শুনেছ কি কভু আম্রপালীর হৃদয়বিদারী কাহিনী !
একাধারে যিনি নটী ও প্রেমিকা,একাধারে যিনি জননী।
স্বপনের মাঝে হেরিনু তাঁহারে বিগত মধ্যযামে,
ক্লিষ্ট আনন–কপোল বাহিয়া অশ্রুর ঢল নামে।
শুধান আমারে–কেমনে নটীরে বিস্মৃত তুমি কবি !
তোমার কলমে কেন গো ব্রাত্য মোর জীবনের ছবি !
হতবাক আমি–বিস্ময়াবেশে দিলেম তাঁহারে কথা,
আঁকিব দেবীর জীবনকথন,হিয়ার হরিষ ব্যাথা।
গভীর নিশীথ–বৈশালী দেশ নিদ্রায় অচেতন,
সিংহদুয়ারে কেবল প্রহরী–রাজপথ নির্জন।
সহসা সেথায় মৃদু হ্রেষারব–অশ্বপৃষ্ঠে বণিক,
বহুদিন পরে ফিরিছেন গেহে–ব্যগ্রতা সমধিক।
সিংহদুয়ার খোলেন প্রহরী পরিচয়নথি হেরি,
নগরে প্রবেশ করেন বণিক–মধ্যযামের ভেরী।
নির্জন পথে নীরব নিশীথে একেলা পথিক অশ্বে,
ভাবেন তিনি কি একাকীই নাকি এই চরাচর বিশ্বে !
ত্বরাপদে চলে বণিকের হয়–সুপ্ত তখনও রজনী,
এমত সময় দূরে ভাসে কোন ক্ষীণ ক্রন্দন ধ্বনি।
সচকিত হন বণিক পুরুষ–বুঝি কোনো শিশু কাঁদে,
না কি তিনি আজি আবদ্ধ হায় অলীকমায়ার ফাঁদে !
সংশয় আর শঙ্কার মাঝে হৃদি কাঁপে দুরুদুরু,
পথের দুপাশে সজ্জিত শত বিশাল আম্রতরু।
সজাগ নয়ন–সহসা দৃষ্টি দূরে এক তরুতলে,
বোধ করি কোন মানব শিশুই ভাসে হায় আঁখিজলে।
অশ্ব হইতে নামেন বণিক–ত্বরাপদে যান সেথা,
রসাল আম্র বিটপের তলে বুঝি কোনো রূপকথা।
সত্যই তাই–তরুতলে এক অসহায়া শিশুকন্যা,
আলো আঁধারীর মাঝে ঊজ্জ্বল তাহার রূপের বন্যা।
অবাক পথিক–তথাপি তাঁহার সংশয় তথা শঙ্কা,
মানসের কোণে বাজায় কেমন অবিশ্বাসের ডংকা।
অবশেষে জাগে শুদ্ধ চেতনা–আর নাহি সন্দেহ,
আম্রতরুর তলে শিশুটিরে রাখিয়া গিয়াছে কেহ।
বণিক বক্ষে স্থিত কন্যাটি–অপত্য স্নেহ স্বাদ,
সন্তানহীন পুরুষ ভাবেন–প্রভুরই আশীর্বাদ।
গেহে ফিরি’তিনি শিশুটিরে দেন জায়ার ক্রোড়েতে তুলি,
আম্রতরুর তলেই প্রাপ্তি–নামটি আম্রপালী।
দিনে দিনে সেই পালিতা দুহিতা অপরূপা এক রূপসী,
কখনও মেনকা,কখনও রম্ভা,কখনও বা উর্বশী।
প্রকৃতপক্ষে ত্রয়ীর রূপেরই আধারে নিজেরে গড়ি,
আম্রপালী কন্যাটি ক্রমে অনিন্দ্যসুন্দরী।
অসীম গুণেও তিনি গুণবতী–এক ও অদ্বিতীয়া,
তাঁহার সমখে লজ্জিত বুঝি চন্দ্রাতপের দিয়া।
দিকে দিকে ধায় আম্রপালীর রূপ ও গুণের বার্তা,
রাজা,মহারাজা,আমীর,উমরা–হইবেন কে বা ভর্তা।
চিন্তিত অতি পিতামাতা দোঁহে–উদ্বেগে রাজসভা,
বৈশালী বুঝি করে ছারখার আম্রপালীর প্রভা।
গুপ্ত কক্ষে মন্ত্রণা সভা– রাজা পারিষদজন,
দেশই করিবে রূপসী নারীর ললাট নির্ধারণ।
‘রূপের ডালির হৃদয় জিনিতে যাহারা হইবে ব্যর্থ,
তাহাদের আর রাজ্যের সনে রহিবেনা কোন স্বার্থ।
পরন্তু সবে হইবে ক্রুদ্ধ–বৈশালী প্রতি খেদ,’
রাজার সহিত সভাসদগণ–নাহি কোন মতভেদ।
‘সেহেতু আম্রপালীর বিবাহ সম্ভব নহে মোটে,’
বৈশালী নৃপ করেন স্বীকার সেই কথা অকপটে।
‘তাঁহার রূপই তাঁহার শত্রু–দু:খিত বৈশালী,
নটীর ভূমিকা পালিবেন এবে নাগরী আম্রপালী।
রাজ–অতিথির মনোরন্জনে আম্রপালীর মোক্ষ,
বৈশালী দেশ রক্ষা তাঁহার একটিমাত্র লক্ষ্য।
সুসজ্জিত হর্ম্যের সাথে অর্থ ও আভরণ,
রূপাজীবা তরে রাজকোষ সদা রহিবে অকৃপণ।
দেশের জন্য প্রাণোৎসর্গ–তাহাই পরম ঋত,’
রাজ ফরমানে পুরনারীগণ হতবাক,স্তম্ভিত।
নতুন জীবন আম্রপালীর–মন্দিরে দেবদাসী,
হিয়া মাঝে বাজে অশ্রুর বীণা–আননে মধুর হাসি।
দিবাভাগে তিনি নর্তকী রূপে–নিশায় প্রেমিকা
সজনী,
এমত ভাবেই গত হয় দিবা,তমসাবৃত রজনী।
জীবনের এই অমোঘ লিখনে নাহি হায় কোন ছন্দ,
আপাত সুখের অন্তরালে বিষণ্ণতার দ্বন্দ্ব।
এহেন ক্ষণেই আম্রপালীর হিয়ায় নতুন আলোক,
চারিপাশ ছায়ে রঙিন স্বপনে–মোহময় বুঝি দ্যুলোক।
আম্রপালীর নৃত্যশিল্প–তাহার রূপের প্রভা,
আলোকিত করে দূরদূরান্ত,মগধের রাজসভা।
মগধ নৃপতি বীরপুঙ্গব শ্রেণীক বিম্বিসার,
সুদূর হইতে অপ্সরা তরে হৃদয় করেন উজাড়।
কিন্তু কিমতে হইবে মিলন–বৈশালী দেশ অরি,
নিরুপায় নৃপ শত্রুপুরীতে–ছদ্মবেশটি ধরি’।
বৈশালী দেশে তাঁহারে কেহই চিনিতে কভুই নারে,
ভাসেন রাজন আম্রপালীর অতল প্রেমের জোয়ারে।
আম্রপালীও নব অতিথির সঙ্গসুখেতে মুগ্ধ,
এমন ভাবে ত’ কেহই তাঁহার হৃদয় করেনি দগ্ধ।
অবশেষে নৃপ বিম্বিসার একদা নিভৃত কক্ষে,
আম্রপালীকে বেস্টন করি’ তাঁহার সবল বক্ষে,
পরিচয় দেন আপনারে তিনি–মগধের নরপতি,
তিলোত্তমার বাকরোধ বুঝি–নয়নে অসীম দ্যুতি।
“চল দেবী তুমি মম সাথে আজি মোর হৃদয়ের অলি,
পাটরাণী পদে মগধ তোমারে দিবে সম্মান ডালি।”
“ না না মহারাজ,সম্ভব নহে–আমি যে শপথে বদ্ধ,
এহেন কর্মে সম্মতি দিলে পরিণাম হায় যুদ্ধ।
বৈশালী মোর দুর্বল দেশ–আপনি প্রতাপশালী,
ক্ষমা চাহি দেব”- সজল নয়নে কহেন আম্রপালী।
মর্মপীড়ায় ক্লিষ্ট নৃপতি শ্রেণীক বিম্বিসার,
ফিরিয়া চলেন পাটলীপুত্রে হারায়ে কণ্ঠহার।
ইতিহাস কহে অজাতশত্রু–বিম্বিসারের তনয়,
আম্রপালীর জন্য তাঁহারও উথালপাথাল হৃদয়।
কিন্তু রূপসী নটীর সমীপে তিনিও প্রত্যাখ্যাত,
আম্রপালীর জীবনকাহিনী কবিকরে অঙ্কিত।
প্রমোদ,বিলাস,প্রাচুর্য্য তথা সম্পদ মনোহর,
তথাপি রূপসী আম্রপালীর বিষণ্ণ অন্তর।
এই জীবনের কিইবা মূল্য–ভাবেন তিলোত্তমা,
‘সুশীতল এক সংসার নীড়ে কেন হলেম না রমা !’
অন্যপ্রান্তে কপিলাবস্তু রাজ্যের রাজপুত্র,
অনুসন্ধান করেন সতত জীবনের নবসূত্র।
অবিনশ্বর শান্তির খোঁজে ঐহিক সুখ ত্যাজি,
সাধনা করেন দিবস রাত্রি জীবন রাখিয়া বাজি।
অবশেষে তিনি সিদ্ধপুরুষ–হইলেন প্রভু বুদ্ধ,
দেব তথাগত–আত্মা তাঁহার শ্বাশ্বতরূপে শুদ্ধ।
বুদ্ধবাণীতে মুগ্ধ মগধ–কোশল কি বৈশালী,
প্রভু দরশনে ব্যাকুলিতা নটী রূপসী আম্রপালী।
বুদ্ধেরে হেরি আম্রপালীর হৃদয় উদ্বেলিত,
তিলোত্তমার সকল কালিমা নিমেষে অন্তর্হিত।
বুদ্ধ চরণে লভেন শরণ–বুদ্ধ বাণীতে শুদ্ধ,
হিয়ার যতেক বন্ধ দুয়ার রহিল না মোটে রুদ্ধ।
কহিলেন তিনি-“হে ভগবন্, সঙ্ঘেতে মাগি ঠাঁই,
ধনসম্পদ,আভরণে মোর আর প্রয়োজন নাই।”
হাসিলেন প্রভু-“ বিহারে প্রবেশে ভিক্ষুরই অধিকার,
নারীর সঙ্গ ক্লিন্ন করিবে পবিত্রতার দুয়ার।”
“এ কেমন তব সিদ্ধাই প্রভু–হে ভগবন্ বুদ্ধ,
ভিক্ষু চিত্ত এমনই অসার–রহিবেনা কেহ শুদ্ধ !
নারীর পরশে পবিত্রতার হইবে কণ্ঠরোধ !”
নটীর কথনে তথাগত মনে জাগ্রত পূতবোধ।
কহেন-“জননী লভিলাম আজি অনুপম এক শিক্ষা,
লজ্জিত আমি–তব সনে এবে যাচিলাম ক্ষমা ভিক্ষা।”
দীক্ষা তাঁহারে দিলেন বুদ্ধ–মুণ্ডিত নারী কেশ,
ভিক্ষুণী রূপে ঘটিল প্রকাশ–নবরূপে উন্মেষ।
নটীর জীবনে টানিলেন ইতি জননী আম্রপালী,
বিষ্মিত কাশী,কোশল,মগধ–হতবাক বৈশালী।
বৌদ্ধ বিহারই তাঁহার আবাস–কণ্ঠে বুদ্ধ বাণী,
কালক্রমে দেবী অম্বাপালী প্রধানা ভিক্ষুণী।
আম্রপালীর করুণ কাহিনী–নারীসত্তার অপমান,
পুরুষত্বের যুপকাষ্ঠে নারকীয় বলিদান।
যুগে যুগে সবে জননী এহেন অন্যায় করি সহন,
লজ্জিত হায় করেন মোদের,চিত্ত মাঝারে দহন।
তিলোত্তমার জীবনকথনে এইক্ষণে টানি ইতি,
বুদ্ধ শরণ, সংঘ শরণ,গাহ তথাগত শ্তুতি।
পুনরায় যদি দেবী দরশন লভি আমি কোন রাতে,
ধন্য হইব মোর সৃষ্টিটি রাখিয়া তাঁহার হাতে।