সেও এমন এক বর্ষার সন্ধ্যার কথা। না বর্ষণ মুখরিত সায়াহ্ন নয়, বৃষ্টিভেজা, কাপড়জামা না শুকনো স্যাঁতসেঁতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। কলকাতার এক স্কুলছাত্রের পথের পাঁচালী উপন্যাসটা পড়া সবে শেষ হয়েছে। কারণ কি? স্কুলে পাঠ্য ‘আম আঁটির ভেঁপু’ মূল বইয়ের একটা ছোট্ট অংশ, কিন্তু মিস বলেছেন গরমের ছুটির পর পুরো বই পরে আসবে। পুরো বই শেষ করা কি চাট্টিখানি কথা? এক একটা লাইন তো শুধু পরে গেলে হয়না, ভাবতে হয়, পায়চারি করতে হয়, বারান্দায় যেতে হয়, হাত পা ছুঁড়ে হজম করতে হয়। ছেলেটি বাংলা বই পরতে ভালোবাসে, কিন্তু এরকম লেখা সে কখনও পরেনি। কি সব অনুচ্ছেদ এক একটা, বিশেষত সেই যেখানে দুর্গার, আহা — “আকাশের নীল আস্তরণ ভেদ করিয়া মাঝে মাঝে অনন্তের হাতছানি আসে – পৃথিবীর বুক থেকে ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হইয়া ছুটিয়া গিয়া অনন্ত নীলিমার মধ্যে ডুবিয়া নিজেদের হারাইয়া ফেলে – পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূরপারে কোন পথহীন পথে – দুর্গার অশান্ত, চঞ্চল প্রাণের বেলায় জীবনের সেই সর্বাপেক্ষা বড় অজানার ডাক আসিয়া পৌঁছিয়াছে!” আহা, এমনটা কেন হতে হল, ঠাকুর? কিন্তু  আবার একইসঙ্গে মনে হয়, কি আছে সেই অজানায়, সবাই কি একদিন জানতে পারবে তাকে? আমিও? সে যাক। বড় ভাল লাগে তার অপুর সাহস, হার না মানা সংগ্রাম আর সাহিত্যপ্রীতি । এই বই শেষ হয়েছে তো কি? এতো সবে একটা। এরপর পরে ফেলতে হবে অপরাজিত। গরমের ছুটির আর কদিন বাকি আছে, মা?

আরেকটা সন্ধ্যার কথা। এই ছেলেটির খুব কাছের বন্ধু (এবং স্কুলের সবচেয়ে বড় কম্পিটিটর) ঘরের বারান্দায় পায়চারি করছে। দুজনেই লিখতে ভালবাসে, স্কুলে গল্প কবিতার  প্রতিযোগিতায় পুরস্কার টুরস্কারও পায়। তবে সবচেয়ে ভালোবাসে পড়তে, পড়ার বই না, গল্পের বই। এমনকি স্কুলে যে গল্প লেখার প্রতিযোগিতা হয়, তাতেও পাশাপাশি দুজনে বসে লেখা শেষ করে জমা দেওয়ার আগে খাতা আদান প্রদান করে পরে ফ্যালে দুজনের গল্প গুলো। তারপর ফেরার পথে আলোচনা চলে, কারটা ভালো হল, কেন ভালো হল না? ইত্যাদি। কিন্তু এবারে, মানে ক্লাস ইলেভেনে, ছেলেটি অসুস্থ, হাসপাতালে। গল্প প্রতিযোগিতায় আর নামা হবে না। তার বন্ধু যেতে পারে, আরামসে পুরস্কার নিয়ে স্কুলের বন্ধুমহলে কলার তুলে ঘুরে বেরাতে পারে, কিন্তু পায়চারি করতে করতে ভাবছে, যাব না। কারণ কি? আরে, পুরস্কার দিয়ে কি হবে? লেখার পরে পাশাপাশি বসে যদি খাতা এদিক ওদিক করে নাই পড়তে পারলাম একজন আরেকজনের গল্প গুলো, তাহলে আর মজাটাই বা কোথায়? কি লাভ শুকনো পুরস্কার নিয়ে?

এরকম সন্ধ্যে আজ আর আসেনা। ছেলেটি এখন বড় হয়ে গেছে, তার পড়ার জগৎ কাজের জগৎ অনেক বড় হয়ে গেছে, সেই জগতে বাংলা ভাষার এমনিতেও কোন জায়গা নেই, কারণ তাতে যথেষ্ট  টার-মিনো-লজি নেই‌, বাংলায় না যায় পড়া, না পড়ানো। বাংলায় গল্প কবিতা লেখালিখি করা যায় নিশ্চয়ই, কিন্তু সময় কই? তাছাড়া লিখলেও যদি কেউ না পড়ে? কেউ লাইক না দেয়? নামী দামী লোকে কত কি নিয়ে লিখে ফেসবুকে দেয়, সংকট, প্রেম, বিপ্লব নিয়ে লেখা দেয়, কিন্তু সবার জীবনে সংকট যথেষ্ট পরিমানে থাকলেও প্রেম বা বিপ্লব নেই, ফেসবুকে লাইক দেওয়ার লোকেরও অভাব। কি দরকার বাবা লেখা ছেড়ে? তারপর জিরো লাইক, জিরো কমেন্ট, অন্য বন্ধুরা হাসছে, ইত্যাদি। থাক। সংকটটা বোঝ। একদিকে টাকা নেই, চেহারা নেই, পরিচিতি নেই, বাইরে আবার করোনা, হাঁচি কাশি বাদই দিলাম, ঘাড়ে ব্যাথা হলেও মনে হয় ওই, দেখি একবার অক্সিমিটারটা চালিয়ে।

মনে পরে ছোটবেলায় রাত জেগে কাটাতে হয়েছিল শ্বাসকষ্টের জন্য। সর্দি কাশি জ্বর তো প্রতি সিজনে একবার করে। কিন্তু তা বলে শুয়ে কাটানো যাবে না। গল্পের বইটা শেষ করতে হবে তো। প্রতিযোগিতা ছিল। হ্যাঁ। আরেকজন শেষ করে ফেলল ৩টে বই আর আমি এখনও একটা শেষ করে উঠতে পারলাম না?  স্কুল বাসে আর মুখ দেখাতে পারব? কিন্তু এখন প্রতিযোগিতা বেড়েছে। গত এক মাসে লকডাউনে বাড়িতে বসে সবাই কত কি ছাপিয়ে ফেলল, পোস্ট করে ফেলল, সার্টিফিকেটও পেয়ে গেল গাদাখানেক, কিন্তু এদিকে অবস্থা খুব খারাপ। কুঁড়েমি করে গত এক মাসে শুধু পড়েছি, কিচ্ছু ছাপাতে পারিনি। আগে সংকট ছিল গল্পের বইতে, এখন সংকট এসেছে জীবনে। আগে পাবলিকেশন মানে বুঝতাম লেখকের বই, আর এখন বুঝি নিজের সিভি। একটাও লেখা ইংরেজি পত্রপত্রিকায় বেরোল না, বাংলা গল্প লিখব ফেসবুকে?  আর লিখলেই বা পড়ছে কে? কেউ লাইক দেবে না, বাকিরা ভেঁপু বাজাবে। বড় চাপ। চাপ থেকেই হজমের গণ্ডগোল, গ্যাস, জেলুসিল। কত লোকে দেখি লেখে, কলকাতা নিয়ে, প্রেম নিয়ে, বিপ্লব ও তার অভাব নিয়ে। মৃত্যু, প্রেম ও বিপ্লব, এই তিনটের ঠিকমত কম্বিনেশনে দিতে পারলে ভাইরাল (ভাইরাসের মতই ভাইরাল) নইলে বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণ মানে, ধর লেখায় ১ টা লাইক, ১ টা ভাববার ব্যাপার আর ২০ টা হাঃ হাঃ। ওই হাঃ হাঃ হচ্ছে প্রমাণ, যে তুমি গোল্লায় গেছো। আগে ফেসবুক ছিল না, ছিল গল্পের বই আর ছোট পত্রিকা, সেখানে গোল্লায় গেলেও এত দ্রুত প্রমাণ হত না, অথচ কি আশ্চর্যের বিষয় যে তখন একবারও পাবলিকেশন নিয়ে ভাবিনি। পাতার পর পাতা পরে গেছি শুধু, ইশ, কি সময় নষ্ট করেছি। এখন হাল ধরার কথা ভাবি, কিন্তু আলস্যি করে হয়ে ওঠে না।

তাছাড়া লিখব কি নিয়ে, আমাকে কেউ বলে দাও? সংকট? হ্যাঁ, টাকা নেই, চাকরি নেই, ধর্ম নেই, রাষ্ট্র নেই, একটা ছেলে দিনরাত মিম বানিয়ে যাচ্ছে? তার স্বপ্ন একদিন সে মিনিস্টার হবে। এরকম একটা গল্প লেখা যেতে পারে। কিংবা, করোনা সংকটকালে আমার কলকাতা। যাকে কোন সংকটই কাবু করতে পারেনা, মতাদর্শহীন ঘুষখোর সমাজের সংকট কিংবা প্রেমহীন সেলফির সংকট, করোনা তার কি করবে? কিন্তু লিখে লাভ নেই। পোস্ট করলেই সেই আবার হাঃ হাঃ। বড় লেখা কারো পড়ার সময় নেই। বিপ্লব নিয়ে লিখে কোন লাভ নেই, বিপ্লব করে বুড়োরা আর যারা চায়ের দোকানে আড্ডা মারতে যায়, তারা। প্লাস, এইসব লিখতে গিয়ে যদি একবার ফেসবুক একাউন্ট টা সরকার দেয় বন্ধ করে, গেল আমার সব পোস্ট, ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফলোয়ার্স (যেটুকু আছে)। থাক। প্রেম নেই, কেন নেই জানি না, লিখতে গেলেই লোকে বলবে, প্রেমিকাই নেই আবার প্রেমের কথা লিখছে? লেখা চলে না। তারপর যদি কেউ একটা কাটা ঘায়ে মিম ছড়িয়ে দেয় তো হয়ে গেল। আর সমাজে মুখ দেখানো যাবে না । এদিকে কিছু না লিখলেও আর মানটা থাকছে না। ধর্ম নিয়ে লেখা যেতে পারে, কিন্তু লোকে পড়বেনা। তার চেয়ে মা কালীর একটা ছবিতে কমেন্ট পড়ে বেশি। লাভ নেই বিশেষ (আর কমেন্টই যদি না পড়ল), যাকগে। কবিতা লেখা যেতে পারে, কিন্তু আমার কবিতায় আবার ছন্দ মেলে (মানে মেয়েলি কবিতা)। ফুল, পাখি, প্রেম কিংবা সমাজ নিয়ে ছন্দ মেলানো কবিতা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু যদি লাইক না পড়ে, তাহলে তো গেল। শেষমেশ কেউ একটা কমেন্টসে এসে বলবে, ‘এবারে তোর একটা মেয়ে দরকার’। দরকার নেই বাবা।

আবারও একটা বর্ষা এসেছে। তার আগে সাইক্লোনও এসেছিল, কোন পোস্ট দিতে পারিনি, এবারেও কিছু পারব না। ভুল্ভাল কিছু স্মৃতিকথা লিখলাম,সবাই হাসবে, হাসুক। আমার খাতা, আমার দেওয়াল, আমার সম্মান, তাতে কারো এমনিতেও কিছু যায় আসেনা। আসলে মুশকিল হল সেইসব বর্ষা আর আসেনা, যখন স্কুলবাসে বসে সত্যজিৎ রায়ের গুপী বাঘার গানগুলো গাইতাম বা বন্ধুদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী- সীমাবদ্ধ নিয়ে আলোচনা হত। তাই এখন আর কিছু লেখার ইনিস্পিরেশন পাইনা। এখন আমরাই সীমাবদ্ধ, লিমিটেড লায়াবিলিটি, যতটুকু লাইক, ততটুকুই লায়াবিলিটি। কেউ কেউ ভাইরাল হয়ে যায়, তাদের সমাজের প্রতিও একটা দায়বদ্ধতা থাকে, আমায় কেউ চেনে না, আমার দায়বদ্ধতাও নেই। তবে সমাজকে না হলেও আমি আকাশকে ভালোবাসি, আমার বারান্দাটাকেও। আকাশের মত বড় বিপ্লবী নেই, সে কোন দুদিন এক রকম করে থাকেনা। অথচ প্রতিদিন তার থেকে শেখা যায়। সে যুক্তি শানায় না, বিচার করেনা, ঘৃণা করেনা, উপেক্ষা তো করেই না, প্রতিদিন সে সবাইকে নতুন নতুন গল্প শোনায়, স্বপ্ন দেখায়, নতুন দিনের, নতুন ঋতুর। তবে ছোটখাট গল্প নয়, বড় গল্প— মেঘের গল্প, রঙের গল্প, হাসির গল্প, কান্নার গল্প, ঝঞ্ঝার গল্প, আলোআঁধারির গল্প। কিন্তু কেউ ছাপায় না তার গল্প, অনেকে তো  ছাপলেও সারা জীবনেও পড়ে না। অনন্ত নীলিমার মধ্যে কত যে অসীম রহস্য আছে কেউ তার খোঁজ জানতে চায় না।  আমার বারান্দাটাও গল্প বলে,  এক শহরের একটি ছেলের গল্প, যে বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কবিতার ছন্দ খুঁজে বেড়াত, আজকাল আকাশের ছবি তুলে লাইক খুঁজে বেড়ায়। কিংবা সেই টিকটিকিটার গল্প, যে বারান্দার সুইচ বোর্ডের খাঁজে লুকিয়ে থাকত আর কাছে গেলে মাঝে মাঝে উঁকি মারত। আজকাল তাকেও আর দেখিনা। অবশ্য অত কাছে গিয়ে কোন কিছু দেখারও ইচ্ছে থাকেনা। বারান্দায় বসারই বা সময় কোথায়? মাঝে মাঝে যাই। এমনিই বললাম।

যাক, এবারে লেখাটা পোস্ট করে দি। অনেক বোর করেছি আপনাদের। আসলে হয়েছিল কি, মাঝখানে একবার হোয়াটস্যাপ স্টেটাসটা চেক করতে গেছিলাম, তাই খেই হারিয়ে গেছিল। কি যেন বলছিলাম?

ও হ্যাঁ, সংকট, সাহিত্য ও আমার ফেসবুকের কথা।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleশকুন অবতার
Next articleনদীর পাড়ের ছেলেটা
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments