প্রায় হপ্তাখানিক হইল আমার ভাঁড়ার ঘরের চাপাটি আটা ফুরাইয়াছে। এদিকে বাজার আলো করিয়া কচিপানা ফুলকপির দল মুখটি আলো করিয়া প্রস্ফুটিত। ফুলকপির চচ্চড়ি সহযোগে নরম-গরম চাপাটি আটার রুটিতে ‘মন্দ নহে’ পরিমাণ ঘৃত মাখাইয়া দিব্য একটি জলযোগ হয়। কিন্তু একটি মুশকিলে পড়িয়াছি। এই নর্থ পোলের প্রায় মুণ্ডদেশে অবস্থিত ডেনমার্কে আসিয়া কতিপয় বঙ্গঁ সন্তানের বাঙালীয়ানা র চাপে ফাঁসিয়াছি।
খুলিয়া বলি। BID অর্থাৎ বেঙ্গঁলীজ্ ইন ডেনমার্ক বলিয়া একটি সংস্থা রহিয়াছে কোপেনহেগেন শহরে। উহারা বাঙালীয়ানার ধ্বজাধারী হইয়া দুর্গোৎসবাদি করিয়া থাকে। এই সুদূর প্রান্তে কোথা হইতে একশত আটটি পদ্ম, দুধসাদা চন্দ্রপুলি-নাড়ু অথবা গনেশের কলাবউ সংগৃহীত হয়, তাহা আমি কদাপি জানিবার দুঃসাহস করি নাই। উহাদের আয়োজিত পূজাশেষের পরিপাটি খিচুড়ি-ল্যাবড়া-চাটনি, ফলমূলাদি সহযোগে নধর দধিকর্মাটি সাবড়াইয়া পূজার মৌতাতটি বেশ তারাইয়া তারাইয়া উপভোগ করিতেছিলাম।
হালে উহাদের ইচ্ছা হইল বাঙালীয়ানার শিরস্ত্রাণে সেরা পালকটি গুঁজিবে, অর্থাৎ একটি শারদীয়া পত্রিকা বাহির করিবে। সাজো সাজো রব পড়িয়া গেল। বাঙালীর সারস্বত প্রতিভা ঈর্ষা করিবার মত। কিন্তু বিস্মিত হইলাম, আমার মত অকালকুষ্মাণ্ডকে ইহারা প্রস্তাব দিলো কিছু লিখিবার। বৃক্ষ হইতে পড়িবার চক্ষু করিয়া জিজ্ঞাসিলাম, ‘কি লিখিব?’ উহারা বলিল, ‘বিদেশে বাঙালী — বিষয়টি কেমন!’ আহা মোলো যা! ইহা কি কোন বিষয় হইল? চীনে আর বঙ্গঁসন্তান তো আজিকাল সর্বত্র। আলাস্কা হইতে সাইবেরিয়া, সাহারা হইতে সাউথ পোল — কোথায় নাই!
বরং বিদেশের মাটিতে বাঙালীর ‘রসনা সাধন’ কেমন বিষয়! যারপরনাই নিবিড় দৃষ্টিতে দেখিয়াছি বাঙালীর জীবন সুখে দুঃখে, বিপদে সম্পদে কোন অবস্থাতেই আলুনি নহে।
মাসকাবারি দাদখানি চাল হইতে মুসুরির ডাল ক্রয় করিতে প্রায়ই যাই স্থানীয় এশীয় বাজারে। বিদেশে এশীয়দের চাহিদার সহিত তাল মিলাইয়া রমরমাইয়া চলে এ হেন দোকানগৃহ। বিদেশের ভূমিতে কলমি শাক, লাল শাক, মোচা, গোলাকৃতি লাউ, লাল গাজর প্রভৃতি দেশজ দ্রব্যের সমাগমে উৎফুল্ল হইয়া ওঠে বাঙালীকুল।
তখন গ্রীষ্মাবকাশ। মাতা ঠাকুরাণী দেশ হইতে আসিলেন এ স্থলে। দেশ হইতে সদ্য আসিয়াছে নধর কচি পটলের দল। মহানন্দে খাবলাইয়া থলেতে ভরিতেছি। সন্নিকটে আরো কিছু মহিলাকুল ঘুরঘুর করিতেছে পটল তুলিবার আগ্রহে। পটল বাছিতে বাছিতে তাহারা পটাপট দূরাভাষে পটলাগত বার্তা ব্রডকাস্ট করিতে লাগিল — ‘দেশের পটল আসিয়াছে! শীঘ্র আইস!’
আমাদিগের হাবভাব দেখিয়া মাতা ঠাকুরাণীর চক্ষু কপালে উঠিয়া গেল। বুঝাইয়া বলিলাম, এদেশে পটল হইল ডুমুরের ফুলের ন্যায়। তাই পালে পার্বণে বাজারে উঠিলে সেলিব্রিটির মর্য্যাদা পাইয়া থাকে।
মাঝে মধ্যে ভাবি, ঢেঁকির কপালে যদি স্বর্গে গিয়া ধান ভানা লিখিত হইয়া থাকে তবে বাঙালীর ভাগ্যে কি আছে? পরম করুণাময় ঈশ্বর যদি নিত্য দুটি ডাল-চালের বন্দোবস্ত করিয়াও দেন তাহা হইলেও বাঙালী সাথে খান দুই পাতিলেবু চাহিয়া লইবে।
দুঃখ শোকেও দেখিয়াছি বাঙালীর চিন্তনের সরলরেখাটি উদরের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া সমাপ্ত হয়। মদীয় বান্ধবীর শ্বশ্রুপিতা বিদেশ ভূমে পীড়িত হইয়া পড়াতে বান্ধবী কাতর হইয়া আমাদিগকে অনুরোধ করিল, ‘আইজ রাত্রে রহিয়া যাও। কখন কি হয়! চাট্টি গরম ভাতে গব্য ঘৃত মাখিয়া ডালসিদ্ধ আলুসিদ্ধ ডিম্ব সহযোগে খাও। গৃহে কাঁচা মরিচাদি রহিয়াছে, কোন চিন্তা নাই।’
শ্বশ্রুপিতাকে লইয়া উহার চিন্তার সূত্র কাঁচা মরিচে ভাসিয়া মিলিল দেখিয়া কিঞ্চিৎমাত্র হতভম্ব হইলাম না। কারণ বাঙালীকুল এমনই হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইহা বাঙালীর আতিথেয়তার প্রকৃষ্ট পরিচয়ও বটে!
ইহা ব্যতীত রহিয়াছে লোক লৌকিকতা, সামাজিকতা। সে সব স্থলে প্রতিযোগীতা তুঙ্গেঁ। দেশের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া আসিলে কি হইবে, সংস্কারের বোঁচকা হিসেবে বাঙালী তাহার সাধের রসনাবিলাসটি সঙ্গেঁ আনিতে ভোলে না। সংস্কারের গোদের উপর রহিয়াছে নস্টালজিকতার বিষফোঁড়াটি । যে রবিবারের দুপুরগুলা কচি পাঁঠার কষা ঝোলের গন্ধে পুরা গৃহ ম ম করিত তাহা এক্ষেত্রে কোথায় বলিয়া কপালে করাঘাত না করিয়া বিদেশের মাটিতেই গোরু খোঁজা খুজিয়া বাঙালী জোগাড় করিয়া আনে কচি পাঁঠা। নর্থ পোলের মুণ্ড হউক কি আণ্টার্টিকা, আফ্রিকার গোবি মরু হউক কি সাহারা, বাঙালী যে স্থলেই যাক না কেন, সেই স্থলে আমদানী হইতে থাকে মানকচু বাটা, পাটশাকের বড়া, সজনাফুলের বড়ি, শুক্তুনি হইতে আমরুল শাকভাজা। মোচা থোড় লাউঘণ্ট, আমড়া চালতের টক, সরিষা বাটা সহযোগে মৎসের ঝোল-ঝাল-বাটা কষা। নারিকেল চালের গুঁড়া সহযোগে পিঠা পুলি পরমান্ন প্রভৃতি। নিজেরাই এক একজন ভজহরি মান্না হইয়া ফিল্ডে নামে এবং স্ব স্ব রসনাটিকে রসে বশে রাখিবার দায়িত্ব নিষ্ঠার সহিত পালন করে।
আর সত্য বলিতে কি, শ্বেতাঙ্গঁদের সহিত আমাদিগের খাদ্যাখাদ্যের অভ্যাসের তুলনাই মিলে না। তিনশত পয়ঁষট্টি দিন ধরিয়া সালাড নামক ঘাসপাতা, ফল পাকুড়, সিদ্ধ, এবং বোম্বাগড়ের রাজার গোমড়া মুখের ন্যায় শক্ত রুটি গিলিয়া তৃপ্ত থাকিবে বাঙালী!
বিদেশের মাটিতে স্বদেশীয়ানার রেশটুকু সর্বপ্রকারে অধিক ধরা পড়ে বাঙালীর খাদ্যাভ্যাসে। ধুতি-পাঞ্জাবী লুঙি-শাড়ি ছাড়িয়া বাঙালী বিদেশভূমে কোট প্যাণ্টের সহিত সমঝোতা করিতে পারে, কিন্তু খাদ্যাভ্যাসটিকে জলাঞ্জলি দিবার পাত্র সে নহে। আর দিবেই বা কেন?
বিদেশের রুক্ষ, অনাত্মীয় ভূমিতে দৈনন্দিন হাজার কাজের সংগ্রামের মাঝে বাঁচিয়া থাকিবার রসদ বাঙালী পুষাইয়া লয় তাহার রসনা বিলাসিতায়। শত কর্মের চাপ থাকুক, পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত হউক, একটি মনমাতানো ফুটবল ম্যাচ, তৎসহযোগে এক ধামা মশলামুড়ি, কিছু তেলেভাজা বাঙালীকে তৃপ্তির সপ্তম স্বর্গে তুলিয়া দিতে পারে কোন সন্দেহ নাই। এই বিদেশভূমে প্রতিটি সপ্তাহান্তই বাঙালীর নিকট উদরপূজার বার্তা লইয়া আসে। আজিও বিদেশভূমে কোন সরকারি দপ্তর বা গ্রন্থাগারের অলিন্দে হঠাৎ যদি কর্ণকুহরে ভাসিয়া আসে এই প্রকার আলাপচারিতা — ‘কল্য আলু চচ্চড়ি করিলে আটা লুচি করিও। আর পেঁয়াজ-রসুনের ঝাল আলুদমে ময়দারটা জমে ভালো। কল্য শনিবার। কব্জি ডুবাইয়া খাইব।’ — তখন আর চমকিত হই না। কারণ ইহা ধ্রুব সত্য বলিয়া জানিয়াছি যে বাঙালী যতদিন এই গোলার্ধের পশ্চিমপাড়ে অবস্থান করিবে ততদিন তাহার রসিক প্রবৃত্তির বশবর্তী হইয়া সে ঝোল-ঝাল বাটা-মাখার ব্যঞ্জনাদিতে মাতোয়ারা হইয়া স্বদেশীয়ানার বিজয় বৈজয়ন্তী উড্ডীন করিয়াই রাখিবে।
(প্রথম প্রকাশিতঃ শারদীয়া পত্রিকা ২০১৫, বেঙ্গঁলীজ্ ইন ডেনমার্ক)