কখনো কখনো বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যে পর্থ্যক্কটা এত ক্ষীণ হয় পরে যে আমরা বুঝে উঠতে পারিনা কোনটা বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব| আমাদের বোধ-বুদ্ধি যেন বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে| আমার এই গল্পটি তারই একটি অভিব্যক্তি।
কী করে যেন আমি একটি জনমানবহিন গ্রামে এসে পড়লাম তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিনা| গ্রামটা যে কোথায় আর আমি এখানে কী করছি কিছুই যেন মনে পড়ছেনা আমার| আমি উদ্ভ্রাংতর মতো ছুটে বেড়াচ্ছি গ্রামের পথে পথে| এদিকে প্রখর রোদে শরীর একেবরে ক্লান্ত, একটু জল না পেলে যেন এখানেই আমার ইতি| যে বাড়ির দরজায় টোকা মারছি, সেই বাড়ির দরজাই খুলে যাচ্ছে, যেন আলতো করে ভেজানো| কিন্তু হাজার চিৎকার করেও কারুর দেখা বা সারা মিলছেনা| পুরো গ্রামটাই যেন খাঁ খাঁ করছে| হটাত্ দূর থেকে কারুর একটু ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পেলাম| আমায় ডাকছে, আমার নাম ধরে| অদ্ভুত! এখানে আমাকে কে চেনে, যে আমার নাম ধরে ডাকবে? যাই হোক, সেই আওয়াজকে অনুশরণ করে এগোতে লাগলাম গ্রামের পথ ধরে| এ গলি সে গলি করে যখন সেই আওয়াজের উত্সের কাছে পৌঁছলাম, দেখলাম সেটা একটা প্রকাণ্ড এঁদারা| আমি যে এতক্ষণ ধরে যে জলের জন্য হাহাকার করছিলাম, এবার তা পূরণ হবে এইই ভেবে কুয়োয়ে ঝুকলাম, আর কে যেন আমাকে একটা জোরে ধাক্কা মারলো|
হটাত্, ঘুমটা ভেঙে গেল| সারা শরীর আমার ঘামে ভিজে গেছে, গলা শুকিয়ে কাট| এতক্ষণ ধরে আমি তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম? স্বপ্ন না দু:স্বপ্ন! এদিকে ভোর হয়ে এসেছে যদিও বা আলো খুব একটা পরিষ্কার হয়ে ফোটেনি| ঘড়িতে ছটা বাজতে কিছু মিনিটই বাকি আছে, তাই আর না শুয়ে উঠে পড়লাম| আজ যখন এত সকালে উঠে পড়েছি, একটু বাইরে বেরিয়ে আশপাশটা ঘুরেনি| সেই ভেবে, ফ্রেশ হয় ক্যামেরা আর মোবাইল ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম| সেপ্টেম্বের মাস, শীত পড়তে শুরু করে দিয়েছে|
আমার নাম সুবিমল সেন| বয়েস তিরিশ বছর, মাসখানেক হলো হরিয়ানার চরখিদাদরি বলে একটি ছোট শহরে এসেছি কর্মসুত্রে| আমার বাড়ি কলকাতায় এবং আমার পড়াশোনা, বড় হওয়া সব কলকাতাতেই| চরখিদাদরির কলেজে কাজের সুযোগ পাই এবং তা সদ্ব্ব্যবহার করতে এখানে চলে আসি| এখানে কলেজে আরো দুজন বাঙালি কর্মরত, যারা লেক্চারার| একজন রুপম সাহা কলকাতার ছেলে, আমার সমবয়েশি, আমারই মতন কর্মসূত্রে এখানে, প্রায় বছর খানেক আগে এসেছে| অপরজন অরিন্দম রয়, প্রবাসী বাঙালি, দিল্লিতে বাড়ি আর ওখানেই পড়াশোনা| উনি আমাদের থেকে বছর দশেক বড়। কলেজটি খুব বড়ো নয়| আমি official কাজের সাথে যুক্ত এবং এখানে একজন admin স্টাফ| আমার কাজ কলেজের এডমিন বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের এডমিশন, ফিস, পরীক্ষার ইত্যাদির রেকর্ড রাখা আমার দায়িত্ব। কলেজ টাইম সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটে অব্দি। তারপর আমার ছুটি। এছাড়া শনিবার ও রবিবার পুরদিনের ছুটি থাকে। আমার ডিপার্টমেন্টে সবাই অবাঙালি, তাদের মধ্যে একজন হলো রাজেশ খাটোয়াল। সেও আমার সমবয়সী বলাচলে, বছর দুই বড় হবে। রাজেশের প্রায় সাত বছর হলো এই কলেজে। ও তার চাকরি জীবনের শুরু থেকেই আছে এই কলেজে। তবে আমাদের মধ্যে কাজের বাইরেও বন্ধুত্ব বেশ ভালো হয় গেছে এরই মধ্যে।
চরখিদাদরি খুব বড় শহর নয়। আবার খুব ছোট বলা যায়না। দিল্লি থেকে সরাসরি সরকারী বাস আছে। ভোর পাঁচটার থেকে শুরু করে রাত আটটা অব্দি। ঘন্টা দুয়েক লাগে। চরখিদাদরিতে একটা রেলওয়ে স্টেশনও আছে তবে তা সরাসরি দিল্লির সাথে যুক্ত নয়। রাজস্থানের কোনো এক শহরের সাথে হরিয়ানার ভিওয়ানী শহরকে যুক্ত করে আর দিনে একটা প্যাসেঞ্জের ট্রেন চলে আর বাকি সময় মালগাড়ি চলে। তাই কারুর দিল্লি যেতে হলে তাকে এখন থেকে বাসে যেতে হয় না হলে ভিওয়ানী গিয়ে ওখান থেকে ট্রেন ধরতে হয়। কলেজটি শহরে এক প্রান্তে। ওখানে পর পর বেশি কিছু স্কুল ও আছে। এটি একটি কৃষি কেন্দ্রিক শহর আর আছে একটি কৃষি বিপণন কেন্দ্র ও বাজার। এখানে বসবাস করি লোকজন বেশির ভাগই হরিয়ানার, কিছু রাজস্থানের ও পাঞ্জাব থেকে আসা লোকজন। এছাড়া কিছু আমার মতন দেশের অন্য প্রান্তে থেকেও আছে যারা নয় সরকারি কর্মচারী আর না হয় স্কুল ও কলেজ চাকরি সূত্রে আছেন।
আমি একটি বিরাট বোরো বাড়িতে একটি ঘরে ভাড়া থাকি। আমার রুমমেট রুপম। ওই আমাকে প্রস্তাবটা দিলো। আমিও থাকার জন্য ঘর খুঁজছিলাম। রুপম অবিবাহিত আর আমিও। তার ওপর ও যে ঘরটা ভাড়া নিয়েছে, সেটা বেশ বড় আর দুজনের জন্য উপযুক্ত। এর জন্য ওকে ভাড়াও বেশি দিতে হচ্ছিল। আসলে ও ছোট ঘর উইথ অট্টাচ বাথরুম পাচ্ছিলনা তাই বাধ্য হয় বড় ঘর ভাড়া নিয়েছিল। আর কারুর সাথে শেয়ার করবে সেরকম ও পাচ্ছিলনা। আমাকে পেতেই সেই সুযোগটা হাতছাড়া করলোনা। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। বাড়ির মালকিন যিনি সে আপত্তি করেননি। ওনার ভাড়ার টাকা পাওয়া নিয়ে কথা। শুধু জল একটু বেশি খরচ হবে ধরে নিয়ে সেটার টাকা বাড়িয়ে দিল। এই বাড়িটির সব ঘরই নানান লোকের ভাড়া নেওয়া। কিছু বাঙালি পরিবারও আছেন। বাড়িটিকে বাড়ি না বলে দুর্গ বললে কিছু ভুল হবে না। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, বাড়িটি কত বড় আর কত ঘর আছে ভিতরে। পুরো বাড়িটি তিনতলার বেশি নয় তবে তারই মধ্যে প্রায় পঞ্চাশটি পরিবার থাকেন। কারুর এক কামরার ঘর ভাড়া নেওয়া তো কারও দুই বা তিন কামরা। একতলায় একদিকে বাড়ির মালকিন থাকেন চার কামরার আলাদা বাড়ি নিয়ে। বাড়িটিতে সবার জন্য ঢোকার ও বেরোনোর একটি মাত্র দরজা। আর এর একটি আলাদা দরজা আছে অন্য দিকে বাড়ির মালকিনের। আমার কলেজের কিছু স্টাফও এই বাড়িটিতে ভাড়া থাকেন।
এখানে আপনাদের একটা কথা মনে করিয়েদি। আমার জানা ছিলো না। হয়তো শুনেছিলাম পরে ভুলে গেছি। অনেক বছর আগেকার কথা। চরখীদাদরি শহরের বাইরে একটু অল্প দূরে উনিশ ছিয়ানব্বই সালের সন্ধেয় ছটা বেজে বত্রিশ মিনিটে মাঝ আকাশে দুটি প্লেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল এবং দুটি প্লেনের সব যাত্রী সহ বিমান চালক ও বিমান সেবিকারা মারা গেছিলেন। যে জায়গায় সেই প্লেন দুটির ভগ্নাংশ আকাশ থেকে পড়েছিল ও হতভাগ্য মানুষজনের মরদেহ পড়েছিল, সেখানে আজও সন্ধের পর কেউ যেতে সাহস পায়না। আমি কলেজের একজন সহকর্মীর সাথে এক ছুটির দিন জায়গাটি দেখতে গেছিলাম। আর সত্যি বলতে কি তারপর থেকেই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করি।
*********
রাজেশের মুখেই শুনলাম সামনের কএক মাস পরেই ওর বিয়ে।
আমিতো শুনেছি তোমাদের একদিকে সবার বেশ অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। ছেলেদের তিরিশ ও পেরোয়না কারুর। আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। আমারও আরো আগেই বিয়েটা হয়ে যেত, তবে একটু বাধা এসে পড়েছিল তাই এতদিন আটকে ছিলাম। জানালো রাজেশ।
মানে? তোমাদের দুজনের কি লাভ ম্যারেজ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হ্যাঁ। দুজনই একই কলেজে পড়াশোনা করতাম। আমি এক বছরের সিনিয়র। আমি বাড়ির বড় ছেলে আর ও বাড়ির মেজ মেয়ে। ওর পর আর একজন আছে আর আমার পর আমার ছোট ভাই ও এক বোন আছে। যায় হোক, সমস্যায় হলো ওর বাবা নিজের মেয়ের বিয়ে আর্মির লোক ছাড়া দেবে না। উনি নিজে আর্মিতে সুবেদার ছিলেন আর বড় মেয়ের বিয়ে একজন আর্মি পার্সোনালের সাথেই দিয়েছেন। এদিকে আমরাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। শেষে পঞ্চায়েত বসে ঠিক করা হলো যে উনি এই বিয়েতে মত দেবেন।
বেশ ইন্টারেস্টিং তো ব্যাপারটা। এরকম আগে আমি শুনিনি। জানালাম আমি।
যাইহোক তোমার কিন্তু আশা চাই চাই বিয়েতে। আগে থেকেই বলে রাখলাম। কোনো অজুহাত শুনবো না। এমনিতে আমি পুরো কলেজ স্টাফেদের কে নিমন্ত্রণ করবো। বললো রাজেশ।
কথা মতন রাজেশ কলেজের সবাইকে নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণ করলো। কলেজে সব মিলিয়ে আমরা পঞ্চানন জন , এডমিন ও টিচিং স্টাফ। তবে শেষমেশ নজন যাবে ঠিক হলো। এডমিন থেকে সাত জন আর টিচিং স্টাফদের থেকে দুজন।
সামনেই দিওয়ালির ছুটি তাই অনেকের নিজের নিজের বাড়ি যাচ্ছেন। আমি ও রুপম পুজোর ছুটিতে কলকাতায় ঘুরে গেছি বলে আর দিওয়ালির ছুটিতে ওখানেই থেকে গেলাম। এখানে পুজোর ছুটি বেশি দিন থাকে না। পাঁচ থেকে ছ দিন তবে দিওয়ালিতে এক সপ্তাহ ছুটি থাকে।
কথা মতন আমরা নজন অফিস স্টাফ ও মাস্টর্মশাইরা কলেজের পর যথারীতি ভাড়া করা টাটা সুমো করে বেরিয়ে পড়লাম বিয়েবাড়ির উদ্দেশে| ঘণ্টা তিনেকের পথ| আমাদের গন্তব্য রাজস্থানের একটি গ্রাম| আমাদের অফিসকলিগে, রাজেশ খাটোয়ালের, দেশের বাড়ি| সেও আমার মতন চরখিদাদরিতে কাজের সুত্রে থাকেন| আমি এখানে আসার পর কাছেপিঠে এদিক ওদিক বেড়ানোর হলেও, দূরে কোথাও যাইনি| তাই আমার বেশ একটা রোমাঞ্চ হছিল প্রথমবার রাজস্থান দেখবো| রাজপুতদের বীরত্ব ও বলিদানের গল্প শুনে বড় হয়েছি, কেল্লা, মরুভূমি ইত্যাদি| আমার উদ্দীপনা দেখে রুপম বলল, আরে না না আমরা অতটাও রাজস্থানের ভিতরে যাচ্ছি না| এইই গ্রামটা হরিয়ানা আর রাজস্থানের বোর্ডেরে বলা জেতে পারে| কেল্লা বা মরুভূমি কিছুই দেখবি না| তবে রাজস্থানের গ্রাম আর আমাদের বাংলার গ্রামে অনেক তফাত আছে তা দেখতে পাবি| শুনে একটু মুশরেই পরেছিলাম| যা ! কেল্লা মরুভূমি কিছুই না?
এদিকে ভারতের সুদূর পশ্চিম দিক হবার জন্য, সূর্যাস্ত এখানে দেরিতে হয়| প্রথম প্রথম তো আমি প্রায় বোকা বনেগেছিলাম দুবার | তখন সবে এসেছি চরখিদাদরী, মে মাসের গরম কাল| হাতঘড়ির ডায়েলের দিকে চোখ রেখে দেখি সন্ধে সাতটা বাজে অথচ আকাশে তখন সুর্যের আভা, যেমন বিকাল পাঁচটার সময় হয়ে কলকাতায়| ভাবলাম আমার ঘড়িটা কী বন্ধ নাকি স্লো হয়ে পড়েছে? একজন-দুজনকে জিজ্ঞেস করতে তারাও একই সময় বলল| তখন বুঝলাম ব্যাপারটা| আবার শীতকালে সকল হয় দেরিতে| প্রায় সকল সাতটার সময়ও দেখি গাড় কুয়াশা ও অন্ধকার| একহাত দূরের কিছু দেখা যায়েনা|
আমাদের বিয়েবাড়ি পৌছতে বেশি দেরি হলোনা| বরং মিনিট ২০ সময় কম লাগলো| ওখানে অব্যর্থনাও পেলাম ভাল| পাত্রপক্ষের লোক বলে বেশি খাতির যত্ন, এই আর কি| বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানটা আয়োজিত করা হয়েছে গ্রাম থেকে একটু দূরে শস্য ক্ষেতের মাঝে এক প্রকাণ্ড খামার বাড়িতে| চারিদিকে ধু-ধু করছে মাঠ আর মাঝে এইই বাড়িটি| আলো, ফুলেরমালা আর বাহারি গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়িটিকে| লোকজনও অনেক| রাজেশের নিজের বাড়ি আর হবু শশুর বাড়ি দুই পাশাপাশি গ্রামে| প্রায় দুটো গোটা গ্রামের লোকজন নিমন্ত্রিত তাই এত বড় জয়েগা পেতে এই ব্যবস্থা| বিয়ে অনেক রাতে আর আমদের থাকার কোনও কথা নয় তাই খাওয়া-দাওয়া যথা সময় সেরে ফেরার পথ ধরলাম|
আকাশে আলোর রেশ আর নেই। অনুষ্ঠান বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তায় আসতেই সমস্যাটা টের পাওয়া গেলো। প্রথমেই গাড়ির একটা টায়র পাংকচার হয়ে গেল তা সারাতে মানে টায়র পাল্টাতে অনেকটা সময় চলে গেল। যখন গাড়ি চলল আবার তখন ঘড়ির কাঁটার রাত নটা বেজে গেছে।
ওদিক্কার গ্রামের চেহারা বাংলার গ্রামের মতন নয়। রাস্তাও কেমন যেন এক গোলক ধাঁধা। বেশির ভাগ একতলা বাড়ি, কিছু দোতলা আর তিনতলাও। তবে একটা বাড়ি দেয়াল বেয়ে আর একটা বাড়ি। রয়েই রকম দুই-তিন সারি বাড়ির পর একটু ফাঁক জায়গা। সেটাই রাস্তা। বাড়িগুলো প্রায় একই রকম দেখতে, প্রতি মোড়ও যেন অদ্ভুত ভাবে একরকম। পার্থক্য প্রায় চোখেই পড়েনা। তা আমরা এই রকম রাস্তায় কতক্ষন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম তা বলা মুশকিল, তবে আমাদের মধ্যে থেকে একজন ড্রাইভেরকে প্রশ্ন করতে সবাই যেন টের পেলাম ব্যাপারটা।
ড্রাইভারও কেমন যেন থতমত খেয়ে গেছে, বুঝতে পারলাম। সে জানালো ও কিছুতেই বুঝতে পারছেনা কি করে একই রাস্তায় এসে পড়ছে বারবার। গ্রামটাও কেমন যেন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে রয়েছে। চারিদিক নিস্তব্ধ, গা ছমছম ভাব। শীতের রাতে বলে হইতে পারে কারণ এটা নভেম্বর মাস আর ভালো রকম শীত পড়েগেছে। রাস্তায় লোকজন তো দূরের কথা, একটি কুকুর বেড়ালেরও দেখা নেই।
আমরা ঠিক করলাম আর এদিকে ওদিক না করে, কোনো বাড়ির কাউকে ডাকা ভালো হবে, তারপর ওনার কাছ থেকে সাহায্য চাইলে হবে। সেই রকম ভেবে আমরা গাড়ি থেকে নেমে সামনের দু একটা বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লাম। প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর জোরে জোরে, এবং সবার শেষে প্রায় তা ধাক্কা মারার মতন পর্যায় চলে গেল। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হোলোনা। পুরো গ্রামটা যেন গভীর ঘুমের জগতের মধ্যে বিরাজ করছে।
এদিকে আমাদের খেয়াল নেই যে কখন আমরা সবাই দলছুট হয়ে পড়েছি। আমার সাথে আমার রুমমেট রয়েছে। সে জানালো, অবস্থা খুব একটা ভালোর দিকে যাচ্ছে না।
কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না রে! কি করবো? সে বললো।
বাকিরা সব কোথায় হওয়া হয়ে গেল? আমি প্রশ্ন করলাম তাকে।
মনে হয়, এবাড়ি ওবাড়ির কড়া নাড়তে নাড়তে সবই এদিক ওদিক হয়ে পড়েছে। এদিকে ফোনে যে কথা বলবো, দুর্ভাগ্যবসত নেটওয়ার্ক কাজ করছেনা।
এই জ্বালা, প্রয়োজনে মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায়না। কি দেশে যে আমরা বাস করি! সে ঝাঁঝিয়ে বললো। তারপর হটাৎ সোজা দৌড় দিলো চেঁচাতে চেঁচাতে, তোমরা সবাই দাঁড়াও আমি আসছি…
আমার আর বোধবুদ্ধি কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো, আবার পা দুটো যেন পাথর হয়ে গেছে, কিছুতেই নাড়াতে পারছিনা।
সেই শীতেও আমি প্রচন্ড ঘামছি। আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখলাম রুপম সোজা গিয়ে ওই এঁদারাতে ঝাঁপ দিলো, আমি চিৎকার করলাম ওকে আটকানোর জন্য, কিন্তু গলা দিয়ে একটিও স্বর বেরোলনা। একটা ঝপাংক করে শব্দ হলো জলে ভারী কিছু পড়ার। এবার আমার পালা। পা দুটো যেন কোন জাদু মন্ত্রে আবার চলতে শুরু করে দিয়েছে ওই এঁদারার দিকে। হটাৎ পিছন থেকে কে যেন আমাকে টেনে ধরলো। ঘুরে দেখি রুপম। হাতটা কেমন যেন ভেজা ভেজা লাগছে! যেন এইমাত্র জল থেকে উঠে এসেছে সে। ওর পিছনে দেখলাম আরো বাকিদের। সবাই যেন জলে ভিজে ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে।
কোন দিকে যাচ্ছিলি তুই? কখন থেকে চিৎকার করে ডাকছি, ভ্রুক্ষেপ নেই তোর। বললো রুপম।
তুই ডাকছিলি? আমি তো তোকে…
থাক আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পুরো ভিজে গেছিস দেখছি।
আমি.. কই না তো। তোরা তো ভিজে দাঁড়িয়ে আছিস।
কি যাতা বলছিস? চল অনেক রাত হয়ে গেছে। গাড়িটাও ঠিক হয়ে গেছে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দিকে এগোলাম।
গাড়িটা কোথায়? আর না থাকতে পেরে জিগ্যেস করলাম।
ওই তো সামনেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে। চল তাড়াতাড়ি উঠেপর গাড়িতে। বললো রুপম।
গাড়িটিও কেমন যেন প্রাণহীন দেখাচ্ছে। এই আছে, এই নেই। সবাই উঠে পড়লো আর সবার শেষে উঠলাম গাড়িতে। তারপর গাড়িটা স্টার্ট দিলো একটা বিকট আওয়াজ দিয়ে। আমার যেন মনে হলো বাজ পড়লো গাড়ির ওপর।
পরের দিন আমরা নিজেদেরকে হাসপাতালের বেডে পেলাম।
আরে আপনাদের কপাল ভালো ছিলো যে ধুলোর ঝড় আপনাদের পথভ্রষ্ট করলেও জানে বেঁচে গেছেন। না হলে এদিকের এই ঝড় কাউকে বেঁচে ফিরতে দেয়না।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ধুলোর ঝরই বা কখন হলো আর আমরা অজ্ঞান হয়ে কোথায় বা পড়েছিলাম, কিছুই বুঝতে পারছিনা।
~সমাপ্তি~