পদব্রজে চলেন সুদামা লক্ষ্য দ্বারকাধাম,
ভক্ত হৃদয়ে উদাস চাহনি–কণ্ঠে কৃষ্ণনাম।
অতি দরিদ্র এক রাহ্মণ সুত পরণে ছিন্নবাস,
নাহি কোনরূপ আবরণ পদে–তিনি যে দাসেরও দাস।
পোরবন্দর দ্বারকার মাঝে বিস্তর ব্যবধান,
বন্ধুর তথা নির্জন পথে ক্লিষ্ট ভক্তিমান।
ব্রহ্মজ্ঞানের অনন্ত পথে পথিক মোদের দ্বিজ,
পূত বারিধারা বহে হিয়ামাঝে–প্রস্ফুটে সরসিজ।
কিন্তু কে সেই উন্নত প্রাণ–তাঁর সনে করি আলাপ,
শতেক ক্লেশেও যাঁহার কণ্ঠে নাহি কোনরূপ বিলাপ !
দ্বারকাধীশের প্রিয় সখা নাকি আমাদের এই নি:স্ব !
দ্বিজের এহেন বাক্য শ্রবণে হাসে চরাচর বিশ্ব।
কিন্তু কথাটি পরম সত্য সংশয় স্থান কোথা !
পাষাণ হৃদয়ও দরবিগলিত এমনই অরূপ গাথা।
ভক্ত সুদামা দ্বারকাধীশের সর্বশ্রেষ্ঠ সখা,
তাঁহাদের কথা পুরাণের মাঝে স্বর্ণাক্ষরে লেখা।
চল যাই এবে শিপ্রার তীরে–উজ্জয়িনীর দৃশ্য,
যেথা সন্দীপনী ঋষিগৃহে পাঠে মগ্ন দুজন শিষ্য।
সখ্যতা সেথা দুজনার মাঝে গাঢ় হতে গাঢ়তর,
শিক্ষা অন্তে যে যাহার গেহে–দেখা হয় নাকো কারো।
একজন তিনি দ্বারকার পতি শ্রীকৃষ্ণ ভগবান,
অপর জন সদা অভাবগ্রস্ত ব্রাহ্মণ সন্তান।
কিন্তু দোঁহার মনের গহনে একে অন্যের প্রতি,
সততই ছিল সন্জীবন ভালবাসা আর স্তুতি।
দক্ষিণা বিনা শিক্ষাদানই দ্বিজের সঠিক কর্ম,
পাঁচ গৃহস্থের ভিক্ষার দ্বারা পালিত জীবনধর্ম।
সুদামার এই জীবনবোধে সংসার চলা দায়,
দারা সন্তান উদরে দুমুঠো অন্ন জোটে না হায়।
তথাপি তাঁহার যাতায়াত কভু ছিল না মিত্র সদনে,
যদিও কেবল কৃষ্ণেরই নাম শয়নে কি জাগরণে।
প্রবল প্রতাপী রাজার স্তুতিতে ব্রাহ্মণ অসমর্থ,
রাজপ্রহরীর ভীষণ প্রহারে অসীম ব্যাথায় গাত্র।
ভিক্ষা করার ক্ষমতাও নেই পরিবার হতমান,
যেটুকু চাউল ছিল হায় ঘরে নহে তা সংকুলান।
কাহারো উদর পূর্তি হয়না অতিথি ঘরের দুয়ারে,
কিছুই থাকেনা সুদামা আর জায়া সুশীলার তরে।
একখানি দানা আধাআধি ভাগ রমা রমাপতি সনে,
সুশীলা কপোলে অশ্রুর ধারা বাঁধ বুঝি নাহি মানে।
অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটন সেদিন মধ্যরাত্রে,
কে যেন দিলেন স্বস্তি প্রলেপ সুদামার সারা গাত্রে।
অবাক সুদামা অনুভবে তিনি স্বয়ং পরম সখা,
অলক্ষ্যে বটে তথাপি তাঁহারই পরশ তনুতে লেখা।
কিন্তু অভাব ত’ সংসারে হায় ক্রমশ বর্ধমান,
শিশুরা ক্ষুধায় জঠর জ্বালায় বুঝি প্রায় হতজ্ঞান।
অবশেষে দ্বিজ জায়া উপরোধে আজি দ্বারকার পথে,
যদিও তাঁহার হৃদয় দীর্ণ সংশয় সংঘাতে।
প্রতিবেশী সনে ভিক্ষা অন্তে তণ্ডুল অতি সামান্য,
সংগ্রহ করে ভার্য্যা সুশীলা মিত্র কৃষ্ণ জন্য।
দণ্ড অগ্রে ছিন্ন বস্ত্রে রক্ষিত উপহার,
পঠন কালের কত সুখস্মৃতি মনে পড়ে সুদামার।
আপন লক্ষ্যে চলেন সুদামা মন অতি অবসন্ন,
কেমনে জুটিবে জায়া শিশুদের দুবেলা দুমুঠি অন্ন !
সহায় যখন স্বয়ং কৃষ্ণ সবই হয় সম্ভব,
এক বণিকের পৌত্রলাভে দশ দিন উৎসব।
অন্ন বস্ত্র দান সেইসাথে দশ গ্রামে দশ দিশে,
সুদামার দীন পরিবারও তাই আর নহে উপবাসে।
অবশ্য দ্বিজ সুদামার এসব ঘটনা ছিলনা কিছুই জ্ঞাত,
অলক্ষ্যে যিনি অন্তর্যামী যোজনা তাঁহারই কৃত।
অজ্ঞাত পথ, অজানা শপথ বুক বুঝি কাঁপে ত্রাসে,
এমন সময় কোথা হতে এক অচেনা পথিক সকাশে।
ছদ্মবেশে তিনি যে স্বয়ং পরম মিত্র কৃষ্ণ,
চিনিতে নারেন দ্বিজ সুদামা করেন কত না প্রশ্ন।
মুরলাীধর মনোহর সাথে দ্বারকাতে উপনীত,
ছদ্মবেশী যবে নিলেন বিদায় ব্রাহ্মণ শঙ্কিত।
রাজার প্রাসাদে যাবেন কিভাবে এমনই ছিন্নবাস !
দ্বারকাধীশ মিত্র শ্রবণে সকলের উপহাস।
সন্ধান করি’ যবে উপাগত প্রাসাদের অঙ্গনে,
বৈভব হেরি’ হতবাক দ্বিজ দৃষ্টি আপন পানে।
দুয়ার রক্ষী করে জিজ্ঞাসা– প্রণাম, হে কুলশ্রেষ্ঠ –
কি হেতু হেথা আগমন দেব দ্বিজ কি ভাগ্যপিষ্ট !”
হাসেন সুদামা – “এমত চিন্তা তব হৃদে কেন বুঝি,
নাহি আমি কোন ভাগ্যক্লিষ্ট কহি তবে সোজাসুজি।”
“দ্বারকাধীশ মোর পরম মিত্র সন্দেশ দিও তাঁহারে
পোরবন্দরে বসতি যাহার সেই সুদামা দাঁড়ায়ে দুয়ারে।”
যদিও কহেন তথাপি চিত্তে দ্বিধা,সংশয়,লজ্জা,
কেমনে তাঁহারে চিনিবেন সখা হেরি’ এই হেন সজ্জা !
ভাবেন-“কবে ঐ কৈশোরকালে গুরুগৃহে হয় দেখা,
সে সব অতীত–বোধ করি এবে বিস্মৃত মোর সখা।”
“যদি বা মিত্রে চিনিতে পারেন দিবেন কি পরিচয় !
সকলের সনে রাজাধিরাজের অবমান নিশ্চয়।”
“কি বিড়ম্বনার মুখোমুখি আজি সুশীলা কথন মানি’
অনাবশ্যকই আগমন হেথা-“ব্রাহ্মণ অভিমানী।”
“অপেক্ষা হেথা অনুচিতই বটে–প্রত্যাগমনই শ্রেয়,
নতুবা মিত্র হইবেন মোর সবার চক্ষে হেয়।”
পুনরায় পথে কৃষ্ণমিত্র–দৃষ্টি লক্ষ্যহীন,
সুদামা হৃদয় মাঝারে কেমন বেসুরে বাজিছে বিণ।
এদিকে প্রাসাদে সন্দেশ আসে দ্বারকাধীশের সনে,
ধাবিত কৃষ্ণ ভাব উন্মাদে সুদামার নাম শ্রবণে।
অনাবৃত পদ পাদুকাবিহীন মুকুট ত’ নাহি শিরে,
কেবল কণ্ঠে মিত্র সুদামা–সিক্ত নয়ন নীরে।
রাজপথ মাঝে স্বয়ং শ্যামেরে হেরিয়া এহেন রূপ,
জনগণ সবে মোহের আবেশে বিহ্বল নিশ্চুপ।
অবশেষে হয় মিত্র মিলন সুদামা ও মধুসূদন
রাজপথখানি যেন বাণভাসি’-অশ্রু মানে না বাঁধন।
সবার কপোলই অশ্রুসিক্ত হেরি অপরূপ চিত্র,
হৃদয়ের মাঝে একটিই সুর–এমনই ত’ হয় মিত্র।
আপন রথে বসায়ে মিত্রে চলেন কৃষ্ণ প্রাসাদে,
সুদামা হৃদয় আনন্দময়–কখনো বা কাঁদে বিষাদে।
মনে পড়ে হায় সুশীলার কথা–শিশুদের দুখী আনন,
উপনীত শেষে মিত্র প্রাসাদে–বুঝি এক মায়া কানন।
অভিনন্দন সুদামা মিত্রে প্রাসাদে প্রবেশি’ মাত্র,
গোলাপ শোভিত চন্দন নীরে ধৌত হইল গাত্র।
রাজসিক মহা আপ্যায়নে মিত্রধর্ম জয়ী,
স্বামীর সখা ত’ দেবর সমান–কৃষ্ণ ভার্য্যা ত্রয়ী।
তণ্ডুল দানা উপহার লভি কৃষ্ণে যেরূপ হর্ষ,
সমধিক খুশী ভার্য্যাবৃন্দ এমনই অমল স্পর্শ।
কত যে গল্প কত স্মৃতিকথা–বীত সপ্তাহকাল,
ভাবেন সুদামা–সবই কি সত্য–নাকি স্বপ্নের মায়াজাল !
কিন্তু হৃদয়ে সতত বিরাজে জায়া শিশু সন্তান,
তাহাদের তরে বড়ই ব্যাকুল দ্বিজ সুদামার প্রাণ।
অতএব আর বিলম্ব নহে ঘরেতে ফেরার পালা,
পোরবন্দর বৃন্দাপুরীতে সুদামার দুইচালা।
এদিকে সখার অজ্ঞাতসারে কৃষ্ণের কৌশলে,
সুদামার গৃহ রাজপুরীসম–বিশ্বকর্মা ভূতলে।
বৃন্দাপুরীর প্রতিটি গৃহই নবসাজে সজ্জিত,
পদ্মালয়ার কৃপায় যেথা বৈভব বিরাজিত।
সুদামা এবং ভার্য্যা সুশীলা–তাঁহাদের সৎকর্ম,
তাই বৃন্দাপুরীর প্রতিটি গেহই আনন্দময় হর্ম্য।
হতবাক রাজা সবকিছু শুনি মাগেন প্রভুর ক্ষমা,
অনুতাপানলে দগ্ধ সতত–কখন আসেন সুদামা।
শত উপরোধ তথাপি সুদামা চলেন গেহের পথে,
পদব্রজেই প্রত্যাগমন–নহে শকটে কিম্বা রথে।
পুনরায় দেখা পথিকের সাথে মুরলীবাদক মনোহর,
সহসাই যেন দৃষ্টিগোচর–সমীপেই পোরবন্দর।
“উপহার কিছু দেয় নাই সখা–এ কেমন মিত্রধর্ম !
সুশীলা যখন শুধাইবে গেহে–নাহি মোর কোন বর্ম।”
“দয়ানিধি নাকি দ্বারকার পতি সম্পদ অগণন !
তবে দীনসখা প্রতি দয়ালের কেন এই হেন আচরণ !”
ভাবেন সুদামা-“তৃষিত কি তিনি কৃষ্ণ বিত্ত হেরি’ !
মিত্র তাঁহার রাজাধিরাজ আর তিনি ত’পথের ভিখারী।”
পরক্ষণেই পশ্চাত্তাপে লজ্জিত ব্রাহ্মণ,
“হায় আমি এত লোভাতুর পাপী–কলুষিত মোর মন।”
মনে মনে ক্ষমা যাচেন মিত্রে-“দাও মোরে এবে দণ্ড,
সত্যই আমি পাপিষ্ঠ অতি–ব্রাহ্মণ নহি চণ্ড।”
অলক্ষ্যে থাকি হাসেন রমেশ–মিত্র মাগিছে ক্ষমা !
হাসেন তাঁহার রাণী রুক্মিণী–যিনি ত আসলে রমা।
পথেই বিদায় লয় মনোহর–নিকটে বৃন্দাপুরী,
কিন্তু দ্বিজের হৃদয়ে ধন্ধ সৌধকিরীট হেরি।
বুঝিতে কিছুই নারেন সুদামা–নয়নে অনেক প্রশ্ন,
এমন সময় ঘোর কলরোল–জয় ভগবান কৃষ্ণ।
আরও কোলাহল সুদামার নামে–ভক্তের জয়ধ্বনি,
মালা চন্দনে তাঁহারে বরণ–বাদ্যের রনরনি।
বরণ তাঁহারে করেন সুশীলা–অপরূপা পূত সাজে,
মহার্ঘ্য সব পোশাকে শিশুরা–সকলে প্রণমি দ্বিজে।
রাজাও আসিয়া মাগিলেন ক্ষমা-“রাজগুরু পদে আচরি’
পবিত্রধাম বৃন্দাপুরী হইবে সুদামাপুরী।”
বন্ধুবর শ্রীধর তাঁহারে করেন সকলি ব্যক্ত,
দরবিগলিত ভক্ত সুদামা–ভাবেন তিনি কি রিক্ত !
“এমন সখারে করি সংশয়–ধিক মোরে শতধিক,
মিত্রধর্ম পালনে মোর বন্ধুটি সৌভিক।”
কৃষ্ণ সুদামা অমর কাহিনী–প্রোজ্জ্বল যুগে যুগে,
যদিও কলিতে মানুষ ব্যস্ত–আপন স্বার্থরোগে।
প্রণাম করি সেই মহাত্মন দ্বিজ সুদামার চরণে,
আর প্রণিপাতি মোর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণে।
তাঁহাদের পূত সখ্যতা কথা ছন্দে দিলেম গাঁথি,
মোর জীবনেও এই মিত্রধর্ম সতত থাকুক ভাতি।