এক
হাওড়া স্টেশান থেকে বোম্বে মেল ছেড়ে দিলো। ট্রেন ছেড়ে দেবার আগে যা হয়… প্রথমে রিসার্ভেশান লিস্টের সামনে বিরাট ভিড়… তার কিছু পরেই আস্তে আস্তে ভিড়টা ট্রেনের দিকে ঘুরে গেলো। কেউ কুলির মাথায়, কেউ নিজেরাই জিনিস পত্র নিয়ে সবাই প্রায় একই সঙ্গে যে যার কামরার দিকে যাবার প্রচেস্টা শুরু করলো…। প্রত্যেকবার কোন দূর পাল্লার ট্রেন ছাড়ার সময় যা হয়… এবারও তাই… কেউ কুলিকে ডাকছে… কেউ সঙ্গের বাচ্চাকে সামলাচ্ছে … কেউ বা বিরক্ত হয়ে কোন আত্মীয়কে সাবধান করছে। ভিড়টা এবার আস্তে আস্তে সরে এসে কামড়ার দরজার বাইরে যে লিস্টটা আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পরলো…। আবার ঠিক সেই আগের মতো… ধাক্কা ধাক্কি … খানিকটা কথা কাটাকাটি … এগুলো পার হয়ে কিছু লোক আস্তে আস্তে নিজের টিকিটের নাম্বার অনুযায়ী সঠিক গেটের দিকে এগুলো। এখানেও প্রতিবার যা হয়… কুলিরা মাথায় করে আনা লাগেজ দুম দাম করে ঠিক ট্রেনের গেটের সামনে ফেলতে লাগলো … মানুষের যাতায়াতের পথ প্রায় বন্ধ সুতরাং আবার মানব জট। আর শুধু মাত্র প্যাসেঞ্জারের ভিড় তো নয়… প্রত্যেক প্যাসেঞ্জারের বন্ধু বান্ধব বা অন্য আত্মীয়রা সবাই সি. অফ. করতে এসেছে … কাজেই প্ল্যাটফর্মে অসংক্ষ্য মানুষের এই ক্ষণিকের অবস্থান।
মধুমন্তীর লাকটা ভালো … এ. সি. টু টায়ারের একটা ছোট কুপে একটা সিট পেয়ে গেছে, মাত্র চারটে সীট, তার মধ্যে একটা তার। সঙ্গে বেশী জিনিস পত্র নেই, কাজেই গেটের সামনের ভিড় এড়িয়ে কোনক্রমে সে নিজের কুপে ঢুকে পরলো। ভাই লোকেশ সঙ্গে এসেছিল, সে হাতের সুটকেসটা দুটো সীটের মাঝখানে রাখলো, এখনও এই কূপে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মধুমন্তী জানলার কাছে নিজের হ্যান্ড ব্যাগটা রেখে তার পাশেই নিজের ভারি শরীরটা নিয়ে বসল…একটু তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করলেই তার এখন হাঁপ লাগে। ট্রেন ছাড়তে এখন মিনিট পনের দেরি কাজেই লোকেশও কূপের দরজাটা বন্ধ করে এসে একটা ফাঁকা সীটে বসে পরল।
লোকেশ। কি রে দিদি, চা খাবি নাকি? বলি এক কাপ?
মধুমন্তী। দূর, এই তো বাড়ী থেকে খেয়ে এলাম …। বলে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে রাখল, ট্রেনের এই ট্রাভেল গুলো সে বই না পড়ে কাটাতে পারে না। বইটা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস পার্থীব।
লোকেশ। আরে ছাড় তো… সে তো প্রায় দের ঘন্টা আগে…।
মধুমন্তী। তোর খেতে ইচ্ছে হলে খা না …।
লোকেশ। আমিও খাব… তুইও…।
এই বলে সে দরজার কাছে মুখটা নিয়ে গেলো, বাইরে তখন ভিড়টা একটু পাতলা… বাইরের ভিড়টা তখন কামরার ভিতরে গমগম করছে। নানা রকম কন্ঠস্বরে নানা প্রকার সাংসারিক কথা বার্তা ভেষে আসছে।
ঠিক পাশের কোন কিউবিকল থেকে কোন ভদ্রলোক চিৎকার করে বলে উঠলেন – এ্যাই পাপাই, রাত্রে কিন্তু তুই ওপরে উঠে যাবি, মা ওপরে উঠতে পারবে না। ঘুম পাবার আগেই বলবি…।
পাতলা কন্ঠে উত্তর এলো – ঠিক আছে…ঠিক আছে…এখন তো জানলার ধারে একটু বসতে দাও…।
আবার অন্য কোন ধার থেকে ভেষে এলো – শোন মিলু, রাত্রে কি খাবে? ভেজ না ননভেজ? মহিলা উত্তর দিলেন – ভেজ ভেজ, ট্রেনে আমি মাংস একদম খেতে পারি না। একটা বাচ্চা পাশ থেকে বলে উঠল – বাবা, আমি কিন্তু মাংস খাব। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলার জবাব এলো – না বাপ্পা, তুই ওই সব ঝাল মসলা একদম খাবি না। পেট খারাপ হলে কি হবে? গতবার মাসির বাড়ী যাবার সময় কি হয়েছিল মনে নেই? বরঞ্চ নেমে হোটেলে উঠে যত ইচ্ছে মুরগী খাস, কেউ মানা করবে না।
মধুমন্তী বুঝতে পারলো কামরাটা প্রায় ভরে এসেছে, এখন পর্যন্ত অবশ্য এই কুপে কারো পদার্পন ঘটে নি। বছরের এই সময় অবশ্য ট্রেনে খুব একটা ভিড় হবার কথাও নয়। লোকেশ বাইরের দিকে তাকিয়ে চা ওয়ালা খুঁজছিল … ওকে মুখ বাড়াতে দেখে একজন এগিয়ে এলো …হাতে একটা বড় কেটলি, একটা ব্যাগে বেশ কিছু প্লাস্টিকের গ্লাস… চায়ে গরম …।
লোকেশ। এই যে ভাই… দুটো … ।
লোকটা দুটো ছোট্ট কাপে গরম চা এগিয়ে দিল। লোকেশ কাপ দুটো ভেতরে নিয়ে জানালার কাছে ছোট্ট কাঠের স্ট্যান্ডে রাখল, তারপর একটা দশ টাকার নোট বারিয়ে দিল… লোকটা ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়েই পাশের অন্য কোন কিউবিকলের দিকে দৌড়াল… হয়তো অন্য কোন যাত্রী ডেকেছে… চায়ে গরম।
মধুমন্তী একটা কাপ নিজের দিকে টেনে নিল। এমন নয় যে তার এখন ভীষণ চা তেষ্টা পেয়েছে … কিন্তু কেনা হয়ে যাবার পর নাটক করার কোন মানে হয় না। আর তাছাড়া সে বরাবরই দেখেছে যে বাড়ীর চা থেকে এই সব বাইরের দোকানের চা খেতে তার বেশী ভালো লাগে… বেশ কষা কষা, একটু বেশী গাঢ় … একটু তেতো ভাব, বাড়ীতে এমন চা কিছুতেই করা যায় না। প্ল্যাটফর্মের চায়ের একটাই প্রবলেম … বড্ড কম দেয় … ভাঁড়টা এতোই ছোট যে দুটো আঙ্গুল একসাথে ঢোকান যায় না। লোকেশ এই সামান্য চা টুকু বেশ ছোট ছোট চুমুক দিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছিল , মধুমন্তী তিন চুমুকে মেরে দিয়ে কাগজের কাপটা সিটের তলায় রেখে দিলো … এখন বাইরে ফেলার কোন উপায় নেই … প্ল্যাটফর্মে মানুষ গিজগিজ করছে, পরে ট্রেন চলতে শুরু করলে একসময় ফেলে দিতে হবে।
মধুমন্তী তার হাত ব্যাগ থেকে চশমাটা বার করলো। আর কয়েক মিনিট পরেই ট্রেন ছাড়বে, তখন কামরা ফাঁকা হয়ে গেলে জমিয়ে বইটা পরা শুরু করবে… এটাই আজ রাত্রের প্ল্যান।
আর চোখে একবার লোকেশকে দেখল, এখন বেশ বিনিত হয়ে দিদি দিদি করছে, চা খাওয়াল… কিন্তু বাবা মারা যাবার পর থেকেই তার এই ভাই এবং ভাইয়ের বউয়ের সাথে তার সম্পর্ক মোটেই ভাল না। মূলত সম্পত্যি নিয়েই যত গণ্ডগোল, যদিও আরো সাংসারিক ব্যাপারও আছে।
মধুমন্তীর বিয়ের আগে ঠিকই ছিল… ভাই বোন বেশ ভালোই সম্পর্ক ছিল। প্রথমে মধুমন্তীর বিয়ে হোল … ভালো চাটার্ড অ্যাকাউনটেণ্ট পাত্র, বেশ বড় ফার্মে চাকরী। সে সময়ও সম্পর্ক ঠিক ছিল। লোকেশ খুব অ্যাভারেজ ছিল পড়াশুনায়… গড়িয়া কলেজ থেকে কোন রকমে বি.এ. পাশ করে বেকার হয়ে বসে ছিল। ওই সময় থেকেই বোধহয় প্রেম ট্রেম চলছিল কলেজেরই কোন মেয়ের সাথে। বছর দুয়েক কোন চাকরী জোটে নি… এই সময় বাবার বন্ধু সুবোধকাকুর রেফারেন্সে বজবজের বাটা কোম্পানিতে একটা ছোট চাকরী হয়ে গেলো। চাকরী হবার পর এক বছরও হয়নি… লোকেশ বিয়ে করলো… হঠাৎ-ই । মধুমন্তী তখন বিয়ের পরে দিল্লীতে, সবটা ভালো জানা নেই, তবে সম্ভবত মাকে বলেছিল, আর মা বাবাকে। বাবা আগেকার দিনের পিউরিটার্ন মানুষ। লোকেশের বউ, মানে তখনকার বান্ধবী… বনানী … তাকে দ্বারিকবাবুর পছন্দ হোল না। ওনার বক্তব্য দুই ফ্যামিলিতে মানাচ্ছে না। দ্বারিকবাবু আগেকার দিনের গ্র্যাজুয়েট… চমৎকার ইংরাজী লিখতেন, সরকারী কর্মচারি ছিলেন, সারা জীবন সততার সঙ্গে চাকরী করে বেশ কয়েক বছর রিটায়ার করেছেন। আর বনানীরা একাত্তরের দেশ বিভাগের পর ভারতে আসেন। বহুদিন ঢাকুরিয়ার লাইনের ধারে জবর দখল জমির ওপর মাটির বাড়ীতে থাকতেন। পরে যাদবপুরের ওদিকে একটা টালি দেওয়া একতলা বাড়ীতে চলে যেতে হয়। বনানীর দুই ভাইয়ের কেউই স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেনি, বনানী নিজে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে কোন এক সময় গড়িয়া কলেজে ভর্তি হয়েছিল… অবশ্য শেষ অবধি ডিগ্রি কমপ্লিট করতে পারে নি। এই রকম পরিস্থিতিতে বাড়ীতে বেশ অশান্তিই চলছিল এই বিয়ের ব্যাপার নিয়ে। এই সময় মধুমন্তী কলেজের শেষ ধাপে… অবশ্য এর পরেই তার বিয়ে হয়ে যায় জয়ন্তর সাথে, রীতিমত কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে… দেখে শুনে, যাকে বলে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। বিয়ের পরে মধুমন্তী আরো মাস পাঁচেক ছিল, শেষ পরীক্ষাটা কমপ্লিট করে সোজা দিল্লিতে, জয়ন্ত তখন ওখানেই পোস্টেড। যাই হোক, এই রকম পরিস্থিতিতে লোকেশ দুম করে একদিন বনানীকে সিঁদুর পড়িয়ে সোজা বাড়ীতে এনে হাজির, ভায়া কালীঘাট।
দুই
দ্বারিকবাবু এমনিতেই লোকেশের পছন্দের ব্যাপারে ভয়ংকর চোটে ছিলেন। দুপুরে খাবার ঠিক আগে হঠাৎ দুজনকে দেখে তিনি প্রথমে রেগে বাঘের মতো চিৎকার করে উঠেছিলেন, কিন্তু ওনার স্ত্রী মনিদীপা সামলে দিলেন, তাছাড়া গন্ডগোল দেখে পাড়ার কিছু মানুষও এগিয়ে এলেন। পাড়ায় একটা কেলেঙ্কারির ভয়ে দ্বারিকবাবুও সামলে গেলেন। কিন্তু সেই যে চুপ করলেন, তারপর সবার সাথেই কথা খুব কম বলতেন, তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। ছেলের বউ বনানীর সাথে তাঁর কোনদিনই বনেনি। এহেন দ্বারিকবাবুও একটা ভুল করলেন, নিজে একটা উইল করলেন, তাও রীতিমত উকিলের পরামর্শ নিয়ে কিন্তু কোর্টে গিয়ে রেজিস্ট্রি করালেন না। তাঁর দেহান্তের পর এই নিয়ে বিরাট গন্ডগোল … উকিলবাবু দ্বারিকবাবুর শেষ উইল নিয়ে বাড়ীতে এলেন, সব পড়াপড়ি হোল… কিন্তু ওই রেজিস্ট্রি না করা নিয়ে লোকেশ এবং তার শ্বশুরবাড়ি একেবারে তুলকালাম। দ্বারিকবাবু ছেলে এবং মেয়েকে সমান ভাগ করে দিয়ে গেছিলেন, কিন্তু লোকেশ মানতে চাইল না। একটু বেশী সম্পত্তির লোভে তার শালারা এসে উপস্থিত … তাদের বোনের দৌলতে তাদেরও যদি কিছু প্রাপ্তি হয়। এই নিয়ে কোর্ট অবধি গরাল … জয়ন্ত অবশ্য এসব চায়নি … কিন্তু মধুমন্তী ব্যাপারটা ছারল না… কোর্টে গেল এবং মামলার রায় খুব পরিস্কার … সম্পত্তি সমান দু ভাগই হবে। অবশ্য মা মনিদীপা বেঁচে থাকতে তিনিই সমস্ত সম্পত্তির মালিক থাকবেন।
বনানী অবশ্য সেই চরিত্রের মেয়ে যারা হাতে কিছু ক্ষমতা এলে আরো বেশী কিছুর জন্য ঝাঁপিয়ে পরে। এদের চরিত্রের আরো একটা দিক হোল মানুষ যত নরম বা ভদ্র হয় এরা ততই নখ দন্ত বিস্তার করে। গরীব ঘরে মানুষ হওয়ায় মানুষের তাচ্ছিল্য বা অপমান বনানীদের অনেক সহ্য করতে হয় তাই মনের মধ্যে একটা আগুন ছিলোই। দ্বারিকবাবু যতদিন জীবিত ছিলেন, বাড়ীতে তাও কিছু নিয়ম ছিল, তাঁর চলে যাবার পর বনানী একছত্র হয়ে পরলো … এতদিন দ্বারিকবাবুর সরব বীতস্পৃহা তার মনে যে হলাহলের সৃস্টি করেছিলো তার ছোবল এখন মনিদীপার ওপর পরতে শুরু করলো। মধুমন্তী পুরো ব্যাপারটা জানত না, তবে কিছুটা শুনেছিল। বছর তিনেক আগে হঠাৎ একবার কলকাতায় এসে পুরো ব্যাপারটা জানতে এবং বুঝতে পেরে আর দেরি করেনি… পরের দিনই উকিল ডেকে ইঞ্চি মেপে বাড়ী এবং সামনের সামান্য জমি ভাগ করিয়েছিল। তারপর নিজের ভাগে মা মনিদীপার থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিল। রাত দিনের কাজের লোক এখন সর্বদা মনিদীপার সাথে থাকে, যখন কলকাতায় আসে মধুমন্তীও তখন মার সাথেই থাকে।
মধুমন্তী প্ল্যাটফর্মের দিকে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে ছিল, আসলে কিছুই দেখছিল না … অতীতের এই সব ভাবনা মনের মধ্যে মেঘের মতো উড়ে যাচ্ছিল, এমন সময় কামড়ার বাইরে রেলের গার্ড আর টিকিট কালেক্টর এসে দাঁড়ালেন। ধড়মড় করে লোকেশ উঠে পরল –
— দিদি, উঠিরে… এবার ট্রেন ছাড়ছে বোধহয়।
মধুমন্তী। হ্যাঁ , আয় … ভাল থাকিস। বনানীকে আর বাচ্চাটাকে আমার ভালোবাসা দিস।
লোকেশ। সাবধানে যাস। মোবাইলটা খোলা রাখিস, মাঝখানে ফোন করব।
মধুমন্তী। অত ব্যাস্ত হবার কিছু নেই, বহুবার তো যাতায়াত করলাম… ফোন খোলাই থাকবে।
লোকেশ নেমে গেলো, তারপর দারুন দায়িত্ববান ভাইয়ের মতো জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। আরো মিনিট খানেক পরে ট্রেন সত্যিই নরে উঠল। মধুমন্তী একটা শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল, এতো সব ভনিতা তার ভালো লাগে না। মধুমন্তী খুব ভালো মতোই জানে যে লোকেশ অভিনয় করছে… গত পনের দিন, যতদিন সে কলকাতার বাড়ীতে মার সাথে ছিল ততদিন বনানীর সাথে খুব ভালো করে কথা কোনদিন হয়নি। লোকেশ যে দিন ঠিক সময়ে বাড়ীতে ফিরত সেদিন ঘরে বসে চা খেয়ে টিভির মধ্যে ডুবে যেত। তবে লোকেশের এখন আবার নেশা করার অভ্যাস হয়েছে যেটা আগে ছিল না। ছাত্র অবস্থায় যেটা ছিল তা হোল ঐ পূজার সময় লুকিয়ে চুরিয়ে প্যান্ডেলের পিছনে গিয়ে চোঁ করে কিছুটা চোলাই মেরে দেওয়া… ওটা সবাই ঐ বয়সে করে থাকে … লোকেশও করতো। চাকরি পাবার পর বোধহয় সেটা রেগুলার হয়ে গিয়েছে। লোকেশ মাইনে বেশী পায় না, গত দশ বছরে একটা মাত্র প্রমোশান পেয়েছে … কাজেই দেশী চোলাইয়ের পেছনে জলের মতো টাকা ওরানোয় বনানীর সাথে তার তুমুল লাগে… সন্ধ্যা বেলায় বাড়ীতে তান্ডব লেগে যায়। আর রাগলে বনানীর মুখ দিয়ে একেবারে ঢাকুরিয়ার লাইনের ধারের বস্তির ভাষা বেরিয়ে আসে, তখন কানে হাত চাপা দেওয়া ছাড়া কোন গতি থাকে না। কিছুই আর গোপন নেই, সারা পাড়াই বেপারটা জানে। এই পরিবেশে মনিদীপা সারাক্ষন পূজোর ঘরেই কাটিয়ে দেন। এখানে থাকে না বলে মধুমন্তী বেঁচে গেছে। আজকে হাওড়া স্টেশানে দিদিকে নিয়ে আসার পেছনে লোকেশের হয়তো কোন মতলব ছিল, অন্তত মধুমন্তীর তো তাই মনে হয়। আগে লোকেশ মাঝে মাঝেই জয়ন্তর কাছে টাকা চেয়েছে, হয়তো আজকেও চাইত… তবে সে সারাক্ষণ ট্যাক্সিতে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে থাকায় লজ্জায় কথাটা পারতে পারেনি। আর কারণ তো একটাই, সারাক্ষণ ভ্যান ভ্যান করে সেই একই কথা – দিদি, ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে, এই আয়ে কি করে করবো… এই সব। ওই সব কথা মধুমন্তী গত দশ বছরে অনেক শুনেছে, মাঝে মাঝে জয়ন্তকে বলে কিছু টাকাও দিয়েছে। কিন্তু লোকেশের স্বভাব পাল্টায় নি, তার নেশার খরচ আরো বেড়ে গেছে, তাই সে এখন আর টাকা দেয় না। লোকেশের ছেলে পাপাই, সে মা আর বাবার লড়াই, চিৎকার, গালিগালাজ … এই সবের মাঝে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, গত বছর সে ক্লাসে ফেল করেছে… এবং তার কোন দোষ না থাকা সত্তেও প্রবল পেটানি খেয়েছে। মধুমন্তী সবই বোঝে কিন্তু লোকেশের ফ্যামিলিতে তার আর কিছু করার নেই। শুধু তাই নয়, আরো আছে বনানীর বাপের বাড়ী। বনানীর ভায়েরা মাঝে মাঝেই এসে দিনের পর দিন থেকে যায়, লোকেশের কাছ থেকে মাঝে মাঝেই টাকাও নেয়। এই রকম গন্ডগোলের ফ্যামিলি থেকে মধুমন্তী দূরেই থাকতে চায়, তার ছেলে মেয়েদের সে কোন দিনই কলকাতায় আনে না। আর যদিও বা আসে, তারা তাদের মামার বাড়ীতেই থাকে।
রাতের খাওয়ার বা শোয়ার এখনও অনেক দেরি, তাই পাশে রাখা শীর্ষেন্দুর বইটা পরবে কিনা ভাবছিল। ঠিক এমন সময় কূপের দরজাটা হড়াম করে খুলে গেলো আর একজন ভদ্রমহিলা হাতের দুটো মাঝারি মাপের স্যুটকেস দরজার সামনে ট্রেনের মেঝের ওপর রেখে হাঁপাতে লাগল। মধুমন্তী ভালো করে মহিলার দিকে তাকাল… আন্দাজে মনে হয় মহিলার বয়স প্রায় তারই মতো… এই মধ্য চল্লিশের কাছাকাছি বা একটু বেশী, তবে পঞ্চাশের নিচে। মুখটা দেখে একটু বেশি প্রৌঢ় বলে মনে হয়, যেন জীবনের অনেক ওঠা পরার মধ্যে দিয়ে গেছেন। মহিলা একটু স্থুলাঙ্গী, মধুমন্তী একবার অপাঙ্গে নিজের দিকে তাকাল, বয়সের সাথে সাথে তার নিজের ওজনও বেড়েছে…। মহিলা একটা মাঝারি দামের সুন্দর কাজ করা ছাপা শাড়ি পরে আছে, মোটামুটি ভাল পছন্দের পরিচায়ক। গলায় একটা বেশ পাতলা হার … আসল না নকল বোঝা মুশকিল।
ভদ্রমহিলা এবার দু পা এগিয়ে এসে মধুমন্তীর ঠিক বিপরিত চেয়ারে বসলেন, তারপর একটা রুমাল নিয়ে মুখের আর গলার ঘাম মুছলেন। তারপর মধুমন্তীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, —
— একটু দেরি হয়েছিল, তাই অন্য কামড়ায় উঠে পড়েছিলাম। তারপর খুঁজে এই দুই হাতে দুটো স্যুটকেস নিয়ে আসতে একটু দেরি হোল।
মধুমন্তী লক্ষ্য করল যে এই বয়সেও ভদ্রমহিলার হাসিটা অনবদ্য, ঝিকমিকে সাদা দাঁতের সারি দিয়ে সাজানো … এককথায় মনোমুগ্ধকর।
তিন
মিতালী নিজের সিটে জমিয়ে বসলো। স্যুটকেস দুটো এখনও দরজার পাশেই রয়েছে… থাক, দরজাটা তো বন্ধই আছে। সে সিটে বসেই বসেই একটু হাঁপিয়ে নিল, তার বয়স এখনও পঞ্চাশের নিচে, কিন্তু হার্টে ট্রাবল আছে, হাঁটুতে একটু বাতও ধরেছে। বেশ কিছু দিন হোল ডাক্তারের উপদেশে নি-ক্যাপ ব্যাবহার করছে, তাতে হাঁটতে কিছুটা সুবিধা হয়। বয়সের সাথে সাথে শরীর ভারি হয়েছে, একটু পরিশ্রম করলেই বুক ধক ধক করে… আজকেও করছে, তবে একটু বসলেই সামলে যায়।
একটু বসতেই শরীরটা সামলে গেল। মিতালী আর চোখে সামনের মহিলার দিকে তাকাল। মহিলাও বোধহয় তার দিকেই তাকিয়ে ছিল, দুজনার চোখাচোখি হতে দুজনাই একটু লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে তাকাবার ভান করল। মিতালী লক্ষ্য করলো যে সামনের ভদ্রমহিলা বেশ দামি একটা সিনথেটিক সিল্কের শাড়ী পড়ে আছে, গলায় একটা মোটা হার… বেশ পয়সা ওয়ালা ঘরের বউ বলে মনে হয়। বয়স তো দেখে তার কাছাকাছি বলেই মনে হয়, তবে বলাও যায় না। গায়ের রঙ এক সময় বোধহয় বেশ ফর্সাই ছিল, এখন বয়সের চাপে একটু ময়লা হয়েছে, তবুও বাঙ্গালী সমাজে একে ফর্সাই বলা যায়। মুখের কাটিং বেশ ভালোই ছিল একসময়, বয়সের তারনায় মুখটা একটু ভারি হয়ে গেলেও গালের কাছে সুন্দর স্পটে একটা তিল যেন মুখটাকে বেশ শ্রীময় করে তুলেছে। ঠোঁটে হাল্কা ন্যাচারাল কালারের লিস্টিক, চোখ দুটো বড় বড়, তাতে যত্ন করে কাজল দেওয়া। ভদ্রমহিলা একটা বই নিয়ে একটা পাতা খুলে বসে আছেন অনেকক্ষণ ধরে, কিছুই পড়ছেন বলে মনে হয় না। হয়তো একটু আনমনা, মনে হয় মিতালীকে দেখেই কিছু ভাবার চেস্টা করছেন।
মধুমন্তী নিজের সিটে বসেছিল, বইয়ের পাতায় মন বসছে না। বার বার সমনে বসে থাকা মহিলার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। এই সুন্দর গালে টোল পরা হাঁসি … একটু তাকালেই মনে হয় হাঁসিটা যেন ঠোঁট থেকে আস্তে আস্তে চোখের মধ্যে ছড়িয়ে পরেছে… এ যেন বড় চেনা। কিন্তু কার? এই মুখ কি সত্যিই চেনা? কোথায় … কবে দেখা হয়েছিল? অল্প বয়সে এই মুখ নিশ্চিত আকর্ষনিয় ছিল বহু মানুষের কাছে… বয়সের সাথে সাথে মুখে একটু চর্বি জমে গেছে … কিন্তু এই বয়সেও চিবুকের চমৎকার ভাঁজ, ভাসা ভাসা হাল্কা বাদামি রোম্যান্টিক চোখ, অল্প কোঁচকান চুল … এ যেন তার ভীষণ চেনা, বহু আগেকার কোন চেনা মানুষ… কিন্তু কে? মধুমন্তী ডুবুরীর মতো তার অতীত স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দিয়ে কিছু হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। ভদ্রমহিলাও কি কিছু মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছেন? মাঝে মাঝে তার দিকেই তাকাচ্ছেন যেন?
এতক্ষণে ট্রেনটা হাওড়া স্টেশানের চৌহদ্দি পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনও বেশ ঢিকির ঢিকির করেই চলেছে। মধুমন্তী এই সময় একটু রিফ্রেশ হবার প্রয়োজন ফিল করল… সেই প্রায় শেষ বিকেলে বাড়ী থেকে বের হওয়া … ট্যাক্সি করে হাওড়া স্টেশান… তারপর আবার অপেক্ষা … কখন ট্রেন প্ল্যাটফর্মে লাগে, তারপর এতক্ষণ ধরে বসে থাকা… এখন একবার যেতেই হবে। তারও তো বয়স গুটি গুটি পঞ্চাশের দিকে পা বাড়িয়েছে, রক্তে চিনির পরিমান বেশ বেশী… মাঝে মাঝেই টয়লেটের দিকে যেতে হয়, বয়সের ধর্ম। ডাক্তার বলেই দিয়েছে যে সুগার কন্ট্রোলে রাখার জন্য ওষুধ খেয়ে যেতে হবে সারা জীবন, এ রোগের কোন পার্মানেন্ট কিওর হয় না…। মধুমন্তী কোলের বইটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়াল –
— সরি, আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি, তারপর আপনার সাথে আলাপ করব।
মিতালী। হ্যাঁ … হ্যাঁ, আপনি আসুন, আমি আর একটু গুছিয়ে বসি। স্যুটকেস্টা সরিয়ে দেব?
মধুমন্তী। না, না, পাশ দিয়ে অনেক জায়গা আছে।
মধুমন্তী উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে সাবধানে স্যুটকেসটা পেরিয়ে কূপ থেকে বেরিয়ে এসে আবার দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। মিতালী আনমনে ঘাড় ঘুরিয়ে মধুমন্তীর দিকে তাকিয়ে ছিল… ভদ্রমহিলার গা থেকে ভারি সুন্দর একটা পাউডারের সুবাস আসছে। মহিলা পেছন ফিরে দরজার দিকে যেতেই সুন্দর করে বাঁধা মাথার খোঁপাটা দেখা গেলো… আটকান মাথার কাঁটা গুলো যে বেশ দামি এটা বুঝতে মিতালীর কোন অসুবিধা হোল না, আঙ্গুলের নখে চমৎকার নেল পলিশ। ভদ্রমহিলার সুন্দর ভাবে পরা শাড়ী নতুন বলে কোথাও একটু ভাঁজ পরেছে, বা হাত দিয়ে কামরার দরজাটা টানতেই আঁচলটা একটু সরে গেল… বাঁ কাঁধের ওপর একটা ছোট্ট ট্যাটু, বহু দিনের পুরনো কিন্তু ভালো করে দেখলে আজও বোঝা যায়। এটা দেখে মিতালীর একটা লম্বা শ্বাস পরল, স্বস্তির না অন্য কিছুর কে জানে।
মিনিট দশেক পড়ে মধুমন্তী ফিরে এল, মুখে হাতে জল টল দিয়ে বেশ ফ্রেস লাগছে… ততক্ষণে কামরার ভেতরটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে… স্যুটকেস দুটো এখন মহিলার সীটের পাশে রাখা রয়েছে তাতে যাতায়াতের অনেকটা জায়গা বেরেছে।
মধুমন্তী ভেতরে ঢোকার পর অন্য মহিলা তাঁর সুন্দর সাদা দাঁতের ঝলকানি দেওয়া হাঁসি হেসে বললেন –
মিতালী। কি, এবার একটু ভালো লাগছে?
মধুমন্তী। উফ, সেই বিকেল থেকে বসে আছি স্টেশানে… ভীষণ চাপ লাগছিল… আমার তো আবার সুগার আছে , বার বার যেতে হয়… এখন অনেক হাল্কা ফিল করছি।
মিতালী। সুগার তো তবু ভালো, আমার আবার হার্টে গন্ডগোল, তার ওপর আবার হাঁটুতে বাত… খুব জোরে হাঁটতেও পারি না । আজকে একটু দেরি করে স্টেশানে ঢুকেছিলাম… আর একটু হলে ট্রেনটাই ছেড়ে যাচ্ছিল। সেই জন্য একটু জোরে হেঁটেছি আর তারপর তো দেখলেন… কামরায় ঢুকে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে হাঁপালাম।
মধুমন্তী রুমাল দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে সীটের ওপর বসলো, তারপর পায়ের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে আরাম করে হ্যালান দিয়ে বসে প্রশ্ন করলো –
মধুমন্তী। আপনিও একদম শেষ অবধি তো ?
মিতালী। না না … আমি নাগপুর পর্যন্ত ।
মধুমন্তী। তাহলেও তো অনেকটা দূর… আলাপের অনেক সময় আছে। নাগপুর তো কাল দুপুরে, তাই না?
মিতালী। হ্যাঁ … দুপুর দুটোর পরে।
মধুমন্তী। তাহলে আসুন, বেশ জমিয়ে বসে গল্প করি। এখনই শুয়ে পরছেন না তো? নেক্সট স্টেশান তো সেই খড়গপুর।
মিতালী। এতো তাড়াতাড়ি তো ঘুমোই না। তাছাড়া খড়গপুরে একবার চা তো খেতেই হবে। আমার তো আবার রাতে কিছু খেতেও হবে।
মধুমন্তী। সে তো বটেই। আমার আবার ট্রেনে একদম ঘুম আসে না… একটু ইনসমনিয়া আছে, রেগুলার রাতে ওষুধ খেতে হয় … তবে ট্রেনে খাই না, সকালে খুব শরীর খারাপ লাগে।
কামরার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, হঠাৎ কারোর ঢুকে পরার সম্ভাবনা নেই। ট্রেন এখন বেশ জোরেই চলছে, খড়গপুর আস্তে এখনও অনেক দেরি। ওরা দুজনে চুপচাপ বসে আছে, কে প্রথমে শুরু করবে বোধহয় তারই প্রতিক্ষা।
দুজনারই বোধহয় মনের কোথাও একটা খটকা লেগে আছে … একটু চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কিছুতেই মনে পরছে না।
দুত্তেরিকা বলে মিতালীই শুরু করলো…
মিতালী। আচ্ছা, আপনি … মানে কোলকাতাতেই মানুষ তো?
মধুমন্তী। মানে? এখানেই জন্ম, লেখা পড়া, সমস্ত কিছু। বিয়ের পর তো কলকাতার বাইরে চলে গেলাম।
মিতালী। কোথায় পড়াশুনো করেছেন?
মধুমন্তী। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে, বাংলা অনার্স। আপনি?
মিতালী। ওমা সে কি, আমিও তো। আচ্ছা আমি একটা আন্দাজ করি, আপনি কি মধু, মানে আমাদের মধুমন্তী?
মধুমন্তী দুই হাত সামনে এনে মুখ ঢাকলো, উত্তেজনায় চোখ দুটো বড় বড়, একটু কাঁপা গলায় সে প্রায় চিৎকার করে উঠলো – আর তুই আমাদের মিতু, মানে মিতালী… রাইট?
মিতালী একটু হাসলো, আবার সেই ঝকঝকে দাঁতগুলো ঝলকে গেল।
মিতালী। আমি কিন্তু আগেই তোকে চিনেছিলাম …। মানে তোর মুখের হয়তো কিছু পরিবর্তন হয়েছে তবু চেনা যায়। তুই যখন ওয়াশরুমে যাচ্ছিলি তখন তো পিঠের ওই ছোট্ট উল্কিটা দেখলাম… সেই যে কলেজের থার্ড সেমেস্টারে আমরা কয়েকজন পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম তখনই তো ওটা করালি…।
মধুমন্তী। ওমা ওটা এখনও আছে? ওটার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম… ওটার কথা এখন তো আমার বাড়ীতে আর কেউ বলে না…।
মিতালী। আর ওই বইটা… কলেজে পড়ার সময় শীর্ষেন্দু তোর কি ভীষণ ফেভারিট ছিল… আমরা তো সবাই জানতাম।
মধুমন্তী। আমারো কিন্তু তোর মুখটা ভীষণ চেনা লাগছিল… কিন্তু সেই কলেজের পর তো আর দেখা হয়নি তাই একটু কনফিউসড ছিলাম। তোর হাঁসিটা একদম সেই রকম সুন্দর আছে… সেই স্মাইল যার জন্য যাদবপুরের কতো ছেলে ফার্স্ট সেমেস্টার থেকে তোর প্রেমে পরেছে… আমরা কয়েকজন তো তোর এই হাঁসির জন্য কি জেলাস ছিলাম…।
মিতালী। বাপরে … সে সব কতকাল আগেকার কথা। এখন তো পুরনো ছবির অ্যালবাম নিয়ে বসলে নিজেকে আর নিজেই চিনতে পারি না… মুখ টুখ সব কি চেঞ্জ হয়ে গেছে…।
মধুমন্তী। আর তোর ওই ছোট্ট জড়ুলটা … কানের ঠিক নিচে। ওটাও তো কি ভীষণ ফেমাস ছিল… ওটা নিয়েও তো কে যেন কবিতা লিখেছিল… নাম গুলো সব ভুলে গেছি, কি যেন … আমল না বিমল কি একটা নাম ছিল।
মিতালী একটু লাজুক হাসলো…। একটু যেন দীর্ঘশ্বাসও পরলো পুরনো কথা ভেবে – বাদ দে ওসব কথা… কত কাল আগের। আয় একটু পাশে বসে সেই কলেজের মতো গল্প করি। তোর সাথে কত বছর পড়ে দেখা… তা প্রায় বাইশ তেইশ বছর তো হোল, তাই না।
মধুমন্তী আস্তে করে উঠে এসে মিতালীর পাশে বসলো, তারপর বললো – হ্যাঁ ওই রকম তো হবেই। সেই বিয়ের পর তো এই প্রথম দেখা।
চার
ট্রেন তখন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে। এ. সি. কামরার জানলা বন্ধ, তার বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার… মাঝে মাঝে দুরের কোন গ্রামের বাড়ীর বা রাস্তার আলো কয়েক মুহুর্তের জন্য জানলায় এসেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কখনো দূরের কোন টাউনশিপের আলো কালো আকাশের পটভূমিতে অসংখ্য তারার মতো দেখা দিয়েই খানিক পরে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে…। একটা ইনটারস্টেট হাইওয়ে অনেকক্ষণ ধরে একটা উজ্জ্বল সরিসৃপের মতো রেল লাইনের পাশে লেপটে ছিল… খানিক পড়ে সেটাও যেন বিরক্ত হয়ে বাঁ দিকে বেঁকে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। দূর থেকে স্ট্রীট লাইট গুলো অন্ধকারে অনেকটা মোমবাতির মতো দেখাচ্ছিল, বোম্বে মেল তাদের হেলায় পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল।
মিতালী আর মধুমন্তী দুজনে পাশাপাশি বসে জানলার দিকে তাকিয়েছিল। তাদের মন কিন্তু হারিয়ে গিয়েছিল তেইশ বছর আগের কোন সময়ে। জীবন তো বড়ই ছোট … আর তেইশ বছর অনেকটা সময়…।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে মধুমন্তী সোজা যাদবপুরের বাংলা অনার্সে ভর্তি হয়ে গেল। এই ব্যাপারে বাড়ীতে বিশেষ কোন ডিসকাসান হোল না… বাবা সোমনাথ ঘোষ যাদবপুরের মেকানিকালের ছাত্র ছিলেন। ব্যাস, বাড়ীতে ফতোয়া জারি… মেয়েকে ওই যাদবপুরেই পড়তে হবে, যা পাওয়া যায়। আর তাছাড়া বাড়ীও লর্ডস বেকারির কাছে, ওখান থেকে রোজ কলেজে যাতায়াত করতে শুবিধাই হবে।
মধু ভর্তি হোল এবং রোজ যাতায়াত শুরুও করল। প্রথমে যা হয়, কারুর সাথেই বিশেষ আলাপ নেই, কাজেই ক্লাস আর বাড়ী, মাঝে একটু চা আর ভেজিটেবিল চপ। কিন্তু সাত দিন যেতে না যেতেই প্রায় ছ সাত জনের একটা গ্রুপ হয়ে গেল। মধু আর মিতু একই গ্রুপে ছিল। তারপর কয়েক মাস এই রকম ভাবেই কেটে গেল। বাড়ীর শাসন থেকে মুক্ত হয়ে কোএড কলেজে এসে এদের সবাই একটা নতুন জীবন পেয়েছে। এই ভাবে প্রথম সেমেস্টার এলো এবং গেলো। কারো রেসাল্ট ভালো হোল কারো বা বাজে, কিন্তু কেউ খুব একটা মাথা ঘামাল না। এর মধ্যে কারো কারো বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়েছে। সেদিন অ্যামিনিটি সেণ্টারে বসে কথা হচ্ছিল —
— কি রে, ক্লাস কেমন চলছে?
— দূর বাদ দে… ওই একই … বাংলার পদাবলী । ওই দিকটা দ্যাখ।
— ওয়াও… ওটা শতাব্দী নয় … ও কি সত্যিই প্রেম ট্রেম করছে নাকি?
— ওই যে দ্যাখ … নীল সার্ট পরা ছেলেটা। ওর নাম বানীব্রত, ওর সাথেই তো কয়েকবার দেখেছি।
— ধুর… আরো কয়েক মাস যাক, তারপর দেখিস। ওরকম বন্ধুত্ব তো কলেজে কতোই হয়…।
— তাছাড়া শতাব্দী জেভিয়ার্সের মেয়ে, ওর ওরকম টুকটাক বন্ধু প্রচুর আছে।
— আচ্ছা মধু, তোর সেই প্রেমিকের কি হোল?
— কে… চিতু মানে চিত্য ? আরে দূর… ওতো আমার পাঠভবনের বন্ধু… অনেক দিন থেকে চিনি। ভীষন ভাল ছেলে… ওকে ওরকম বলিস না।
— আরে… খারাপ কি বললাম…আর প্রেম করা কি খারাপ কিছু নাকি? ওর যদি তোকে ভালো লাগেই… তো সেটা খারাপ কিছু নাকি?
— তোরা না ভীষণ বাজে কথা বলিস। আমি অনেক দিন থেকেই কো-এডে পড়ছি… ঠিক আছে? প্রেম আমার কাছে নতুন কিছু নয়… ও সব আমরা ক্লাস টুয়েলভে সিনেমা দেখতে যাবার নাম করে একটু আধটু করেছি… ওই ঢাকুরিয়া লেকে। কাজেই আমাকে প্রেমের নামে আওয়াজ দিও না, কোন লাভ নেই। ফ্যাক্ট হচ্ছে… চিত্য শুধুই বন্ধু… পিরিয়ড।
এই সময় মিতালী হুড়মুড় করে টেবিলে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে লাগলো। মধু ওর দিকে ফিরে একবার দেখল।
— কি .রে , তোর আবার কি? এতো দেরী কেন? তোদের কি আবার এক্সট্রা টাইম নিয়ে পড়াচ্ছে নাকি?
— না না, ক্লাসের পর একবার লাইব্রেরীতে ঢুকেছিলাম … একটা বইয়ের ব্যাপারে, কিন্তু পেলাম না। যাক তোরা তো শুরু করে দিয়েছিস দেকছি … কি খাওয়া যায় বলতো? আমার আবার আজকে মাত্র দশ টাকা বাজেট।
— দূর… রোজ যা খাস তাই খা। গোটা দুই ভেজিটেবিল চপ আর চা।
— হ্যাঁ , দাঁড়া … কাউন্টারে বলে আসি।
মিতালী উঠে গেল কাউন্টারের দিকে। মিনিট পাঁচেক বাদে খাবারের প্লেট হাতে আবার টেবিলে এসে বসলো। অবশ্য ওদের টেবিলে অনেকেরই প্লেটে তখনও আধ খাওয়া খাবার পরে আছে।
মিতালী। ওফ … যা খিদে পেয়েছে না । দুটো চপে পেট ভরবে কিনা কে জানে…।
শ্রীপর্না। এই মিতু, তোর চপ দুটো একটু বড় কেনো? আমাদেরটা দ্যাখ … কেমন ছোট্ট ডিমের মতো আর তোরটা কেমন ক্রীকেট বলের মতো… চেঞ্জ করবি? আমারটাও গরম…।
মিতালী। অ্যাই … একদম নজর দিবি না। এই খিদের সময় খাচ্ছি … তোদের জন্য পেট খারাপ না হয়।
ঝুমুর। অ্যাই মিতু … কাল তোকে সন্ধ্যাবেলায় এইট বি-তে একটা ছেলের সাথে দেখলাম … নতুন কলেজে ঢুকেই প্রেম ট্রেম করছিস নাকি?
মিতালী চপে একটা বড় কামড় বসিয়ে খানিকক্ষণ চিবাল, তারপর সুরুত করে একটু চা খেয়ে ঝুমুরের দিকে ফিরলো।
মিতালী। ঝুম … বড্ড গোয়েন্দাগিরি করছিস দেখছি। তুই ওখানে কি করছিলি শুনি?
ঝুমুর। আমার আবার কি… ক্লাসের পর একটু আড্ডা দিতে আমরা কয়েকজন একটা চায়ের দোকান খুঁজছিলাম … হাঁটতে হাঁটতে ওদিকে চলে যাই। কথা ঘোরাস না, তোর ব্যাপারটা বল ।
মিতালী। কিছুই নয় …। আমি লোকনাথ স্টোরে গিয়ে একটা নোটসের খাতা কিনছিলাম … হঠাৎই পুলকের সাথে দ্যাখা… ব্যাস … আবার কি?
ঝুমুর। এই … আবার চেপে গেলি … বাজারের পাশের ওই চায়ের দোকানে তোরা চা খাচ্ছিলি আর মাথা নারিয়ে নারিয়ে হাঁসা হাঁসি করছিলি … ঠিক কি না?
মিতালী। উফ … হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কি? পুলকের সাথে আমার দিনে পাঁচবার দ্যাখা হয়… পাশের জিওলজী বিল্ডিঙে ওদের ক্লাস… রাস্তায় দেখা হলে কথা বলবো না? আর আমি কি রাম গরুরের ছানা যে হাসবো না?
মধুমন্তী। আঃ … এবার চাপ। আচ্ছা ঐ ছেলেটাকে দেখেছিস … ঐ যে সবুজ জামা পরা … কেমন আনমনা ভাবে মোগলাই খেয়ে যাচ্ছে… ওর নাম জানিস?
ঝুমুর। কেন… প্রেম করবি?
মধুমন্তী। তোর মাথাতে শুধু ঐ…। জিজ্ঞাসা করছি কারণ সেদিন দেখলাম গড়িয়াহাট দিয়ে কেমন ক্যাবলার মতো একা হেঁটে যাচ্ছে… বোধহয় ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছে…।
মিতালী। তা গড়িয়াহাটে দেখলি যখন তখন কথা বললি না কেন? ডেকে আলাপ করলেই তো পারতিস…।
মধুমন্তী। আরে সেরকম কিছু নয়। একা একা ঘুরে বেড়ায় তাই জানতে চাইছিলাম। আর তোরা তো সব টেলিফোন ডাইরেক্টরি … সবার ফোন নাম্বার আর বাড়ীর অ্যাড্রেস মুখস্থ।
শ্রীপর্না। বাবা শুধু কি আমরাই… তোকেও তো সেদিন দেখলাম ওই এস. এফ. আই. এর তরুন লীডার নীলুদার সাথে দারুণ আড্ডা মারতে… তারপরে বোধহয় চাও খাওয়াল…ঠিক না?
মধুমন্তী। আরে সেটা ভোটের ব্যাপারে … ক্লাসে এবার হাওয়া কোন দিকে সেটাই জানতে চাইছিল।
ঝুমুর। আর বিমল… ওই যে ঐ পাশে বসে আছে…? ওর সাথেও তো তোর বেশ হুঁ হুঁ চলে…।
মধুমন্তী এবার একটু হাঁসলো, তারপর চোখ দিয়ে মিতালীকে দেখিয়ে বললো – ওটা ওর জন্য। বিমল মিতালীর সাথে আলাপ করতে চায়। আমি তো মিতুকে বলেইছি … ও তো লজ্জাতে আলাপই করতে চাইছে না।
মিতালী। দ্যাখ তা নয়… সবে তো সেকেন্ড সেমেস্টার, এরপর আরো দু বছর আছে। তাছাড়া বাংলা নিয়ে পরছি… এম. এ. না করলে ইভেন টিচিং চাকরীও জুটবে না। কাজেই অনার্স তো পেতে হবে। ও বন্ধুত্ব করতে চাইলে করতে পারে কিন্তু এখনই প্রেম ট্রেম করতে চাই না।
ঝুমুর। আহা একবার আলাপ করে দেখতে পারতিস কেমন ছেলে … ও কুইক কোন ডিসিশান নিতে চাইলেই তো হোল না তোরও তো একটা ওপিনিয়ান আছে…।
এই রকম কথা হতে হতেই হঠাৎ বিমল তার টেবিল ছেড়ে এদিকেই এগিয়ে এলো …।
বিমল। হাই … তোরা সব এখানে গল্প করছিস… আমাদের ওই টেবিলে চল না … আমরা অনেকে আছি…।
মধুমন্তী। আমাদের বেশী টাইম নেই রে…খেয়েই উঠে পরবো… খুব ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। চারটের পর আমি ফ্রি… তারপর আর ক্লাস নেই… তখন জমিয়ে আড্ডা দিতে পারি।
বিমল। আমি সাড়ে চারটেতে ফ্রি… তাহলে পৌনে পাঁচটায় এখানেই…? কি রাজি? ঝুমুর, মিতালী … শ্রীপর্না … তোদের কি অবস্থা? কতক্ষন ক্লাস আছে?
ঝুমুর। আমরা সবাই বাংলা অনার্স যদিও স্পেশালাইজেশান আলাদা আলাদা … আর এখন তো সবই কমন সাবজেক্ট … কাজেই আমরাও সবাই এসে যাব।
বিমল। ঠিক আছে… তাহলে ঐ কথাই রইল।
সে আবার নিজের টেবিলে ফিরে গেল। ওরাও যে যার চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পরল।
… to be continued