ভূতের গল্পের প্রতি বাঙালির আসক্তি চিরকালীন। রাত্রিবেলা গা ছমছমে ভূতের গল্প পড়তে কোন বাঙালি না ভালবাসে? এরকমই দেশে বিদেশে অসংখ্য ভূতের গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। লাতিন আমেরিকার ভূতের গল্পও সারা পৃথিবীতে খুব জনপ্রিয়। কিন্তু স্প্যানিশ ভাষায় লেখা বলে সেগুলি বাঙালি পাঠকদের খুব একটা পড়ার সুযোগ হয় না। ‘লা ইওরোনা’ সেই রকমই একটি পৃথিবী বিখ্যাত জনপ্রিয় লাতিন আমেরিকান ভৌতিক লেজেন্ড।
লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশেই (যেমন মেক্সিকো, চিলে, আর্জেন্টিনা, ইকুয়াদোর, পেরু, কলোম্বিয়া, কোস্তারিকা, এল সালভাদোর, উরুগুয়ে, হন্ডুরাস, ভেনেযুয়েলা ইত্যাদি) এবং স্পেনেও এই গল্পটি শোনা যায়। শত শত বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই গল্পটি শুনে আসছে, আজও এই এই গল্পের জনপ্রিয়তা এততুকুও কমে নি। পৃথিবীতে একটি ভৌতিক লেজেন্ড নিয়ে এত সংখ্যক প্রচলিত গল্পের নজির পৃথিবীতে বিরল। এই ইওরোনাকে নিয়ে এক একটি দেশে এক এক রকম গল্প প্রচলিত থাকলেও গল্পের মূল জায়গাটি সব দেশেই প্রায় এক-
ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রতারিত হয়ে একজন মহিলা তাদের সন্তানকে (সন্তানদের) নদীর জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলে, তারপর সে আত্মহত্যা করে। এরপর সে বেদনাক্লিষ্ট আত্মা হয়ে আবার ফিরে আসে, নদীর পাড়ে তার সন্তানদের খুঁজে বেড়ায় (Ayy mis hijos-oh my children) আর কাঁদতে থাকে।
স্প্যানিশ ভাষায় ‘La llorona’(লা ইওরোনা)শব্দের অর্থ হল the weeping lady বা ক্রন্দনরতা মহিলা।
এবার মেক্সিকোর একটি প্রচলিত গল্প শোনা যাক।
সম্ভবত মেক্সিকোতে যখন স্প্যানিশ উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল গল্পটি সেই সময়ের। একটি ছোট গ্রামে মারিয়া নামে একটি মেয়ে ছিল। একটি গরীব কৃষক পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। তার মাথায় ছিল এক রাশ ঘন কালো চুল। তাকেই পৃথিবীর সেরা সুন্দরী বলা হতো এবং সেও সেটা বিশ্বাস করতো যে এই পৃথিবীতে তার থেকে বেশী সুন্দরী আর কেউ নেই।
মারিয়া বড় হতে লাগলো, তার সৌন্দর্যও দিনে দিনে যেন আরও বাড়তে লাগলো। রূপের অহঙ্কারও ছিল তার। এমনকি যুবতী মারিয়া তার গ্রামের ছেলেদের দিকে কখনও ফিরেও তাকাত না। কারণ সে মনে করতো যে তারা তার যোগ্য ছিল না। সে তার নিজের মনে মনেই বলতো- ‘আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুপুরুষ যুবককেই বিয়ে করব।’
একদিন হঠাৎ ঘোড়ার পিঠে চেপে এক উদ্যমী, সুদর্শন স্পেনীয় যুবক তাদের গ্রামে এসে উপস্থিত হল, ঠিক যেন তার স্বপ্নের রাজপুত্র যার কথা এতদিন সে নিজের মনে ভেবে এসেছে। সে ছিল দক্ষিণের সমতলের এক ধনী খামার মালিকের ছেলে।
মারিয়া এই যুবককেই মনে মনে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে স্থির করে ফেলে এবং কিভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় সেই কৌশলও তার জানা ছিল।
গ্রামের পথে কখনও মারিয়ার সাথে দেখা হলে যুবকটি তার সাথে কথা বলতে চাইতো, কিনতু মারিয়া মুখ ঘুরিয়ে চলে যেত। যুবকটি তাকে মুল্যবান উপহার দিতে চাইলেও সে সেগুলো ফিরিয়ে দিত। যুবকটিও হার মানার পাত্র নয়, নিজের মনে মনে সে বলল- ‘অহংকারী মারিয়া, তোমার হৃদয় কিভাবে জয় করতে সে কৌশল আমার জানা আছে, এই মারিয়াকেই আমি বিয়ে করব।’
কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সম্পর্ক তৈরি হল এবং তারা বিয়ে করে ফেলল। প্রথম দিকে কয়েক বছর তাদের সম্পর্ক ভালই ছিল, তাদের দুটি সন্তানও হল। কিন্তু ধীরে ধীরে যুবকটি মদ্যপান ও অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ল। মাঝে মাঝেই তাকে কাজের জন্য মাসের পর মাস বাইরে কাটাতে হতো। একবার সেই যুবক কোনও এক বিশেষ কাজে বেশ কয়েক মাসের জন্য বাইরে চলে যায়। যখন সে ফিরে আসে সে শুধু তার সন্তানদের সাথেই দেখা করে, মারিয়ার প্রতি তার কোনও ভালবাসা বা দায়বদ্ধতা ছিল না। এমনকি সে মারিয়াকে তার জীবন থেকে সরিয়ে স্পেনীয় উচ্চবিত্ত সমাজেরই একজন বিত্তশালী মহিলাকে বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে।
মারিয়া সেই যুবকের ওপর খুব রেগে গেল এবং তার সেই রাগ সন্তানদের ওপর পড়ল, কারণ তারা সেই যুবকেরই সন্তান যাদের সে স্নেহ মমতা দিয়ে মানুষ করেছে।
একদিন সে যখন তার সন্তানদের নিয়ে নদীর ধারে একটি ছোট রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ সেই পথে ওই যুবকের ঘোড়ার গাড়িটি তাদের সামনে এসে থামল। একজন সুন্দরী মহিলা তার পাশেই বসে ছিল। সে তার সন্তানদের সাথে কথা বলেই আবার ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে সেখান থেকে চলে গেল। মারিয়ার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, সে মারিয়ার দিকে ফিরেও তাকালো না।
সেই যুবকের এই রকম আচরণে সে খুব কষ্ট পেল এবং রাগে ফেটে পরল। দুর্ভাগ্য বশত সেই রাগ গিয়ে পড়ল তার সন্তানদের ওপর। এরপর সেই দুঃখ জনক ঘটনাটি ঘটল- প্রচণ্ড রাগে সে সাময়িক ভাবে তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো এবং তার সন্তানদের নদীর জলে ডুবিয়ে মেরে ফেললো। কিছুক্ষণ পর সে যখন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল ততক্ষণে তার সন্তানেরা নদীর স্রোতে তলিয়ে গেছে। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে নদীর পাড় ধরে দু হাত বিস্তৃত করে ছুটতে লাগলো আর তার সন্তানদের পাগলের মত খুঁজতে লাগলো, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। অনুতাপে সে এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারতো না, বুকে একরাশ বেদনা নিয়ে সে দিবারাত্র ওই নদীর পাড়ে তার সন্তানদের খুঁজে বেড়াতো। মনের দুঃখে সে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। এর ফলে সে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সুন্দর চেহারাটি ক্রমে কঙ্কালসার হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিন অনাহারে থাকার ফলে তার মৃত্যু হয়।
আবার কেউ কেউ বলেন নিজের সন্তানদের নদীর জলে ডুবিয়ে হত্যা করার ফলে অনুতপ্ত হয়ে সেও নদীর জলে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে।
একজন গ্রামবাসী মারিয়ার মৃতদেহ নদীর পাড়ে পড়ে থাকতে দেখে তৎক্ষণাৎ গ্রামবাসীদের এসে সেই খবরটি দেয়। গ্রামবাসীরাও সেখানে গিয়ে মৃত মারিয়াকে দেখতে পায় এবং তারা সেখানে একটি কবরখানায় তাকে সমাধিস্ত করে।
রহস্যজনকভাবে মারিয়াকে ঠিক যেদিন সমাধিস্ত করা হয়েছিল সেই রাত থেকেই সেই নদীর পাড়ে গ্রামবাসীরা কান্নার শব্দ শুনতে পায়- লা ইওরোনা।
‘Ayyy mis hijos…(oh my children) আমার সন্তানেরা কোথায়?’-এই বলে কাঁদতে কাঁদতে সে নদীর পাড়ে এদিক ওদিক ছুটতে থাকে। আর গ্রামবাসীদের বর্ণনা অনুযায়ী ঠিক যে পোশাকে মারিয়াকে সমাধিস্ত করা হয়েছিল সেই পোশাকেই ইওরোনাকে নদীর পাড়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটতে দেখা যায়। বহুবার তাকে গভীর রাতে ওই নদীর পাড়ে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে দেখা গেছে।
আবার কেউ কেউ বলেন সাদা মলিন গাউন পড়ে সে কাঁদতে কাঁদতে নদীর জলে ভেসে বেড়ায় বা নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। এখন তার মারিয়া নামটি মুছে গেছে, সে এখন ইওরোনা নামেই পরিচিত। তাকে বিভিন্ন নদী, হ্রদের ধারে রাত্রিবেলা ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
প্রচলিত গল্প থেকে জানা যায় মৃত্যুর পর সে যখন স্বর্গে যায়, কিনতু তাকে স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় নি, কারণ সেখানে তার সন্তানদের সম্বন্ধে জানতে জানতে চাওয়া হয়। আর তাকে বলা হয় যতদিন না পর্যন্ত তার সন্তানদের সে খুঁজে নিয়ে আসতে পারবে তাকে স্বর্গে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে না। ফলে সে আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে বাধ্য হয় এবং সে একটি অভিশপ্ত ও বেদনাক্লিষ্ট আত্মা হিসেবেই জীবিত ও প্রেত জগতের মধ্যবর্তী স্থানেই ঘুরে বেড়ায় ও নদীর পাড়ে কাঁদতে কাঁদতে তার মৃত সন্তানদের খুঁজতে থাকে, কারণ তার কৃতকার্যের জন্য তার আত্মা আর কখনও প্রেতলোকে ফিরতে পারবে না।
ইওরোনা তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ছোট শিশুদের ধরে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাই রাতের অন্ধকারে ছোট বাচ্চাদের একা একা বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হয় কারণ ইওরোনা তাদের ধরে নিয়ে গেলে তারা আর কখনও বাড়ীতে ফিরে আসতে পারবে না।
লা মালিঞ্চে ও ইওরোনা
লা মালিঞ্চে (La Malinche) বা দোনিয়া মারিনা ছিল একজন মেক্সিকান গালফ কোস্ট এর নাউয়া মহিলা। যুদ্ধে জয়ী হয়ে স্পেনীয়রা অ্যাজতেক সভ্যতার দখল নিয়েছিল এবং তার পেছনে একটি বড় ভুমিকা ছিল মারিনার। তাই তাকে বিশ্বাসঘাতকতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গন্য করা হয়। মেক্সিকোতে কোনও বিশ্বাসঘাতককে বোঝাতে ‘মালিঞ্চিস্তা’ (malinchista) শব্দটি ব্যবহার করা হয় ঠিক আমাদের ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ যে অর্থে ব্যবহৃত হয়। সে স্পেনীয় হেরনান কোরতেস-এর উপদেষ্টা, প্রেমিকা, ও দোভাষীর কাজ করতো। কারণ সে ছিল স্থানীয় মেয়ে এবং স্থানীয় ভাষা খুব ভালো জানতো। তাবাস্কো থেকে যে ২০ জন ক্রীতদাসী দেওয়া হয়েছিল সে ছিল তাদের অন্যতম। পরবর্তীকালে তাদের একটি সন্তানও হয়েছিল, যার নাম ছিল মারতিন, তাকেই প্রথম মেস্তিজো শ্রেণীর (people of mixed European and indigenous American ancestry)অন্যতম বলে গন্য করা হয়।
অনেকে মনে করেন এই ইওরোনা গল্পের উৎপত্তি সেই সময়েই হয়েছিল- স্থানীয় আমেরিকান ও তার স্পেনীয় প্রেমিকের প্রেম ও বিশ্বাস ঘাতকতার গল্প।
ইওরোনাকে মেস্তিজাখের (mestizaje – interbreeding and cultural intermixing of Spanish and local American people) অন্যতম প্রতীক বলে গন্য করা হয়।
যদিও এই গল্প নিয়ে দ্বিমত আছে। কারণ এই ইওরোনা গল্পের উৎপত্তি ঠিক কবে হয়েছিল সেটা সঠিক করে কেউ বলতে পারে না।