নিশিকান্ত সেন একজন একলা মানুষ। বয়স আন্দাজ চল্লিশের আশেপাশে।বিয়ে থা করেননি। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া দীর্ণ বিদীর্ন চারতলা বাড়ির ছাদের উপর দুটি ঘর নিয়ে তার বাস। বাকি বাড়িটা অগুনতি মানুষে ঠাসাঠাসি।তার কতজন যে তার আত্মীয় আর কতজনই বা অনাত্মীয় তা নিশিকান্ত জানে না। বলা ভাল কোনদিন জানার চেষ্টাও করে নি। এত লোকের মাঝে বাস করেও তার মতো একলা মানুষ হয়ত এই শহরে বেশি নেই। নিশিকান্ত এক বেসরকারি সংস্থায় কেরানীর চাকরি করে। সামান্য যা মাইনে পায়, তা তার যৎসামান্য খরচ চালানোর পরেও বেশ খানিকটা উদ্বৃত্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। না আছে তার কোন নেশা, না আছে তার কোন শখ।নিস্তরঙ্গ জীবন অতিবাহন করতে করতে তার মধ্যে কখনো কোনরূপ ক্লান্তি বা বিরক্তি এসেছে তা স্বয়ং বিধাতাও হলপ করে বলতে পারবেন না। রোজ কাকভোরে উঠে প্রাতঃকৃত সেরে ঘরের সামনে মাঠের মতো বিছানো ছাদটায় ঘোরাঘুরি করে নিজের মনে।। জীবনে একমাত্র চাইয়া বা পাওয়া যায় হোক , তা হল এই ছাদটা। মর্নিং ওয়াক যাকে বলে তা নয়। শুধুই পায়চারি করা। তারপর কি শীত কি গ্রীষ্ম ছাদের কল থেকে এক বালতি জল নিয়ে বেশ খানিক্ষন সময় নিয়ে চান ও সামান্য কিছু পূজোআচ্চা সেরে নিজের দুপুরের খাবার তৈরি করা এবং সামান্য কিছু জলযোগ সেরে অফিস বেরোনো। সারাদিন অফিস সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মুখহাত ধুয়ে রাতের একটু কিছু খাবার বানিয়ে নিয়ে একটু টিভি দেখে আবার ছাদে খানিক ঘুরে রাতের খাবার খেয়ে রাত ন’টার মধ্যে শয্যা গ্রহণ। এই কর্ম কান্ডের কোন পরিবর্তন কস্মিনকালেও হয় নি আর সম্ভবত হবেও না।
কিন্তু হল। নিশিকান্তর নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে জীবনের ছোট্ট জলরাশির মধ্যে একটি ঘটনার সূচনা বেশ বৃহৎ একটি আন্দোলনের সৃষ্টি করল। এ বাড়ির তৃতীয় তলে বাস করে গোকুল সেন এবং তার পরিবার। লতায় পাতায় নিশিকান্তর কেমন যেন আত্মীয় হয় তারা। গোকুলের একটি মাত্র পুত্র। নাম ধনা। ভাল নাম হয়ত বা ধনঞ্জয় হবে কিন্তু বহুকাল অব্যবহারের কারণে তা ডাইনোসরের মতোই অবলুপ্ত হয়েছে। ধনা স্বয়ং এবং তার বাবা তার এই নামটি নিয়ে যথেষ্টই গৌরবান্বিতই বোধ করে। যদিও আশেপাশের বিস্তীর্ন এলাকায় কান পাতলেই জানা যায় যে ধনা নামটির সঙ্গে দুর্নাম বিশেষণ টাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। মস্তানি, মাতলামি, মহিলা ঘটিত বহু ঘটনার মুখ্য নাম হল এই ধনা। কত যে অভিযোগ জমা পড়েছে তার নামে তা দারোগা বাবুও হঠাৎ করে বলতে পারবেন না। রীতিমত হিসাব নিকাশ করে বলতে হবে তাকে। এককথায় পুলিশের খাতাতে ধনার নাম বেশ জ্বলজ্বলে অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। তবুও কলার উচিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে ঠোঁটে বিলিতি সিগারেট ঝুলিয়ে এই ধনাবাবু যখন রাস্তা দিয়ে চলেন তখন পাড়ার সাধারণ মানুষজন একটু তফাতেই চলে যান। নিশিকান্ত এইসব ঘটনার কিছুটা জানে, অনেকটাই জানে না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে কখনো মুখোমুখি হয়ে গেলে ধনা নিস্পৃহ স্বরে ‘কি কাকা কি খবর?’ হয়ত বলে। নিশিকান্তও ততোধিক নিস্পৃহ স্বরে কিছু একটা বলেন কিন্তু তা শোনার জন্য ধনা দাঁড়ায় না।নিশিকান্তর উত্তর শেষ হবার পর তা তার নিজের কানেই বিদঘুটে শোনায়।
সেদিন অন্য দিনের মতোই নিশিকান্ত অফিস সেরে বাড়ি ফিরেছেন। হাত মুখ ধুয়ে সবে রাতের রান্নায় হাত দিয়েছেন, এমনি সময় ধনা প্রবেশ করল তার ঘরে। নিশিকান্ত যারপরনাই অবাক হল। কিন্তু , বেশিক্ষণ তাকে অবাক হয়ে থাকতে হল না। ধনা জানাল যে পাড়ার এক উঠতি প্রোমোটারের সঙ্গে তার কথাবার্তা সারা হয়ে গেছে বাড়িটা নিয়ে। বাড়িটা ভেঙে এক ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হবে এখানে আর নিশিকান্তর ভাগে পড়বে গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটি এক কামরার ফ্ল্যাট। দিনদশেকের মধ্যে এ বাড়ি ছেড়ে আপাতত কিছুদিন তাকে অন্য কোথাও ভাড়া থাকতে হবে। এইসব বলে ধনা একটা দলিল তার দিকে এগিয়ে দিল তার দিকে। খুব পরিষ্কার ভাবেই নিশিকান্তকে জানাল যে তাকে শুধুমাত্র এই দলিলে একটু কষ্ট করে সাইনটাই করতে হবে, আর কিছু নয়। পুরো ব্যাপারটাই ধনা এতটাই তাড়াতাড়ি আর নিস্পৃহ ভাবে জানাল যে নিশিকান্তর বুঝে উঠতেই বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। মোটামুটি বোঝার পর ধনার দিকে একপলকে খানিক্ষন তাকিয়ে থাকার পর নিশিকান্ত খুব শান্ত স্বরে এই পুরো বন্দোবস্তের উপর তার আপত্তি জানাল। অসম্ভব এক ভয় তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল কিন্তু এই দুটো ঘর আর এই ছাদটাই তার জীবন। এ না থাকলে তিনি বাঁচবেন না। একতলার ঘুপচি এককামরার ঘরে গিয়ে তিনি থাকতে পারবেন না। কিছুতেই না। ধনা প্রথমে বুঝতেই পারল না নিশিকান্তর কথা। কেউ যে এ বাড়িতে তার উল্টো কথা বলতে পারে তা তার ধারণার মধ্যেই ছিল না। যখন বুঝতে পারল যে নিশিকান্ত তার পুরো প্ল্যানটাই বানচাল করে দিতে চাইছে, তখন সে বিষাক্ত সাপের মতোই ফনা তুলে মুহূর্তের মধ্যেই বিষদাঁত বার করে ফেলল। দলিলটা নিশিকান্তর বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে হিসহিসে স্বরে বলল ‘ রেখে গেলাম। রাতে আবার আসব। সইটা করে রেখ। ও হ্যাঁ, রাতে আমার সঙ্গে দু একজন বন্ধুও থাকতে পারে। আসি’। সিঁড়ি দিয়ে দুরদার শব্দে তার নেমে যাওয়া টের পেল নিশিকান্ত।
রোজের গতে বাঁধা রুটিনে ছেদ পড়ল নিশিকান্তর। রান্না হল না, ন’টার সময় শোওয়া হল না। কান মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। অস্থির ভাবে সারা ছাদময় পায়চারি করতে লাগল একটানা। এমনি ভাবে কতঘন্টা কেটে গেছে কে জানে। হঠাৎ সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পেয়ে ভয়ে সিটিয়ে গেল নিশিকান্ত। বিস্ফারিত চোখে দেখল ধনা এবং তার সুযোগ্য বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব পুরোপুরি বেহেড অবস্থায় স্খলিত পদক্ষেপে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জড়ানো গলায় ধনা বলে উঠল ‘কাকা, সই টা হয়ে গেছে তো ! এবার দলিলটা দাও দিকি। অনেক কাজ আছে।’ নিশিকান্ত বেশ বুঝতে পারল যে সে কি ভীষণ বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিন্তু ভাঙা ভাঙা কম্পিত স্বরে সে বলে উঠল ‘সই আমি দেবো না ধনা।’ ভয়ানক উত্তেজনার চোটে নিশিকান্ত অনুভব করতে পারল যে তার হৃদযন্ত্রটা বুঝি এবার ইস্তফা দেবে। মাথাটা কেমন যেন টাল খাচ্ছে, চোখের দৃষ্টিটাও কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। মুহূর্তের মধ্যেই সেই ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে দেখতে পেল ধনার এক বিশাল বপু বন্ধু তার দিকে ভয়ানক আক্রোশে তেড়ে এল আর মারল তাকে সজোরে এক ধাক্কা। মুহূর্তের মধ্যে নোনাধরা কমজোরি ছাদের পাঁচিলের উপর গিয়ে আছড়ে পড়ল নিশিকান্ত। দুর্বল সেই আলসে সেই ধাক্কা সামলাতে পারল না। ছাদ থেকে সামনের রাস্তার দিকে পড়ে যেতে যেতে নিশিকান্তর চারপাশ ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেল । ভয়ানক এক পৈশাচিক উল্লাস কানে আসতে আসতে মিলিয়ে গেল।
ধনা সেই নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেও খুব পরিষ্কার বুঝতে পারল ঠিক কি ঘটে গেছে। এক মুহূর্ত আর দেরি না করে বন্ধুবান্ধব সমেত বাড়ির পিছন দিক দিয়ে রাতের আলো আঁধারির মধ্যে মিলিয়ে গেল। অনেক মস্তানি সে করেছে, অনেক মারামারিও করেছে কিন্তু খুন সে কোনদিন করেনি। সে যে তার কাকার খুন হবার একমাত্র কারণ তা বুঝতে পেরে অসীম সাহসী ধনারও বুক শুকিয়ে এল। এখন এ তল্লাটে তার থাকা যাবে না। দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ধনা দৌড়তে লাগল। রাতের টিমটিমে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যে মায়াবী আলোছায়া তৈরি হয়, সেই আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে পাগলের মতো দৌড়তে লাগল সে। কোন পথে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না, কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। পথ তার দু পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কোন এক নাম না জানা নদীর মতো। এ পথের শেষ কোথায় সে জানে না। শুধু এ গলি ও গলি দিয়ে নিশাচর এক প্রেতের মতো দৌড়চ্ছে দোর্দন্ডপ্রতাপ ধনা। তার পা টলছে, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। কিন্তু থামলে চলবে না। দৌড়তে তাকে হবেই। পালাতেই হবে এখান থেকে অনেক দূরে। কতঘন্টা বা কতক্ষন এভাবে দৌঁড়েছে সে হিসাব নেই ।হঠাৎই দূরে, বেশ খানিকটা দূরে , যেখানে গলিটা শেষ হয়েছে, সেখানে বড় রাস্তার উজ্জ্বল আলো দেখতে পেল সে। টলতে টলতে দৌড়তে লাগল সেই উজ্জ্বল আলোটা লক্ষ্য করে। খানিক্ষন এর মধ্যেই বড় রাস্তায় পৌঁছে গেল সে। চোখ বুজে একটু শ্বাস নিল । কিন্তু, পরক্ষনেই চোখ খুলে ভয়ানক চমকে দেখল সে তাদের বাড়ির সামনেই এসে পড়েছে। আলো আঁধারির মধ্যে বিশাল এক দৈত্যের মতো বাড়িটা যেন তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বার করে হাসছে। ধীরে ধীরে রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির সামনে এসে দেখল ফুটপাথ জুড়ে পরে আছে ছাদের পাঁচিলের ভাঙা টুকরো। অনেক তার মাটিতে জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। একটা ভাঙা চশমাও যেন দেখল। একপাশে বেশ কিছুটা রক্তের ছোপও লেগে আছে ।কিন্তু, নিশিকান্ত কই? কোথায় তার শরীরটা ? কোথাও কোন চিন্হ নেই লোকটার। ভোজবাজির মতো যেন উবে গেছে। কোথাও না আছে কোন মানুষ না আছে কোন শব্দ । মানুষ বা শব্দ থাকার কথাও নয়। ধনা লোকজন নিয়ে কোথাও গেলে আশেপাশের সব শব্দই বন্ধ হয়ে যায়। কেউ ঘরের জানলাটাও ফাঁক করে দেখে না।টলতে টলতে বাড়ির দরজার দিকে এগোল ধনা। অন্ধকার মেশা সদর দরজার ঠিক মুখে পৌঁছতেই দেখল কে যেন বসে আছে সদরের সিঁড়িটায়। বিকৃত জড়ানো কন্ঠস্বরে সে বলে উঠল ‘কে ? কে ওখানে’ । বলতে বলতেই সিঁড়ির মুখে পৌঁছে গেল আর পৌঁছেই চরম আতঙ্কের সঙ্গে দেখল কাঁপতে কাঁপতে একটা শরীর তার দিকে এগিয়ে আসছে । জড়ানো কাঁপা গলায় শুধু বলছে ‘সই আমি দেবো না ধনা। কিছুতেই দেব না’। ঘোলাটে হয়ে আসা চোখে অন্ধকার নেমে আসতে লাগল ধনার। নেশাগ্রস্ত শরীরটা বিগত কয়েক ঘণ্টার বিপুল উত্তেজনা আর পরিশ্রমের পর এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য আর নিতে পারল না। ধনার হৃদযন্ত্র ব্যাপক এক হেঁচকি খেয়ে তার কাজে ইস্তফা দিল।
না, ধনা নিশিকান্তর অশরীরি প্রেতাত্মাকে দেখেনি। নিশিকান্তর আয়ু হয়ত শেষ হয়নি। সে ছাদ থেকে পড়েছে কিন্তু সরাসরি মাটিতে পড়েনি। বাড়ির সামনে গুচ্ছ গুচ্ছ যে তারের সারি ঝুলছিল, তারাই নিজেদের জীবন দিয়ে নিশিকান্ত কে নতুন জীবন দান করেছে।
সই আমি দেবো না, কিছুতেই দেবো না। বিড়বিড় করতে করতে কাঁপতে কাঁপতে নিশিকান্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ছাদের উপর তার দু কামরার স্বর্গে।