বাইরে তখন প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইছে।পিচ ঢালা রাস্তায় ঝিরঝির বৃষ্টির শব্দ।তার সাথে ভেজা মাটির ঘ্রান।বিদ্যুতের ঝলকানি এসে অন্ধকার ঘরটাতে মাঝে মাঝে আলো ভোরে দিচ্ছে।আমাদের কেরানীগঞ্জের ৪ তলা বাড়িটা নীরবতার অন্ধকারে নিমজ্জিত।আজ সারাদিন বাড়ি থেকে একবারও বের হইনি।আলস্য ভরা দিনের শেষে ঘুমানোর একটু পরেই প্রতিদিনের মতো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছে।এই নিঃসঙ্গতায় এখন একজনকেই পাওয়া যাবে।রিরিন।
মনে করার সাথে সাথেই বুকের ভেতরে নাড়া দিয়ে একটা কণ্ঠ বের হলো,”তুমি আবার কি স্বপ্নে দেখলে ?”
“আগুন,মৃতদেহ,রক্ত।গত ৩ বছর ধরে এসব শুরু হয়েছে।আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না,রিরিন।”ওর কণ্ঠ পাল্টা প্রশ্ন করলো,”তোমার সাইকিয়াট্রিস্ট কি বললো?”
“বললো,আমি নাকি সবকিছু কল্পনা করি।তুমি বা তোমার কণ্ঠ কোনোটাই সত্যি নয়।”
“সংক্ষেপে যাকে বলে ডিলুশনাল ডিসর্ডার।”
আমি জানি রিরিন আমার কল্পনা নয়,ও একজন সত্যিকারের মানুষ।শুধু ওর সাথে আমি কোনো মাধ্যম ছাড়াই কথা বলতে পারি।অনেকটা ইএসপির টেলিপ্যাথির মতো।কিন্তু কেন বা কিভাবে তা জানিনা।কেউ বিশ্বাস করে না।
আমি চোখ বন্ধ করে কিছু অনুভব করলে তা সত্যি হয়ে যায়,রিরিন সামনে না থাকলেও ওর সাথে কথা বলতে পারি,ঘরের মধ্যে পরাবাস্তবতার উপস্থিতি টের পাই।সব কল্পনা নয়।ছোটবেলা থেকে আমার সাথে এমন কিছু হয় যা বিজ্ঞান এখনো প্রমান করতে পারেনি।
খুব ছোটবেলায় একটা স্বপ্ন দিয়ে শুরু।এরপর থেকে আমি সাধারণ মানুষের মতো বাঁচার অধিকারটুকু হারিয়ে ফেলেছি।
গত ১ বছর সবার কথা মেনে রিরিনের সাথে কথা বন্ধ রেখেছিলাম,লাভ হয়নি।উল্টো সমস্যার ভয়াবহতা বেড়েছে।
রিরিন বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলে,”আমার কোনো অস্তিত্বের প্রমান তোমার কাছে নেই।তুমি কিভাবে বিশ্বাস করবে যে আমি সত্যি?”
“৫ বছর পর আমাদের দেখা হবে।এটা নির্ধারিত।আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই।”
রিরিন চুপ করে থাকে,ওর দীর্ঘশ্বাসগুলো শুধু পড়তে পারি আমি।বৃষ্টির শব্দের মধ্যেই দূর থেকে ভেসে আসে কুকুরের ডাক।হঠাৎ রিরিন বলে,”মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পারে না।তুমি কিভাবে জানো আমি,আমার কণ্ঠ,অসিত্ব সব সত্যি?”
আমি বুঝতে পারি না রিরিনকে আমি কল্পনা করছি নাকি ওর সাথে সত্যি সত্যি কথা বলছি।হয়তো সবার কোথায় ঠিক।আমি জানি না।বিশ্বাস করি না।আমাকে পাগল সাজিয়ে সবার লাভ কি?আমি রিরিনকে চিনি,দেখেছি.আমি মনে মনে বলে উঠি,
“আজ বিকেলে এলিফ্যান্ট রোডে কি করছিলে?”
“তুমি…তুমি কিভাবে জানো আমি সেখানে ছিলাম?”
রিরিনের কণ্ঠে স্পষ্ট উৎসাহ,আতঙ্ক আর জিজ্ঞাসা,”বলো,কিভাবে দেখেছো আমাকে?”
রিরিন এভাবে চমকে গেলে আমার খুব মজা লাগে।মনে হয় আমি নিজের সাথে নিজে কথা বলছি না,সবাই ভুল,আমি ঠিক,এই কণ্ঠ অন্য একজন মানুষের।বুকের ভেতরে অদ্ভুত শান্তি অনুভূত হয়।আঁধারে আচ্ছন্ন নীরবতায় আমি খিলখিল করে হাসতে হাসতে উত্তর দেই,
“আজ গিয়েছিলাম ওখানে…তোমাকে তো স্পষ্ট দেখলাম।”
Print Friendly, PDF & Email
Previous articleচেকমেট
Next articleনিয়ম
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments