পোস্টমাস্টারের কার্যালয়টি ছিল উলাপুর গ্রামে।গ্রামটি অতি সামান্য ,তার নিকটেই নীল গাছের আবাদ ছিল, এবং যোগাযোগের প্রয়োজনে ম্যানেজার একজন ইংরেজ পোস্ট অফিস স্থাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
পোস্টমাস্টার ছিলেন কলকাতার এক যুবক।স্টেশনটা কিছুটা সভ্যতার জ্ঞাত সীমা থেকে দূরে,তিনি নিজেকে কিছুটা জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যে-রকম হয় তেমন মনে করছিলেন ।তাঁর অফিস একটা অন্ধকার কুড়ে ঘরের মতো এবং চারদিক জুড়ে ছিল বনভূমি ঘেরা একটি বন্য পুকুর।বৃক্ষরোপণ কর্মীদের মনে হয় তাদের নিজস্ব দল রয়েছে।দুটি ভিন্ন শ্রেণীর লোকের মধ্যে সামাজিক বিভ্রান্তি অর্থাৎ যে-সকল কর্মচারী আছে তাদের সাথে ভদ্রলোকের সাথে মিশাটা তেমন উপযুক্ত না।
সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে শহরের ছেলেটি সেখান লোকদের সাথে তেমন একটা মিশে উঠতে পারছিলো না।অপরিচিত স্থানে গেলে খানিকটা হয় খিটখিটে নয় অপ্রতিভ হয়ে থাকে এবং এই কারণে সেখানকার লোকেদের সাথে তার মেলামেশা হয়ে উঠেছিলো না।তখন তার হাতে আবার তেমন একটা কাজও ছিলো না।তাই সে কখনো কখনো কবিতা লিখার চেষ্টা করতেন।সেখানে তিনি তার এমন একটি ভাব প্রকাশ করেছেন যে সমস্ত দিন তরুণ পাতাগুলির ম্লান কাঁপছে,এবং আকাশের মেঘ দেখেই জীবনের স্মৃতিগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়েচ্ছিল কিন্তু অন্তর্যামী জানেন যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য এসে এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব সমস্ত চারিপাশের গাছগুলা কেটে পাকা রাস্তা বানিয়ে দেয় এবং যা খোলা আকাশে মেঘের দর্শনকে বাধা দেয়।তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।শহরটি তার তাঁবুগুলি ছড়িয়ে দিয়েছিল, তাকে ফিরিয়ে ডাকছিল।
সাঝের বেলা হতেই গোয়ালঘরগুলো থেকে ধোয়া উঠা শুরু করতো,ঝিঝি পোকা গুলো ঝোপে ঝাড়ে ডাকত এবং দূর গ্রাম থেকে বাউলের গানগুলি বাতাসে মাতালের মতো ভাসতে থাকতো।চারিদিকে অন্ধকার দেখে মনে হলো হারিয়ে যাওয়া কবিতার সুরের মূর্ছনার মতো,চারিদিকের নীরবতা হৃদয়ে কিঞ্চিৎ হৃৎকম্পন হতো তখন ঘরের প্রদীপ জ্বালিয়ে পোস্টমাস্টার রতনকে ডাক্তেন।রতন এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতো কিন্তু একবার ডাকেই সে আসতো না।
বলতো “কি দাদাবাবু আপনি আমাকে ডেকেছেন?”
পোস্টমাস্টার: তুই কি এখন কোন কাজ করছিস?
রতন:এখনি চুলাতে আগুন ধরাতে হবে।
পোস্টমাস্টার:তোর এসব চুলোর কাজ পরেও হবে এখন একবার চটজলদী করে আমার তামাকটা সাজিয়ে দিয়ে যা।
রতন হুকাটিতে জোরে ফু দিতে দিতে প্রবেশ করল এবং ঘাম যেন তার কপালে পুতিরমালার মতো নাচছিল।পোস্টমাস্টার হুকাটি তার হাত থেকে নিয়ে হঠাৎ তাকে জিগেস করলো” রতন তোর কি মায়ের কথা মনে পড়ে না?”সে আসলে অনেক কথা কিছু মনে পড়ে আবার কিছু পড়ে না।তার মনে পড়ে তার মায়ের ছেয়ে তার বাবা তাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো। তার বাবার হাসি স্পষ্ট তার মনে আছে।তিনি যখন সন্ধ্যায় ফিরে আসতেন তখন তিনি সবসময় হাসি মুখে ফিরতেন এমনি দুই একটা স্মৃতি তার মনে আছে।এসব গল্প করতে করতে রতন কখন পোস্টমাস্টারের পায়ের কাছে মাটিতে এসে বসলো সে নিজেও জানে না।ইতিমধ্যে তার আরো কিছু স্মৃতি মনে পড়লো যে তার এক ভাই ছিল,তারা দুজন কীভাবে পুরানো এক ডোবার মত পুকুরে গাছের ডাল দিয়ে ছিপ বানিয়ে মাছধরা খেলা খেলতো।সে তার অতীতকে এমন ভাবে মনে করছিল যেন এগুলো গতকালেরই ঘটে জাওয়া ঘটনা।এবং জীবনের বৃহত্তর স্মৃতি গুলো থেকে এগুলোই তার বেশি মনে পড়ে।এমন ভাবে এক কথা দু কথা বলতে বলতে অনেক বেশি রাত হয়ে যেত,তারপর আলসেমির করণে পোস্টমাস্টারের আর রান্না করার ইচ্ছা জাগত না।তারপর আর কি রতন দোরে গিয়ে আগের রান্না করা খাবারগুলো কোনো রকম গরম করে এনে দুজুনের মিলে খেয়ে রাতের খাবার চালিয়ে দিতো।
ঝুপড়ির পাশে কাঠের তক্তায় বসে, জনৈক পোষ্টমাস্টার নিজেকে তাঁর পুরনো স্মৃতিচারণের মধ্যে আবিস্কার করেন। দিনগুলি ছিলো সম্মোহনমূলক অতীত-আতৃ, যার চারপাশে তাঁর মন ঘূর্ণিত হচ্ছিলো, কেন্দ্রিকভাবে সে তার ছোট ভাই, বোন এবং তাদের সবার সম্পর্কে ভাবছিলেন, যাদেরকে তিনি পিছনে ফেলে রেখে এসেছেন। উনার সকল অনুভূতিগুলো ইতিমধ্যে কোথাও না কোথাও লেখা হয়েছিলো, এমনকি উনি জানতেন উনি কি বলবেন, তবুও তিনি কখনো উনার আশেপাশের লোকদেরকে নিজের অতীতের স্মৃতির অংশীদার করেননি। এর পরিবর্তে তিনি এই ছোট মেয়েটিকে তার গল্পের অংশীদার করেন। একরকমভাবে এই ছোটমেয়েটিকেই এর জন্য উপযুক্ত মনে হচ্ছিলো। কালক্রমে, রতন পোষ্টমাস্টার গল্পগুলির চরিত্রগুলোকে তাদের সম্পর্কের নাম- মা, ভাই, বোন দ্বারা উল্লেখ করতে শুরু করে। ব্যাক্তিগত ইতিহাস হয়ে উঠেছিলো পারস্পারিক স্মৃতি। নিজের স্বপ্নগুলিতে তাদের সকলকে পরিদর্শন করার পর, কল্পনার ক্যানভাসে সে তাদের সকলের মুখ অংকিত করেছিলো।
এক মেঘহীন বিকেলে পুরনো ঝুপড়ির দিকে বাতাসের মৃদু ঝাপটা বয়ে যাচ্ছিলো। ঘাসগুলি সূর্যের আলোতে সিক্ত বলে মনে হচ্ছিলো, এবং লতাগুল্মগুলোর নিচ থেকে এক মনোমুগ্ধকর সুবাস ভেসে আসছিলো। ক্লান্ত পৃথিবীর উষ্ণ নিঃশ্বাস ত্বকে সাঁতার কাটছিলো, এবং মনে হয়েছিলো যেনো নির্বাসিতো একগুঁয়ে পাখি, স্বদেশের নির্বাসিত গানে তার অসমতার গানটি গাইছে। জনৈক পোষ্টমাস্টারের কিছুই করার ছিলোনা- মধ্যাহ্নের আকাশে ধূসর রঙের দুর্গের সাথে শিশিরের পাতাগুলো মিলিত হয়ে যে অতিশয় দৃশ্য তৈরি করেছিলো, মনে হচ্ছিলো তা উনাকে একটি মহিমান্বিত ধারণার দ্বারা পরিপূর্ণিত করে তুলছে। কিন্তু চূড়ান্ততা ছিলো বিরোধীদের উত্তেজনা। তিনি অসংখ্য এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জৃম্ভমান শূন্যতার দ্বারা আবদ্ধ ছিলেন- যদি, শুধুমাত্র যদি উনার সাথে ভাগ করে নেওয়ার মতো কেও থাকতো! আর ঠিক তদানুযায়ী সমস্ত প্রকৃতি তাঁর অতল গহ্বরের প্রতিধ্বনি করছিলো।
আমার হৃদয় নিখরচায় পড়েছে। কেও কি তাকে ধরবে না?
এটি ছিলো পরিযায়ী পাখির গান, এটি ছিলো ঝকঝকে পাতার ফিসফাসানি।
কিন্তু তারপরে, কেই বা বিশ্বাস করতো- এমনকি কেই বা জানতো-যে এমন চিন্তাভাবনা একটি গ্রামের অল্প বেতন প্রাপ্ত জনৈক পোষ্টমাস্টারের মধ্যে দৃষ্ট হয়েছিলো।
জনৈক পোষ্টমাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “রতন!” তিনি ডেকে উঠলেন। ছোট্ট মেয়েটি পেয়ারা গাছের নিচে খেলছিলো। তার কর্তার ডাক শুনে সে ছুটে গেলো তাঁর ঘরে।
“আপনি ডেকেছিলেন?” সে ঊর্দ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করলো।
“আমি তোমাকে কীভাবে পড়তে হয়, তা শেখাতে চাই। “
অতপর পোস্টমাস্টার তাকে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ গুলোর উচ্চারণ শিখাতে লাগলো।এবং খুব শীঘ্রি রতন সেগুলো বলতে শিখেও গেলো।
বষ্রাকালে বর্ষণের যেন আর অন্ত নাই।খাল বিল গুলো জলে ভরে গেছে।অবিরাম বৃষ্টির শব্দ এবং মেঘের ডাক।গ্রামে হেটে চলাচল একপ্রকার বন্ধই হয়ে গেছে নৌকা দিয়ে যেকোনো জাগায় যেতে হয়।
একদিন বিকাল বেলা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। পোস্টমাস্টারের ছাত্রীটি অনেকক্ষণ দুয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল,কিন্তু অন্য দিনের মতো যথাযথ সময়ে ডাক শুনতে না পেয়ে নিজে থেকেই আস্তে আস্তে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল।দেখলো পোস্টমাস্টার চুপ করে তার চোকির উপর শুয়ে আছে। সে আরর পোস্টমাস্টার কে ঢাক না দিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বাইরে যেতে লাগলো।ঠিক তখনই শুনতে পেল” রতন “।রতন তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে বলল” দাদাবাবু তুমি কি ঘুমাচ্ছিলে “?
পোস্টমাস্টার নিচু স্বরে বলল “না, শরীরটা তেমন একটা ভালো লাগছে না,দেখতো কপালে একটু হাত দিয়ে। “
এই নিতান্ত একলা প্রবাসে ঘনবর্ষায় রোগকান্ত শরীরে তার একটুখানি পরিবারের সেবা পাইতে ইচ্ছা করছে।তার মার কথা খুব মনে পরছে।গরম কপালে মায়ের কোমল সেই হাতের কথা মনে পরছে।ছোট বালিকা রতনার বালিকা রইল না সে এখন মায়ের পদ ধারণ করেছে,দৌড়ে সে গ্রামের ডাক্তার নিয়ে এলো সময়মতো তাকে খাবার এবং ওষুধ খাওয়ালো এবং সে সারা রাত জেগেও রইল আর বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো” দাদাবাবু এখন কি শরীর কিছুটা ভালো লাগছে ? “
পোস্টমাস্টার রোগ থেকে সেরে উঠতে প্রায় এক সপ্তাহ লাগলো।সে যখন পুরোপুরি রোগ থেকে সেরে উঠলো তখন সে মনস্থির করলো যে আর না এখন এখান থেকে আমার চলে যাওয়া উচিত।তিনি তৎক্ষণাৎ স্থানীয় স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করে কলকাতার কর্তৃপক্ষের কাছে তার বদলির জন্য একটি দরখাস্ত লিখলো।
পোস্টমাস্টার ঠিক হয়ে যাওয়ার কারণে রতন এখন রোগসেবা থেকে নিষ্কৃতি পেল এবং সে তার আগের স্থানে ফিরে গেল। কিন্তু আগের মতো তার একটা আর ডাক পড়ে না, তাই প্রাই সে উঁকি মেরে দেখে যে পোস্টমাস্টার তার চোকির ওপর কেমন আনমনা হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু রতন তার ডাকের অপেক্ষায় বসে থাকে এইদিকে পোস্টমাস্টার ও তার দারখাস্তের উত্তরের অধীর আশায় দিন পার করছে।ছোট বালিকাটি দুয়ারের বাহিরে বসিয়া তার নিজের পড়া গুলো বারবার পড়ছিল। অবশেষে এক সপ্তাহ পর এক সন্ধাবেলায় তার ডাক পরলো।খুব খুশি হয়ে রতন ঘরে প্রবেশ করে বলল “দাদা বুবু আমাকে ডাকছিলে?”পোস্টমাস্টার বলল “কালই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি “
রতন:”তুমি কোথায় চলে যাচ্ছো দাদাবাবু “
পোস্টমাস্টার:”আমি আমার বাড়ি চলে যাচ্ছি রে “
রতন:”তা আবার কবে ফিরে আসবে “
পোস্টমাস্টার :”আর কখনো ফিরে আসবো না “
এসব শোনার পর রতন আর কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করল না। পোস্টমাস্টার নিজে থেকেই তাকে বলল আমি আসলে বুঝিয়ে দরখাস্ত করেছি এবং সেটি মঞ্জুর হয়ে গেছে। তাই আমি কাজ ছেড়ে এখন বাড়ি যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরেই কেউবা কোন কথা বলছে না। মিটমিট করে ঘরের এক কোণায় প্রদীপ জ্বলছে তখনই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল এবং টপটপ করে বৃষ্টির পানি গুলো পড়ছে।
রতন আস্তে করে সেখান থেকে উঠে গেল এবং সে রান্নাঘরে গিয়ে রাতের খাবার বানাতে লাগলো। অন্যদিনের মতো তেমন চটজলদি খাবার রান্না হলো না, কারণ তার মাথায় অনেক কিছুই ঘুরছিল খাবার খাওয়া শেষ হতেই পোস্টমাস্টার কে রতন জিজ্ঞেস করলো “দাদবাবু আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?”
পোস্টমাস্টার বালিকাটির দিকে তাকালো এবং বললো ” সে আর কিভাবে হয় বল! “
ব্যাপারটা আসলে কি কি কারণে অসম্ভব সে আর সেই অবুঝ বালিকা কে বোঝানো তেমন একটা দরকার মনে করলেন না।
সারারাত ধরে রতনের কানে শুধু পোস্টমাস্টারের হাসি আর “সে কি করে হয় বল “বাজতে থাকলো
পরেরদিন পোস্টমাস্টার ঘুম থেকে উঠলো এবং দেখলো যে তার গোসল করার জল প্রস্তুত আছে।কলকাতার অভ্যাস অনুসারে তিনি সবসময় তোলা জলে গোসল করতেন। কখন তিনি যাত্রা করবেন সে কথা রতন জিজ্ঞেস করতে পারে নাই, এবং সে রাত্রেবেলাই নদী থেকে পানি এনে তার গোসলের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিল।গোসল শেষ হতেই রতনের ডাক পড়ল। রতন খুব চুপচাপ এবং মনমরা হয়ে ঘরে প্রবেশ করল এবং পোস্টমাস্টারের দিকে একাধারে তাকিয়ে থাকলো পোস্টমাস্টার বলল “রতন আমার পরে এখন যে আসবে আমি তাকে বলে যাবো সে যেন আমার মতই যেন তোকে যত্ন করে, তোকে আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। “
কথাগুলো শুনেই বোঝা যাচ্ছে রতনের প্রতিটা স্নেহ এবং ভালোবাসা কিন্তু মনকে আর কে বোঝায়।রতন তার মনিবের অনেক তিরস্কার মুলক কথাই শুনেছেন কিন্তু এসব শুনে সে আর তার কান্না ধরে রাখতে পারল না। রতন একবারে কেঁদে উঠল এবং বলল” না না তোমার কাউকে কিছু বলতে হবেনা আমি এখানে আর থাকতে চাই না “।
পোস্টমাস্টার রতনের এরকম ব্যবহার দেখে হতভম্ব হয়ে গেল হয়ে গেল।
নতুন পোস্টমাস্টার আসলো এবং তাকে সব কিছু চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে পুরাতন পোস্টমাস্টার রওনা হইলেন। যাবার সময় রতনকে ডেকে বললেন,
“শোন, রতন। তুই আমার জন্য যা করেছিস তার জন্য আমি কখনো তোমাকে ধন্যবাদ জানাইনি। এখন যখন আমি চলে যাচ্ছি আমি তোকে কিছু দিতে চাই। এটা রাখো। এটা তোর চাহিদাগুলোকে কমপক্ষে কিছু সময়ের জন্য হলেও পূর্ণ করবে। “
জনৈক পোস্টমাস্টার তার হাতে একটি থলি দিলেন। ভেতরে দৃষ্টিগোচর করে রতন দেখতে পেলো যে, এটিতে তার কর্তার সমস্ত আয় রয়েছে। হতবাক, ছোট্ট মেয়েটি মেঝেতে পড়ে, পোস্টামাস্টারের পাঁ আঁকড়ে ধরলো।
“দাদাবাবু!” সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো, “আমি আপনার কাছে মিনতি করছি! আপনার আমাকে কিছু দিতে হবেনা! অনুগ্রহ করুন! আমি আপনার দয়া চাইনা! কাওকেই- কাওকেই আমার দায়িত্ব নিতে হবেনা।“
এবং সে ছুঁটে গিয়ে, ঝুপড়িকে ঘিরে থাকা কুয়াশার মধ্যে বিলীন হয়ে গেলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে,জনৈক পোস্টমাস্টার তার জিনিসপত্র গুলিকে একত্রিত করলেন, তিনি তার কোমড়ে একটি ছুতার থলে ঝুলালেন, তার বাকী থলে গুলোকে তুললেন এবং নদীর তীরে যেখানে তাঁর জন্য একটি নৌকা অপেক্ষা করছিলো সেদিকে হাটতে লাগলেন।
অবশেষে নৌকাটি যখন স্রোতের মধ্যে অতিবাহিত হলো, বৃষ্টি-চুম্বিত নদী, অন্তহীন আকাঙ্ক্ষার সমুদ্রের মতো কেঁপে উঠলো। এটি ছিলো তখন যখন পোস্টমাস্টার হঠাৎ করেই বিষাদের ভার অনুভব করলেন, যেটি তাঁর হৃদয় কে আকৃষ্ট করে, স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটছিলো। সেই আকর্ষণ ছিলো একটি পরিচিত মুখের দিকে, সেই ছোট্ট মেয়েটির মুখ; যেই মুখ অকথিত কথার দ্বারা পূর্ণ ছিলো। “আমার ফিরে যাওয়া উচিত।“ তিনি নিজের মনে মনে তা চিন্তা করলেন।
“আমাকে ওকে আমার সাথে নিতে দাও; সে,যে সর্বদা অবহেলিত হয়েছে। সে, যাকে কখনোই স্বাগত জানানো হয়নি।“
তবে ততক্ষণে বাতাস পাল কে উদ্যমশীল করে তুলেছিলো, বর্ষার নদী তার জলের মন্থন করছিলো, গ্রামটি পিছনে পরে রইলো এবং দূর থেকে একটি কবরস্থান দেখা যাচ্ছিলো।
ভয়েজারের কবোষ্ণ হৃদয় চিরন্তন দর্শন শ্বাস্ত্রের দ্বারা নিজেকে সান্তনা দেয়ঃ জীবন ছিলো বিচ্ছেদ এবং প্রস্থান, মৃত্যু এবং উৎপাটন, আকাঙ্খা ও একাত্নতার এক নদী। পেছনে ফিরে তাকানোতে কি আছে? এ পৃথিবীতে কে কার জন্য?
কিন্তু রতনের ছোট্ট হৃদয়ে এ জাতীয় কোন দর্শনই আশ্রয় নেয়নি। সে তার নিজের অশ্রুনদীতে জড়িয়ে, পুরনো সেই ঝুপড়ির চারপাশে প্রদক্ষিণ করছিলো। সম্ভবত সে তার হৃদয়ে একটি কোমল আশা পোষণ করেছিলো যে তার দাদাবাবু একদিন ফিরে আসবেন। এর শিকড় দ্বারা বিশ্বস্ত হয়ে, সে তার নিজের ভগ্ন হৃদয় এর ধ্বংসাবশেষ থেকে সরে যেতে অস্বীকার করেছিলো।
আহ, হৃদয়! কত অযৌক্তিক, কত মানব! ভ্রান্তকে অস্বীকার করে, আমরা যুক্তির আদেশের দিকে অন্ধ দৃষ্টি রাখি। অবিশ্বাস কে আদালত হিসেবে ধরে, আমরা অনাদায়ী শক্তির সাথে মিথ্যা আশাকে আঁকড়ে রাখি। আমরা চলতে থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত দড়ি কেঁটে না যায়। যতক্ষণ না হৃদয় শুকিয়ে যায় এবং অবশেষে ফাটল ধরে। এবং এরপর আমরা জেগে উঠি; আমাদের ক্ষতগুলো আবার উন্মুক্ত করার পর, আমরা আবার একই জায়গায় ফিরে যাই, সেই একই মুখগুলিতে, সেই একই বিপর্যয়ের দিকে, বিপদকে স্বাগত জানাই, জীবনের সকল বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান করি, নিরবিচ্ছিন্নভাবে আবার শুরুতেই ফিরে যাই।