি হেসে হ্যান্ডশেকের ভঙ্গীতে হাত বারিয়ে বলল “হ্যালো অনীক, তোমাকে সব সময় দেখি, কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয় নি”। অনীক! এ নামে পদাকে সচারাচর কেউ ডাকেনা। শুনে পদার খুব ভাল লাগলো। “সত্যি? তুমি আমাকে দ্যাখো?” বলতে চাইলো পদা, কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। তার ভীষন আক্ষেপ হতে লাগল যে সে আজ সেজে গুজে আসেনি। কি করে জানবে যে বাবলুদা এই রকম একটা কান্ড করে বসবে! কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে একটু হেসে সোনালির হাতে হাত ঠেকিয়ে বলল “হ্যালো”! ইতিমধ্যে বাবলুদা কোথায় একটা হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো। দু হাতে দুটো চকলেট আইস্ক্রিম। “কি ব্যাপার? মুখটা ওরকম মেনি বেড়াল মার্কা করেছিস কেন?” বলে একটা আইস্ক্রিম সোনালি আর অন্যটা পদার দিকে এগিয়ে দিল। “আমি খাব না” পদার গলাটা এবারে একটু পরিষ্কার হয়েছে। “কি ন্যাকা মাইরি তুই। আইস্ক্রিম আবার কেউ না করে নাকি?” সোনালিও না বলতে যাচ্ছিল। বাবলুদার কথা শুনে একটু থমকে গেল। তারপর তার গোলাপী জিভ বার করে ধীরে ধীরে আইস্ক্রিম চাটতে শুরু করলো। অতি সাবধানে, যাতে লিপ্সটিকের ক্ষতি না হয়। পদা হাঁ করে খানিক্ষণ দেখলো। ঊফ! শরীরটায় একটা অদ্ভুত কিচুলি বিচুলি ভাব হচ্ছে। পদা বিভ্রান্ত! শেষে চোখ সরিয়ে নিয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল। “চলো, আমার হয়ে গেছে”। সোনালির গলার স্বরে পদার ঘোর কাটলো। তিনজনে সিনেমা হলের গেটের দিকে এগতে শুরু করলো। বাবলুদা পকেট থেকে চিরুনি বার করে চুল ব্যাকব্রাশ করতে করতে বলল “কিরে, সিনেমায় যাচ্ছিস, সিনেমার নামই তো জানিস না?” “তুমি তো বললে না”। সোনালি একটু আগে যাচ্ছে। সোনালির গায়ে যাতে কারো ছোঁয়া না লাগে তার জন্য বাবলুদা তার দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে সোনালির ঠিক পেছন পেছন তাকে আগলে চলেছে। পাশে পদা। “গন উইথ দা উইন্ড। ঘ্যামা বই। ড্রামা আছে, ফাইটিং আছে, যুদ্ধ আছে। সব পাবি”। তারপর পদার কানের কাছে মুখটা এনে বলল “আর পোচুর ঢলানি আছে। ওই জন্যই তো ওকে নিয়ে এলাম”। বলে মুছকি হাসল। “তা আমাকে আসতে বললে কেন?” “তুই না এলে যে ও আসতো না” পদার মূহুর্তের জন্য কথাটা ভাল লাগল, কিন্তু পরক্ষনেই সে বুঝে নিল ব্যাপারটা। সাময়িক রাগ হলেও মনে মনে মানতে বাধ্য হল যে বাবলুদার জন্যই সোনালির সাথে তার পরিচয়টা আজ হল।
ইতিমধ্যে ওরা হলে প্রবেশ করেছে। সারে তিন টাকার টিকিটের পুরো সেকশনটাতে মাত্র দুজন টিকিট চেকার। তাকে ঘিরে ধরেছে জনা শয়েক লোক। বাবলুদা বলল “তুই ওর কাছে কাছে থাক তো!” বলে “এইযে দাদা…” হাঁক পেড়ে ঝাঁপিয়ে পরলো ভিড়ে। মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরে এলো টিকিট চেকারকে বগলদাবা করে। ভদ্রলোক মিনমিনে কন্ঠস্বরে কি যেন বললেন বাবলুদাকে। শোনামাত্র পদা আর সোনালির হাত ধরে বাবলুদা হুকুম করলো “চলে আয়। আমি জানি কোথায় সিট”। অন্ধকারে অন্যান্য লোকের পা মারিয়ে হোঁচট খেতে খেতে হঠাত পদা আবিষ্কার করলো যে সে তার সিটে বসে পরেছে। পাশে বাবলুদা। বাবলুদার ওপাশে সোনালি। ঠিক যেন ম্যাজিক! শান্ত হবার পর ভাবলো একবার বাবলুদাকে বলে “কেন? সোনালি কে মাঝে বসাতে পারো তো? ও তো আমার জন্যই এসেছে!” কিন্তু মনের কথা মনেই রয়ে গেল।
তবে বিধাতা বোধহয় আজ পদার জন্য অন্য পরিকল্পনা করেছেন। সিনেমা শুরু হবার আগে আডভাটিস্মেন্ট চলছে। তার শব্দে ওপাশে বাবলুদা আর সোনালি ফিশফিশ করে কি খুনসুটি করছে তা কান খাড়া রেখেও পদা শুনতে পাচ্ছে না। তার ভীষন রাগ হচ্ছে। কি ভাবে ওদের আলাপে ব্যাঘাত ঘটাবে সেই চিন্তায় পদা যখন ব্যাস্ত, তখন হঠাত বাবলুদা তিড়িং করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর সোনালিকে টপকে ঝুঁকে পরে পাশের ভদ্রলোকের কলার ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে গর্জে উঠলো “এইযে দাদু, বাড়িতে কি বাতি জ্বলে না? সিনেমা হলে এসব কি করছেন? বার করে দেবো?” তারপর কলার ছেড়ে দিয়ে সোনালিকে মৃদু কন্ঠে বলল “তুমি মাঝখানে বসো”। “ভগবান, তুমি সত্যিই আছো!” ভাবে পদা। মূহুর্তের মধ্যে একটা মিষ্টি গন্ধে ছেয়ে গেল পরিবেশ।
সেই সুগন্ধের নেশায় তলিয়ে গেল পদা। কখন যে সিনেমা শুরু হল, কে যে সেই সিনেমার নায়ক নায়িকা, কি যে সেই সিনেমার কাহিনি, কিছুই পদাকে প্রথম দশ পনেরো মিনিট আর ছুঁলো না। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে শুধু বুক ভরে গভীর ঘ্রাণ নেয় আর আরচোখে চুরি করে দেখে। এমনি ভাবে কতক্ষন কাটে পদার খেয়াল নেই। এক সময় সে লক্ষ করলো যে যে ভদ্রলোক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করছে তার প্রতি সোনালির অপলক আকর্ষণ। লোকটাকে দেখতে খারাপ নয়, তবে চেহারাটা কেমন যেন একটু ষন্ডা মার্কা। একে এত ভালো লাগার কি আছে? তবে মানতেই হবে, ভদ্রলোকের গলাখানা খাশা। সত্যিকারের ম্যানলি যাকে বলে। ইন্টারভেলে বেরিয়ে চট করে পোস্টারে দেখে নিল যে লোকটার নাম রেঠ বাটলার আর তার ভূমিকায় অভিনয় করছে ক্লার্ক গেবেল। মনে রাখতে হবে। সিনেমা চলতে থাকে। বাবলুদা ঠিকই বলেছে। প্রচুর ঢলানি। চুমুর পর চুমু। এরা এত চুমু খায় কেন? ভাবে পদা। একটা খেলেই তো বরং ভাল হোতো। কে জানে? সোনালিকে আরচোখে দেখে একবার। ওর ঠোট দুটো বেদানার মত। ওকে চুমু খেলে কেমন হবে? মনে মনে লজ্জা পায় পদা। কান গরম হয়ে যায় তার। শেষে যখন রেঠ বাটলার নায়িকাকে বলল “ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং ডিয়ার, আই ডোন্ট গিভ এ ড্যাম…” তখন দেখলো সোনালির চোখ দুটো চিকচিক করছে। খুব কষ্ট হয়েছিল তখন পদার। মনে হচ্ছিল ওকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
সিনেমা শেষ। ওরা বেরিয়ে এল হল থেকে। বাইরে প্রচন্ড রোদ আর নতুন শো তে ঢোকবার জন্য লোকের ভীড়। “এই তোরা একটু দাঁড়া। আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি,” বলে বাবলুদা হাওয়া। ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে রইল। ভীড়ে জায়গা কম। সোনালির আঁচলটা পদার বুকে ঠেকছে। আবার সেই নেশা ধরানো সুবাস। সোনালির নিঃশ্বাসের ছোঁয়া লাগছে তার গলায়। পদা চোখ বুজে শুধু অনুভব করছে। চোখ খুললেই ওর হাঁটু দুটো কেমন যেন দুর্বল লাগছে। সোনালি যে বড্ড কাছে! এই ভাবে কতক্ষণ ওরা দাঁড়িয়েছিলো পদা জানে না। হঠাত অনুভব করলো যে তার হাতে আর একটা হাত। নরম তুলতুলে। সোনালির হাত। হয়ত ভুল করে নিজের অজান্তেই সোনালির হাত ধরে ফেলেছে সে। ছিঃ ছিঃ! কি লজ্জা! হাত সরিয়ে নাওয়ার আগেই সোনালির হাতের মুঠো দৃঢ় হোলো। পদার দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখে চোখ রেখে সে বলল “মাসিমা সেদিন মা কে বলছিলেন যে তুমি নাকি দারুণ মাউথ অরগান বাজাও। আমাকে শোনাবে একদিন অনীক?”
… to be continued