ছোটবেলায় পড়া সেই কবিতাটা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে; যেখানে বলা হয়েছে প্রাতঃস্মরণীয় মহাজ্ঞানী মহাজনদের পথ অনুসরণ করে কোনও একদিন বরণীয় মানুষ হওয়া যাবে| এই ধারণাটা এখনকার পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে গেলে কিছু ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিতে পারে| যে যুগের কবিতা, সে যুগে মহাজ্ঞানীরা সাধারনতঃ সোজা রাস্তায় চলতেন, তাই রাস্তার শেষটা দেখা যেত| সুতরাং পথের কষ্ট ছাপিয়ে বরণীয় হওয়ার জেদটা বজায় রাখা সহজ ছিল| এযুগের ছোট বা মাঝারি অফিসগুলোতে ছোট-বড় সাহেবরা বড্ড এঁকেবেঁকে পথ চলেন, তাই তাঁদের অনুসরণযোগ্যতা নিয়ে মনে একটু দ্বিধা আসে বইকি| তবু অফিস কাছারিতে আজকাল একটা কথা খুব চলে – ‘এক্সাম্পল সেটিং’| উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা প্রাঞ্জল করতে গিয়ে প্রাণ-জল করে দিয়েছে ‘ইক্ষু নদীর নারী’; ‘মেক অ্যান এক্সাম্পল অফ’-এর সঙ্গে শাস্তি দেওয়া, ওয়ার্নিং দেওয়ার কি সব যেন সম্পর্ক উল্লেখ করে গুলিয়ে দিয়েছে পুরোপুরি|

‘এক্সাম্পল সেটিং’-এর একটা চালু পুরনো গল্প আছে| এক মা তার চিনিখোর ছেলেকে নিয়ে সে যুগের এক বিখ্যাত লোকের কাছে এলেন| মায়ের আশা, ওনার কথায় যদি ছেলে চিনি খাওয়ার অভ্যেস ছাড়ে| সব শুনে গম্ভীর হয়ে সেই বিখ্যাত ব্যক্তি দু’হপ্তা পরে আবার আসতে বললেন| মা ছেলেকে নিয়ে দু’হপ্তা পরে এলে তিনি ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে বললেন – “অমন মুঠো মুঠো চিনি খেওনা বাপধন, বেশি চিনি খাওয়া ভাল নয়|” অবাক মা’কেও অবশ্য বুঝিয়ে বলেছিলেন  – “আমার নিজের একই অভ্যেস ছিল, এই পনের দিনে আমি চিনি খাওয়া বন্ধ করেছি, নাহলে আমার কথার মূল্য থাকত না এই বাচ্চাটার কাছে|”

এযুগের বিচারে বাজে সময় নষ্ট মনে হতে পারে, ‘আনপ্রোডাক্টিভ টাইম, ওয়েস্টেজ’| কারণ অফিসকাছারিতে ‘এক্সাম্পল সেটিং’টা খুব সোজা কাজ| যার ভাবগত অর্থ সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে রাজা উজির মারার গল্প বলা| যে কোনও সময় একটু ফাঁক পেলেই শুরু করে দেওয়া যায়| চিনি কম খাওয়ার উপদেশ দেওয়ার আগে নিজের অভ্যেস পাল্টানোর দায় অফিস কাছারিতে থাকে না| অন্যান্য কাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবাইকে জড়িয়ে নিতে হয়, নাহলে দায় একার ঘাড়ে পড়তে পারে| কিন্তু এই জড়াজড়ির ধারণা ‘এক্সাম্পল সেটিং’-এর ক্ষেত্রে খাটেনা| এ ব্যাপারে সাহেবরা ‘একলা চলো রে’ দর্শনে বিশ্বাসী, এমনকি ডাকাডাকি আর শোনাশুনির ব্যাপারটাও কেবল শ্রোতাদের জন্য প্রযোজ্য| দু’একজন তালে তাল মেলানোর লোক থাকলে খুব ভাল, না হলেও চলবে| তবে হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা বলছে একবার ফ্লো এসে গেলে বন্যার জলের মত সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তখন চারদিকে অথৈ জলের মধ্যে ঘাটে নাও ভেড়ানো মুশকিল হয়ে পড়ে|

‘এক্সাম্পল সেটিং’-এর গল্প এক্সাম্পল ছাড়া হতে পারে না|

ছোট অফিসের দোর্দন্ডপ্রতাপ মেজো সাহেব, কাজের ব্যাপারে নিখুঁত হিসেবে নিকেশ করেন| পান থেকে চুন খসার উপায় নেই, কারণ চুন শুকোনোর সময় থাকেনা| “ডু ইট নাউ” দর্শনের একজন জবরদস্ত ধরণের প্রবক্তা; কাজটা কখন করতে হবে জানতে চাইলে উত্তর দিতেন ‘ইয়েসটারডে’| তাঁর তীক্ষ্ণ নজর আর ব্যাঘ্রগর্জন থেকে বাঁচা প্রায় অসম্ভব ছিল| নথিপত্রে প্রস্তুতি, পুনঃসমীক্ষা, অনুমোদন আর স্বীকৃতি (Preparation, Review, Approval, Endorsement) – এই চার ধরণের কাজের যথাক্রমে নীল, সবুজ, লাল, বেগুনী এই চার রঙের কালিতে চারজনের সই না থাকলে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিতেন| কোনও এক প্রোজেক্টে তিনি এটা চালু করেছিলেন এবং সফল ভাবে সেই প্রোজেক্ট উৎরে গিয়েছিল| চার রঙের সই দেখে কর্তৃপক্ষ এতখানি সন্তুষ্ট হয়েছিল যে প্রথম ধাপের সব কাজ শেষে সব পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিয়েছিল| তবে পরের ধাপে কাজ আর শুরুই হয়নি, কারণ হিসেবে তিনি অবশ্য ভারতবর্ষের চিন্তা ভাবনার দৈনতা আর অনাবশ্যক রাজনীতির কথা বলতেন|

মুড ভাল থাকলে অবশ্য তিনি কনিষ্ঠদের উন্নতির পথনির্দেশ দিতেন| ভালো টিম তৈরি করাই যে তাঁর লক্ষ্য, তা প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন| উদাহরণ সহযোগে বলতেন কিভাবে তিনি কাজ শিখেছেন, কিভাবে বিদেশে কাজ করে সুনাম কুড়িয়েছেন, কতরকম জটিলতার মধ্যে থেকে তিনি কার্যোদ্ধার করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি| গল্প শুনে যদি অন্য টেবিল থেকে কেউ উঁকি মারে তবে তিনি একটু ঘুরে দাঁড়াতেন, যাতে দুজনেরই ভবিষ্যৎ তৈরি হয়| আর দুচারজন উঁকিঝুঁকি মারলে সবার ভবিষ্যতের রাস্তাটা মসৃন করার জন্য ঘরে ডেকে নিতেন সবাইকে| তাতে তাঁর সূক্ষ্ণ নজরদারি, ঠিক সময়ে কাজের অভ্যেস, জ্ঞান আর উপস্থিত বুদ্ধির উদাহরণ দেওয়াটাও মসৃন ভাবে হত| একেবারে চুপ করে শুনলে ‘ডিসকাশন’ হয়না, তাই মাঝে মাঝে প্রশংসা সূচক মন্তব্য করাই শ্রেয় ছিল শ্রোতাদের পক্ষে|

একদিন কোম্পানির লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হল| সাহেবের ব্যাখ্যা শুনে সহজেই বোঝা গেল কোম্পানির লক্ষ্য আর একজন কর্মচারীর লক্ষ্য এক হতে হবে| লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে রাস্তার ডানদিক বামদিক না দেখে বিপদ আপদ তুচ্ছ করে কেবল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়| অতি সাধারণ নিজস্ব লাভ ক্ষতির কথা ভাবলে চলে না| সাহেব কিভাবে লক্ষ্যে স্থির থেকে সাফল্য পেয়েছেন, তাও নজরে আনলেন বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে| এদিক ওদিক ঘুরে শেষে সাহেব পৌঁছলেন মহাভারতে – চারদিকের মানুষজন, হৈচৈ, রাজকীয় আয়োজন না দেখে অর্জুন দেখতে পেলেন শুধু পাখির চোখ| (এটা খুব দরকার, মহাভারত জুড়ে দিলে বক্তব্যটা বেশ পান্ডিত্যপূর্ন লাগে| রামায়ণের চেয়ে মহাভারতটা বেশি চলে, কারণ চরিত্র আর বৈচিত্র্য অনেক বেশি)| অর্জুনের মতই লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে, পাখির চোখের মত কোম্পানির লাভই একমাত্র লক্ষ্য হবে ইত্যাদি বলে সাহেব ইতি টানলেন| পাগলাটে বিবেকবাবু এতক্ষন বড়বড় চোখ করে শুনছিলেন, হঠাৎ বললেন – “তাতে লাভটা কি হল স্যার, সেই তো যৌবনে বনবাস, প্রৌঢ় বয়েসে যুদ্ধ আর বুড়ো বয়সে পাহাড়ে পা পিছলে মৃত্যু|” সাহেব পিছু হটার লোক নন, বললেন – “কিন্তু একমাত্র অর্জুনই তো পারল লক্ষ্যভেদ করতে|” বিবেকবাবুও নাছোড়বান্দা – “মাছের চোখে লক্ষ্যভেদ করে পাওয়া বৌ – তাতেও অন্যরা ভাগ বসাল|” লক্ষ্যে অবিচল থাকার ফল কতটা দূর-প্রসারী হতে পারে, তা বুঝতে কারও কোনও অসুবিধা রইল না|

একদিন সাহেবের মুড ভাল দেখে একজন একটা আর্জি পেশ করল – স্ত্রী আসন্নপ্রসবা, ডাক্তার বদ্যি ছাড়াও মিঞা বিবির সংসারে দেখাশোনার জন্য আর কেউ নেই, তাই আগামী কয়েক মাস ওর পক্ষে কলকাতার বাইরে যাওয়া একটু সমস্যাজনক| ভাল মুডে থাকা সাহেব বিষয়বস্তু পেয়ে গেলেন এক্সাম্পল সেটিং এর| শুরু হল লম্বা ফিরিস্তি দেওয়া – কবে কোথায় কোন অফিসের কাজে তিনি বাড়ির বাইরে লম্বা সময় থেকেছেন| বাড়ি ছেড়ে লম্বা সময় বাইরে পড়ে থাকাটা কিভাবে তাঁর চাকরি জীবনে উপরে উঠতে সাহায্য করেছে, সে কথাও বিস্তারিত বললেন| অফিসের জরুরি কাজ ছেড়ে বাড়ির কথা ভাবলে কোম্পানির কি কি ক্ষতি হয়ে যেত, তার খতিয়ান দিলেন| মানুষের শরীর থাকলেই ডাক্তার বদ্যির ব্যাপার থাকবে; তার জন্য দুনিয়ার এগিয়ে যাওয়া বন্ধ হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি| বন্যার জলের মত উদাহরন বাড়তেই থাকল, বাড়তেই থাকল| একসময় দুকূল ছাপিয়ে উঠল বাঁধ ভেঙে|

সাহেব মোক্ষম ভাবে এক্সাম্পল সেটিং করলেন, বললেন – “আমার ছোট মেয়েটা যখন হয়, তখন আমি মধ্য প্রাচ্যের এক রিফাইনারিতে যন্ত্রপাতি বসাচ্ছি| প্রচন্ড ব্যস্ততায় দিন কাটছে, নাওয়া খাওয়া ভুলে প্রায় দু বছর মাটি কামড়ে ওখানে পড়ে আছি| দেশে ফেরার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা, ওই ফোনেই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ থাকত| সবার জানা আছে বোধহয়, তেলই বিশ্ব-রাজনীতির নীতি নির্ধারক, প্রচন্ড চাপের মধ্যে কাজ করতে হয় ওখানে|”

সবাই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল| কয়েক সেকেন্ড সেটা বেশ উপভোগ করে আবার বলা শুরু করলেন – “যন্ত্রপাতি প্রায় চালু করে দিয়েছি, কাজ শেষের দিকে এমন সময় মেয়ে হওয়ার খবরটা পেলাম| সব কাজ গুছিয়ে একদম অন্নপ্রাশনের ঠিক আগে আগে বাড়ি ফিরেছিলাম| ফোনেই ডাক্তার বদ্যি, হাসপাতাল, নার্সিং হোম সব ব্যবস্থা করেছি; কোনও অসুবিধা হয়নি| আসলে কাজের প্রতি ভালোবাসাটা থাকা দরকার|” বহুক্ষণ চুপচাপ সবাই শুনেছে আর চুপচাপ ঘাড় নেড়েছে, চোখ বড় থেকে বড়তর হয়েছে| এবার কিছু না কিছু মন্তব্য প্রয়োজন| হাঁ বন্ধ করে, একটা ঢোঁক গিলে বিবেকবাবু বললেন – “আপনার কাজের প্রতি ভালবাসা নিয়ে তো কোনও প্রশ্নই ওঠেনা, তার চেয়েও বড় কথা স্ত্রী কন্যা সহ সংসারটা এখনও টেনে যাওয়ার মত আপনার উদার মনটা|”

সত্যিই তাই, উদাহরণযোগ্য মানসিক দৃঢ়তা আর প্রচন্ড উদারতা না থাকলে লোকে হয় সন্ন্যাসী হয়ে যায় বা আত্মহত্যার চেষ্টা করে এসব সময়ে|

 

~ যে পথে করে গমণ …. ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleখারাপ সকাল, ভালো দিন (দ্বিতীয় পর্ব)
Next articleখারাপ সকাল, ভালো দিন (তৃতীয় পর্ব)
SUBHAMOY MISRA
জন্ম আর বড় হওয়া অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় হলেও কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর চাকরির সুবাদে এখন হাওড়ার বাসিন্দা। দেওয়াল পত্রিকায় লেখা শুরুর পরে স্কুল কলেজের পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বই পড়া, নাটক দেখা, গান শোনারও নেশা আছে। পেশাসূত্রে লব্ধ অভিজ্ঞতা লেখার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে আছে মনের মধ্যে।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments